
গভীর চিন্তাভাবনার পর যা বুঝলাম, দোষ আসলে গম্ভীরবাবুরও না, অজিতকাকারও না, দক্ষিণ আফ্রিকার ও না, আর ভারতীয় ক্রিকেটের তো না-ই। দোষ আসলে আমারই! মানে, আমাদেরই! যারা আশা রাখি। ভরসা রাখি যে, সুসময়ে ভালোবাসা হবে। সুদিন আসবে। ভারত স্পিন খেলবে। চতুর্থ ইনিংসে ১০ উইকেট নেবে। বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ জিতবে। আর যদি হেরেও যায়, কোচ এসে পিচের দোহাই দেবে না! টস হেরে যাওয়ার কথা তুলবে না। স্বীকার করবে হারকে। স্বীকৃতি দেবে ব্যর্থতাকে।
–ওয়াশিংটন ৩ নম্বরে খেলবে!
–কিন্তু বদ্দা, ওয়াশিংটন তো আটে নামে।
–নামত। পাস্ট টেন্স!
–মানে আপনি বলতে চাইছেন, ওয়াশিংটন সুন্দর আমাদের ওয়ান ডাউন ব্যাটার!
–বলতে চাইছি না, বলছি!
না, অবশ্যই এমন কোনও কথোপকথন ভারতীয় ড্রেসিংরুমে হয়নি। এ নিছকই আমার মস্তিস্কপ্রসূত খিল্লি। কিন্তু কমল মিত্রর সঙ্গে গৌতম গম্ভীরের মিলটা তো উপেক্ষা করা যায় না। মানে, কমলবাবু যতটা গম্ভীর ছিলেন, গম্ভীরবাবুও ততটাই কমল। দু’জনের সবচেয়ে বড় মিলটা যদিও সন্তান মানুষ করায়। ‘সন্তান কী চাইছে?’ তার চেয়ে বড় হল ‘আমি কী চাইছি?’। তাই গম্ভীরবাবু কখনও কমল মিত্র, কখনও ইশানের বাবা আবার কখনও ‘উড়ান’-এ লাস্ট সিনে নিজের ছেলের পেছনে দৌড়তে থাকা রণিত রায়। আর সন্তানের নাম, ভারতীয় ক্রিকেট!

তবে দোষ কি শুধু বাবার? একেবারেই না। ছেলে-মেয়ে নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে ইঞ্জিনিয়ারিং করবে কি না, তা হয়তো ভাবে বাবা, কিন্তু তার এই মাস্টারপ্ল্যানে শিলমোহর লাগায় বাবার বিশ্বস্ত কোনও ছোটবেলার বন্ধু অর্থাৎ, ‘কাকা’। সেই কাকা কখনও অমিত তো কখনও অজিত। বাবা গম্ভীর যখনই ভারতীয় ক্রিকেটের সত্যান্বেষণ করছেন তখন তাঁর যুক্তিতে আমল দিয়েছেন আমাদের কাকা অজিত। সত্যি বলতে, আজকের এই ক্ষণস্থায়ী যুগে, এত ভালো পার্টনারশিপ দেখেও ভালো লাগে। যেন বাংলা সিরিয়ালের শাশুড়ি-ননদের যুগলবন্দি। কার সাধ্য ছোটবউকে শান্তিতে থাকতে দেয়!
অজিত কাকাকে আমার ছোটবেলায় বোলিং করতে দেখেছি, কিন্তু তিনি যে অবসর নেওয়ার পরেও নির্বাচক হিসেবে এমন চমকপ্রদ বোলিং ফিগার অর্জন করবেন ঘরের মাটিতে, ভাবতে পারিনি। ৫-২! নেহাত মাঝে ওয়েস্ট ইন্ডিজ চলে এল, ভাগ্যিস, তাই দুটো ম্যাচ আমরা জিতে ফেললাম।

কিন্তু দোষ কি শুধু বাবা-কাকার? হারগিস না! দোষ দক্ষিণ আফ্রিকা নামক এই আউট অফ সিলেবাস ‘চোকার্স’ দেরও। যারা নাকি ক্রিকেট খেলার নামে শুধুমাত্র ক্রিকেট খেলাতেই মগ্ন। দুঃসাহসটা ভাবুন, কারও-র মন ব্র্যান্ড ক্যাম্পেনিং-এ নেই। টেস্ট, ওয়ান ডে-র ক্যাপ্টেন নাকি আইপিএল খেলেন না। মাঠে তাকে ‘বামন’ বলা হলে তার উত্তর সে ব্যাটে দিচ্ছে। এ কী অলুক্ষুনে কথা! তোরা জন্মের চোকার্স। তোদের জেতা হারার মাঝে স্বয়ং বিধাতা এসে দাঁড়িয়েছে বারবার। তাও তোরা হার মানবি না? উঠে দাঁড়াবি। বামন হয়ে চাঁদের জমিতে প্লট কিনবি? বাভুমা আর তাঁর দল, এভাবে অনবরত ক্রিকেটের সাধনা করে গেলে খুব বড়জোর ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়ন হবে আরও দু’-একবার। কিন্তু অক্ষয়কুমার কি তাঁদের বায়োপিকে অভিনয় করবে? কভি নেহি!

তবে দোষের ভাগ বাঁটোয়ারা করতে বসলে তালিকায় নাম তো ভারতীয় ক্রিকেট টিমেরও উঠবে। লোকে বলছে, অশ্বিনের অবসরের পর থেকে ভারতীয় টিম কোনও সাবেকি স্পিনার বানাতে পারল না এবং চেষ্টাও করল না ম্যাচ উইনার স্পিনার তৈরি করতে। এই বক্তব্য আবারও ভুল প্রমাণিত হয়ে গেল দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে। কে বলে ভারত স্পিনার তৈরি করে না? দিব্যি তো করল। এক বছর আগে ইজাজ প্যাটেল আর এই মাসে সাইমন হার্মার। কী নাজেহালটাই না করল! ‘ভারতের মাটিতে ভারত স্পিন খেলতে পারবে না’ এই উক্তি যদি কেউ ক’-বছর আগে বলত, লোকে তাকে ততটাই সিরিয়াসলি নিত, যতটা মন্টি পানেসারকে অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট নেয়। কিন্তু আজ এই উক্তি, কোনও অজানা দুর্বাসা মুনির দেওয়া অভিশাপের মতোই সত্যি। তাই দক্ষিণ আফ্রিকার কোচ দম্ভের সঙ্গে বলতে পারেন, ‘উই ওয়ান্টেড ইন্ডিয়া টু গ্রোভেল!’ তার বিশ্লেষণে অনিল কুম্বলে যখন বলেন, ‘হোয়েন ইউ আর অন টপ, চয়েস অফ ওয়ার্ডস আর ভেরি ইম্পর্ট্যান্ট!’, শুনে মনে হয় যেন এ-কথা দক্ষিণ আফ্রিকার কোচ কে নয়, আমাদের ভারতীয় দলকেই বলছেন। যে ভারতীয় দল, মাঠে থাকতে পারে না। যে ভারতীয় দল এক অজানা বাজবল খেলায় মত্ত। যে ভারতীয় দল, পারলে ১১ জন পন্থকে নিয়ে নামে। যে দলে কোনও পুজারা নেই। কোনও রাহানের স্থান হয় না। সরফরাজ সুযোগ পায় না। আর ক্রমাগত ঘরোয়া ক্রিকেটে লড়ে যাওয়ার পরেও ক্রিকেটীয় কৃপাচার্যরা অভিমন্যুকে চক্রব্যূহ থেকে বের করার কৃপাটি করেন না।

সেই দলের এত অতিরিক্ত বীরদর্পের কথা সাজে না। তাতে নিজেদেরই ‘ছোট’ হতে হয়। এই ভারতীয় দল তাই কখনও খানিক রাজস্থান রয়্যালস, তো কখনও খানিক গুজরাত টাইটান্স। কখনও একটু দিল্লি ক্যাপিটালস, তো কখনও বড্ড কেকেআর। তাই ভারত জিতুক কিংবা হারুক, জিতে যায় আইপিএল!
জিতে যায় আরও একজন। সে মানুষ নয়। সে মানুষ, অমানুষ, ঈশ্বর, পৃথিবী, ভালোবাসা– এসবের ঊর্ধ্বে। তার নাম? ইন্সটাগ্রাম! যে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে হারের দায় নেয় না, কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে জয়কে দশগুণ বাড়িয়ে দেয়। যে হোম সিরিজে হোয়াইটওয়াশের পরিবর্তে মুখে ছুঁড়ে দেয় বিরাট কোহলির কভার ড্রাইভের রিল। যে টেস্ট ক্রিকেটে হেরে যাওয়াকে ভুলিয়ে রাখে টি-টোয়েন্টি ওয়ার্ল্ড কাপের দামামা বাজিয়ে। ভারতীয় ক্রিকেটের বিষণ্ণ আকাশকে যে ঢেকে রাখে অতীতের রঙিন চাদর দিয়ে। সেই কারণেই রাহুল দ্রাবিড় হয়তো এই প্রজন্মে জন্মালে সুযোগ পেতেন না। কারণ, তাঁর খেলা তো ‘ইন্সটা-ওয়ার্দি’ নয়! তাঁর শটে বা সেলিব্রেশনে রিল বানানো যায় না। কিন্তু ইন্সটাগ্রামকে তাই বলে দোষ দেওয়া যায় না। সে হেরে যাওয়া বাচ্চাদের লজেন্স, সেই লজেন্স আছে বলেই তো জীবনকে অল্প হলেও সুন্দর লাগে।

কিন্তু ওয়াশিংটন? তাঁর কি আদৌ এই নিয়মিত ছিনিমিনি খেলা সুন্দর লাগে? শেষ যখন বোলিং অলরাউন্ডারকে জোর করে ব্যাটসম্যান বানানোর চেষ্টা করেছিল ভারত, আমরা এক সুইং বোলারের অকালমৃত্যু দেখেছিলাম। সেকালের পাঠান, একালের সুন্দর। একা সুন্দরও তো শুধু না। সাই সুদর্শন! কেজরিওয়ালের ‘অড ইভেন’ রুলের মতো টেস্ট টিমে আসেন এবং চলে যান। তার এই আসা যাওয়ার মাঝে আমাদের অধিনায়ক চোট পান। ঋষভ পন্থকে অধিনায়ক হতে হয়।
হ্যাঁ, হতে হয়। কারণ, তিনি তো আদৌ ক্যাপ্টেন হতে চাননি। তিনি শেহবাগের মানসপুত্র। তিনি শুধু চেয়েছেন, ছয় মারতে! মারার প্রয়োজন হোক না হোক, তিনি কেবলই চেয়েছেন বলকে মহাশূন্যে পাঠাতে। কিন্তু সমস্যা হল, তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ব্যাটিং ম্যাচ জেতাতে পারে, বাঁচাতে পারে না। যদিও ‘ম্যাচ বাঁচানো’ ব্যাটিং তো ‘ডোডো পাখি’র মতো লুপ্তপ্রায়। আর কেউ ম্যাচ বাঁচাতে ইচ্ছুক না। সবাই জিতবে নইলে হারবে। ড্র করলে তুমি মধ্যবিত্ত! কে যে সবাইকে বুঝিয়ে দিল, টেস্ট ক্রিকেটকে ‘এন্টারটেনিং’ করতে গেলে ড্র করা যাবে না, তাকে গড়-প্রণাম। তিনি পেরেছেন ক্রিকেটকে যুদ্ধে পরিণত করে শিল্পকে মেরে ফেলতে।

তবে, শেষমেশ গভীর চিন্তাভাবনার পর যা বুঝলাম, দোষ আসলে গম্ভীরবাবুরও না, অজিতকাকারও না, দক্ষিণ আফ্রিকারও না, আর ভারতীয় ক্রিকেটের তো না-ই। দোষ আসলে আমারই! মানে, আমাদেরই! যারা আশা রাখি। ভরসা রাখি যে, সুসময়ে ভালোবাসা হবে। সুদিন আসবে। ভারত স্পিন খেলবে। চতুর্থ ইনিংসে ১০ উইকেট নেবে। বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ জিতবে। আর যদি হেরেও যায়, কোচ এসে পিচের দোহাই দেবে না! টস হেরে যাওয়ার কথা তুলবে না। স্বীকার করবে হারকে। স্বীকৃতি দেবে ব্যর্থতাকে। কমল মিত্র নিজের ভুল বুঝবেন। তারপর?
ভুল শুধরে নিয়ে ভারত নামবে আবারও ২২ গজে। কিন্তু সেই আশা শীতের কুয়াশায় হারিয়ে যায়। আবার এ পোড়া দেশে অনিচ্ছাকৃত ইঞ্জিনিয়ারের সংখ্যা বেড়ে চলে। বন্ধুরা দেশ ছেড়ে সেটল করে টেক্সাসে। বাড়ি ভেঙে শপিং মল ওঠে শহরের আকাশ চিড়ে। যাদের থেকে যাওয়ার কথা ছিল, তাদের নম্বর ডিলিট করতে হয়। আর আমি ঘুম ভেঙে দেখি, ভারত দু’ উইকেট ডাউন! কিন্তু আমার প্রিয়তম প্লেয়ার ক্রিজে নেই। শুধু ব্যাট হাতে চেষ্টা করছেন, ওয়াশিংটন সুন্দর!
………………………
রোববার.ইন-এ আরও পড়ুন: যাঁরা টেম্বা বাভুমা নন, তাঁদের ক্ষত সারবে কোন ওষুধে?
………………………
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved