১৯২১ সালের এক সকালে যিনি ‘শেক্সপিয়র অ্যান্ড কম্পানি’-তে ঢুকে মালকিন সিলভিয়া বিচের সামনে দাঁড়িয়ে গম্ভীর, অথচ মনোরম উচ্চারণে বললেন– আমার নাম আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, তাঁকে নিয়েই আজকের গল্প। হেমিংওয়ের বয়স বছর তেইশ। এবং ঠিক একশো বছর আগের প্যারিস। আমি দাঁড়িয়ে সেই প্যারিসের সামনেই। সেই দোকান। সেই উপচে পড়া বই।
২.
এই বৃষ্টি। এই রোদ্দুর। এই মুহূর্তের প্যারিস। তারই মধ্যে ২৮ অগাস্টের দুপুরবেলা গিয়ে পৌঁছলাম প্যারিসের এক ছবির মতো ছোট্ট রাস্তায়। এক আকাশ সাহিত্য ও সংস্কৃতির মনকেমন নিয়ে বিছিয়ে এই প্যারিস-সরণি, ‘রু দে লা বুশেরি’। এই রাস্তায় ৩৭ নম্বর বাড়িটি একটি বই-দোকান, যার সঙ্গে তুলনা করা যায় এমন বইয়ের দোকান পৃথিবীতে নেই। এই দোকানে জীবনে কোনও এক সময়ে সারাদিন কাটাব বই কিনে, বই দেখে, বই চেখে– এমন স্বপ্ন দেখেছি আমার বাইশ-তেইশ বছর বয়স থেকে। সেই যখন পড়েছিলাম প্যারিসের ওপর আমার-পড়া সব থেকে মায়াময় রূপকথা, ‘প্যারিস ইজ আ মুভেবল ফিস্ট’, যার লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। সেই স্বপ্নময় বইয়ের দোকানের নাম ‘শেক্সপিয়র অ্যান্ড কম্পানি’। বিশের দশকে সিলভিয়া বিচ নামের এক মার্কিন মহিলা প্যারিসে এসে খুললেন প্যারিসের একমাত্র ইংরেজি বইয়ের দোকান! নাম দিলেন ‘শেক্সপিয়র অ্যান্ড কম্পানি’। এবং সম্ভবত সেই নামের ম্যাজিক-চুম্বক কাকে না টেনে নিয়ে এল এই ক্যাফেতে! এলেন টি. এস. এলিয়ট, জেমস জয়েস, অঁদ্রে জিদ, পল্ ভ্যালেরি, স্কট ফিৎজিরাল্ড, ডি. এইচ. লরেন্স, জর্জ অরওয়েল, বার্ট্রান্ড রাসেল এবং ভিয়েনা থেকে সিগমন্ড ফ্রয়েড! তবে ১৯২১ সালের এক সকালে যিনি এই দোকানে ঢুকেই মালকিন সিলভিয়া বিচের সামনে দাঁড়িয়ে গম্ভীর, অথচ মনোরম উচ্চারণে বললেন– আমার নাম আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, তাঁকে নিয়েই আজকের গল্প। হেমিংওয়ের বয়স বছর তেইশ। এবং ঠিক একশো বছর আগের প্যারিস। আমি দাঁড়িয়ে সেই প্যারিসের সামনেই। সেই দোকান। সেই উপচে পড়া বই। পাশেই সেই ক্যাফে। হেমিংওয়ের প্রিয় লাল সুরা। তাঁর প্রিয় ‘সামন্ স্টেক’। এবং তাঁর প্রিয় বন্ধু সিলভিয়া বিচ– সবাই রয়েছে। আমিও আমার হুইলচেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালাম। পরদা উঠল।
‘আই ফেল্ট দ্য ওয়ারমেস্ট ফ্রেন্ডশিপ ফর আর্নেস্ট হেমিংওয়ে ফ্রম দ্য ডে উই মেট।’ আমার মনে পড়ছে, লিখলেন সিলভিয়া। আরও লিখেছেন তিনি– ‘আমি আর্নেস্ট হেমিংওয়ে’– ওই গম্ভীর ঘোষণা শুনেই মাথা তুলে তাকালাম। দেখি আমার সামনে বেশ লম্বা-চওড়া এক যুবক। রোদে পোড়া গায়ের রং। যার ডিপ-ডিপ ভয়েস আমাকে মুগ্ধ করেছে। কিন্তু কে সে? লেখক? নাম শুনিনি তো! তবু বসতে বললাম। সে বসল। বলল, সে শিকাগোতে বড় হয়েছে। তবে আপাতত আসছে মিলিটারি হাসপাতাল থেকে। যুদ্ধে গিয়েছিল। পায়ে গুলি খেয়ে হাঁটতে পারেনি অনেক দিন। ধীরে ধীরে হারানো পা ফিরে পাচ্ছে। তবে এবার সে হাতের কাজে ব্যস্ত হতে চায়। সে নাকি লেখক হবে! এবং প্যারিসকে বেছে নিয়েছে নিজেকে লেখক তৈরি করার সাংস্কৃতিক শহর হিসেবে। একজন আমেরিকান সৈনিক। সে লেখক হতে চায়। লিখবে ইংরেজি ভাষায়, এবং প্যারিস হবে তাঁর লেখক হয়ে জন্মানোর শহর। আমার দিব্য লাগল এই তরুণের স্বপ্ন! বললাম, প্যারিসে স্বাগত। সে নিয়মিত আসে আমার দোকানে। একদিন বলে বসল, সিলভিয়া, আমি কিন্তু তোমার সেরা খদ্দের। কথাটা সত্যি। আর্নেস্ট খুব বই পড়ে। বেশ কয়েকটা ভাষাও জানে। ফরাসি ভাষায় তার দখল আমাকে অবাক করে। সাহিত্য-সংস্কৃতির সর্ব বিষয়ে খেয়াল রাখে। দারুণ কথা বলে। বড্ড বেশি মদ খায়। তা খাক, আর্নেস্টকে আমার ভাল লেগে গেছে। এবার বলি কেন ভাল লেগেছে।
আরও পড়ুন: প্যারিস যেন চলন্ত চড়ুইভাতি
একদিন আর্নেস্টকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার হাঁটতে বেশ কষ্ট হয়। পায়ে কী হয়েছে? আমার জানতে ইচ্ছে করে।
–দেখতে চাও সিলভিয়া?
–হ্যাঁ, চাই, যদি না তোমার আপত্তি থাকে।
–সো বিজনেস অ্যাট শেক্সপিয়র কম্পানি ওয়াজ সাসপেন্ডেড! আর্নেস্ট জুতো খুলল। মোজা খুলল। প্যান্ট গুটিয়ে তুলল। ওর হাঁটু দেখে শিউরে উঠলাম। হি শোড মি দ্য ড্রেডফুল স্কার্স কভারিং হিজ লেগ অ্যান্ড ফুট। হাঁটুটার আর কিচ্ছু নেই! ঠিক সেই মুহূর্তে আমার মধ্যে, আমার বন্ধুত্বে, ‘হেমিংওয়ে ওয়াজ ব্যাপটাইজড’। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে আমাকে সেইদিন ওর জীবনের শুরুর কথা বলল– যেমন করে কোথাও বলেওনি, লেখেওনি। কোনও রকম বাড়াবাড়ি না করে আর্নেস্ট বলল: ‘সিলভিয়া, আমি তখন স্কুলের ছাত্র, আ বয় ইন শর্ট প্যান্টস! মাই ফাদার সাডেনলি ডায়েড, লিভিং মি আ গান অ্যাজ আ সোল লেগাসি।’ আমি স্কুল ছাড়লাম। মা, ভাই-বোন সবার দায়িত্ব আমাকে নিতে হল। খবরের কাগজ বিক্রি থেকে রাস্তায় বক্সিং লড়ে দু’-চার পয়সা কামানো, সব করেছি। কিন্তু আমি অবাক হলাম, আর্নেস্টের পড়াশোনা দেখে। হি ওয়াজ আ ওয়াইডলি এডুকেটেড ইয়ংম্যান! এবং সেটা শুরু করেছে ফিকশন লিখে ফেমাস হওয়ার জন্য। আমার আর্নেস্টকে রোজ নতুন করে ভাল লাগতে শুরু করল।’ এসব কথা সিলভিয়া বিচ লিখেছেন তাঁর ‘শেক্সপিয়র অ্যান্ড কম্পানি’ নামের বইয়ে।
আর হেমিংওয়ে, তিনি কী লিখলেন তাঁর অসাধারণ স্বল্পভাষিতায়? লিখলেন, সিলভিয়ার ব্রাউন চোখ দু’টি কী সুন্দর! ছোট-ছোট ছাঁটা চুল থেকে যে ঝকমকে ঘাড়টুকু বেরিয়ে আছে– আহা! কিন্তু তা বলে সিলভিয়ার লেখক বন্ধু উইন্ডহ্যাম লুইস আমাকে বলবে বোকা, গাম্বাট ষাঁড়! রাগের মাথায় সেদিন সিলভিয়ার বইয়ের দোকানের চারপাশে তিনডজন টিউলিপ গাছের মাথা কেটে উড়িয়ে দিয়ে বলেছি, সিলভিয়াকে আমার জন্মদিনের উপহার।
আরও পড়ুন: মিলান কুন্দেরার দরজায়
তারপর, সিলভিয়াকে একটি চেকে হেমিংওয়ে লিখে দিলেন গরিব লড়াকু লেখকের সর্বস্ব– এসব কথা জানতেই পারতাম না, যদি না ‘সামন স্টেক’ নিয়ে বসতাম ‘শেক্সপিয়র অ্যান্ড কম্পানি’র পাশেই আর্নেস্ট হেমিংওয়ের প্রিয় ক্যাফে ‘শেক্সপিয়র’-এ!
(চলবে)