Robbar

আক্ষেপের ভুবন জয়ে দ্রাবিড়ীয় পথই পাথেয় গম্ভীরের

Published by: Robbar Digital
  • Posted:July 10, 2024 6:32 pm
  • Updated:July 10, 2024 6:32 pm  

গৌতম গম্ভীর কি পারবেন রাহুল শরদ দ্রাবিড় হতে? পারবেন দ্রাবিড়ীয় ধৈর্যপরীক্ষায় ভারতীয় ক্রিকেটের দ্রোণাচার্য হিসেবে নিজেকে সফল হিসেবে প্রমাণ করতে? উপেক্ষার পৃথিবীতে যতই সহাবস্থান হোক, দ্রাবিড় ও গম্ভীর– দুই ক্রিকেট কুশীলব মন ও মানসিকতায় ভিন্ন মেরুর বাসিন্দা। নিমগ্ন সাধকের নির্লিপ্তি নিয়ে বরাবর যাবতীয় সমালোচনাকে অগ্রাহ্য করে গিয়েছেন দ্রাবিড়। গম্ভীর সেখানে অকপট। ঠিক তাঁর খেলোয়াড়ি সত্তার মতোই।

অরিঞ্জয় বোস

রাহুল দ্রাবিড় ছিলেন যে পথের পথিক, সেই পথে গৌতম গম্ভীর এসে কখনও দাঁড়াবেন, তাঁদের সময়কালে কেউ ভাবেননি নিশ্চয়ই। একজন স্থিতধী, শান্ত, ধৈর্যশীল, অফুরন্ত বল ছেড়ে দিতে পারেন। আরেকজন রাগী, আগ্রাসী, অভিমানী, ক্রিজচঞ্চল। এই দু’রকম প্রায় বিপরীতমুখী চরিত্র এক হল কোন প্লটে? দেখা যাবে, দু’জনেই অদম্য প্রতিভায় বিশ্বক্রিকেট খেললেও, সেসময় যথোপযুক্ত সম্মান পাননি।

দ্রাবিড় পার্টনারশিপে চিরকাল উল্টোদিকের ব্যাটারকে গড়তে দিয়েছেন দীর্ঘ ইনিংস। তাঁকে আড়াল করে বীরনায়কের রাজসিংহাসন আলো করেছেন কখনও সৌরভ, কখনও শচীন, কখনও বা ভিভিএস লক্ষ্ণণ। গম্ভীরের ললাট লিখনও তাই। বিশ্বকাপ ফাইনালের মতো ম্যাচে সেঞ্চুরি থেকে তিনরান দূরে থেমে গিয়েছে গোতির ইনিংস। ধোনি এসে ঢেকে দিয়েছেন, প্রায় ভুলিয়ে দিয়েছেন সেই ময়লা জার্সির রূপকথা। কিংবা তারও আগে ২০০৭-র টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। তাঁর লড়াকু ৭৫ চাপা পড়ে গিয়েছে যোগিন্দার শর্মার ওই মহাকাব্যিক শেষ ওভারের উপস্থাপনায়। থমকে যাওয়া সেই রূপকথা আবার শুরু হল। দ্রাবিড় প্রথম অধ্যায় লিখে গিয়েছেন। সেই না-পাওয়ার উপন্যাসের দ্বিতীয় অধ্যায় রচনার ব্যাটন এবার গৌতম গম্ভীরের হাতে।

Rahul Dravid played under shadow of Sachin Tendulkar but his impact on Indian cricket is same: Gautam Gambhir - India Today
একফ্রেমে: গৌতম গম্ভীর-রাহুল দ্রাবিড়

…………………………………………………………………………………..

বিয়াল্লিশের গৌতমকে সেই দুর্লঙ্ঘ্য শৃঙ্গে পদার্পণ করতে গেলে অবশ্য মসৃণ রসায়ন গড়ে তুলতে হবে রোহিত, বিরাটের সঙ্গে। নির্ভার ড্রেসিংরুমের পরিবেশ যে সাফল্যের মূল সূত্রধার সেটা আগেই প্রমাণ করেছেন ‘দ্য ওয়াল’ দ্রাবিড়। অতীতে ‘ক্যাপ্তেন কিসসা’য় সরগরম থেকেছে ভারতীয় ড্রেসিংরুম। বিরাটের অধিনায়কত্ব হারানো, রোহিতের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের শৈত্যতা নিয়ে কম কালিকলম খরচ হয়নি গণমাধ্যমে। কিন্তু নির্মোক দৃষ্টিভঙ্গিতে সে ঝঞ্ঝার আঁচ টের পেতে দেননি দ্রাবিড়।

……………………………………………………………………………………

প্রশ্ন এখন একটাই। গম্ভীর কি পারবেন রাহুল শরদ দ্রাবিড় হতে? পারবেন দ্রাবিড়ীয় ধৈর্যপরীক্ষায় ভারতীয় ক্রিকেটের দ্রোণাচার্য হিসেবে নিজেকে সফল হিসেবে প্রমাণ করতে? উপেক্ষার পৃথিবীতে যতই সহাবস্থান হোক, দ্রাবিড় ও গম্ভীর– দুই ক্রিকেট কুশীলব মন ও মানসিকতায় ভিন্ন মেরুর বাসিন্দা। নিমগ্ন সাধকের নির্লিপ্তি নিয়ে বরাবর যাবতীয় সমালোচনাকে অগ্রাহ্য করে গিয়েছেন দ্রাবিড়। দলের সাফল্যের দিনে ক্রিকেটারদের এগিয়ে দিয়েছেন, ব্যর্থতায় প্রশ্নবাণ সামলেছেন নিজে, অক্লেশে বুকচিতিয়ে। গম্ভীর সেখানে অকপট। ঠিক তাঁর খেলোয়াড়ি সত্তার মতোই। সমালোচনার বাঘনখ যত প্রখর হয়েছে, গম্ভীর ততই জ্বালাময়ী হয়েছেন ঋষি দুর্বাসার মতো। যেমনটা তিনি ছিলেন মাঠে ও মাঠের বাইরে।

Gautam Gambhir regrets infamous 'aggressive' acts in his IPL career: 'I've done some things I shouldn't have done' | Crickit

………………………………………………………………….

পড়ুন সুপ্রিয় মিত্র-র লেখা: ডানহাতিদের উপত্যকায় বাঁহাতির সফল দাদাগিরি

………………………………………………………………….

যখন খেলতেন, তখন জেতার সুতীব্র খিদে যেমন তার শরীরী ভাষায় ফুটে উঠত, সেইসঙ্গে ঠিকরে বের হত প্রবল আগ্রাসন। যা বহু বিতর্কের জন্ম দিয়েছে ২২ গজে, গম্ভীরকে কেন্দ্র করে। সে মাঠে শাহিদ আফ্রিদি, কামরান আকমলের সঙ্গে বিতণ্ডা হোক কিংবা স্বদেশীয় বিরাট কোহলির সঙ্গে দৃষ্টিকটু বাক্যবিনিময়। সময় সঙ্গে গম্ভীর অভিজ্ঞ হয়েছেন, কিন্তু পাল্টাননি। ওই ক্রোধসর্বস্ব ‘অ্যাংরি’ মেজাজটাই তাঁর পরিচয় হয়ে উঠেছে। আইপিএলের মঞ্চে মেন্টরের ভূমিকায় থাকাকালীন সেই বিতর্ক বারবার মাথাচাড়া দিয়েছে। ক্রিকেটের বাইরে যখন মাইক্রোফোন হাতে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েছেন, তখনও ঠোঁটকাটা গম্ভীর রেয়াত করেননি কাউকে। এমনকী, ধোনি নামক ক্রিকেটজনতার পূজিত বিগ্রহকেও না। আসলে গম্ভীর এমনই– স্পষ্টবাদী। তাই সবচেয়ে কমবয়সি প্রশিক্ষক হিসেবে যতই জাতীয় ক্রিকেট দলের হটসিটে বসে পড়ুন, আশঙ্কার চোরাস্রোত তাঁকে ঘিরে আবর্তমান, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

5 instances Gautam Gambhir got involved in an on-field altercation
আইপিএলে বিরাট-গম্ভীর বিতর্ক

তাহলে দ্রাবিড়-সভ্যতায় যতিচিহ্ন টেনে এই যে গৌতম-যুগ শুরু করল ভারতীয় বোর্ড, সেটা কি নেহাতই ঝোঁকের বশে? স্রেফ মেন্টর হিসেবে তাঁর আইপিএল জয়ের নিরিখে? আরও পরিষ্কার করে বললে বলতে হয়, কোচ গম্ভীর কি যোগ্য উত্তরসূরি দ্রাবিড়ের বিজয়পতাকা বহনের জন্য? আসন্ন শ্রীলঙ্কা সিরিজ প্রথম সোপান, সেই প্রশ্নের উত্তর নিরসনের। ধাপে ধাপে, সময়ের কালযাত্রায় সেই প্রশ্নজিজ্ঞাসার মীমাংসা হবে ঠিকই। তবে এই মুহূর্তে গম্ভীরই দ্রাবিড়ের যোগ্য বিকল্প। কারণটাও খুব স্পষ্ট। একটা পালাবদলের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে ভারতীয় ক্রিকেট। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ের পরে ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ত ফরম্যাট থেকে অবসর ঘোষণা করেছেন টিম ইন্ডিয়ার দুই মহাতারকা রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলি। অভিষেক শর্মা, যশস্বী জয়সওয়াল, রিঙ্কু সিংদের মতো নতুন মুখের এখন বিশ্বক্রিকেটের উত্তাল ঢেউয়ে থিতু হওয়ার সন্ধিক্ষণ। এই অবস্থায় গম্ভীরের মতো একজন হেডস্যরের প্রয়োজন যাঁর কাছে দল মুখ্য, তারকাপ্রথা গৌণ। ব্যক্তিপুজোর চেয়ে যাঁর কাছে টিমগেমের গুরুত্ব বেশি। এবং চাঁদমারি অবশ্যই পরের বছরের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি, বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ এবং অতি অবশ্যই ওডিআই বিশ্বকাপ। যা অধরা রেখেই নিজ অধ্যায়ে দাঁড়ি টানতে হয়েছে রাহুল শরদ দ্রাবিড়কে। বিয়াল্লিশের গৌতমকে সেই দুর্লঙ্ঘ্য শৃঙ্গে পদার্পণ করতে গেলে অবশ্য মসৃণ রসায়ন গড়ে তুলতে হবে রোহিত, বিরাটের সঙ্গে। নির্ভার ড্রেসিংরুমের পরিবেশ যে সাফল্যের মূল সূত্রধার সেটা আগেই প্রমাণ করেছেন ‘দ্য ওয়াল’ দ্রাবিড়। অতীতে ‘ক্যাপ্তেন কিসসা’য় সরগরম থেকেছে ভারতীয় ড্রেসিংরুম। বিরাটের অধিনায়কত্ব হারানো, রোহিতের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের শৈত্যতা নিয়ে কম কালিকলম খরচ হয়নি গণমাধ্যমে। কিন্তু নির্মোক দৃষ্টিভঙ্গিতে সে ঝঞ্ঝার আঁচ টের পেতে দেননি দ্রাবিড়। মিশে গিয়েছেন রোহিত, বিরাটদের সঙ্গে অবলীলায়, কোচের বর্ম পরিত্যাগ করে ‘রাহুল ভাই’ হয়ে, টিমের প্রয়োজনে দল-অধিনায়কের ‘ওয়ার্কিং ওয়াইফ’ সত্তায়।

সপরিবারে রোহিত শর্মা, সঙ্গে রাহুল দ্রাবিড়

গম্ভীর সেই পথের পথিক হতে পারবেন তো? আগ্রাসন আর ক্রোধের মধ্যে যে সূক্ষ্ণ প্রভেদ রয়েছে, তা শেষ আইপিএলে মিটিয়ে দিয়েছেন মেন্টর গম্ভীর। আমরা দেখেছি, মাঠের ধারে হাস্যময় উপস্থিতিতে গম্ভীর-কোহলিকে, অতীত তিক্ততা ভুলে নৈকট্যের আবেশে। এই পরিণতবোধই ‘গোতি’কে এগিয়ে দিয়েছে টিম ইন্ডিয়ার কোচের পদ অর্জনে। দ্রাবিড়ের মতোই ব্যক্তি গম্ভীরের কাছে শৃঙ্খলা শেষ কথা। ব্যক্তির আগে দল। ব্যক্তিগত প্রাপ্তির আগে দলের সাফল্য। এর সঙ্গে যোগ করুন গম্ভীরের দেশপ্রীতি। ভারতীয় ক্রিকেটের সেবা তাঁর কাছে দেশসেবার সমার্থক। ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকাকে সাফল্যের শৃঙ্গে উড়তে দেখাটাই গৌতমের মোক্ষ, গম্ভীরের স্বপ্ন। তবে টিম ইন্ডিয়ার কোচের পদ চিরকালই কণ্টকাকীর্ণ। ব্যর্থতার নাগপাশ সেখানে গাঢ় হয় সমালোচনার ছোবলে। ভারতীয় ক্রিকেট টিমের দীর্ঘমেয়াদি কোচিং জীবনের সঙ্গে তুলনায় আসে না তিনমাসব্যাপী আইপিএল কোচিংয়ের। সব দিক থেকেই তা ভিন্ন মঞ্চ, ভিন্ন চ্যালেঞ্জ। গম্ভীর পারবেন সেই চ্যালেঞ্জ জিততে?

……………………………………………..

ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল

……………………………………………..

মার্ক টোয়েনের কথা ধার করে বলতে হয়– ‘জীবনে সফল হতে দুটো জিনিস প্রয়োজন, জেদ ও আত্মবিশ্বাস।’ সেই জেদ ও আত্মবিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছেন ভারতীয় ক্রিকেটের ‘ডবল জি’। একদা তাঁর ওপেনার-সঙ্গী শেহবাগ বলেছিলেন, ‘গোতি ভারতীয় ক্রিকেটে সেকেন্ড ওয়াল’।

দ্রাবিড় সভ্যতা শেষে সেই দেওয়াল হয়ে ওঠার সাধনা শুরু এবার গৌতম গম্ভীরের।