Robbar

নিজেকে না বদলালে হার্দিকের পক্ষে দেশনায়ক হওয়া কতটা সম্ভব বলা মুশকিল

Published by: Robbar Digital
  • Posted:March 26, 2024 8:11 pm
  • Updated:March 26, 2024 8:11 pm  

উনিশ বছর পূর্বে বাংলার ঘরের ছেলেকে বাদ দিয়ে ইডেনে নামার ‘ধৃষ্টতা’ দেখিয়েছিলেন দ্রাবিড়। আর হার্দিক ‘ধৃষ্টতা’ দেখিয়েছেন ঘরের মাঠ, গুজরাতের টিম ছেড়ে চলে যাওয়ার! যে টিম তাঁকে অধিনায়ক করে এনেছিল, জামাই-আদরে রেখেছিল। অবশ্যই প্রতিদান দিয়েছেন তিনি।‌ আইপিএল আত্মপ্রকাশে গুজরাতকে চ্যাম্পিয়ন করে। দ্বিতীয় বার রানার্স করে। কিন্তু তার পরই হুট করে ছেড়ে চলে গিয়েছেন হার্দিক, পুরনো টিমের আশ্রয়ে, নতুন মোহের হাতছানিতে। এবং ভারত অধিনায়ককে ‘রিপ্লেস’ করে তাঁর সিংহাসনে উপবিষ্ট হয়েছেন। জনতা আর ছাড়বে কেন?

অরিঞ্জয় বোস

‘আই হ্যাভ নেভার সিন এনি ইন্ডিয়ান প্লেয়ার গেটিং বুড লাইক দে বুয়িং হার্দিক পাণ্ডিয়া হিয়ার ইন আমেদাবাদ। দিস ইজ আ রেয়ার হ্যাপেনিং!’
জন্ম দক্ষিণ আফ্রিকায় হলেও কেভিন পিটারসেনের ক্রিকেট খেলা যে দেশের হয়ে, প্লেয়ার সেখানে সমালোচনার কোলে-পিঠে বড় হয়! ইংল্যান্ড! ব্রিটিশ মিডিয়া যে কী বিষম বস্তু, তা যে জানে, সে জানে! বিলিতি মিডিয়ার হাত ধরে অবিরাম স্বর্গ থেকে পাতালে যাতায়াত করে প্লেয়ার, ভবিতব্যকে মেনে নিয়ে। তুমি ভালো খেললে, কালজয়ী। তোমার মতো প্লেয়ার ইহজগতে আসেনি। কিন্তু তুমি ঝোলালে কী গেলে! পাড়া টিমে খেলারও তুমি তখন উপযুক্ত নও। বেশি পিছনোর প্রয়োজন নেই। গত ভারত-ইংল্যান্ড টেস্ট সিরিজেই জো রুটকে ঝেড়ে কাপড় পরিয়ে দিয়েছিলেন বিখ্যাত ক্রিকেট লিখিয়ে শিল্ড বেরি। রাজকোট টেস্টে জসপ্রীত বুমরাকে রিভার্স স্কুপ মারতে গিয়ে রুট উইকেট জলাঞ্জলি দেওয়ার পর বেরি সোজা লিখে দিয়েছিলেন, ‘ইংল্যান্ডের টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসের জঘন্যতম শট!’ তা, সে দেশের হয়ে খেলার পর, অধিনায়কত্ব করার পর কি না কেপি এত বিস্মিত, এমন হতভম্ব!
দেখতে গেলে আছে, পিটারসেনের বাকরুদ্ধ হওয়ার কারণ যথেষ্ট আছে। না, না, সমালোচনা-টমালোচনা অবশ্যই নয়। ও সব আসবে, যাবে। সাময়িক গায়ে লাগবে, শেষে ধুয়ে যাবে। কেপি-র বিস্ময়ের কারণ বোঝা যায়। আসলে ইংল্যান্ড ক্রিকেটের ধাত্রীভূমি ঠিকই। কিন্তু খেলাটাকে পূর্ণতা দিয়েছে ভারত। ভারতীয়দের সমর্থন। যারা ধীরে-ধীরে ক্রিকেটকে নিছক খেলার লক্ষ্মণরেখায় সীমাবদ্ধ করে রাখেনি। যাপনের অংশ করে নিয়েছে। এ দেশে মানুষের যে দুটো ধর্ম। প্রথমটা জন্মগত। বিবিধ। হিন্দু-মুসলিম-ক্রিশ্চান। আর দ্বিতীয়টা সর্বধর্মের প্রেম-সংকলন। ক্রিকেট! এ দেশে বহুকাল ক্রিকেটাররা আর মনিষ্যি নন। দেবতা। বিগ্রহ। ঈশ্বর। ক্রিকেটের সেই পুণ্যভূমিতে, সেই ভারতে, এক জাতীয় ক্রিকেটার ভারতীয় সমর্থক দ্বারা ‘আক্রান্ত’ হচ্ছেন, যথেচ্ছ দুয়ো কুড়োচ্ছেন, মনুষ্যেতর প্রাণীর সঙ্গে তাঁর তুলনা চলছে, ‘ছাপরি’ বলা হচ্ছে ,এ যে দেখা যায় না। দেখলেও বিশ্বাস হয় না!
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ক্রিকেট এখন এত কর্পোরেট, এত অর্থ সেখানে যে, রাগ-দুঃখ-যন্ত্রণা প্রকাশের বিশেষ স্থান নেই। পান‌ থেকে চুন খসলে ভাবমূর্তির সাড়ে বারোটা বাজবে, ফসকে যাবে এনডোর্সমেন্ট। হার্দিক তাই বলতে পারবেন না। বলা অসম্ভব। অথচ বাস্তব হল, আমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে যে ‘ব্যারাকিং’-এর মধ্যে পড়তে হয়েছিল হার্দিককে, তার একমাত্র তুলনা হতে পারে ২০০৫ সালের ইডেন গার্ডেন্স। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে বাদ দিয়ে যখন খেলতে এসেছিল রাহুল দ্রাবিড়ের ভারত। এসে দেখেছিল, দেশের মাঠ, দেশের মানুষ, কীরকম ‘দ্বেষা’ত্মবোধক আচরণ করছে!
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
IPL 2024: Hardik Pandya faces ire of Mumbai Indians fans during defeat at Gujarat 'home'
গত রোববার গুজরাত টাইটান্স ম্যাচ শেষে নতুন মুম্বই ইন্ডিয়ান্স অধিনায়ক হার্দিক পান্ডিয়াকে পুরস্কার বিতরণী মঞ্চে বলতে শুনলাম, ‘আমেদাবাদে ফিরে দারুণ লাগছে। মানুষ এখানে প্রাণ দিয়ে সমর্থন করতে আসেন।’ হাস্যকর‌ কথা। ক্রিকেট এখন এত কর্পোরেট, এত অর্থ সেখানে যে, রাগ-দুঃখ-যন্ত্রণা প্রকাশের বিশেষ স্থান নেই। পান‌ থেকে চুন খসলে ভাবমূর্তির সাড়ে বারোটা বাজবে, ফসকে যাবে এনডোর্সমেন্ট। হার্দিক তাই বলতে পারবেন না। বলা অসম্ভব। অথচ বাস্তব হল, আমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে যে ‘ব্যারাকিং’-এর মধ্যে পড়তে হয়েছিল হার্দিককে, তার একমাত্র তুলনা হতে পারে ২০০৫ সালের ইডেন গার্ডেন্স। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে বাদ দিয়ে যখন খেলতে এসেছিল রাহুল দ্রাবিড়ের ভারত। এসে দেখেছিল, দেশের মাঠ, দেশের মানুষ, কীরকম ‘দ্বেষা’ত্মবোধক আচরণ করছে! হিংস্রভাবে দক্ষিণ আফ্রিকাকে সমর্থন করছে! ঘরের ছেলের প্রতি ‘প্রবঞ্চনা’ মানতে না পেরে। শোনা যায়, পরবর্তী কেন্দ্রে গিয়ে দ্রাবিড় নাকি বলেছিলেন, যাক বাবা, দেশে ফিরলাম! হার্দিকও মুম্বই ফিরে সে কথাই ভেবেছিলেন কি?
তফাত হল, ১৯ বছর পূর্বে বাংলার ঘরের ছেলেকে বাদ দিয়ে ইডেনে নামার ‘ধৃষ্টতা’ দেখিয়েছিলেন দ্রাবিড়। আর হার্দিক ‘ধৃষ্টতা’ দেখিয়েছেন ঘরের মাঠ, গুজরাতের টিম ছেড়ে চলে যাওয়ার! যে টিম তাঁকে অধিনায়ক করে এনেছিল, জামাই-আদরে রেখেছিল। অবশ্যই প্রতিদান দিয়েছেন তিনি।‌ আইপিএল আত্মপ্রকাশে গুজরাতকে চ্যাম্পিয়ন করে। দ্বিতীয়বার রানার্স করে। কিন্তু তার পরই হুট করে ছেড়ে চলে গিয়েছেন হার্দিক, পুরনো টিমের আশ্রয়ে, নতুন মোহের হাতছানিতে। এবং ভারত অধিনায়ককে ‘রিপ্লেস’ করে তাঁর সিংহাসনে উপবিষ্ট হয়েছেন। জনতা আর ছাড়বে কেন? ছাড় দেবে কেন? তা সে যতই আইপিএল কঠোর পেশাদার ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ হোক। আরে বাবা, দিন শেষে পৃথিবীর সমস্ত খেলা, সমস্ত লিগ, সমর্থকের আবেগ দিয়ে চলে। না হলে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো আসতে পারেন শুনে, আটলেটিকো মাদ্রিদ জনতা আগাম প্রতিবাদী রণমূর্তি ধারণ করত না! বছর কয়েক আগে যা ঘটেছিল। সিআরকেই যদি এ হেন ‘হেনস্থা’র সম্মুখীন হতে হয়, তাহলে কে হার্দিক পান্ডিয়া?
তার ওপর আচরণ। ২০১১ সালে গৌতম গম্ভীর যখন কেকেআর অধিনায়ক হয়ে আসেন, সর্বপ্রথম যে কাজটা করেছিলেন, তা হল কলকাতার মানুষের মন পাওয়া। কারণ, কেকেআরে তাঁর পূর্বতন অধিনায়কের নাম ছিল সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। অর্থাৎ, শ্রীযুক্ত পশ্চিমবঙ্গ! বুদ্ধিমান গম্ভীর কখনও সে নামের সঙ্গে লড়তে যাননি। ভাবেনইনি। বরং যদ্দুর মনে পড়ে বলেছিলেন, ‘আমি কলকাতার দ্বিতীয় সন্তান।’ প্রথম সন্তান কে? সহজেই অনুমেয়। মনে রাখা প্রয়োজন, গম্ভীর যখন নাইট অধিনায়ক হয়ে এসেছিলেন, কেকেআর ব্যর্থতার মহাসাগরে ডুবেছিল। তবু গম্ভীর বলেছিলেন। সে তুলনায় হার্দিকের কাজ সেখানে অধিকতর কঠিন ছিল। প্রথমত, তিনি যাঁর মসনদ ‘দখল’ করছেন, তাঁর নাম রোহিত শর্মা। ভারত অধিনায়ক। দ্বিতীয়ত, মুম্বই অধিনায়ক হিসেবে আইপিএল ট্রফি রোহিত জিতেছেন পাঁচবার। অতএব, পূর্বসূরিকে অনেক বেশি সহমর্মিতা, অনেক বেশি সম্মান, দেখাতে হত হার্দিককে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
বদলে তিনি কী করলেন? না, রোহিতকে কড়াভাবে বাউন্ডারি লাইনে ফিল্ডিং করতে যেতে বললেন! সাধারণত যিনি তিরিশ গজী বৃত্তে ফিল্ডিং করে থাকেন। রোহিতকে দৃশ্যতই অবাক দেখিয়েছিল। একবার জিজ্ঞাসাও তিনি করেন হার্দিককে যে, সত্যিই তাঁকে বাউন্ডারি লাইনে যেতে মুম্বই অধিনায়ক বলছেন কি না? শেষে ভারত অধিনায়ক বোঝেন যে, বলা হচ্ছে। দ্বিরুক্তি না করে তিনি চলেও যান। কিন্তু দেশজুড়ে তারপর ক্ষোভের বিস্ফোরণ হয়ে যায়। আগেকার দিন হলে এ সমস্ত করে পার পাওয়া যেত। বলে দেওয়া যেত, সাংবাদিক মিথ্যে লিখেছে। আদতে এসব কিছু ঘটেইনি। কিন্তু এখন সত্তরটা ক্যামেরার যুগে ওসব অজুহাত চলে না। ‘অপরাধী’ হার্দিকের তাই টুইটার ট্রেন্ডিং হওয়া তাই বড় স্বাভাবিক ছিল। পরে রোহিতের কাঁধে চাপার চেষ্টা করলেন হার্দিক। ভারত অধিনায়ক এক ঝটকায় নামিয়ে দিলেন। জসপ্রীত বুমরা অনুযোগ করলেন নতুন নেতাকে নিয়ে, পুরনো নেতার কাছে। যে আমেদাবাদ জনতা হার্দিককে বিদ্রুপের আলকাতরায় স্নান করিয়ে দিল, তারাই রোহিত নিয়ে হর্ষধ্বনিতে ফেটে পড়ল। পৃথিবী সব দেখল, শুনল, জানল। অথচ পারতেন হার্দিক অনেক ভালোভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে। পারতেন, অগ্রজের প্রতি সম্মান প্রদর্শনে তাঁকেই টস করতে পাঠিয়ে দিতে। কিছুক্ষণের জন্য হলেও অধিনায়কের আর্মব্যান্ড রোহিতকে দিয়ে দিতে। যা সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের শেষ টেস্টে করেছিলেন কোনও এক মহেন্দ্র সিং ধোনি! এক লহমায় দেশ তখন ঘুরে যেত। ধন্য ধন্য পড়ে যেত ভারতীয় অলরাউন্ডারকে নিয়ে। কিন্তু এর একটাও করেননি হার্দিক, কিস্যু না।
নাহ্, রোহিতকে বাউন্ডারি লাইনে ফিল্ডিং করতে পাঠিয়ে কোনও ভুল করেননি হার্দিক। অধিনায়ক সর্বক্ষমতাসম্পন্ন। সে বলতেই পারে। এবং তা প্লেয়ারকে শুনতেও হবে। কিন্তু তারপরেও একটা দুনিয়া পড়ে থাকে। ভদ্রতার দুনিয়া। শিষ্টাচারের দুনিয়া। সভ্যতার দুনিয়া। হার্দিক বড় ক্রিকেটার। অবশ্যই বড় অলরাউন্ডার। কিন্তু এসবের পর দেশনায়ক তাঁর পক্ষে আর কতটা হওয়া সম্ভব, বলা‌ মুশকিল। নিজেকে না বদলালে, না পাল্টালে, একটা ধোনি বা গম্ভীর হয়ে ওঠা তাঁর পক্ষে কঠিন, খুব কঠিন।
উল্টে হার্দিক এমন এক চরিত্র হয়ে ভারতীয় ক্রিকেটে চিরাচরিত থেকে যেতে পারেন, মাত্র দু’শব্দে যাঁর ব্যাখ্যা হয়ে যায়। যা এক জাতীয় টিভি চ্যানেলে বেফাঁস বলে মহাবিতর্কের শরিক হয়েছিলেন তিনি।
‘করকে আয়া’!