হারের শোক যতই অতলান্ত হোক, মোহনবাগানের হারে যতই দীর্ঘশ্বাস বয়ে থাক, তাও, চিরজীবী থাক এ বাংলার ফুটবল আবেগ। এ বাংলার ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা। তাই শনিবার আইএসএল ফাইনালে মোহনবাগান হারলেও সবুজ-মেরুন সমর্থকরা জিতে গিয়েছেন। ম্যাচে বল গড়ানোর আগেই জিতে গিয়েছিল বাংলা ফুটবলের আবেগ, জিতিয়ে দিয়েছিলেন মোহনবাগান অনুরাগীরা।
আবেগের ঝরনাধারায় স্নাত হয়েছেন কখনও? কখনও মিশেছেন উদ্বেলিত জন-অরণ্যে? জয়-পরাজয়ের দোলাচলতাকে বুকে নিয়ে কখনও শামিল হয়েছেন মোক্ষলাভের আশায়? উত্তরটা ‘হ্যাঁ’ হতেই পারে, যদি শনিবাসরীয় সন্ধ্যায় পাঠক আপনার পায়ের ধুলো পড়ে থাকে যুবভারতীতে।
না, মোহনবাগান আইএসএল জিততে পারেনি। অর্জন করতে পারেনি নতুন শতাব্দীতে ত্রিমুকুট জয়ের গৌরব। বুকভার এক নিষ্ঠুর পৃথিবীকে সঙ্গী করে শনিবার রাতে ঘরে ফিরেছে যারা, যুবভারতীর গ্যালারিতে দেখুন এখনও তাদের নিথর স্বপ্নগুলো পড়ে আছে। ফুটবলে কেন, বিশ্বের যে কোনও খেলার মঞ্চে সাফল্যই শেষ কথা। কিন্তু জয়-পরাজয়ের পাটিগণিতে কবেই বা সমর্থকদের আবেগের গভীরতাকে মাপা গিয়েছে? যায়নি, যাবেও না।
তাই তো সূর্যের খরতাপ ম্লান হয়ে আসতেই রং-রূপ বদলাতে শুরু করেছিল যুবভারতীর। ছোট ছোট ম্যাটাডর গাড়িতে কালো কালো মাথার ভিড়। সেই ভিড় ক্রমশ ঢেউ হয়ে উঠছে সল্টলেক স্টেডিয়ামের সিংহদুয়ারে। সেই জনগর্জন ছাপিয়ে বাওবাবের মতো মাথাচাড়া দিচ্ছিল চেনা রং, চেনা আবেগ– ‘সবুজ-মেরুন’। শুধু ফাইনালে বলে নয়, শেষ কয়েকটা ম্যাচে সেই আশাব্যঞ্জক ছবিটা মেলে ধরেছেন বাংলা ফুটবলের অনুরাগীরা। আইপিএলের ভরা মরশুমেও ‘হাউসফুল’ থেকেছে যুবভারতীর আনাচ-কানাচ। টিকিট চেয়ে ফোনে অনুরোধের আসর বসেছে। ফিরেছে চেনা সেই ময়দানের ফেলে আসা স্মৃতি, নতুনরূপে।
যুবভারতীর চত্বর নিমেষেই হয়ে উঠেছিল মোহনভারতী। তখনও মোহনবাগানের ভাগ্যাকাশে নির্মম অভিশাপের মতো হারের বজ্রপাত নেমে আসেনি। মাঠে বল গড়ানোর অনেক আগেই, প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের প্রারম্ভে যেমন সলতে পাকাতে হয়, সেইভাবে সেজে উঠেছিল স্টেডিয়াম, একটু একটু করে। শহর থেকে শহরতলি, নগর থেকে জেলা– সবার একটাই গন্তব্য হয়ে উঠেছিল বঙ্গ-ফুটবলের ‘কলোসিয়াম’ যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন। সেই ভিড়ের কতই না বাহার, কতই না বয়সের রংমিলান্তি! সবকিছুকে একসুতোয় বেঁধে ফেলেছিল ‘মোহনবাগান’, শুধু এই আবেগটুকু। সেই আবেগের গভীরতা এমনই, কোনও শব্দে তার ব্যাখ্যা চলে না। যেমনটা হয়ে উঠেছিল শনিবারের আইএসএল ফাইনালের মঞ্চে। যা দেখে মন বলে উঠতে চেয়েছে– ‘আহা! কী দেখিলাম! জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না।’
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
যুবভারতীর চত্বর নিমেষেই হয়ে উঠেছিল মোহনভারতী। তখনও মোহনবাগানের ভাগ্যাকাশে নির্মম অভিশাপের মতো হারের বজ্রপাত নেমে আসেনি। মাঠে বল গড়ানোর অনেক আগেই, প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের প্রারম্ভে যেমন সলতে পাকাতে হয়, সেইভাবে সেজে উঠেছিল স্টেডিয়াম, একটু একটু করে। শহর থেকে শহরতলি, নগর থেকে জেলা– সবার একটাই গন্তব্য হয়ে উঠেছিল বঙ্গ-ফুটবলের ‘কলোসিয়াম’ যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
সব দেখেশুনে মনে হচ্ছিল, বুঝি ভুল বলেছে আবহাওয়া দপ্তর! চাতকরূপী বঙ্গ-সমাজকে খামোকা আশ্বাস দিয়েছে, সুসময় আসন্ন। বৃষ্টি নামবে শহর তিলোত্তমার বুকে। আজ না হয় কাল। কাল না হয় পরশু। সেইসঙ্গে ঝড়। ভুলতে বসা কালবৈশাখী ফিরবে। কিন্তু শনিবারের আলো ঝলমলে যুবভারতীতে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল, কাল-পরশু নয়, কালবৈশাখী তো এসে গেছে! সটান সল্টলেক স্টেডিয়ামে। মোহনবাগান জনতার আবেগের ছদ্মবেশে। গ্যালারি জুড়ে যেদিকে চোখ যায়– শুধু সবুজ-মেরুন তরঙ্গ হিল্লোল। সত্তর হাজারের যুবভারতীর গ্যালারির সিংহভাগ জুড়ে বিরাজ করল মোহনবাগান, মেরিনার্সের বন্য-আবেগ। উঠল শব্দগর্জন, আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে। সুরে সুরে, তালে তালে– ‘মোহনবাগান… মোহনবাগান…’। ফাইনাল শেষে সেই শব্দব্রহ্ম বদলে গেল নীরবতায়। একবুক শূন্যতা নিয়ে তাদের ফিরতে হল ফাইনাল শেষে, যা তাদের মোটেই প্রাপ্য ছিল না। তাদের সেই যন্ত্রণাকে যদি আত্মস্থ করা যায়, যদি অনুভব করা যায়, নিশ্চিতভাবেই মনে হবে ঠিক বলেছেন জোহান ক্রুয়েফ। ‘ফুটবলের সবকিছু জীবনের মতো’– প্রবল অনিশ্চয়তায় ভরা।
যে যুবভারতী খালি হাতে ফেরাল মোহনবাগান-জনতাকে, দিনকয়েক আগে তারাই এক অনন্য ইতিহাসের সাক্ষী থেকেছে এই ক্রীড়াঙ্গনে। দেখেছে, মোহনবাগানের আইএসএল শিল্ড জয়। তারও আগে দেখেছে মরশুমের শুরুতে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইস্টবেঙ্গলের গ্রাস কেড়ে ডুরান্ড-জয়। চলতি মরশুমে মোহনবাগানকে কল্পতরুর মতো দু’হাতে ভরিয়ে দিয়েছে কলকাতা-ফুটবলের প্রাণকেন্দ্র সল্টলেক স্টেডিয়াম। স্বপ্নের পরিবৃত্তটা শেষে এসে যদিও পূর্ণতা লাভ করেনি। ঠোঁট আর কাপের দূরত্ব রেখে গিয়েছে। ডুরান্ড, লিগ-শিল্ড জিতলেও ‘মোহনভারতী’ হয়ে ওঠা যুবভারতীতে আইএসএল ট্রফি জেতা হল না গতবারের চ্যাম্পিয়নদের।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: হাবাস বোঝালেন কেন তিনি দেশের সফলতম বিদেশি কোচ
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
কী ভাবছেন পাঠক, মাত্রাতিরিক্ত আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে লেখনী জুড়ে? হারের ক্ষতে প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টা করছি কথার কথায়? না, একদমই তা নয়। দেখেননি যুবভারতী মুখর সমর্থকদের চোখের ভাষা কী বলছিল? কী প্রত্যাশার ডালি নিয়ে তারা উপস্থিত হয়েছিল সবুজ রণাঙ্গনে? সেই উল্লাসমুখর মুখগুলোর ভালোবাসা তো মিথ্যা হতে পারে না? তাই হারের শোক যতই অতলান্ত হোক, মোহনবাগানের হারে যতই দীর্ঘশ্বাস বয়ে থাক, তাও, চিরজীবী থাক এ বাংলার ফুটবল আবেগ। এ বাংলার ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা। তাই শনিবার আইএসএল ফাইনালে মোহনবাগান হারলেও সবুজ-মেরুন সমর্থকরা জিতে গিয়েছেন। ম্যাচে বল গড়ানোর আগেই জিতে গিয়েছিল বাংলা ফুটবলের আবেগ, জিতিয়ে দিয়েছিলেন মোহনবাগান অনুরাগীরা।
সেই আবেগের ঝরনাধারা পাঠক আপনিও কি স্নাত হয়েছেন? গা ভাসিয়েছেন সেই সৃষ্টিসুখের উল্লাসে? যদি হয়ে থাকেন, তাহলে আপনিও অক্লেশে বলতে পারেন– সুপবন বহিতেছে দেখিয়া, জাতীয় পতাকা উড়াইয়া দাও– তাহাতে নাম লেখ ‘মোহনবাগান’!