২০২২-এর বিশ্বকাপ। মুখ ঢেকে টানেলে প্রবেশ। একা। কান্না। তারপর ইউরো কাপের কোয়ার্টার ফাইনাল। একা। কান্না। আমরা ভেবেছি, আলো কমে আসিতেছে। ট্রেম্বলিং টিনেজার ফুরিয়ে গেছে তবে! এইবার, এইবারই শেষ বিষাদ-মুহূর্ত… না মশাই। এইবার, নেশনস লিগের সেমিফাইনালে জয়সূচক গোল। ফাইনালে, দ্বিতীয় গোল। টাইব্রেকার শেষে, সাইডলাইনে হাঁটু মুড়ে কান্না। এখনও একা। কান্নার ধরনগুলো কেমন বদলে বদলে যায়, তাই না? কখনও তীক্ষ্ণ বরফ হয়। বুকে খোঁচা লাগে প্রতিনিয়ত। কখনও মুক্তো। আলো। চ্যাম্পিয়ন।
মাথার ভেতরে অমোঘ এক কণ্ঠস্বর ঘাই মারছিল। প্রত্যেকটি ধ্বনির সঙ্গে ওতপ্রোত পরিচিতি, কতশতবার শুনেছি, যেন সহোদরের মতো, তবু গুলিয়ে যাচ্ছিল শেষমেশ। জার্মানির আলিয়াঞ্জ এরিনা থেকে জাম্পকাটে– ইংল্যান্ড। ২০২১। ওল্ড ট্র্যাফোর্ড। পিটার ড্রুরি বলছিলেন, ‘মাদেইরা, ম্যাঞ্চেস্টার, মাদ্রিদ, তুরিন অ্যান্ড ম্যাঞ্চেস্টার এগেইন…’ টানেল থেকে বেরচ্ছেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো (Cristiano Ronaldo)। ফের একবার গ্যালারি যেন লুন্যাটিক। ফের একবার লাল-সাদা সাত নম্বর জার্সি। ফের একবার…
না মশাই। এ কোনও ঈশ্বরগাথা নয়। বরং পৃথিবীর তাবড় তাবড় ঈশ্বরের বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা কোনও শয়তান অথবা অ্যাবসোলিউট মহামানবের। জীবনের প্রতি যে তৃষ্ণাহীন দৃষ্টি, ক্লান্তি, অবসাদ আর ইনস্টাগ্রাম রিলসের যে মায়াখেলায় ধরা পড়ে গিয়েছি সকলেই, যেন চিৎকার করে এ-ব্রহ্মাণ্ডকে জানিয়ে দিতে সাধ হয়, আমি হেরে গেছি– সেইখানেই, প্রতি পলে, একজন রক্ত-মাংসের মানুষ জ্বলে ওঠেন একাকী। সকলকে বিস্মিত করে, একটা গোওওওল! স্পেনের বিপক্ষে, ইউয়েফা নেশনস লিগের ফাইনালে যেমনটি করলেন রোনাল্ডো। খেলায় সমতা ফিরল। ২-২। পিটার ড্রুরির কমেন্ট্রি আমার অবচেতনে একটা দীর্ঘ নদীর মতো বইতে থাকে, ‘রিথড ইন রেড, রেস্টর্ড টু দিস গ্রেট গ্যালারি অফ দ্য গেম, আ ওয়াকিং ওয়ার্ক অফ আর্ট…’ মনে হয়, আরও কিছু বেঁচে থাকা বাকি। মনে হয়, স্বপ্নে স্বপ্নে মাতাল হয়ে যাই। মনে হয়, মতি নন্দীর উপন্যাস পড়ি। মনে মনে আওড়াই, ‘স্ট্রাইকার, এবার ঘা মারো, সর্বশক্তি দিয়ে ঘা মারো’।
পর্তুগাল ইউয়েফা নেশনস লিগ জিতল। দেশের জার্সিতে, ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর তিন নম্বর ট্রফি। আন্তর্জাতিক গোলসংখ্যা ১৩৮। বহুদিন পরে ফেসবুক স্ক্রল করলেই ৪০ বছরের ক্রিশ্চিয়ানো। বহুদিন পরে যুক্তি-প্রতিযুক্তি। ট্রোল। ব্যান্টার। মিম। রোনাল্ডো-কেন্দ্রিক। যেমন সকলে আরও একবার আলোচনায় মেতেছেন, এখনও কেন রোনাল্ডো? লামিন ইয়ামাল, কিলিয়ান এমবাপে, রাফিনহা অথবা আর্লিং হালান্ডের সময়েও কেন রোনাল্ডো স্পটলাইটে? তাই রোনাল্ডো-পরবর্তী সময়ে, পর্তুগালের জাতীয় ফুটবল দলের রেকর্ড এবং স্ট্যাটিসটিক্সে চোখ রাখলে আশ্চর্য হচ্ছি বারবার। সেই যাবতীয় সংখ্যাতত্ত্ব সম্পর্কে আমরা অবগত। আমরা এ-ও জানি, অফ দ্য বল মুভমেন্টে রোনাল্ডো বিশ্বশ্রেষ্ঠ। তবু একটা উদাহরণ দিই। লেফট ব্যাক নুনো মেন্ডেজ উইং ধরে এগোচ্ছেন। পেনাল্টি বক্সে রোনাল্ডোকে ঘিরে স্পেনের তিন ডিফেন্ডার। এইবার, নুনো মেন্ডেজ বল পায়ে বক্সে ঢুকে এলেন অনেকখানি। স্পেনের ডিফেন্স লাইন ভেবেছিল, মেন্ডেজ নির্ঘাত পাস দেবেন রোনাল্ডোকে। ডিফেন্ডারেরা তাই ফোকাস করছিলেন সেই পাসিং লাইনের স্পেসে। রোনাল্ডোর মুভমেন্টও তেমনই ছিল। অথচ সকলকে চমকে দিয়ে গোলে শট নিলেন নুনো মেন্ডেজ এবং পর্তুগালের প্রথম গোল।
ফ্র্যাকশান অফ এ সেকেন্ডের ওই মুভমেন্ট অথবা অতিরিক্ত সময়ের একটা কর্নারে দানব-সমান ডিফেন্ডারকে ছাপিয়ে যাওয়া কোনও অকল্পনীয় হেডার, অথবা একটা বাইসাইকেল কিক– আমাদের শৈশব আর কৈশোর মুড়ে রেখেছিল নিখাদ রোমাঞ্চে। মনে পড়ে, ফিজিক্যাল এডুকেশন ক্লাসের কথা। কোনও এক ম্যাজিকে, সেইদিন সব্বার ব্যাগ থেকেই বেরিয়েছিল রিয়েল মাদ্রিদের সাত নম্বর জার্সি। সস্তা ফেব্রিক রঙে লেখা, রোনাল্ডো। অপার বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখছি, ব্যারাকপুর রাষ্ট্রীয় উচ্চ বিদ্যালয়ের সুবিস্তৃত মাঠে ৪৫ জন রোনাল্ডো। পিটি করছে। এক-দুই-এক, এক-দুই-এক।
স্মৃতির জন্মলগ্ন থেকেই কান্নার সঙ্গে যোগাযোগ। ক্যামেরায় রোনাল্ডোর ছলছলে চোখ। পিটার ড্রুরি বলছেন, ‘ভিন্টেজ বিয়ন্ড ভ্যালুয়েশান, ভিন্টেজ বিয়ন্ড ফোরজারি অর ইমিটেশন। এইট্টিন ইয়ার্স সিন্স দ্যাট ট্রেম্বলিং টিনেজার অফ টাচ অ্যান্ড টিজ, ফার্স্ট টিপটোড অনটু দিস স্টোরিড স্টেজ…’ এরপরে কী হয়? আঠেরো বছর পরে প্রিয় ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডে ফিরে এসে, কোচ এরিক টেন হ্যাগের সঙ্গে আপাত-বিবাদ। নিত্যসঙ্গী রিজার্ভ বেঞ্চ। বিদায়। সৌদি আরবের ক্লাব– আল নাসের। সেই লিগের খেলা কতজনই-বা দেখে নিয়মিত? তারপর ২০২২-এর বিশ্বকাপ। মুখ ঢেকে টানেলে প্রবেশ। একা। কান্না। তারপর ইউরো কাপের কোয়ার্টার ফাইনাল। একা। কান্না। আমরা ভেবেছি, আলো কমে আসিতেছে। ট্রেম্বলিং টিনেজার ফুরিয়ে গেছে তবে! এইবার, এইবারই শেষ বিষাদ-মুহূর্ত… না মশাই। এইবার, নেশনস লিগের সেমিফাইনালে জয়সূচক গোল। ফাইনালে, দ্বিতীয় গোল। টাইব্রেকার শেষে, সাইডলাইনে হাঁটু মুড়ে কান্না। এখনও একা। কান্নার ধরনগুলো কেমন বদলে বদলে যায়, তাই না? কখনও তীক্ষ্ণ বরফ হয়। বুকে খোঁচা লাগে প্রতিনিয়ত। কখনও মুক্তো। আলো। চ্যাম্পিয়ন।
চালচলন দেখে খুব বুঝতে পারি, শরীর সঙ্গ দিচ্ছে না আর। মস্তিষ্কের সঙ্গে পেশির সামঞ্জস্য ক্ষীণ হচ্ছে। যে কারণে মিস হয়ে যায় পেনাল্টি। ফ্রি-কিকে ধার কমে আসে। ড্রিবলও হয় না তেমন। তবু সেই ট্রেম্বলিং টিনেজার ছুটতে থাকেন! সতেরো বছর বয়সি লামিন ইয়ামালের থেকে বল স্ন্যাচ করেন দু’বার। পেদ্রি, নিকো উইলিয়ামস, ডিন হিউসেন, মার্টিন জুবিমেন্ডির মতো একঝাঁক আগুনে ইয়ং-ব্লাড ইউরোপের আর কোনও দেশের ফুটবল স্কোয়াডে নেই। তাদের বিপক্ষে গোল করে ভেঙে দেন ফুটবলের যাবতীয় ব্যাকরণ। দেখা যায়– ফার্স্ট হাফ শেষে, স্পেন যখন এক গোলে এগিয়ে, স্পেনের রাইট উইঙ্গার নিকো উইলিয়ামস ছুটে আসেন। কেন? রোনাল্ডোর জার্সি চাই!
আমরা তো জেনেছি ফুটবল একটা যুদ্ধ। রক্ত। ঘাম। আবেগ। সব মিলিয়ে একটা সংগ্রাম। যে যুদ্ধে, লামিন ইয়ামালকে গতকাল বারবার পরাস্ত করেছেন নুনো মেন্ডেজ। মাঝমাঠের দখল নিয়েছেন ভিতিনহা কিংবা ব্রুনো ফার্নান্ডেজ। তবু এহেন যুদ্ধ সমূলে খতম হয়, যখন প্রতিপক্ষ দলের কোনও উল্লেখযোগ্য খেলোয়াড় আকাঙ্ক্ষায় থাকে একটা জার্সির। রোনাল্ডোর জার্সির।সে কি নতুন করে জীবনের পাঠ নেবে পর্তুগালের ওই সাত নম্বর জার্সি থেকে?
তাই এখনও কেন রোনাল্ডো?– উত্তরে যেন রোনাল্ডো নিরুদ্বেগী। মহাজাগতিক আভা চারিদিকে। আভায় মিশে যাচ্ছে প্রজ্ঞা। ফুটবল-বুদ্ধিমত্তা। একাগ্রতা। শ্রম। আঠেরো বছর বয়সের অযৌক্তিক জেদ আর নাছোড়বান্দা মন। মতি নন্দীর ‘স্ট্রাইকার’ উপন্যাসে, প্রসূন ভট্টাচার্যের একটা স্বপ্ন। যে দিগন্ত-বিস্তৃত স্বপ্ন জুড়ে আছেন একজন ধ্যানী আর ধ্যানীর তন্ময়তা।
পিটার ড্রুরি কমেন্ট্রিতে বলেন, ‘নাও ইন হিজ ইম্যাকিউলেট ম্যাচিওরিটি, সিআরসেভেন রিইউনাইটেড’। এ এক আশ্চর্য পুনর্মিলন! সামনে বছর চল্লিশ। ৯৩৮ গোল। অযুত-নিযুত রেকর্ড। এই নেশনস লিগ না জিতলে কি খুব ক্ষতি হত? কে জানে! তবু বললেন, চোট সঙ্গে করেই ফাইনাল খেলেছেন। কেন? দেশের জন্য ট্রফি জেতা প্রয়োজন। বিশেষত বর্তমান প্রজন্মের নিরিখে। ওরা এই ট্রফি ডিজার্ভ করে। তারপর আসলে দেশ জিতে যায়। দেশের মানুষ জিতে যায়। রাষ্ট্রের যত টানাপোড়েন আর অপ্রেশনের মধ্যে, ওদের জিতে যাওয়াটা জরুরি। তারপর আঠেরো বছরের সেই রোনাল্ডো যখন হাত বাড়িয়ে দেবে বর্তমানের দিকে, এমন পুনর্মিলনের মুহূর্তে হয়তো শোনা যাবে, ‘যেতে পারি, যে-কোনো দিকেই আমি চলে যেতে পারি, কিন্তু কেন যাবো?’