গত দশবছরে দেশ বদলে যাচ্ছে আমূল। বিদ্বেষের যে সব অনুপুঙ্খ কুঠুরি আমরা যৌথতা দিয়ে জ্যাম করে রাখতে পেরেছিলাম, তা খুলে দিয়েছে রাজনীতি। আমাদের পাশাপাশি বসে থাকার মাঝে সূক্ষ্ম পাঁচিল উঠে গেল কবেই, বিদ্বেষ ঠোঁটে করে নিয়ে এল ঘৃণা। হিংসা। পঞ্চাশ ওভার ধরে ক্রিকেট দেখার মন বদলে গেল; পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেটের বিশ্বকাপ আর হবে কি না জানা নেই, এসবে স্বাভাবিক হয়ে যাওয়া আমরা শেষবেলায় একটা বিশ্বকাপ পেয়ে গেলাম আচমকা, পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার মতো।
উদ্দেশ্যবিহীন জীবনগুলো হারিয়ে গেল কেমন। জীবন মানে, তার একটা উদ্দেশ্য থাকতেই হবে আজকাল। যেন, হেমন্তের বিকেলে হেঁটে হেঁটে একটা দেবদারু গাছ অবধি যাওয়া, এক কাপ চা খেয়ে ফের ঘরে ফিরে আসার মতো ঔদাসীন্যের পিঠে কেউ চাপিয়ে দিয়েছে তিন ভুবনের ভার। হাতে মোবাইল। কানে এয়ারপড। কিংবা, নিছক টেলিফোন করতে করতেই দৌড়নো মাপজোক করে রাখা গন্তব্যে। এ বোঝার ভারে, কোমর তো ভাঙলই, ভেঙে গেল আমাদের পাড়াও। পাড়া মানে দশ ও দেশ। মনও বটে। বেঁটে-মোটা-কালো-ঢ্যাঙা-রোগা বন্ধুদের বিচ্ছিরি সব নাম, আর তাদের সেইসব ডাকনামের সঙ্গে, আলুথালু পোশাকের সঙ্গে, মুখখারাপ করা গালিগালাজের সঙ্গে একছাদের নীচে একসঙ্গে বসে অনেকটা সময় ধরে দেখা শচীনের ব্যাটিং– ক্লাবঘরের ম্যাচবোর্ডের পাশে রাখা ২০ বছর আগের সৌরভের ‘টিম ইন্ডিয়া’-র জার্সির ওপর দু’-দশকের ধুলো।
সে সময়ে নতুন শতক শুরু হচ্ছে, গ্লোবালাইজেশনের ভারে নয়ের দশক যেন কুঁজো হয়ে ঢুকে পড়তে চাইছে একুশ শতকে। ঢুকছেও। ভারতের ক্রিকেট দলটাকে নিয়ে বিজ্ঞাপনে ছেয়ে যাচ্ছে বাজার। ঠান্ডা পানীয়ের কোম্পানি বাজার ধরতে ক্রিকেট দলটাকে প্রোজেক্ট করল ‘টিম ইন্ডিয়া’ বলে। আমরা দেখলাম, মাঠে নামার আগে, আরও ঘন হয়ে আসে এগারোটা শরীর, শক্ত চোয়ালে সৌরভ কিছু বলেন, তারপর সবাই মিলে হাতে হাত রেখে নেমে পড়ে সবুজে। সেই থেকে আমাদের ‘টিম ইন্ডিয়া’ ওয়ান্ডারার্সে খেলে। জোহানেসবার্গে খেলে। আডিলেডে খেলে। কোটলা-ইডেনে খেলে। আবার চক্রবর্তী পাড়া, ভচ্চাজ পাড়া, মন্টুর দোকান, নিমতলার মাঠেও খেলে। আমরা যৌথ প্রার্থনার যুগে ডিগবাজি খাই সে সময়ে। সবাই মিলে সন্ধের মুড়ির মতো ভাগ করে নিই আশাবাদ। খেলা যে কেবল মাঠে হয় না, ক্রিকেটের অন্তঃকঙ্কাল আমাদের ভেতরেও ঢুকে পড়ে, তা বুঝেছিলাম ওই সময়ে।
যৌথতাবোধ এক অদ্ভুত ক্রিকেট ম্যাচ। মাঠ লাগে না। স্কোরবোর্ড লাগে না। জয়-পরাজয়ের বাইনারি লাগে না– যেমন বারোয়ারি পুজোয় হুল্লোড়ের মাঝে কেউ কেউ বলত, ‘ওই দিক থেকে, দুটো পাড়া মিলে হাজার দুয়েক চাঁদা তুলে আনবি, খেলা শেষ…’– ওই যে, খেলাটা এসে গিয়েছিল। আর এসেছিল পার্টনারশিপ। ডিজিটাল যুগের আগে, আমাদের পাকাপাকি হোয়াটসঅ্যাপ যুগের আগে ছিল হাঁকা-হাঁকির যুগ। ননস্ট্রাইকিং এন্ড থেকে হেঁকে হেঁকে আমরা জুটিয়ে ফেলতাম বন্ধু। পাড়ার ঠাকুর আনতে একা যায়নি কেউ। যেমন যায়নি কারও ঠাকুমা-দাদুর মাঝরাতে আচমকা অসুস্থতায়। আমাদের মধ্যে অলিখিত ক্যাপ্টেন নির্ধারিত হয়ে যেত ম্যাচ চলাকালীন। এসব পূর্বজন্মের স্মৃতিতে আসলে ওই উদ্দেশ্যহীন হাঁটাচলারা আছে, যার আশপাশে জোনাকির মতো এসে বসত টিমমেটরা।
গত দশবছরে দেশ বদলে যাচ্ছে আমূল। বিদ্বেষের যে সব অনুপুঙ্খ কুঠুরি আমরা যৌথতা দিয়ে জ্যাম করে রাখতে পেরেছিলাম, তা খুলে দিয়েছে রাজনীতি। আমাদের পাশাপাশি বসে থাকার মাঝে সূক্ষ্ম পাঁচিল উঠে গেল কবেই, বিদ্বেষ ঠোঁটে করে নিয়ে এল ঘৃণা। হিংসা। পঞ্চাশ ওভার ধরে ক্রিকেট দেখার মন বদলে গেল; পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেটের বিশ্বকাপ আর হবে কি না জানা নেই, এসবে স্বাভাবিক হয়ে যাওয়া আমরা শেষবেলায় একটা বিশ্বকাপ পেয়ে গেলাম আচমকা, পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার মতো। গোড়ায় মাঠ ফাঁকা। বন্ধুরা আসে না যেন, বিকেল পেরিয়ে যায় দ্রুত। ভারত শুরু থেকেই এক অদ্ভুত ফর্মে। আমাদের পাড়ার অজস্র ক্রিকেট ম্যাচ, মাঠে কিংবা মাঠের বাইরে, এমন ফর্মে খেলে উতরে দিলেও নীল জার্সির এগারোজন ভারতীয়কে বিশ্বকাপে এমন দাপট দেখাতে আমরা দেখিনি কোনও দিন। পথচলতি জনতা যেমন আচমকা টিভির সামনে দাঁড়ায় স্কোর দেখতে, এই আকালে, এই প্রবল ভাগাভাগি-বৈষম্যের সন্ধেতে আমরাও তেমনি এসে দাঁড়ালাম কোন এক পরিত্যক্ত ক্লাবঘরে। হাতে হাত চেপে প্রার্থনা, আর দেখতে দেখতে ভারত ফাইনালে। প্রার্থনার অভিমুখ ব্যক্তি থেকে সমষ্টিতে বদলে গেল হঠাৎ, ‘এ কি সত্য, সকলি সত্য?’
অনেক দিন আগে, আমার এক বন্ধু জাতীয় ফুটবল দলের প্রাক্তন অধিনায়ক শান্তি মল্লিকের কাছে যান এক বিশেষ দরকারে। শান্তিদেবী তাঁকে কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন– খেলা কিন্তু খেলোয়াড় একা খেলে না, খেলে দর্শকেরাও, খেলা দেখাও আসলে ম্যাচের অংশ, এই যৌথতাবোধ আমাদের শিকড়। এই নভেম্বরের পাতাঝরার মরশুমে, একটা বিশ্বকাপ এসে যেন আমাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে পূর্বজন্মে। যৌথ প্রার্থনা– ‘ভারত জিতে যাক…’, আমরা জানি, এই জয়ে আমাদের নিত্যযাপনের শিকিভাগ বদলও আসবে না। তবু চাইছি জয়। একা নয়। সকলে মিলে। গত দশ বছরে আমরা তো একসঙ্গে কিছু চাওয়ার আগে ভেবেছি কেবল ব্যক্তিগত মুনাফার হিসেব। এবার চাইছি না।
আলগা হিম, ছাতিমের গন্ধ আর শীত পড়ে আসার মাঝে একটা বিশ্বকাপ যেন টাইম মেশিনে বসিয়ে দিল সবাইকে। যেখানে পৌঁছলাম, সেখানেই থেকে যেতে ইচ্ছে করে খুব…
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved