কেরিমা লোরেনো তারিমানের (জন্ম তাঁর ১৯৭৯-এর মে মাসে) শৈশবের দিনগুলি কেটেছে বইপত্র, নাটক, কবিতার আবহে। তাঁর বাবা পাবলো আরসিলা তারিমান কালচারাল সেন্টার অভ ফিলিপিনস-এর জনসংযোগ বিভাগে কাজ করতেন। কেরিমার মা, মারলিনা লোরেনো, কবি ছিলেন, মার্শাল ল অ্যাক্টিভিস্ট ছিলেন এবং ছিলেন ভূতপূর্ব রাজনৈতিক বন্দিও।
১৭.
কেরিমা লোরেনো তারিমান। ফিলিপিনস
প্রাক্কথা
সময়কে পড়েছি আমি
কীভাবে সময় বহে যায়…
আমি পড়েছি
পল, দিন, সপ্তাহ, মাস
সম্ভাবনা, ধাঁচগুলিকে।
কতটা দীর্ঘ হলে
জনযুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয়?
কতখানি দ্রুত, কত ধীরে ধীরে–
কিছু আসে যায়?
শেষ প্রশ্ন চিরন্তন।
কখন জিতব আমরা?
ফিলিপিনসের অর্ধশতাব্দীব্যাপী জনযুদ্ধ সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণাটুকু না থাকলে আপনি কেরিমা তারিমানকে মোটেই বুঝতে পারবেন না। কারণ, কবি কেরিমা আর জনযোদ্ধা কেরিমা একটি অবিচ্ছিন্ন অস্তিত্ব। দীর্ঘস্থায়ী জনযুদ্ধের মাধ্যমে আধা সামন্ততান্ত্রিক আধা ঔপনিবেশিক ফিলিপিনসকে জনগণের রাষ্ট্রে পরিণত করবার লক্ষ্য নিয়ে ১৯৬৮-তে পুনর্গঠিত হয়েছিল পার্তিদো কমিউনিস্তা ন্গ ফিলিপিনাস (কমিউনিস্ট পার্টি অভ ফিলিপিনস)। সিপিসি-র দুটি বাহু হল ন্যাশনাল পিপল্স আর্মি এবং ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট– গণফৌজ এবং ফিলিপিনো জনগণের বিভিন্ন অংশের যুক্তফ্রন্ট। ছয়ের দশকের শেষ থেকে আজ অবধি সিপিসি লাগাতার ও-দেশের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ চালিয়ে আসছে, দেশের ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম হয়ে থেকেছে। ন্যাশনাল পিপল্স আর্মি বিবেচিত হয় আজকের দুনিয়ায় সবচেয়ে বড় লাল-সৈন্যদল হিসাবে (দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে সম্ভবত ভারতের মাওবাদীদের পিপল্স লিবারেশন গেরিলা আর্মি)। পার্বত্য ও গ্রামীণ ফিলিপিনসের বিস্তীর্ণ অংশ সিপিসি-এনপিএ-এনডিএফ (বলার সুবিধার জন্য আমরা পুরোটাকে ‘লাল ফিলিপিনো’ বলতে পারি?) শাসনাধীন, কিংবা প্রভাবিত। শহর অঞ্চলেও তাদের জনসমর্থন উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। বহু সাংবাদিক, লেখক, কবি, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী প্রকাশ্যে চলমান জনযুদ্ধের পক্ষে সরব থেকেছেন। এবং অবশ্যই তার জন্য মাশুলও দিয়েছেন।
প্রারম্ভকথা
‘গেরিলা কবি’ বললে প্রথম যে দু’জনের নাম লাল ফিলিপিনো বৃত্তে উঠে আসবে, তাঁরা হোসে মারিয়া সিসন এবং এমানুয়েল লাকাবা। সদ্যপ্রয়াত মারিয়া সিসন (ইনি সিপিসি-র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাও বটে) ১৯১৩-য় লেখা ‘দ্য গেরিলা ইজ লাইক আ পোয়েট’ রচনার শিরোনামটিতেই কবি ও গেরিলাকে সংযুক্ত করেছিলেন। ‘জনগণের মহাকাব্য, জনগণের যুদ্ধ’ চিত্রকল্পের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে তিনি বুঝিয়েছিলেন, কবি ও গেরিলা, দু’জনেই, তাঁদেরকে ঘিরে থাকা পরিবেশকে অনুধাবন করেন এবং বদলাতে চান– সে পরিবেশ প্রাকৃতিক হোক, বা রাজনৈতিক। এর অনেক আগে লেখা ‘অ্যান ওপেন লেটার টু ফিলিপিনো আর্টিস্টস’ কবিতায় (১৯৭৬)-এ এমানুয়েল লাকাবা কিন্তু অনেক প্রত্যক্ষ এবং স্পষ্ট। তিনি কবি ও শিল্পীদের তাঁদের পুরোনো শিকড়ের টানকে অতিক্রম করে ‘কম চলা রাস্তায়’ পা ফেলতে। ‘কম চলা রাস্তা’ নিঃসন্দেহে জনযুদ্ধের রাস্তা। তাঁর কবিতার লাইনে এই অতিক্রমণের প্রক্রিয়া স্পষ্ট– ‘তার হাতের বলপেন দোনলা বন্দুকের মতো দীর্ঘ হয়ে ওঠে/ বদলে যাওয়ার লড়াই তার নিজের ভিতরেও চলতে থাকে’।
কথা
কেরিমা লোরেনো তারিমানের (জন্ম তাঁর ১৯৭৯-এর মে মাসে) শৈশবের দিনগুলি কেটেছে বইপত্র, নাটক, কবিতার আবহে। তাঁর বাবা পাবলো আরসিলা তারিমান কালচারাল সেন্টার অভ ফিলিপিনস-এর জনসংযোগ বিভাগে কাজ করতেন। কেরিমার মা, মারলিনা লোরেনো, কবি ছিলেন, মার্শাল ল অ্যাক্টিভিস্ট ছিলেন এবং ছিলেন ভূতপূর্ব রাজনৈতিক বন্দিও। ছোটবেলায় বাড়িতে দেখাশোনার কেউ না থাকায় অনেকদিনই পাবলো ছোট্ট ‘কিমা’-কে অফিসে নিয়ে ছেড়ে রাখতে বাধ্য হতেন। কিমাও মনের সুখে লাইব্রেরিতে দৌড়ে বেরাত, অর্কেস্ট্রা শুনত, নাটক দেখে নিত। একটু আধটু ব্যালে শিখে নেওয়ার শুরুও এখানেই। ২০১২-র এক কথোপকথনে কেরিমা বলছেন, কীভাবে কালচারাল সেন্টার তাঁর ছোটবেলার খেলাঘর হয়ে উঠেছিল আর সরকার-পোষিত শিল্প সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর দেখা-জানা-বোঝার শুরুও কীভাবে এখানে হয়েছিল। এখানে প্রায়ই দেখা মিলত বিখ্যাত সব লেখক-শিল্পীদের– তাঁদের কেউ রাষ্ট্রনায়কের জীবনীকার, কেউ বা রাষ্ট্রপতির ভাষণ লিখে দেন, অথবা সংগীত-ফিল্ম-থিয়েটারের নক্ষত্র সব!
সেন্টারের বাইরেও তাঁর চারপাশ ঘেরা থাকত বইয়ে, বাড়ি ভর্তি বই ছিল তাঁদের। সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকল ছোটবেলা থেকেই। ইশকুলের পড়া শেষ হতেই ভর্তি হয়েছিলেন ফিলিপিনস হাইস্কুল ফর আর্টস-এ, সৃজনশীল লেখক গবেষক হিসাবে। আর ১৯৯৬-তে বের হল তাঁর প্রথম কবিতা-সংকলন। কেরিমার বয়স তখন ১৬।
(শেষাংশ পরের সপ্তাহে)
বর্তমানে ভারতের অধিকাংশ সিঙ্গল স্ক্রিন হল বন্ধ হয়ে গিয়েছে, নয়তো অস্তিত্ব সংকটে। সাধারণ জনগণের জন্য তৈরি হয়েছিল এই হলগুলো, বর্তমানে তাদের জায়গা দখল করে নিয়েছে উচ্চমূল্যের মাল্টিপ্লেক্স সংস্কৃতি। একে তো টিকিটের উচ্চ দাম, তার ওপর পপকর্ন-জলের বিল, আর অতিরিক্ত যাতায়াত খরচ– সব মিলিয়ে চলচ্চিত্র দেখা যেন এখন অভিজাত শ্রেণির বিনোদনে রূপান্তরিত।
আত্মীয়তা, সংহতি, বন্ধুত্বের রাজনীতিকেই ভয় করে শাসক। তাই জনমানসে কারাগার, কারাজীবনকে বরাবর এক অপরাধ সম্পৃক্ত বিপজ্জনক পরিসর হিসেবে চিহ্নিত করতে লাগে। বন্দিদের অপরাধ প্রমাণের আগেই তাঁদের অপরাধী করে তুলতে লাগে, বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার আগেই সাজা চলতে থাকে। মেয়েদের রাজনৈতিক সত্তাকে অস্বীকার করলেও, মেয়েদের রাজদ্রোহিতা তাই শাস্তিযোগ্য।
আজ ভারতীয় সিনেমার শরীরে যখন বাসা বাঁধছে গোয়েবেলসীয় প্রোপাগান্ডা, তখন সেই ছয়-সাতের দশক থেকে কারণে-অকারণে, প্রেমে-বিরহে, স্কুলকলেজ বা অফিস কাটিয়ে বা পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে সিনেমা হলের আশ্রয় যারা নিয়েছে, তারা জানে অন্ধকারের মহিমা। শেষ হল জনতা সিনেমা হল।