ঋতুদাই আমার প্রথম অভিনয়-শিক্ষক। অভিনয় তো এভাবে কাউকে ধরে শেখানো যায় না, কিন্তু একটা দিশা দেখিয়ে সাহায্য করা যায়। ঋতুদা আমার সেই গাইড ছিলেন। কারণ, এর আগে আমি কখনওই অভিনয় করিনি, আমার কোনও ‘ফিল্ম ব্যাকগ্রাউন্ড’-ও ছিল না। ইনফ্যাক্ট আমি এর আগে কখনও শাড়িও পরিনি! ঋতুদা আমাকে শাড়ি পরা, শাড়িটা ক্যারি করা শিখিয়েছিলেন!
ঋতুদার সঙ্গে প্রথম আলাপ ‘গানের ওপারে’-র জন্য বুম্বাদার বাড়িতে অডিশন দিতে গিয়ে। আমি বসেই ছিলাম। অডিশন চলছিল। আমার তখনও ডাক পড়েনি। অডিশনে সবাইকে বিভিন্ন লাইন বলতে হচ্ছিল। তারপর আমাকে যখন ডাকল, আমাকে কোনও লাইন বলতে বলা হয়নি। ঋতুদা একটা শাড়ি আমার গায়ে ফেলে, সাবর্ণীদির (দাস) থেকে একটা বড় টিপ নিয়ে পরিয়ে দিলেন, নিজে হাতে কাজলটা লাগিয়ে দিয়ে– আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, ‘ও-ই আমার পুপে।’ আমার আজও স্পষ্ট মনে আছে, এইভাবেই আমাকে সিলেক্ট করেছিলেন! ঋতুদা প্রায় নিজে হাতে আমাকে তৈরি করেছিলেন, ‘পুপে’-র মতো করে।
তখন ঋতুদার বাড়ির কাছেই আমি থাকতাম। প্রায়ই বিকেলবেলা আমাকে নিজের বাড়িতে ডেকে নিতেন। ঋতুদা সবসময় হাতে স্ক্রিপ্ট লিখতেন, আমার সেটা পড়তে অসুবিধে হত। উনি সামনে বসে গোটা সিনটা পড়তেন, আমার লাইন, অন্যের লাইন, কোথায় পজ হবে, কীভাবে কোন শব্দ বলব– সবটা ডিক্টাফোনে রেকর্ড করে শুনতাম। এইভাবে আমি রেডি হতাম শুটিংয়ের জন্য।
ঋতুদার সংস্পর্শে যখন এসেছি তখন আমি অনেকটাই ছোট। ‘গানের ওপারে’-র আগে ‘আকাশ বাংলা’য় সবে একটা কাজ করেছি। ম্যাচিওরিটি বলতে যা বোঝায়, সেটা তৈরি হয়নি। যদি কেউ জিজ্ঞেস করে প্রথম দিনে, বা অডিশনে ভয় পেয়েছিলাম কি না, আমি না-ই বলব। কারণ কিছুই সেভাবে জানি না। আমার হারানোরও কিছু ছিল না। যেদিন ‘তাসের ঘর’-এর মেন গেট খুলে প্রথম ওই বাড়িতে ঢুকি, মুখোশের দেওয়াল পেরিয়ে লাইব্রেরিতে বসেছিলাম। সাদা মলমলের পর্দা আর রাশি রাশি বই। তার মধ্যে উঁকি মারছে ঋতুদার জাতীয় পুরস্কার! ছোটবেলায় আমি ‘চোখের বালি’ দেখেছি। সেই ছবির পুরস্কার বইয়ের তাকে সাজানো দেখে খুব এক্সাইটেড হয়েছিলাম মনে পড়ে। ঋতুদাই আমার প্রথম অভিনয়-শিক্ষক। অভিনয় তো এভাবে কাউকে ধরে শেখানো যায় না, কিন্তু একটা দিশা দেখিয়ে সাহায্য করা যায়। ঋতুদা আমার সেই গাইড ছিলেন। কারণ, এর আগে আমি কখনওই অভিনয় করিনি, আমার কোনও ‘ফিল্ম ব্যাকগ্রাউন্ড’-ও ছিল না। ইনফ্যাক্ট আমি এর আগে কখনও শাড়িও পরিনি! ঋতুদা আমাকে শাড়ি পরা, শাড়িটা ক্যারি করা শিখিয়েছিলেন!
বিকেলবেলার সেশনে একদিন বললেন, ‘ধর, এটা তোর বাড়ি, এইখান থেকে ওই ড্রেসিং টেবিল পর্যন্ত শাড়ি পরে হেঁটে যাবি কীভাবে?’ আমার হাঁটা দেখে তো ঋতুদার মাথায় হাত! ‘তুই এইভাবে হাঁটবি!’ তারপর বললেন, ‘না! পুপে শাড়ির আঁচলটা একটু টেনে নেবে, যাওয়ার পথে টেবিলে ধুলো থাকলে সেটাকে আলতো করে মুছে নেবে’– এইরকম ছোট ছোট ডিটেলিং উনি খুব সহজ করে বুঝিয়ে দিতেন! আমার প্রথম সিরিয়াস অভিনয়-ওয়ার্কশপ ঋতুদার হাতে সবে শিখছি। কিন্তু এদিকে দেখতাম, সিরিয়ালের লিড নায়িকা কী সুন্দর রঙিন শাড়ি পরছে। আর আমার লুকের শাড়ি দেখে ভাবতাম, এইটা আমার শাড়ি? সাবর্ণীদি বলতেন, ‘ভরসা রাখ, ঋতু তোর জন্য বেছে দিয়েছে, পুপেকে এসব শাড়িতে মানাবে।’ তারপর তো দেখলাম এই লুকটা খুব জনপ্রিয় হয়ে গেল! প্রায় একটা ‘কাল্ট’ হয়ে গেল!
ঋতুদা প্রথম দিকে সেটে আসতেন। আমি কিন্তু কোনও দিন বকা খাইনি। এমনিতেই আমি খুব বাধ্য ছাত্রী। আমাকে যা বলা হত, হোমওয়ার্ক করে আসতাম খুব ভাল করে। ঋতুদাও খুব স্নেহ করতেন। আর খুব আতুপুতু করে রাখতেন। ওঁর গয়না, শাড়ি দিয়ে সাজিয়ে প্রোমো শুট হত। সবদিকে তাঁর নজর থাকত। কীভাবে কথা বলব, কীভাবে হাসব, কারণ পুপে জোরে হাসে না। অনেকক্ষণ বসে শট দিলে, শাড়ি, চুল কেমন থাকবে– সবটা দেখে দিতেন। প্রচুর টেক হত! বড় বড় শট নেওয়া হত। অদ্ভুত লাগে ভাবলে সেই সময় আমি একেবারে নতুন, কিন্তু আমার কখনও ঋতুদার সামনে ভয় করেনি, বরং এখন ভয় বা টেনশন– এই ধরনের অনুভূতি অনেক বেশি কাজ করে। আসলে তখন নিজেকে নিয়ে কোনও এক্সপেকটেশন ছিল না।
‘গানের ওপারে’-র সঙ্গে ঋতুদার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হল, তখন সকলের সঙ্গে একটা ডিসটেন্স তৈরি হলেও আমাকে মাঝে মাঝে মেসেজ করতেন। ফোনে কথা না হলেও, কোনও এপিসোড ভাল লাগলে, জানাতেন মেসেজ করে। আর সব মেসেজের শেষে লিখতেন ‘অনেক আদর!’ এইভাবেই যোগাযোগটা ছিল। কখনও কখনও শুধুই লিখতেন ‘অনেক আদর’, আমি কী উত্তর দেব ভেবে না পেয়ে একটা হার্ট সাইন পাঠিয়ে দিতাম। আমি এতটাই ছোট ছিলাম যে, সেভাবে কনভারসেশন চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো জায়গা বা স্পেসটাই তৈরি হয়নি। তাছাড়া স্বল্পদিনের আলাপ। কী-ই বা বলতে পারি। কতটা মেপে কথা বলব, বুঝতেই পারতাম না। একটা ছবির কথা হয়েছিল আমাদের, সেখানে আমার একটা ডান্স ফর্ম শেখার কথা ছিল। ঋতুদার সঙ্গে তার পরে আর সেভাবে আমার দেখাও হয়নি। শেষ দেখা ওই বিদায়বেলায়। খুব মনে হয় আরও একটু ম্যাচিওর অবস্থায় ঋতুদার সঙ্গে আলাপ হলে ভাল হত। কোনও ছবি দেখলে মনে হয়, ঋতুদা থাকলে কীভাবে করত! কত কিছু শেয়ার করতে পারতাম। আজকাল থার্ড জেন্ডার নিয়ে এত কথা হয়, উনি তো কতদিন আগেই ভোকাল হয়েছিলেন। ঋতুদার সঙ্গে নানাবিধ বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে পারতাম, এটা মনে হয়। ঋতুদাকে খুব অল্প সময়ের জন্য চিনেছিলাম। এবং একজন শিক্ষক হিসেবে চিনেছিলাম, বন্ধু নয়। তাঁর জন্মদিনে এটুকুই বলব– যেটুকু পাওয়া তা আমারই। আমার প্রজন্মের যারা, তাদের মধ্যে আমি নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে করি, কারণ অল্প সময়ের জন্য হলেও, ঋতুদার সংস্পর্শে আসতে পেরেছি।
‘মহুয়া’র প্রচ্ছদের নেপথ্যে নন্দলালের আঁকা সহজ পাঠের ছবি রবীন্দ্রনাথকে নিশ্চয়ই প্রাণিত করেছিল। সহজ পাঠের আগে আমরা দেখেছি, ১৯২২ সালের শেষে আন্দ্রে কারপেলেস প্যারিস থেকে এনেছিলেন একগুচ্ছ কাঠখোদাই। এমনকী, বিশের দশকে রবীন্দ্রনাথ যে কয়েকবার বিদেশ সফরে গিয়েছেন, সেখানে জার্মানিতে ও ফ্রান্সে তাঁর রীতিমত চেনাজানা ঘটেছিল কাঠখোদাই মাধ্যমটির সঙ্গে।