এ পর্যন্ত পাঁচজন দৃষ্টিশক্তিহীন মানুষ পর্বতারোহী এভারেস্টের চূড়ায় পা রেখেছেন। তাঁদের মধ্যে আংমো শুধু একজন নয়, প্রথম মহিলা দৃষ্টি-প্রতিবন্ধী, যিনি মাউন্ট এভারেস্ট জয়ী। আংমোর এই সাফল্য দিগন্তের প্রথম আলোর মতো। একটা ভিশন, যা আপামর ভারতবাসী তথা বিশ্বের বুকে আশা জাগায়। পাহাড়ি নদীর প্রবল স্রোত আছড়ে পড়ে বুকের ভেতর, একটা উদ্দীপনা, যার অমোঘ টান শত শত মানুষকে সুখী গৃহকোণ থেকে টেনে বার করে এনে ফেলবে পাথুরে, কঠিন রুক্ষ হিমালয়ের পথে। উদ্দেশ্য একটাই, এডমন্ড হিলারির কথায়– ‘It is not the mountain we conquer… but ourselves.’।
সময়টা সকাল ৮:৩০। ১৯ মে ২০২৫।
খবর এল আরও একজন ভারতীয় সাগরমাথা জয় করেছেন, সেদিনের ১৩৫ জন পর্বতারোহীর মধ্যে উজ্জ্বলতম আরোহী চোনজিন আংমো, ভারতের সর্বপ্রথম দৃষ্টি-প্রতিবন্ধী মাউন্ট এভারেস্ট জয়ী।
চোনজিন আংমো একজন দক্ষ পর্বতারোহী, ঠিক আর পাঁচজন পর্বতারোহীর মতো নয়, তাঁদের থেকেও স্পেশাল! কারণ তাঁর ‘ভিশন’ সবার চেয়ে আলাদা। ঠিক যে ভিশনের কথা বলেছেন হেলেন কেলার, যার সাফল্য চোখে দেখা, বা ছুঁয়ে দেখা যায় না, শুধু অনুভব করা যায়।
চোনজিনের বাড়ি হিমাচলের কিন্নর প্রদেশের একটি ছোট্ট গ্রাম চাঙ্গোতে। আংমো তাঁর দৃষ্টিশক্তি হারান ৮ বছর বয়সে। তখন তিনি ক্লাস থ্রি, হঠাৎ স্কুল থেকে খবর আসে ঠিকমতো লিখতে-পড়তে পারছেন না। বাড়িতে নেমে আসে উদ্বেগের ছায়া। ছোট্ট পাহাড়ি গ্রামে চিকিৎসাব্যবস্থা তেমন নেই, তাই ছুটতে হল সিমলা, প্রায় ৩৩৫ কিলোমিটার। সেখান থেকে আরও অনেক জায়গায়। চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখেননি তাঁর বাবা-মা। কিন্তু শেষরক্ষা হল না, ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ দৃষ্টিশক্তি হারায়, ছোট্ট চোনজিন। যাকে বলে Visually Impaired– অর্থাৎ আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলা। দৃশ্যপট পর্দায় ঢেকে যাওয়ার মতো।
চোনজিনের গ্রামখানা ভারি সুন্দর। ১০,০০০ ফুট উচ্চতায় বরফ ঢাকা পাহাড়ে ঘেরা একটা সবুজ জনপদ। এখানে প্রায় সকলেই বুদ্ধধর্মপ্রাণ। বেশ কিছু প্রাচীন গুম্ফা আছে এখানে, প্রায় ৫০০ বছরের পুরনো। সারা বছর লেগে থাকে নানা উৎসব-অনুষ্ঠান, হাসিখেলা-ছোটাছুটি। চারিদিকে ঝোলানো থাকে প্রার্থনা-পতাকা। শীত এলে বরফে ঢেকে যায় চাঙ্গো। পাহাড়ি ঝরনাগুলো জমে যায়। এই সময় চাঙ্গো হয়ে ওঠে আরও সুন্দর। এই গ্রামের খুব কাছেই চাঙ্গো গ্লেসিয়ার। অ্যাডভেঞ্চার-প্রেমীরা দূরদূরান্ত থেকে আসে সেই গ্লেসিয়ারে আইস ক্লাইম্বিং করতে। খুব ভালো আপেলও পাওয়া যায় এখানে। চোনজিনের বাবার একটা আপেলের বাগান আছে। রোদ-ঝলমলে দিনে সেখানে মিঠে হাওয়া দেয়। সরসর শব্দ হয় পাতায় পাতায়।
এখানেই ছোট ভাই-বোনদের সঙ্গে কত হাসি-মাখা দুপুর কাটিয়েছে চোনজিন। রোদ মেখেছে, আপেল পেড়েছে, সন্ধে নামার মুখে ছুটে বাড়ি ফিরেছে। তারপর হঠাৎ একদিন দৃশ্যপট ঢেকে গেল পর্দায়। পালটে গেল আলো-ঝলমলে দুপুরগুলো। সবুজে ঘেরা পাহাড়, সাদায় মোড়া পাহাড়গুলো নিমেষে হারিয়ে গেল চোখের সামনে থেকে। হিমাচলের পাহাড়ে জন্মানো মেয়ে নাকি আর পাহাড় দেখতে পাবে না, ঋতু পরিবর্তন দেখতে পাবে না। আংমোর চোখে নেমে এল আঁধার। একেবারে পালটে গেল জীবন। তবে বেশিদিন এ অবস্থা রইল না। রাত গভীর হতেই ধীরে ধীরে চাঙ্গোর আকাশে ফুটে উঠল অসংখ্য তারা। সে এক অপূর্ব মুহূর্ত। সেই তারার মাঝে একটি তারা হাতছানি দিল আংমোকে, দেখাল দিশা, সে তারার নাম হেলেন কেলার। ছোটবেলা থেকেই হেলেন কেলারের লেখা পড়েছে আংমো। তাঁর আত্মজীবনী, অন্যান্য লেখা অনুপ্রাণিত করেছে সবসময়, হয়েছে তাঁর নিত্যসঙ্গী। আংমো পাশে পেয়েছে তাঁর পরিবারকে, বাবা অমরচন্দ, মা সোনাম আগলে রেখেছে সর্বদা। দৃঢ় করেছে তাঁর প্রত্যয়কে।
দৃষ্টি চলে যাওয়ার পরে নতুন জীবন শুরু করেন আংমো। লে-তে মহাবোধি স্কুলে নতুন করে পড়াশোনা শুরু হয়। স্কুলের পাট শেষ হলে দিল্লির মিরান্ডা হাউস থেকে গ্র্যাজুয়েশন। ততদিনে আংমো তাঁর লক্ষ্য স্থির করে ফেলেছেন। ২০১৬-তে ‘অটল বিহারী বাজপেয়ী ইন্সটিটিউট অফ মাউন্টেনিয়ারিং অ্যান্ড অ্যালায়েড স্পোর্টস’ থেকে BMC অর্থাৎ Basic Mountaineering Course করেন। এই সময় ফ্রেন্ডশিপ পিক, কাংইয়াৎসে ২, সিয়াচেন গ্লেসিয়ারের মতো কঠিন সাফল্যগুলো সহজেই তিনি পুরে ফেলেছেন তাঁর ঝুলিতে। তিনি জাতীয় পুরষ্কারও পেয়েছেন ‘এমপাওয়ারমেন্ট অফ পারসনস উইথ ডিজাবিলিটি’-র ক্ষেত্রে। হিমালয়ের ভূমিকন্যা চোনজিন, পাহাড়ের চড়াই-উৎরাই সহজাত তাঁর। সামান্য পর্দার ক্ষমতা নেই তাঁকে আটকে রাখার।
অ্যাডভেঞ্চারের নেশা চোনজিনের রক্তে, পাহাড়ি খাদ তাঁরই অভ্যাস।
মাউন্টেনিয়ারিং অত্যন্ত টেকনিকাল বিষয়, থাকে নানা ইকুইপমেন্টের ব্যবহার– রোপ, ক্যারাবিনার, জুমার, ল্যাডার ক্রসিং ইত্যাদি ছাড়াও জানতে হয় নানা নট (Knots), ফিগার অফ এইট, বাটারফ্লাই নট, ফিশারম্যান’স নট, ক্লোভ হিচ। এছাড়াও দরকার endurance, প্রবল শারীরিক ক্ষমতা। আর সবচেয়ে বড় হল মনের জোর, যা একজন মাউন্টেনিয়ারের মূল কাণ্ডারি। এ এক সাধনার বিষয়। মনকে করতে হয় পবিত্র, চিন্তাশূন্য। একাত্ম হতে হয় নিজের সেই সত্তার সঙ্গে, যাকে ছুঁয়ে দেখা যায় না, চোখে দেখা যায় না, শুধু একটা অনুভূতি, যা একটা বিশেষ বন্ধনে বাধা থাকে। ফিগার অফ এইট।
অস্ট্রিয়ান বিখ্যাত মাউন্টেনিয়ার হেনরিক হারার-এর লেখা বই ‘সেভেন ইয়ার্স ইন টিবেট’ থেকে তৈরি অতি প্রিয় সিনেমার একটি দৃশ্য মনে পড়ে যাচ্ছে। যেখানে হেনরিক হারার-এর ভূমিকায় ব্র্যাড পিটকে ছোট্ট দলাই লামা ক্লাইম্বিং নিয়ে জিজ্ঞাসা করছে–
Dalai lama: Then tell me what you love about it.
Henrich: The absolute simplicity. That’s what I love. When you are climbing, your mind is clear and free from confusions, you have focus. And Suddenly the light became sharper. … The sounds are richer and you’re filled with the deep, powerful presence of life.
মাউন্ট এভারেস্ট সামিটে প্রধানত দু’টি রুট ব্যবহার করেন পর্বতারোহীরা। একটি হল নেপাল থেকে সাউথ কোল রুট, এই রুটেই হিলারি ও তেনজিং এভারেস্ট জয় করেছিলেন। অপর রুটটি হল তিব্বত থেকে নর্থ রিজ রুট। আংমো সামিট করে সাউথ কোল রুটে। এই রুটের চারটি ক্যাম্প– প্রথমটি কুম্ভ হিমবাহের মাথায়– এই ক্যাম্পে পৌঁছতে অতিক্রম করতে হয় কুম্ভ হিমবাহ, অত্যন্ত বিপজ্জনক বলে গণ্য করা হয় এই অংশকে। এর পরের ক্যাম্পটি হল ABC ক্যাম্প, অ্যাডভান্স বেস ক্যাম্প– এই অংশটিকে বলা হয় ‘ভ্যালি অফ সাইলেন্স’, Western CWM। উচ্চতা ৬৪০০ মিটার। তিন নম্বর ক্যাম্পটি রয়েছে লোৎসে ফেস-এ, উচ্চতা ৭১৬২ মিটার। ক্যাম্প নম্বর চারের উচ্চতা ৭৯২০ মিটার– এই অঞ্চলকে বলা হয় ‘ভ্যালি অফ ডেথ’। এখানে অক্সিজেন প্রায় নেই বললেই চলে। শেষ অ্যাক্লামাটাইজেশন করে এখান থেকেই আরোহীরা সামিট পুশ করে।
চোনজিন আংমো নিজেকে পুশ করেছিলেন, কঠিন ছিল সেই পরীক্ষা। সিলেবাসে ছিল সেই আপেল বাগানের ঝলমলে দুপুর; চাঙ্গোর দিনরাত্রি, স্কুল-কলেজ, BMC, কুম্ভ গ্লেসিয়ারের গভীর ফাটল আর দৃষ্টিহীনতা। পরীক্ষার মার্কশিটের নম্বর এল– ৮৮৪৯ মিটার, অর্থাৎ সাগরমাথার প্রথম পদাধিকারী মেয়ে।
এ পর্যন্ত পাঁচজন দৃষ্টিশক্তিহীন মানুষ পর্বতারোহী এভারেস্টের চূড়ায় পা রেখেছেন। তাঁদের মধ্যে আংমো শুধু একজন নয়, প্রথম মহিলা দৃষ্টি-প্রতিবন্ধী, যিনি মাউন্ট এভারেস্ট জয়ী।
আংমোর এই সাফল্য দিগন্তের প্রথম আলোর মতো। একটা ভিশন, যা আপামর ভারতবাসী তথা বিশ্বের বুকে আশা জাগায়। পাহাড়ি নদীর প্রবল স্রোত আছড়ে পড়ে বুকের ভেতর, একটা উদ্দীপনা, যার অমোঘ টান শত শত মানুষকে সুখী গৃহকোণ থেকে টেনে বার করে এনে ফেলবে পাথুরে, কঠিন রুক্ষ হিমালয়ের পথে।
উদ্দেশ্য একটাই, এডমন্ড হিলারির কথায়– ‘It is not the mountain we conquer… but ourselves.’।