
যে পাহাড় কেটে টেম্বা পথ তৈরি করেছেন, সে পাহাড় কাটা কখনও শেষ হয় না। বর্ণ গেলে দেহ আসে। নিয়তির অমোঘ পরিহাস, যে ক্রিকেটের নন্দনকাননে বর্ণবিদ্বেষের কালরাত্রি পেরিয়ে প্রোটিয়া ক্রিকেটের নতুন সূর্যোদয় ঘটেছিল; সেই নন্দন কাননে টেম্বাকে ‘বাওনা’ বক্রোক্তি শুনতে হয়। টেম্বা মুখে জবাব দেন না। তাঁর হয়ে ব্যাট কথা বলে। সমুচিত জবাব দিয়ে, কঠিন পিছে স্থিতধী যোগীর মতো অপরাজিত ম্যাচ জেতান ইনিংস খেলে যান। ‘স্বাভাবিক’ উপহাস করা ভারতের সর্বকালের সেরা জোরে বোলার জবাবটা ঠিক পেয়ে যান। খেলা শেষে টেম্বার কায়া এতটাই দীর্ঘ হয়ে ওঠে যে জশপ্রীতের ক্ষমাপ্রার্থনা নিতান্তই আনুষ্ঠানিক কর্তব্য প্রতিভাত হয়।
ছেলেটা তখনও কৈশোরে পা দেয়নি। ক্লাস সিক্সে পড়ে। স্কুল যেতে ভালোবাসে। একদিন ছেলেটার মা লক্ষ করলেন, সপ্তাহের বিশেষ একটা দিনে ছেলে স্কুলে যেতে চাইছে না। স্কুলে যাওয়ার প্রতি অনীহার কারণ জেনে মা অবাক! আসলে ছেলেটার শারীরিক বিবরণ গড়পড়তা উপমহাদেশীয় ছেলেদের মতো নয়। পার্থক্য সামান্য। মাথার অধিকাংশ চুল সাদা। সহপাঠীদের উপহাস বা সৌহার্দ্যপূর্ণ টিটকিরি সে দিব্যি মানিয়ে নিতে শিখে গিয়েছে। বুঝে গিয়েছে, সতীর্থদের এই ব্যবহার ‘স্বাভাবিক’। কালোকে ‘কালা’, বেঁটেকে ‘নাটা’, ট্যারাকে ‘ট্যারা’ বলাটাই ‘স্বাভাবিক’। সেটাই দস্তুর। কিন্তু শিক্ষক যদি ক্লাসের মাঝে ‘বুড়ো’ বলে সম্বোধন করেন! মানিয়ে নিতে অস্বস্তি হয়। তখন স্কুলে যেতে না-চাওয়াটাই স্বাভাবিক। এই চিরন্তন ‘স্বাভাবিক’ মানসিকতায় বন্ধু ও শিক্ষকের অবস্থানও গুলিয়ে যায়। শিক্ষক ক্ষমা চেয়ে নিতে জানেন। ছাত্রের কাছে শিক্ষকের ক্ষমা চাওয়া, উপমহাদেশীয় গুরু-শিষ্য পরম্পরায় দৃষ্টান্ত হতে পারে। সহপাঠীদের কেউ কেউ বন্ধু হয়ে যায়, আর কেউ কেউ সময়ের নিয়মে হারিয়ে যায়। চাইল্ডহুড ট্রমা সহজে পিছু ছাড়ে না। সিকি শতাব্দী পেরিয়েও ক্ষতটা ঠিক থেকে যায়।

নাটা, কালা, ট্যারা– বিশেষণ এক সময় অভ্যাসে পরিণত হয়। যেখানে নীতিকথার বইয়ের উপদেশেরা নিষ্প্রাণ অক্ষর মাত্র। যা কোনও বোধের জন্ম দিতে পারে না। শিক্ষা দিতে পারে না। স্কুলশিক্ষিকা দলজিত বুমরার সন্তান, ভারতের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জোরে বোলার জসপ্রীতের মন্তব্য ‘বাওনা’ তাই ‘অস্বাভাবিক’ কিছু না। এমনটাই যে দস্তুর!

অন্যদিকে টেম্বা। অস্বাভাবিক-কে স্বাভাবিক বানাতেই যে দস্তুর। বাওনা– টেম্বার জন্য নতুন শব্দবন্ধ হতে পারে; এর মর্মার্থ তাঁর সহজেই অনুমেয়। লাঙ্গার তিন মাথার মোড়ের লাইট পোস্টের নিচে ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে খর্বকায় টেম্বা যে লাহোর, লর্ডস, এমসিজি-র অলীক স্বপ্ন দেখতে জানতেন! রাত্রে বিছানায় শুয়ে শোনেন গুলির শব্দ। লাঙ্গায় সেটাই স্বাভাবিক। ব্যাটিং প্রতিভার জোরে টেম্বা দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম সারির স্কুলে প্রবেশের সুযোগ পান। যেখানে একদা কৃষ্ণাঙ্গদের প্রবেশাধিকার ছিল না। টেম্বার জাতীয় দলের প্রতিনিধিত্বকেও বিদ্রুপ করা হয়। তাঁকে প্রতি মুহূর্তে থাকতে হত আতস কাচের তলায়। সর্বক্ষণ তাঁকে প্রমাণ করতে হয় কৃষ্ণাঙ্গ প্রোটিয়ারাও ব্যাট করতে পারে। টেম্বার প্রথম শতরানে দেশের কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটের অভিমুখ বদলে যায়। তাঁর ব্যর্থতা সমগ্র কৃষ্ণাঙ্গ সমাজের ব্যর্থতার সমার্থক হয়ে ওঠে। টেম্বার খর্ব কাঁধজোড়ায় যত ভার পরেছে, দিনে দিনে তা ততই শক্ত হয়ে উঠেছে।
…………………………………………………
পড়ুন এক ক্লিকে: মেয়েদের ক্রিকেটের বিশ্বজয় মেয়েদের অন্যান্য খেলাকে লঘু করে দেবে না তো?
…………………………………………………
এইভাবে একদিন তিনি দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট দলের অধিনায়ক হলেন। নিঃসন্দেহে বিশ্ব ক্রিকেটের কঠিনতম দায়িত্ব। টেম্বাকে শুনতে হয় ‘কৃষ্ণাঙ্গ কোটার’ অধিনায়ক। সময় লেগেছে কিন্তু ‘কোটার’ অধিনায়ক টেম্বা বিভিন্ন বর্ণ, ভাষা প্রাদেশিক আচার ও লোকাচারের মিশ্র সংস্কৃতির প্রোটিয়া ক্রিকেটকে এক সূত্রে গেঁথেছেন। হ্যামস্ট্রিংয়ের চোট নিয়ে, নিজের ক্যারিয়ার বাজি রেখে, টেম্বার বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়ানশিপের ফাইনালে মার্করামের সঙ্গে ব্যাট হাতে নামা তাই নিতান্ত স্বাভাবিক ঘটনা। চিরকালীন চোকার্স তকমা ঘুচিয়ে টেম্বা দেশকে জিতিয়েছেন বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ। কালক্রমে টেম্বার কৃষ্ণাঙ্গ বিশেষণ খসে পড়েছে। এখন সমস্ত পৃথিবী সম্ভ্রমে স্বীকার করে, টেম্বা প্রোটিয়াদের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অধিনায়ক। যিনি ক্রিকেটের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ অধিনায়কদের পথে হাঁটছেন।

যে পাহাড় কেটে টেম্বা পথ তৈরি করেছেন, সে পাহাড় কাটা কখনও শেষ হয় না। বর্ণ গেলে দেহ আসে। নিয়তির অমোঘ পরিহাস, যে ক্রিকেটের নন্দনকাননে বর্ণবিদ্বেষের কালরাত্রি পেরিয়ে প্রোটিয়া ক্রিকেটের নতুন সূর্যোদয় ঘটেছিল; সেই নন্দন কাননে টেম্বাকে ‘বাওনা’ বক্রোক্তি শুনতে হয়। টেম্বা মুখে জবাব দেন না। তাঁর হয়ে ব্যাট কথা বলে। সমুচিত জবাব দিয়ে, কঠিন পিচে স্থিতধী যোগীর মতো অপরাজিত ম্যাচ জেতান ইনিংস খেলে যান। ‘স্বাভাবিক’ উপহাস করা ভারতের সর্বকালের সেরা জোরে বোলার জবাবটা ঠিক পেয়ে যান। খেলা শেষে টেম্বার কায়া এতটাই দীর্ঘ হয়ে ওঠে যে জশপ্রীতের ক্ষমাপ্রার্থনা নিতান্তই আনুষ্ঠানিক কর্তব্য প্রতিভাত হয়। ভারতের সর্বকালের সেরা জোরে বোলার জবাবটা ঠিক পেয়ে যান। প্রোটিয়াদের ‘আয়রন ম্যান’ সিংহহৃদয় টেম্বার শরীরে কোনও ক্ষতচিহ্ন জমে না। তিনি সামাজিক ‘স্বাভাবিকতার’ ঊর্ধ্বে স্বাভাবিক।

তবু, প্রশ্নটা থেকেই যায়। চিরন্তন প্রশ্ন। আফ্রিকা মহাদেশ থেকে এশীয় উপমহাদেশ, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ থেকে ইউরোপ। সবকালের, সবযুগের শাশ্বত প্রশ্ন। সামাজিক মানবজাতির বর্ণ, দেহ নিয়ে এই ‘স্বাভাবিক’ অস্বাভাবিকতার শেষ কোথায়? সবাই তো টেম্বা হতে পারেন না। ক্রিকেটের পোস্টার বয়, সোশাল আইকন জশপ্রীতরা কি কখনওই সংযত হবেন না?
পরিশেষে মাইকেল হোল্ডিংয়ের ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক মন্তব্যেই ভবিষ্যতের আশা সঞ্চারিত হোক–
‘What I said about education? education is important. Unless we just want to continue living the life that we are living, and continue having demonstration if we now again. And again few people saying a few things. And when I say education, I mean going back in history…’
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved