ঈশান কিষাণ ‘আর পি ১৭’ লেখা ব্যাট হাতে নেমেছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের শেষ টেস্টে। ক্রিকেটের দানবীয় প্রতিযোগিতায় তা কি নিছকই একটি বন্ধুত্বের মলিন বিজ্ঞাপন? লিখছেন অর্পণ গুপ্ত।
সময়ের কিছু নিজস্ব দাবি থাকে। আর সেই দাবি, ছাইচাপা পরিস্থিতির ভেতর থেকেও কোনও অনুপুঙ্খ কুঠুরি দিয়ে বেরিয়ে আসে বারবার। আত্মকেন্দ্রীকতার এই যে ভয়াবহ উদযাপনের এক যুগ এল, যেখানে ব্যক্তির কাছে একমাত্র মূলধন হল তার ব্যক্তিগত অর্জন, যকের ধনের মতো সে আগলাতে শুরু করল নিজস্ব চাওয়া-পাওয়াকে– এমন গুমট বিকেলেই সময় দাবি করে এক সমষ্টির বোধ, বকলমে বন্ধুতা– যে রোয়াকে এসে প্রতিযোগিতায় ক্লান্ত জীবন জিরিয়ে নিতে পারে দু’-দণ্ড।
এমন ধান ভানতে শিবের গাজন কেন? কারণ ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের শেষ টেস্টে ব্যাট করার সময় তরুণ উইকেটকিপার ঈশান কিষাণ যে ব্যাট নিয়ে নেমেছেন, তাতে ইংরেজি অক্ষরে লেখা– ‘আর পি সেভেন্টিন’। বিখ্যাত স্পোর্টস ইক্যুইপমেন্টস অ্যান্ড অ্যাকসেসারিজ প্রস্তুতকারক সংস্থা ‘এস জি’ ঋষভ পন্থের নামাঙ্কিত ‘আর পি সেভেন্টিন’ মডেলের ব্যাট নিয়ে এসেছে কিছুদিন আগেই। ভারতীয় ক্রিকেটে এ জিনিস নতুন না। প্লেয়ারের নামাঙ্কিত ব্যাট ভার্সান আগেও নিয়ে এসেছে বহু বিখ্যাত কোম্পানি। কিন্তু মজার বিষয় হল, ঋষভের নামের ব্যাট হাতে যিনি নেমেছেন, টেস্ট ক্রিকেটে, জাতীয় দলে ঋষভ পন্থের সাবস্টিটিউট খেলোয়াড় হিসেবেই ভাবা হচ্ছে তাকে। অর্থাৎ, একথা কিছুটা জোর দিয়েই বলা যায়, চোট সারিয়ে যখন ঋষভ স্বমহিমায় ফিরে আসবেন জাতীয় দলে, তখন ঈশান কিষাণের ঠাঁই হবে রিজার্ভ বেঞ্চে। একথা বিলক্ষণ জানেন ঈশান, জাতীয় দলে চান্স পাওয়ার উত্তুঙ্গ প্রতিযোগিতা তাঁর চেনা হয়ে গিয়েছে বিগত কয়েক বছরে। তবু ঋষভকে মনে করানোর কারণ?
ঈশান কিষাণ বলছেন, এই সিরিজের আগে তিনি ছিলেন ন্যাশনাল ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে, সেখানে ছিলেন ঋষভ পন্থও। ভারতের হয়ে টেস্ট অভিষেকের আগে তাঁকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ টিপস দেন ঋষভ, তাঁর খেলার ধরনের কথা মাথায় রেখে ঋষভের দাওয়াই ছিল ব্যাট পজিশনিং ঠিক করা– আর তাতেই নিজের খেলাকে আরও সাবলীল করতে পেরেছেন ঈশান। তাছাড়া অনুর্ধ্ব-১৯ জাতীয় দল থেকেই ঋষভ ও ঈশান একে-অপরের বন্ধু, এই ব্যাট একাধারে সেই বন্ধুতাকে সামনে নিয়ে আসাও বটে।
স্মৃতির নকশিকাঁথার ভেতর মুখ গুঁজলে মনে পড়ে আমাদের ধুলো ওড়া বিকেল, যেখানে পিঠে লটারি করে ব্যাটিং অর্ডার ঠিক করার সময়ে আমাদের অলিখিত নিয়ম ছিল আঙুল লুকিয়ে নিজেকে আগে ব্যাট এনে দেওয়া, জীবন বোধ করি সন্ধে নামার আগে আমাদের ব্যাট হাতে কারসাজি দেখানোর লোভকে উসকে দিত ওই ডানপিটে কৈশোরে, কিন্তু এই বাগবিতণ্ডা, হাতাহাতির পরও সাবলীলভাবে এসে পড়ত এক সহবৎ। যেসব বন্ধু সাইকেল নিয়ে আসতে পারেনি আজ, তাদের গলির মুখ অবধি পৌঁছে দিত আমাদের টলমলে সাইকেল, গোড়ালি কেটে যাওয়া বন্ধুর উপশমের জন্য কী ভীষণ দ্রুততায় জোগাড় করে আনতাম টিংচার আয়োডিন। যত দিন গেল, ওই লটারির কারচুপি বয়ে বয়ে চলে এল একটা দশক, অথচ ফিকে হল মাঠের পাশে হেলান দিয়ে রাখা সাইকেল কিংবা লাল ওষুধে ভেজা তুলোর গল্পরা।
এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনার দিকে নজর রাখা যাক। ব্রিটিশ ও ক্যারিবিয়ানদের জাতিগত বিরোধ ও বর্ণবিদ্বেষের ইতিহাস সর্বজনবিদিত। ক্যারিবিয়ান প্লেয়ারদের ইংল্যান্ডে কাউন্টি খেলতে এসে বর্ণবিদ্বেষের শিকার হওয়া নতুন নয়। ভিভ রিচার্ডস তখন সমারসেটের হয়ে কাউন্টি খেলছেন। ১৯৭৮ সালে পিটার রোবাক দলের হর্তাকর্তা হয়ে দল থেকে ছেঁটে দিলেন ভিভকে, তাঁর বদলে দলে নিলেন নিউজিল্যান্ডের মার্টিন ক্রো-কে। এই ঘটনার সর্বপ্রথম প্রতিবাদ যিনি করেছিলেন, তিনি ইংল্যান্ডের ক্রিকেট ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ অলরাউন্ডার ইয়ান বথাম। প্রিয় বন্ধু ভিভকে অপসারণের প্রতিবাদ করে টপ ফর্মে থাকা বথাম সমারসেটের সঙ্গে ১২ বছরের সম্পর্ক ছিন্ন করে যোগ দেন প্রতিপক্ষ ওয়ারসেস্টারশায়ারে। অথচ, ভিভের অনুপস্থিতিতে বথামের কাছে সমারসেটের ‘একমেবদ্বিতীয়ম’ হয়ে ওঠার সমস্ত চিত্রনাট্য কিন্তু সেদিন তৈরি ছিল– আর ভিভ এরপর প্রিয় বন্ধু বথামের বিপক্ষে পোর্ট অফ স্পেন বা বার্বাডোজে যতবার নেমেছেন, সেঞ্চুরি বা হাফসেঞ্চুরি করে ন্যূনতম সেলিব্রেশনও করেননি।
ইংল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের দীর্ঘকালীন ক্রিকেট দ্বৈরথে ভিভ-বথামের বন্ধুত্ব এসেছিল সময়ের দাবি মেনে, তেমনই জনপ্রিয়তার শিখরে থাকা আইপিএলের সিঁড়ি বেয়ে জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার ইঁদুর দৌড়ের ভেতর ঈশান-পন্থের এই বন্ধুত্বখানা আর ব্যাটের ওপর লেখা ‘আর পি সেভেন্টিন’– ছোট্ট একটা নাম– খরচ করাল সামান্য কিছু নিউজ প্রিন্ট– আর আমরাও একঘেয়ে ময়দান থেকে এ সুযোগে কেমন ডুবসাঁতার দিয়ে কুড়িয়ে আনলাম খেলার উত্তাপ, খেলা শেষের মনকেমন, সন্ধের আরতির শাঁখ আর বন্ধুর ডাকনাম…
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved