ধোনি-গম্ভীর সম্পর্কের সেই দহনকে আইপিএল মিলিয়ে দিল এক পরম হার্দ্য- করমর্দনে। যখন চিপকে কেকেআর-সিএসকে ম্যাচ শেষে দু’জন জড়িয়ে ধরলেন দু’জনকে। আর আইপিএলও কোথাও গিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে গেল, ক্ষোভ-বিক্ষোভ যতই গগনচুম্বী হোক, সম্পর্ক যতই তলানিতে ঠেকুক– তা ধ্রুবক নয়, পরিবর্তনশীল। তাই বিদ্বেষের শেষে অপেক্ষা করে আন্তরিকতা, বিরহের শেষে দাঁড়িয়ে থাকে ভালোবাসা। বিচ্ছেদের বিপ্রতীপে থাকে বন্ধন। উষ্ণ আলিঙ্গনে স্মিত হাসিতে সেই বৈরিতার পৃথিবীকেই যেন জয় করে নিলেন ধোনি-গম্ভীর।
‘ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট শ্যাল নেভার মিট’। পুব-পশ্চিমের কখনও মিল হতে পারে না।
রুডিয়ার্ড কিপলিং-এর কথাটা শিরোধার্য করেও বলতে হয়, এ পৃথিবীতে কোনকিছু চিরস্থায়ী নয়। জগতের মতোই তা সদা পরিবর্তনশীল। ধ্যান-ধারণা। সম্পর্ক। সম্পর্কের ভাঙাগড়া। নিয়ত সেই অনুভূতির প্রবাহে জোয়ার-ভাঁটা খেলে। বিদ্বেষ মুছে গিয়ে জায়গা নেয় শ্রদ্ধা। উপেক্ষার অস্তরাগে জেগে ওঠে আন্তরিকতা। জীবন ধ্রুবপদের মতো সেই চলিষ্ণু শিক্ষাই দেয়। আমাদের উপলব্ধির মূলে নতুন বিশ্বাসের জন্ম দেয়, নতুন প্রত্যয়কে আবিষ্কার করে।
উপলব্ধির সেই দুনিয়াটাকে আরও স্বচ্ছ করে দিয়েছে আইপিএল।
মহাবিশ্বে সমস্ত কিছুর লয়-ক্ষয় রয়েছে। ক্রিকেট তার বাইরে নয়। ব্যর্থতার ধ্বংসস্তূপ থেকে সাফল্যের আকাশ প্রদীপ গড়ে তোলার সহজপাঠ শিখিয়েছে এই আইপিএল বিশ্ব। কত রেকর্ডের ভাঙাগড়া দেখিয়েছে। তারকার উত্থান দেখিয়েছে, পতন দেখিয়েছে। অবাক বিস্ময়ে তা আত্মস্থ করেছি। শুধু রেকর্ড? সম্পর্কের ব্যবচ্ছেদ? তার শৈত্য, গভীরতা? সেটাও কম অনুভূত হয়েছে নাকি আইপিএল আঙিনায় দাঁড়িয়ে!
এ চর্মচক্ষু আইপিএলের হাত ধরে যেমন শাহরুখ-সৌরভ বিচ্ছেদ দেখেছে, তেমনই দেখেছে বাদশা-মহারাজের মিলমিশ। দেখেছে সৌরভ নামক বঙ্গ-আবেগের দিকে বিরাটসুলভ রক্তচক্ষু। তারপর রূপকথার ছন্দে তাদের হৃদ্যতায় হর্ষধ্বনি করেছে অক্লেশে। দেখেছে, কোহলি-গম্ভীর তিক্ততার ‘মধুরেণ সমাপয়েৎ’।
এসব আইপিএলের দান! জীবন শিক্ষাও বটে। যেখানে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্যে যেমন পারস্পরিক ক্ষোভ আছে, তেমনই আছে অপার শ্রদ্ধা। সেই অনুভূতি কোথাও গিয়ে মিলিয়ে দিয়ে গেল মহেন্দ্র সিং ধোনি এবং গৌতম গম্ভীর নামক ক্রিকেট নীহারিকার দুই জ্যোতিষ্ককে।
গম্ভীর ঘনিষ্ঠরা বছর কয়েক আগেও গরগর করতেন যে, ভারতীয় টিম, ভারতীয় অধিনায়কত্ব, বিশ্বজয়ের অধিকারে ধোনির পৈতৃক অধিকার নেই! আসলে এঁরা মনে করেন, ধোনি পারতেন নিজের উত্তরসূরি হিসেবে গম্ভীরকে নির্বাচন করতে। যাঁর তর্কাতীত যোগ্যতা ছিল ভারত অধিনায়ক হওয়ার। কিন্তু তা তিনি করেননি। বরং ওয়াংখেড়েতে বিশ্বজয়ের চার বছর পরেও টানা অধিনায়কত্ব করে, উত্তরসূরির তাজ বিরাট কোহলির মাথায় পরিয়ে দেন। যার নিটফল, গম্ভীরের ভারত অধিনায়ক হওয়া আর হয়নি। রাগটাও তাই যায়নি। পরবর্তী সময়ে প্রকাশ্যে বহুবার পরোক্ষে ধোনির সমালোচনা করেছেন গম্ভীর। এটাও বলেছেন, এ দেশের সংস্কৃতি হল, একজনের কীর্তি নিয়ে নাচানাচি করা। বাকিদের অবদানকে বাদ দিয়ে। গম্ভীরের যন্ত্রণার কারণ বোঝা যায়। ২০১১ বিশ্বকাপ ফাইনালে তাঁর ৯৭ ছিল। ধোনি করেছিলেন ৯১ নট আউট। কিন্তু দোসরা এপ্রিলের ওয়াংখেড়ের মায়ারাতে ধোনিকে নিয়ে, নুয়ান কুলশেখরাকে মারা তাঁর কালজয়ী ছয় নিয়ে যে পরিমাণ নাচানাচি হয়েছে, আলোচনা হয়েছে, তার ছিটেফোঁটাও হয়নি গম্ভীরকে নিয়ে। আজও হয় না। কিন্তু গম্ভীর যে ঠিক কতটা ভালো অধিনায়ক, বুঝিয়ে দিয়েছেন পরে। কেকেআর জার্সিতে। ব্যর্থতা-ব্যর্থতায় ‘মুমূর্ষু’ এক টিমকে দু’বার আইপিএল চ্যাম্পিয়ন করে। বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনি ছিলেন সেই অবহেলার হীরকখণ্ড, ভারতবর্ষ যাঁকে গর্ভে ধরেও মর্যাদা দিতে পারেনি। সে যাতনা, সে জ্বালা যে কতটা ভোগাত গম্ভীরকে, বোঝা গিয়েছে ভবিষ্যতে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
গম্ভীর ঘনিষ্ঠরা বছর কয়েক আগেও গরগর করতেন যে, ভারতীয় টিম, ভারতীয় অধিনায়কত্ব, বিশ্বজয়ের অধিকারে ধোনির পৈতৃক অধিকার নেই! আসলে এঁরা মনে করেন, ধোনি পারতেন নিজের উত্তরসূরি হিসেবে গম্ভীরকে নির্বাচন করতে। যাঁর তর্কাতীত যোগ্যতা ছিল ভারত অধিনায়ক হওয়ার। কিন্তু তা তিনি করেননি। বরং ওয়াংখেড়েতে বিশ্বজয়ের চার বছর পরেও টানা অধিনায়কত্ব করে, উত্তরসূরির তাজ বিরাট কোহলির মাথায় পরিয়ে দেন। যার নিটফল, গম্ভীরের ভারত অধিনায়ক হওয়া আর হয়নি। রাগটাও তাই যায়নি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
একবার আইপিএলে সিএসকে-কেকেআর ম্যাচে তো ধোনি নামামাত্র তাঁর ব্যাটের আশপাশ ফিল্ডারের চক্রব্যূহ দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন গম্ভীর! প্রচ্ছন্ন বার্তা দিয়ে যে, পারলে ফাটিয়ে বের হও ফিল্ডারের ‘প্রাচীর’। দেখি তুমি কত বড় বীর! তুমি বিশ্বজয়ী অধিনায়ক বলে বাড়তি খাতির পাবে না। বাকিদের কাছে তুমি ঈশ্বর। আমার কাছে নও! সেই শৈত্যকে, সেই বৈরিতাকে, ধোনি-গম্ভীর সম্পর্কের সেই দহনকে আইপিএল মিলিয়ে দিল এক পরম হার্দ্য- করমর্দনে। যখন চিপকে কেকেআর-সিএসকে ম্যাচ শেষে দু’জন জড়িয়ে ধরলেন দু’জনকে। আর আইপিএলও কোথাও গিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে গেল, ক্ষোভ-বিক্ষোভ যতই গগনচুম্বী হোক, সম্পর্ক যতই তলানিতে ঠেকুক– তা ধ্রুবক নয়, পরিবর্তনশীল। তাই বিদ্বেষের শেষে অপেক্ষা করে আন্তরিকতা, বিরহের শেষে দাঁড়িয়ে থাকে ভালোবাসা। বিচ্ছেদের বিপ্রতীপে থাকে বন্ধন। উষ্ণ আলিঙ্গনে স্মিত হাসিতে সেই বৈরিতার পৃথিবীকেই যেন জয় করে নিলেন ধোনি-গম্ভীর।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: বদলে যাওয়া এই মহামেডানের সঙ্গে ইস্ট-মোহনের লড়াই আর ‘মিনি ডার্বি’ নয়
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
শুধু বোধহয় লিখতে হবে, আপাতত। এখনকার মতো। ভবিষ্যতে আবার যে দুইয়ের সংঘর্ষে স্ফুলিঙ্গ জ্বলবে না, কে বলতে পারে? না জ্বললে সবচেয়ে ভালো। দুই বরেণ্যের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে হানাহানি কে-ই বা চায়? কিন্তু আবার জ্বললে? আবার পরোক্ষে লাগলে? করার নেই কিছু।
লিখলামই তো, দুনিয়া চির-পরিবর্তনশীল! তার সব কিছুই বদলায়। পাল্টায়। আপনার-আমার মন রাখার দায় এ জীবজগতের নেই!
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved