ভারতীয় শুটিংয়ের রাজকন্যা। প্যারিস অলিম্পিকের মঞ্চে যাঁর লক্ষ্যভেদে প্রথম পদকপ্রাপ্তির স্বপ্নপূরণ ঘটল আসমুদ্রহিমাচলের। পদকের রং ব্রোঞ্জ না হয়ে হতে পারত রুপালি, ০.১ পয়েন্টের চুলচেরা ব্যবধানটুকু কেড়ে নিল সেই স্বপ্ন। পোডিয়ামে দাঁড়ানো বছর বাইশের মনুকে দেখে অবশ্য বোঝার উপায় নেই, তাঁর অন্তরে কী পরিমাণ আবেগের লাভাস্রোত বইছে। বহিরঙ্গে শান্ত, স্থিতধী চিত্ত। স্মিতহাস্যে যুদ্ধজয়ের তৃপ্তি। কিন্তু এই পদক-লাভের যাত্রা যে খুব সহজ ছিল না, মনুর চেয়ে ভালো আর কে জানেন!
মেয়েরা পুরুষদের অসমকক্ষ– এই ভ্রান্তধারণাকে সমাজের বেদিমূলে প্রতিষ্ঠাদানের প্রয়াস বহু যুগ ধরেই চলছে। ‘মনু-সংহিতা’র মতো স্মৃতিশাস্ত্র বারবার নারীবিদ্বেষের আগুনকে উসকে দিয়েছে। সেই অচল গড্ডালিকা প্রবাহে গা না ভাসিয়ে যুগে যুগে বীরাঙ্গনাদের আবির্ভাব ঘটেছে সমাজে, ক্রীড়াক্ষেত্রেও। রবিবাসরীয় ‘অ্যান ইভিনিং ইন প্যারিস’-এ সেই ব্রাহ্মমুহূর্তের জন্ম হল আরও একবার, প্যারিস অলিম্পিকের মঞ্চে। কাকতালীয়, যাঁর হাত ধরে সেই ইতিহাসের সৌধ নির্মাণ ঘটল ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’-এ, তাঁর নামও মনু।
মনু ভাকের।
ভারতীয় শুটিংয়ের রাজকন্যা। প্যারিস অলিম্পিকের মঞ্চে যাঁর লক্ষ্যভেদে প্রথম পদকপ্রাপ্তির স্বপ্নপূরণ ঘটল আসমুদ্রহিমাচলের। পদকের রং ব্রোঞ্জ না হয়ে হতে পারত রৌপ্যমণ্ডিত, ০.১ পয়েন্টের চুলচেরা ব্যবধানটুকু কেড়ে নিল সেই স্বপ্ন। পোডিয়ামে দাঁড়ানো বছর বাইশের মনুকে দেখে অবশ্য বোঝার উপায় নেই, তাঁর অন্তরে কী পরিমাণ আবেগের লাভাস্রোত বইছে। বহিরঙ্গে শান্ত, স্থিতধী চিত্ত। স্মিতহাস্যে যুদ্ধজয়ের তৃপ্তি। কিন্তু এই পদক-লাভের যাত্রা যে খুব সহজ ছিল না, মনুর চেয়ে ভালো আর কে জানেন!
………………………………………………………………………………………..
হাতের যন্ত্র বিশ্বাসঘাতকতা করলে কাকেই বা দোষ দেবেন মনু, নিজের ভাগ্যকে ছাড়া। ভাগ্যবিড়ম্বনায় শূন্য হাতে ফিরতে হয়েছিল অলিম্পিক থেকে। সমালোচনার শক্ত বুলেট ভেসে এসেছিল তাঁর দিকে, ঝাঁকে ঝাঁকে। হতাশায় ভেবেছিলেন ছেড়ে দেবেন প্রাণের প্রিয় শুটিংটাই। কলকাতায় এসে একান্ত সাক্ষাৎকারে তাঁর মুখ থেকেই শুনেছিলাম সেই যন্ত্রণার কথা– ‘টোকিও গেমসের কথা ভাবলে আজও কষ্ট পাই। যতরকমের সমস্যা হতে পারে, মোক্ষম সময়ে সেসবের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। মুখিয়ে ছিলাম ভালো কিছু করার জন্য। কিন্তু প্রাপ্তি হয়েছিল স্রেফ ব্যর্থতা।’
………………………………………………………………………………………..
টোকিও অলিম্পিকের সেই হার্টব্রেকের কথা মনে আছে? কুরুক্ষেত্রে যেমন মোক্ষম সময়ে রথচক্র বসে গিয়েছিল সূর্যপুত্র কর্ণের, অমোঘ নিয়তি বয়ে এনেছিল মৃত্যুঘণ্টা! টোকিও-র মঞ্চেও সেই মৃত্যুসম ব্যর্থতার আস্বাদ পেয়েছিলেন মনু। ততদিনে তিনি ভারতীয় শুটিংয়ের সেনসেশন। আপামর ভারতবাসীর পদকজয়ের স্বপনচারিণী। কিন্তু স্বপ্ন আর বাস্তবের মধ্যে যে আকাশ-পাতাল তফাত। টের পেয়েছিলেন মনু। টোকিও-র শুটিং রেঞ্জে মোক্ষম সময়ে বিগড়ে গিয়েছিল এয়ার পিস্তল। হাতের যন্ত্র বিশ্বাসঘাতকতা করলে কাকেই বা দোষ দেবেন মনু, নিজের ভাগ্যকে ছাড়া। ভাগ্যবিড়ম্বনায় শূন্য হাতে ফিরতে হয়েছিল অলিম্পিক থেকে। সমালোচনার শক্ত বুলেট ভেসে এসেছিল তাঁর দিকে, ঝাঁকে ঝাঁকে। হতাশায় ভেবেছিলেন ছেড়ে দেবেন প্রাণের প্রিয় শুটিংটাই। কলকাতায় এসে একান্ত সাক্ষাৎকারে তাঁর মুখ থেকেই শুনেছিলাম সেই যন্ত্রণার কথা– ‘টোকিও গেমসের কথা ভাবলে আজও কষ্ট পাই। যতরকমের সমস্যা হতে পারে, মোক্ষম সময়ে সেসবের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। মুখিয়ে ছিলাম ভালো কিছু করার জন্য। কিন্তু প্রাপ্তি হয়েছিল স্রেফ ব্যর্থতা।’
আর সমালোচনার নখরাঘাত? মনু সহ্য করেছেন, আর সংকল্পনিষ্ঠ হয়েছেন নতুন করে ফিরে আসার– ‘যাবতীয় সমালোচনাকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করার চেষ্টা করেছি। জানি, গোটা দেশ আমার কাছ থেকে পদকের প্রত্যাশা করে। তা পূরণ করতে না পারলে সমালোচনা হতে হবেই।’
ব্যর্থতার অতল থেকেই ফেরার লড়াইটা শুরু করেছিলেন মনু। নিজেকে গড়েছেন তিলে-তিলে। একগুঁয়েমি সরিয়ে ফোকাসড হয়েছেন নিজের লক্ষ্যে। বেদবাক্য করেছেন গুরু যশপাল রানার প্রতিটি পরামর্শকে। সেই অধ্যাবসায়ের ফসল রবিবাসরীয় বিকেলে প্যারিস গেমসে পদক প্রাপ্তি। দীর্ঘ এক যুগ পর শুটিংয়ে পদক পেল ভারত, গগন নারাংয়ের পর। ভারতের পদক প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে মনু প্রমাণ করলেন, তিনি ফুরিয়ে যাননি। কলকাতায় একান্ত সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় কথাপ্রসঙ্গে নিজের স্বপ্নের কথা বলেছিলেন মনু। প্যারিস থেকে পদক জিততে চান– সেই সংকল্প ফুটে বের হয়েছিল মনুর শপথে। হলও তাই। কথা রাখলেন ভাকের। অতীতে যেমন রেখেছেন যুব অলিম্পিক কিংবা বিশ্ব শুটিংয়ের মঞ্চে।
………………………………………………………………..
আরও পড়ুন অরিঞ্জয় বোস-এর লেখা: আক্ষেপের ভুবন জয়ে দ্রাবিড়ীয় পথই পাথেয় গম্ভীরের
………………………………………………………………..
নিজেকে প্রমাণ করার এই তাগিদের ফসল হিসেবে রবিবার ব্রোঞ্জ লাভ হল ভারতীয় শুটারের। কোয়ালিফায়িং রাউন্ডে প্রথম তিনে শেষ করার পর থেকেই মনুকে ঘিরে প্রত্যাশার পারদ চড়ছিল। তবে এবার বলে নয়, অতীতেও প্রত্যাশার পাহাড় ঘাড়ে নিয়ে শুটিং রেঞ্জে লক্ষ্যস্থির করতে হয়েছে মনুকে। কে বলবে তাঁর বয়স মাত্র ২২! রবিবার একপ্রকার অসাধ্যসাধন করলেন হরিয়ানার শুটিং-কন্যা। টোকিও-তে চাপের কাছে কুঁকড়ে গিয়েছিলেন। প্যারিসের মঞ্চে মনু দেখালেন, তিনি চাপকে জয় করার রহস্যভেদ করে ফেলেছেন। আর পেরেছেন বলেই তাঁর হাতে শোভা পাচ্ছে অলিম্পিকের পদক। যখন থামলেন, তাঁর নামের পাশে ২২১.৭ পয়েন্ট। আর একটু হলে নিশ্চিত হয়ে যেত রুপোর পদক। যাক গে, যাক। হোক তা ব্রোঞ্জ, সেই প্রাপ্তি সোনার চেয়ে কম কি! এখনও দু’টো ইভেন্ট বাকি। সোনার স্বপ্নপূরণের সুযোগ এখনও তো হারিয়ে যায়নি মনুর কাছ থেকে।
ইতিহাস যদিও মনে রাখবে মনুর এই অদম্য লড়াইকে। যেখানে ব্যর্থতার পৃথিবী থাকবে, যেখানে সমালোচনার আস্ফালন থাকবে, সেখানে নিশ্চিত একজন মনুও থাকবেন। ভাবীকালের স্বপ্নকে আঁকড়ে। ব্যর্থতা থেকে সাফল্যের জাগরণে। সেই লড়াইয়ের বিগ্রহ হয়ে আজ থেকে বিরাজ করবেন মনু ভাকের।
……………………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………………..