দুর্গাপুজো শিল্প করতে গিয়ে আমি সব হারিয়েছি। সংসার, পরিবার, নিজেদের লোক। তাদের সময় দিতে পারিনি। যদিও পেয়েছি এক বৃহত্তর পরিবার। কারণ আমি ২৪ ঘণ্টাই প্যান্ডেলে পড়ে থাকতাম। বাকি অনেকের মতো দূর থেকে জ্ঞান দিয়ে চলে যেতাম না।
১২.
প্রথম পর্ব থেকেই আমি কথা বলে চলেছি রাস্তায় নেমে কাজ করার ব্যাপারে। পথে নামার ব্যাপারে। পথে এবার নামো সাথী, পথেই হবে পথ চেনা। এই পথ চেনা, আমার কাছে শিল্পের পথ চেনা। আপনাদের মনে হতেই পারে, এই যে রাস্তায় নেমে সারাদিন-রাত একত্র করে কাজ করে চলেছি আমরা, সেই সব শিল্পীর কত শতাংশ পুরুষ, নারী কত শতাংশ? একথা বলতে খারাপই লাগে, নারীর সংখ্যা এখনও এই শিল্পে বেশ কম। আমি অবশ্যই চাইব তারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নেমে পড়ুক। প্যান্ডেল-মূর্তি গড়ুক। রাত ২টো-৩টে পর্যন্ত জেগে দিনের পর দিন কাজ করা যদিও খুবই পরিশ্রমসাধ্য কাজ। তরতরিয়ে উঠে পড়তে হয় বাঁশ বেয়ে। কিন্তু আমার কাছেই তো অনেক মেয়ে কাজ করেছে। তারা পেরেছে। মনে পড়ে মীরা মুখোপাধ্যায়ের কথা। বকুলবাগানের পুজোয় তিনি বহুবার মূর্তি গড়েছেন। তিনি আসলে মাটির গন্ধ বুঝতেন। ছেলে হোক, মেয়ে হোক, বুঝতে হবে মাটির গন্ধ।
…………………………………………………………………………………………….
নলীন সরকার স্ট্রিট বা হাতিবাগানে যে পুজো করেছিলাম, কোনও লেআউট ছিল না হাতে। রোজ যেতাম, দেখতাম। ২০০৬ সালে আমি পুজো করেছি ২১ দিনে। সেবার বৃষ্টি হয়ে অসুর গলে গিয়েছিল কোমর অবধি। তখন আমরা ওই ক্লাবের সবাই মিলে পাঁক পরিষ্কার থেকে শুরু করে সমস্তটাই করেছি। শিল্পের ডিসকোর্সের মধ্যে এগুলোও পড়ে।
…………………………………………………………………………………………….
শিল্প ঠিকঠাকভাবে করে ওঠার আগেই, শিল্পী হয়ে যাওয়া খুব মুশকিল। অনেক শিল্পীকেই দেখেছি, ৫০ বছর ধরে হোয়াইট কিউবে রং দিয়েও তিনি শিল্পীর খেতাব পাননি। নিরন্তর অসম্ভব নিষ্ঠার সঙ্গেই তিনি কাজ করে চললেও অনেক সময় সামান্য খ্যাতিটুকুও মেলে না। অথচ দুর্গাপুজোর তিনমাসে শিল্পীদের ঢল পড়ে যায়। নাম ছড়ায়। যারা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত নয়, তারাও এই সুযোগে নাম করে নেয়। এটা এই শিল্পের খারাপ দিক। যে কোনও মাধ্যমে– সাহিত্য-শিল্প যাই হোক না কেন, ভালো কিছু হলে, খারাপও হবে। এটা একটা প্যারালাল রিয়ালিটি। কারণ এখানে মতাদর্শের নানা সমস্যা রয়েছে। শিল্পীদের নিজেকে জাহির করাও কি কম? ঠাকুর তৈরি হয়ে গেছে হয়তো, কিন্তু যখন প্রেস আসছে ছবি তুলতে সে দাঁড়িয়ে পড়ে আবার চোখ আঁকছে। হঠাৎ করে শাড়ি পরাচ্ছে। মাটিতে হাত বোলাচ্ছে। এত সহজে কি হয়? এটা ধ্রুপদী সংগীতের মতো, রেওয়াজটা জরুরি। গন্তব্য একটাই, কিন্তু কোন পথ দিয়ে যাবে? সে পথ যেন মাটির হয়, পিচের না।
দুর্গাপুজো শিল্প করতে গিয়ে আমি সব হারিয়েছি। সংসার, পরিবার, নিজেদের লোক। তাদের সময় দিতে পারিনি। যদিও পেয়েছি এক বৃহত্তর পরিবার। কারণ আমি ২৪ ঘণ্টাই প্যান্ডেলে পড়ে থাকতাম। বাকি অনেকের মতো দূর থেকে জ্ঞান দিয়ে চলে যেতাম না। নলীন সরকার স্ট্রিট বা হাতিবাগানে যে পুজো করেছিলাম, কোনও লেআউট ছিল না হাতে। রোজ যেতাম, দেখতাম। ২০০৬ সালে আমি পুজো করেছি ২১ দিনে। সেবার বৃষ্টি হয়ে অসুর গলে গিয়েছিল কোমর অবধি। তখন আমরা ওই ক্লাবের সবাই মিলে পাঁক পরিষ্কার থেকে শুরু করে সমস্তটাই করেছি। শিল্পের ডিসকোর্সের মধ্যে এগুলোও পড়ে। আমি কোনও হনু নই। ল্যাপটপ নিয়ে এসে, ছড়ি ঘুরিয়ে, এটা করতে হবে, ওটা করতে হবে– বলে পালিয়ে যাব। এটা কোনও প্রোজেক্ট না। জনগণের রক্তমাংসের শিল্প। খেটে খাওয়া শিল্প।
হাতিবাগানে, নলীন সরকার স্ট্রিটে যে কাজ করতাম, সেখানে বস্তির বাচ্চা বাচ্চা ছেলেরা এসে কাজ করত। বস্তি বললাম বলে, আপনাদের অসুবিধে হল? আমার হয় না। কারণ আমি বস্তিরই ছেলে। বস্তি থেকেই উঠে এসেছি। আমার এসব বললে খারাপ লাগে না। লুঙ্গি, গেঞ্জি, মায়েদের শাড়ি দিয়েছি দিনের পর দিন। দুর্গাপুজো করে লাখ লাখ টাকা মুনাফা লুটব, ভাবিনি কোনও দিন। পুজোর টাকায় একটা সিগারেট পর্যন্ত খাইনি।
এই হল সেই শিল্পের পথ, যেখানে আমি কৃচ্ছ্রসাধন করেছি।
(চলবে)
…আরও পড়ুন ত্রিনয়ন ও ত্রিনয়ন…
পর্ব ১১: বাদল সরকারের থিয়েটার পথে নেমেছিল, আমার শিল্পও তাই
পর্ব ১০: যে কারণে এখন দুর্গাপুজো শিল্প করছি না
পর্ব ৯: এদেশে শিল্প সেক্যুলার হবে না
পর্ব ৮: শুধু শিল্প নিয়ে যারা বাঁচতে চায়, তারা যেন বাঁচতে পারে
পর্ব ৭: ক্যালেন্ডারের দেবদেবীর হুবহু নকল আমি করতে চাইনি কখনও
পর্ব ৬: সাধারণ মানুষকে অগ্রাহ্য করে শিল্প হয় না
পর্ব ৫: দেওয়ালে যামিনী রায়ের ছবি টাঙালে শিল্পের উন্নতি হয় না
পর্ব ৪: দেবীঘটও শিল্প, আমরা তা গুরুত্ব দিয়ে দেখি না
পর্ব ৩: জীবনের প্রথম ইনকাম শ্মশানের দেওয়ালে মৃত মানুষের নাম লিখে
পর্ব ২: আমার শরীরে যেদিন নক্ষত্র এসে পড়েছিল
পর্ব ১: ছোট থেকেই মাটি আমার আঙুলের কথা শুনত