Robbar

হিংসার পৃথিবী জয়ের বীজমন্ত্র জানে এই ‘টিম ইন্ডিয়া’

Published by: Robbar Digital
  • Posted:March 11, 2025 5:37 pm
  • Updated:March 11, 2025 7:05 pm  

সামাজিকমাধ্যমই তো বাজার নির্ধারণ করে! তারা নতুন ভারতের প্রতিভূ। তাদের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব চাই, তাদের অদৃশ্য শত্রু চাই, তাদের আপাত বিপদচিন্তা চাই! এসব না হলে, আর তা মুচমুচে করে পরিবেশিত না হলে তাদের চলবে না! আর প্রাক্তন ক্রিকেটাররাও এই সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হয়ে রয়েছেন। এমনিতে প্রতিভাকে ঘষামাজার ক্ষেত্রে পেশাদারী কোচিং-এর সহায়তা পাওয়া প্রাক্তনদের অনেকেই নিজেরা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেননি, অথবা বদলে যাওয়া খেলাটার সঙ্গে তাল মেলাননি। কিন্তু বিশেষজ্ঞ হিসাবে ভুল মন্তব্য করে বর্তমান ক্রিকেটারদের সমস্যা আরও বাড়িয়ে দেওয়ায় তারা সিদ্ধহস্ত। এই আবহে দাঁড়িয়ে এই যে ভারতীয় ক্রিকেট দল বিশেষত সাদা বলের ক্রিকেটে একটা জয়ের সংস্কৃতি তৈরি করে ফেলেছে, তাতে কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়।

সৌরাংশু

এই লেখা লিখতে বসেই মনে পড়ে গেল রবীন্দ্রনাথের সেই পঙক্তিগুলি–

‘একাকী গায়কের নহে তো গান, মিলিতে হবে দুই জনে–
গাহিবে একজন খুলিয়া গলা, আরেক জন গাবে মনে।’

বস্তুত, আজকাল ক্রিকেটই হোক বা ফুটবল, কিংবা হকি, ব্যাডমিন্টন বা অন্য কিছু, খেলা দু’জায়গায় হয়– একটা মাঠে বা কোর্টে, আরেকটা সামাজিক মাধ্যমের চার দেওয়ালের গণ্ডিতে। মাঠের খেলায় খেলতে গেলে অবশ্যই যোগ্যতা লাগে, দরকার শারীরিক কসরত, দরকার নিবিষ্ট মনঃসংযোগ, দরকার প্রতিভা আর নিবিড় অনুশীলন।

ICC Champions Trophy 2025 final: India beat New Zealand by four wickets | Cricket News | Al Jazeera
আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়ী ভারতীয় দল

কিন্তু সামাজিক মাধ্যমের ক্ষেত্রে কেউ সে সবের ধার ধারে না। বর্তমান রাজনীতিতে ডিজিটালিকরণের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আসার সঙ্গে সঙ্গে দুটো জিনিস যেন ধুয়ে মুছে গেছে। একটা হল দায়বদ্ধতা এবং দ্বিতীয়টি হল নীতিবোধ! যে কোনও বিষয়ে কথা বলতে গেলে দরকার সেই বিষয়ে সামান্য সাধারণ জ্ঞান। সেই জ্ঞান আসে হয় আপনি নিজে সেই কাজটা করেছেন, অথবা নিয়মিত ভিত্তিতে চর্চা করেছেন।

সামাজিক মাধ্যমের ক্ষেত্রে এই সব শর্ত একেবারে কর্পূরের মতো উবে গেছে। ক্রিকেট নিয়ে বক্তব্য রাখতে গেলে যে ন্যূনতম যোগ্যতা দরকার, তা ডাস্টার দিয়ে গুঁড়ো চকের লেখা মুছে দেওয়ার মতো নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে সামাজিক মাধ্যম। সেখানে সকলেই বিশেষজ্ঞ, সকলেই সবজান্তা। ক্রিকেট নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে সামান্য পড়াশুনো বা সামান্য মাঠে নেমে খেলার প্রয়োজন সেখানে নেই। ক্রীড়াপ্রেমীদের ক্ষেত্রে এ ব্যাপারটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এর সঙ্গে যে জিনিসটা যুক্ত হয়েছে সেটা বোধহয় শুধু এই শতাব্দী নয়, এই সময়ের বিশেষ বৈশিষ্ট্য! সেটা হল ব্যর্থতার প্রতি তীব্র অসূয়া বোধ। নিজেদের জীবন নিয়ে যে সমস্ত মানুষ খুশি নয় তারাই বোধহয় খেলোয়াড়রা ব্যর্থ হলেই দাঁত-নখ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর তার সঙ্গে যুক্ত হয় ‘বিভিন্নতার প্রতি বৈরিতা’। এ এক নতুন ভারত! এখানে আরবি পদবীধারীকে স্বচ্ছন্দে ‘গদ্দার’, ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যা দিয়ে দেওয়া যায়। ভারতীয় দলে মহম্মদ সামি ক্যাচ মিস করলে ধারাভাষ্যকাররাই নির্দ্বিধায় বলে দিতে পারেন ‘সামির আর আত্মনির্ভর ভারতের পরিচয় হয়ে ওঠা হল না!’ একবারও ভাবেন না এর প্রভাব কতটা সুদূরপ্রসারী। দেশের প্রতি দায়বদ্ধতার পরীক্ষা সামিকে তাই বারবার দিতে হয়।

No Need To Act As Judge': Muslim Clerics Defend Cricketer Mohammed Shami Over Ramzan Fasting Row | Sports News - News18
সাফল্য পাওয়া সত্ত্বেও বিতর্ক তাড়া করেছে মহম্মদ সামিকে

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পরিবার নিয়ে ট্রোলিং। নতুন ভারতের ধারক ও বাহকরা ২০২৩ বিশ্বকাপ ফাইনালে ভারতকে হারানোর মূল কাণ্ডারি ট্র্যাভিস হেডের শিশুকন্যাকে পর্যন্ত আন্তর্জালে ধর্ষণের হুমকি দিতে ছাড়ে না। ব্যর্থতার দায় স্ত্রী বা বান্ধবীর ওপর স্বচ্ছন্দে চাপিয়ে দেয়। আর বিচ্ছেদ হলে তো কথাই নেই! মহম্মদ সামির বিরোধিতা করে একটা গোষ্ঠী। কিন্তু মহম্মদ সামি ভালো পারফর্ম করলে প্রত্যক্ষভাবে তাঁর প্রাক্তন স্ত্রী হাসিন জাহানকে কটাক্ষ করতে পিছপা হয় না তারা। একই ঘটনা ঘটে হার্দিক পান্ডিয়ার প্রাক্তন স্ত্রী নাতাশার ক্ষেত্রেও! হার্দিককে যখন রোহিত শর্মার মতো আইকনকে সরিয়ে মুম্বই ইন্ডিয়ানের অধিনায়ক করা হল তখন থেকেই ভারতীয় অলরাউন্ডারকে নিশানা করেছিল সমাজমাধ্যম। কিন্তু হার্দিকের পারফরম্যান্সে যেই ওয়েস্ট ইন্ডিজে ভারত টি২০ বিশ্বকাপ জিতল তখন স্বচ্ছন্দে পুরনো কথা ভুলে গিয়ে নাতাশার দিকে কামান ঘুরিয়ে দিতে বাধেনি।

Hardik Pandya why India didnt travel to Pakistan - 'Pakistani people must have enjoyed...': Hardik Pandya's clear cut response on why India didn't travel to Pakistan for Champions Trophy - SportsTak
হার্দিক পান্ডিয়া

আরেক সমস্যা হল আইকন সংস্কৃতি! বোম্বে-দিল্লি, নবীন-প্রবীণ, ভারতীয় দলে গোষ্ঠী-সংস্কৃতি আগেও যে ছিল না, তা নয়। কিন্তু সাম্প্রতিক অতীতে বিরাটকে সরিয়ে রোহিতকে অধিনায়ক করার সঙ্গে সঙ্গে গোষ্ঠী দ্বন্দ্বের জল্পনায় ঘি ডালা শুরু হয়। ঠিক যেভাবে অফিস পরিসরে রামের জায়গায় শ্যামকে বড় দায়িত্ব দিলে শ্যাম গোষ্ঠী আর রাম গোষ্ঠীর মধ্যে ঝগড়া লেগে যায়! এক্ষেত্রে অবশ্য জনপ্রিয় মিডিয়ার দায়-দায়িত্ব কিছু কম নয়। তারা দুই সহযোদ্ধার মধ্যে কাল্পনিক যুদ্ধ লাগিয়ে দিয়ে অস্ত্রব্যবসায়ীর মতো গোলাবারুদ বিক্রি করতে শুরু করে।

রোহিত ব্যর্থ হলে কোহলির বিরাট ‘ফ্যান’বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর বিরাটের ক্ষেত্রে রোহিতের শুভাকাঙ্ক্ষীরা! ভুলে যায় যে, দু’জনেই আদতে ভারতীয় দলের হয়ে বহুদিন ধরে ঘাম-রক্ত ঝরিয়েছে। ব্যক্তিগত সংঘাত থাকলেও তা মূল উদ্দেশ্যের বাধা হয়ে দাঁড়ায় না! অথচ সাফল্যের বা ব্যর্থতার পরে দু’জনেই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আনন্দ বা ব্যর্থতার প্রতিফলন একযোগে করেন সেটা চোখে পড়লেও বাজার খাবে না বলে স্বচ্ছন্দে ভুলে যান।

একতা: যা টিম ইন্ডিয়ার জার্সিতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন বিরাট-রোহিত

সামাজিকমাধ্যমই তো বাজার নির্ধারণ করে! তারা নতুন ভারতের প্রতিভূ। তাদের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব চাই, তাদের অদৃশ্য শত্রু চাই, তাদের আপাত বিপদচিন্তা চাই! এসব না হলে, আর তা মুচমুচে করে পরিবেশিত না হলে তাদের চলবে না! আর প্রাক্তন ক্রিকেটাররাও এই সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হয়ে রয়েছেন। এমনিতে প্রতিভাকে ঘষামাজার ক্ষেত্রে পেশাদারী কোচিং-এর সহায়তা পাওয়া প্রাক্তনদের অনেকেই নিজেরা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেননি, অথবা বদলে যাওয়া খেলাটার সঙ্গে তাল মেলাননি। কিন্তু বিশেষজ্ঞ হিসাবে ভুল মন্তব্য করে বর্তমান ক্রিকেটারদের সমস্যা আরও বাড়িয়ে দেওয়ায় তারা সিদ্ধহস্ত। বিস্তারিত ঘটনার বিবরণে যাচ্ছি না, কিন্তু জনসমক্ষে মন্তব্যের ক্ষেত্রে অধিকাংশ প্রাক্তনই হয় দায়িত্বজ্ঞানহীন অথবা চমকে বিশ্বাসী, ফলাফলে নজর না রেখেই। অথচ যাঁরা সত্যি কাজ করেন এবং অবসরের পর খেলাটাকে কিছু ফিরিয়ে দিতে চান, তাঁরা কিন্তু বেশি কথা বলেন না, নিভৃতে কাজ করেন! এই আবহে দাঁড়িয়ে এই যে ভারতীয় ক্রিকেট দল বিশেষত সাদা বলের ক্রিকেটে একটা জয়ের সংস্কৃতি তৈরি করে ফেলেছে, তাতে কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়।

……………………………………….

আরও পড়ুন সরোজ দরবার-এর লেখা: সুনীল গাভাসকরের নাচ আনন্দনৃত্য নয়, বরং বিরোধহীন নতুন ভারতের সামনে পুরনো ভারতের প্রত্যাবর্তন

……………………………………….

এমনিতে ভারতীয় বোর্ডও সামাজিক মাধ্যম দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়। শ্রেয়স আইয়ারের শর্ট-বলে টেকনিকাল সমস্যা হচ্ছে, চোট-আঘাত থেকে ফিরে আসার পর সে বিষয়ে কাজ করার সময় পাননি– এসব শোনার বান্দা ভারতীয় বোর্ড নয়। অস্ট্রেলিয়ায় লাল বলে ব্যর্থ হয়েছে ভারতীয় দল, তার নেপথ্যে সিনিয়র প্লেয়ারদের মানসিক সমস্যা হতে পারে, টেকনিকাল সমস্যাও থাকতে পারে। কিন্তু তাদের সবার জন্য এক দাওয়াই! স্থানীয় ক্রিকেট খেলো! আরে সমস্যার সমাধান কি গড়পড়তা একইভাবে হয় নাকি!

তারপরেও ভারতীয় বোর্ডের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা প্রশংসনীয়। আইপিএলের ফলে একটা ট্যালেন্ট পুল তৈরি হচ্ছে। উঠতি ক্রিকেটারদের পরিচর্যার ক্ষেত্রেও যথেষ্ট ধৈর্যের পরিচয় দেওয়া হচ্ছে। সুযোগ দিলে তাঁদের পিছনে যথেষ্ট সময় ব্যয় করা হচ্ছে। সবার মধ্যে জেতার মনোভাব প্রোথিত হচ্ছে এবং সর্বোপরি সামাজিক মাধ্যম বা সংবাদমাধ্যমের কুপ্রভাব থেকে বাঁচার সার্বিক প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে। আর সবথেকে বড় কথা হল, দলের সিনিয়র-জুনিয়র আবহে ইগোর লড়াই থাকলেও, মতপার্থক্য থাকলেও বৃহত্তর উদ্দেশ্যকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

রোহিতের সঙ্গে শুভমান গিল

এর ফলও দেখা যাচ্ছে কিন্তু! গত ১২ বছরে নিয়মিত ভিত্তিতে সেমিফাইনাল, ফাইনাল খেলার পর পরপর দু’টি আইসিসি টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হল ভারত! এবং গত তিনটি আইসিসি টুর্নামেন্টের ২৩টি ম্যাচে মাত্র একটিতে পরাজিত তারা! এমন আধিপত্য হয়তো সাত বা আটের দশকের ওয়েস্ট ইন্ডিজ বা নয় কিংবা শূন্য বা দ্বিতীয় দশকের অস্ট্রেলিয়াও দেখাতে পারেনি।

সেখান থেকেই আশার আলো জাগে। বৈপরীত্যে ভরা এই দুনিয়ায় পথ হারাবার সমস্ত প্রবন্ধন থাকলেও একসূত্রে বেঁধে বেঁধে থাকার ফলে এবং যে যার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করার কারণেই বোধহয় দীর্ঘস্থায়ী সাফল্যের মুখ দেখতে শুরু করেছে ভারত।

বিরাট কোহলি তো বলেই দিয়েছেন, ‘আগামী আট বছরে সমস্ত লড়াইয়ের জন্য ভারত প্রস্তুত!’ শুধু ভয় হয়, চারদিক থেকে এত প্রলোভন, এত চাপ তা যেন দম দেওয়া মেশিনকে লাইনচ্যুত করে দিতে না পারে! আসলে সঠিক প্রস্তুতি, সঠিক মনোভাব এবং পরিকল্পনার সঠিক রূপায়ণের মাধ্যমে দীর্ঘস্থায়ী সাফল্য আসে! চমক অথবা ঝটকায় নয়! বীজমন্ত্রটা ভারতীয় দল শিখে গেছে। অন্তত সাদাবলের ক্রিকেটে।

…………………………………….

ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল

…………………………………….