Robbar

ডেলিভারি বয়, ইলেকট্রিক অ্যাপরেন্টিস থেকে ক্রিকেট বিশ্বকাপের মঞ্চ: ডাচ রূপকথায় নতুন পালক

Published by: Robbar Digital
  • Posted:October 31, 2023 2:49 pm
  • Updated:October 31, 2023 2:49 pm  

নেদারল্যান্ডস অঘটন ঘটিয়েছে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠা দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে। বিশ্ব-ক্রিকেটের মানচিত্রে এই যে আচমকা ‘কমলা-ঝড়’-এর উদ্ভাস, সেটা মোটেই কাকতালীয় নয়। ২২ গজে ডাচ-রূপকথার রূপকারদের জীবন-খাতার প্রতি পাতায় আলো ফেললে সহজেই উপলব্ধি করা যায়, তাঁদের সাফল্যের নেপথ্যে কত রক্ত জল করা পরিশ্রম লুকিয়ে আছে।

সুমন্ত চট্টোপাধ্যায়

হ্যান্সের কথা মনে আছে? ওই যে ফেলে আসা ইশকুল জীবনের সাদা-কালো পাঠ্যপুস্তকে জায়গা করে নেওয়া এক ছোট্ট ডাচ বালক। কোন এক হেমন্ত গোধূলিতে বাঁধের গায়ে ছিদ্র দেখে থমকে দাঁড়িয়েছিল আলের ওপর। বাঁধ ভাঙলে জলের তোড়ে ভেসে যাবে গোটা গ্রামখানা। শিয়রে শমন বুঝেই মুহূর্তে ঠিক করে নিয়েছিল আশু কর্তব্য। বাঁধের ফাটলের ভিতর হাত ঢুকিয়ে আটকে রেখেছিল জলস্রোত। সারা রাত। অক্লান্ত, অদম্য অভিপ্রায়ে।

Netherlands National Cricket Team - Top | Best University in Jaipur |  Rajasthan | Poornima University
সাউথ আফ্রিকাকে হারিয়ে অঘটন ঘটিয়েছে নেদারল্যান্ডস

হিম-রাতের শৈত্যকে অগ্রাহ্য করে দুর্লঙ্ঘ্য প্রতিকূলতাকে জয় করার যে দৃষ্টান্ত ছোট্ট হ্যান্স রেখেছিল কালচক্রের পাকদণ্ডিতে ভর করে, আজ তা কিংবদন্তি।‌‌ ডাচ রূপকথায় চিরশাশ্বত হ্যান্সের সেই অনিমেষ ইচ্ছাশক্তি। আচ্ছা, ‌বিশ্বকাপের আসরে ইডেন উদ্যানে ‘সোনার বাংলা’র স্বপ্ন চুরমার করে ওই যে অঘটনের ইতিহাস লিখলেন ১১ জন ওলন্দাজ ক্রিকেট-যোদ্ধা, ওঁরা কি রসদ সঞ্চয় করেছিলেন হ্যান্সের হার না মানা লড়াই থেকে? হতেই হবে।

আরও পড়ুন: মারাদোনার অপরাধ তিনি শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা ছিনিয়ে নিয়েছেন

বিশ্বকাপে তো শুধু বাংলাদেশ নয়, আরও বড় অঘটনের জন্ম দিয়েছে নেদারল্যান্ডস। অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠা দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে। বিশ্ব-ক্রিকেটের মানচিত্রে এই যে আচমকা ‘কমলা-ঝড়’-এর উদ্ভাস, সেটা মোটেই কাকতালীয় নয়। ২২ গজে ডাচ-রূপকথার রূপকারদের জীবন-খাতার প্রতি পাতায় আলো ফেললে সহজেই উপলব্ধি করা যায়, তাঁদের সাফল্যের নেপথ্যে কত রক্ত জল করা পরিশ্রম লুকিয়ে আছে।

স্কট এডোয়ার্ডসের কথাই ধরা যাক। বিশ্বকাপে এখনও পর্যন্ত ‘আফ্রিকার সিংহ’ আর ‘বাংলার বাঘ’ শিকার করে তাক লাগিয়ে দিয়েছে ওলন্দাজ বাহিনী। আর সেই সাফল্যে অপরিমেয় অবদান ডাচ অধিনায়ক স্কটের। প্রোটিয়াদের বিরুদ্ধে অপরাজিত ৭৮ আর বাংলাদেশের বিপক্ষে অমূল্যবান ৬৮, দুটোই চাপের মুখে দাঁড়িয়ে খেলতে হয়েছে নেদারল্যান্ডসের নেতাকে। তবে দলের জয়ের ভিত রচনার মতো জীবনযুদ্ধেও তো কম সংগ্রাম করতে হয়নি ওলন্দাজ ক্রিকেট-অধিপতিকে।

আরও পড়ুন: মণ্ডপের হুজুগে ভিড় বাঙালির পরিযায়ী শিল্পমনস্কতার পরিচয়

অস্ট্রেলিয়ায় জন্ম, বড় হয়ে ওঠা হলেও স্কটের কর্মজীবনের শুরু নেদারল্যান্ডসে। সেটাও ক্রিকেটার হিসাবে নয়, রুজি-রোজগারের টানে বেছে নিয়েছিলেন ইলেকট্রিক্যাল অ্যাপরেন্টিস কাজ। সেটাই চলছিল বেশ। ক্লাব কোচ রায়ান ক্যাম্পবেল নেদারল্যান্ডসের দায়িত্ব নেওয়ার পর স্কটকে ক্রিকেটের মূলস্রোতে ফেরাতে উদ্যোগী হন। ২২ গজের সেই অমোঘ আকর্ষণ অগ্রাহ্য করতে পারেননি স্কট‌ও। ভাগ্যিস! নয়তো ধরমশালা কিংবা নন্দনকাননে তৈরি হত নাকি চোয়ালচাপা লড়াইয়ের ওমন অত্যাশ্চর্য উপাখ্যান!

জীবনযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত লড়াই কম নেই র‌ওলফ ভ্যান ডার মার‌উইয়ের জীবনেও। স্কটের বর্তমান সতীর্থ একদা ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকা দলের নিয়মিত সদস্য। কাপ মাসলে চোট তাঁকে ছুড়ে ফেলেছিল ২০১১ বিশ্বকাপ দলের বাইরে। তারপর শুধু পশ্চাদসরণ। ব্যর্থতা আর বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাওয়া মার‌উই দক্ষিণ আফ্রিকা ছেড়েছিলেন উপেক্ষা আর অভিমান সঙ্গী করে। প্রত্যাবর্তনের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করে অবশ্য ফিরেছেন জোহানেসবার্গ-জাত এই বাঁ-হাতি স্পিনার। তবে দক্ষিণ আফ্রিকা নয়, ফিরেছেন নেদারল্যান্ডস জার্সিতে। বিশ্বকাপে তাঁর সেই ‌সফল কামব্যাক হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে প্রোটিয়া বাহিনী। সতীর্থদের কাছে ‘বুলডগ’ নামে খ্যাত মার‌উই বুঝিয়ে দিয়েছেন জেতার খিদে আর অদম্য ইচ্ছাশক্তি থাকলে অসাধ্যসাধন করা অলীক কল্পনা নয়।

আর পল ভ্যান মিকেরন? ইডেনে সাকিবদের স্বপ্নভঙ্গের অন্যতম কারিগর ডাচ পেসারের জীবনটাই যে আস্ত রূপকথা! করোনা অতিমারীর জেরে ২০২০-র টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ পিছিয়ে গিয়েছিল একবছর। বাধ্য হয়েই পেট চালাতে সেসময় ‘উবের ইটস’-এ ডেলিভারি বয়ের কাজ করতে হয়েছে মিকেরনকে। জীবনের সেই চড়াইউতরাই ভেঙে ২২ গজে সাফল্যের দ্যুতি ছড়াচ্ছেন মিকেরন। বিপক্ষের উইকেট তাক করে যখন তাঁর হাত থেকে ছিটকে বেরোয় বিষাক্ত ডেলিভারিগুলো, অজান্তে কি মনে পড়ে বছর কয়েক আগের সেই মিকেরনকে? ক্ষুন্নিবৃত্তির দায়ে যে ছেলেটা বাড়ি বাড়ি খাবার ‘ডেলিভারি’ করত!

আরও পড়ুন: শুভ বিজয়ার নোনতামুখ

মিকেরনের মতো ক্ষুধার এই পৃথিবীতে ঝলসানো রুটির স্বাদ হয়তো নিতে হয়নি লোগান ভ্যান বিককে। না নিলেও সংগ্রাম কম ছিল না তাঁর জীবনেও। ক্রাইস্টচার্চে জন্ম লোগানের ক্রিকেট-হাতেখড়ি নিউজিল্যান্ডে। ব্ল্যাক ক্যাপসের অনূর্ধ্ব-১৯ দলে খেলেছেন। খেলেছেন নিউজিল্যান্ডের বাস্কেটবল টিমেও। তাঁর বাল্যবন্ধু টম ল্যাথাম এখন নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসনের ডেপুটি। ম্যাট হেনরি, মিচেল ব্রেস‌ওয়েলের সঙ্গে বন্ধুত্ব সেই ছোটবেলা থেকে। কিন্তু বন্ধুদের মতো নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি কিউয়ি ক্রিকেটে। বাধ্য হয়ে চাকরি নেন নিউজিল্যান্ডের একটি কনসালটেন্সি সংস্থায়। কিন্তু মাথায় যে ক্রিকেট-ভূত নাচছে! তা থেকে নিস্তার পাবেন কী করে!

As Netherlands Stun South Africa, Dutch Star Paul Van Meekeren's Old 'Uber  Eats' Tweet Is Viral | Cricket News
পল ভ্যান মিকেরন

ডাচ নাগরিকত্ব থাকায় ২০১৪-তে আচমকাই নেদারল্যান্ডসের জাতীয় দলের হয়ে খেলার সুযোগ চলে আসে লোগানের কাছে। সেই সুবর্ণ সুযোগ তালুবন্দি করতে ভুল করেননি তিনি। কিন্তু ক্রিকেট খেলে তো পেট চলে না নেদারল্যান্ডসে! অগত্যা ফের চাকরির খোঁজ শুরু। কাজ মিলল। পার্টটাইম জব, রিয়াল এস্টেট এগজিকিউটিভ পদে। তাই স‌ই। একদিকে ক্রিকেট, অন্যদিকে জীবিকা। দুয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে স্বপ্নের ভিত গড়েছেন লোগান। বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জন পর্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে লোগানের ওইরকম অবিশ্বাস্য পারফরম্যান্স না থাকলে আজ তৈরি হত নাকি বিশ্বকাপে ডাচ-রূপকথা? কখনও নয়।

আসলে স্কট, লোগানদের নিয়ত জীবনযুদ্ধটাই ডাচ-রূপকথার প্রাণভ্রোমরা। গল্পের হ্যান্সের সঙ্গে তাই বাস্তবের মিকেরনদের আলাদা করা যায় না।