১৮২৭ সালে গেজেটে নোটিশ দিয়ে জানায় যে পালকির মালিক আর বেহারাদের নির্দিষ্ট কর দিয়ে লাইসেন্স নিতে হবে; অন্যথায় রাস্তায় সেই পালকি বের করা যাবে না। নোটিশে পালকি ভাড়া করার নতুন হিসেবও বলা হল, ‘ইংরেজ ঘড়ি’ অনুযায়ী ১৪ ঘণ্টার জন্য ১৪ আনা। ওড়িয়া বেহারারা এই বিজ্ঞপ্তি বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ধর্মঘট করে শহরে পালকি চলাচল বন্ধ করে দেন। বলা চলে এই ছিল কলকাতার শ্রমজীবী মানুষদের প্রথম সংগঠিত আন্দোলন।
২৮.
প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ কলকাতার রাস্তাঘাটে নতুন নয়। স্বদেশি আন্দোলনের সময়ে সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে পড়েছিলেন ঔপনিবেশিক সরকারের প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে। তবে সে ছিল শিক্ষিত, মধ্যবিত্তের পথে নামা। এর অনেক বছর আগে থেকেই কলকাতায় সংগঠিত আন্দোলনের সূত্রপাত। উনিশ শতকে বারেবারে ঔপনিবেশিক সরকারের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে ধর্মঘট করেছিলেন কর্মসূত্রে শহরে আসা বিভিন্ন লোকজন। সেইসব অভাব-অভিযোগের কথা মূলত ছিল শহরের নিম্নবর্গের মানুষের। আধুনিক ঔপনিবেশিক শহরে উনিশ শতক জুড়ে যান চলাচলের প্রধান উপায় ছিল বেহারার কাঁধে চেপে পালকি, ঘোড়ায় টানা কোচ, বা নিতান্তই ঢিমেতালের গরুর গাড়ি। ট্রাম-বাস-মোটর বেশ খানিক পরের ব্যাপার, উনিশের শেষ-বিশ শতকের শুরুর দশকে সেই সব দেখা যাবে শহরের রাস্তাঘাটে। তাই শহর চালু রাখার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল পালকির বেহারার বা ঘোড়ার কোচম্যানের। আর এই মানুষগুলির সঙ্গেই ঔপনিবেশিক সরকারের খটাখটি লেগেই থাকত।
উনিশ শতকের গোড়ায় কলকাতায় পালকির বেহারাদের মধ্যে একটা বড় অংশ ছিল ওড়িশার লোকজন। তাঁদের মধ্যে তালমিল বেশ ভালো ছিল; নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া ছিল শহরের এলাকা ভাগ নিয়ে। এক জায়গার পালকি তার এলাকা ছেড়ে অন্যের পথে যাবে না– এই ধারণা তাঁদের মধ্যে রেষারেষির সম্ভাবনা বেশ কমিয়ে দিয়েছিল। এই এলাকা ভাগ নিয়ে যদিও যাত্রীরা বিশেষ খুশি ছিল না, তা বলা বাহুল্য। কিছু নিয়মকানুন থাকা উচিত বলে অনেকেই মনে করতেন, যাতে বেহারাদের এইসব বেয়াক্কেলে আবদার আইনত ‘অপরাধ’ হিসেবে দেখা হয়। খানিকটা চাপে পড়েই সরকার অবশেষে ১৪ মে, ১৮২৭ সালে গেজেটে নোটিশ দিয়ে জানায় যে পালকির মালিক আর বেহারাদের নির্দিষ্ট কর দিয়ে লাইসেন্স নিতে হবে; অন্যথায় রাস্তায় সেই পালকি বের করা যাবে না। নোটিশে পালকি ভাড়া করার নতুন হিসেবও বলা হল, ‘ইংরেজ ঘড়ি’ অনুযায়ী ১৪ ঘণ্টার জন্য ১৪ আনা।
ওড়িয়া বেহারারা এই বিজ্ঞপ্তি বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ধর্মঘট করে শহরে পালকি চলাচল বন্ধ করে দেন। বলা চলে এই ছিল কলকাতার শ্রমজীবী মানুষদের প্রথম সংগঠিত আন্দোলন। ‘সম্বাদ তিমির নাশক’ কাগজে ছাপা খবরের সারাংশ অনূদিত হয়ে ছাপা হল ১৮২৭ সালের ১৮ মে-র সন্ধ্যার ক্যালকাটা গেজেটে–
Those Courteous gentlemen of Ooriya, the Bearers, have been these three or four days making a great noise against the new Regulation passed by Government, for licensing Teeka Palkea and Bearers, and levying taxes on them. Some are assembled on the plain of the Fort, others at Chand Pal Ghaut, in separate bodies. They say, these confounded Firingis have been at their usual tricks of taxing our bodily labour!
এর দিন কয়েক বাদে, ২ জুন (২১ জ্যৈষ্ঠ ১২৩৪), ‘সমাচার দর্পণ’-এ লেখা হল,
‘এই নূতন ব্যবস্থাবিষয়ে কেহ এই এক ওজর করে যে কেবল সময়ানুসারে হার নিরূপিত হওয়াতে তাহারদের পক্ষে অনেক ক্ষতি অতএব সময়ানুসারে হার না করিয়া যদি দূরাদূর বুঝিয়া করা যাইত তবে ভাল হইত যেহেতুক কলিকাতা হইতে কালীঘাটে কোন বাবুকে লইয়া জাইতে হইলে মরেপিটে এক ঘণ্টার মধ্যে যাওয়া যায় এবং সেই এক ঘণ্টায় তাহারদের তাবৎ দিবসের বল যাইবে।
…সময়ানুসারে বেতন নিরূপণের নূতন আইন হওয়াতে বেহারাদের প্রাণ লইয়া টানাটানি হইয়াছে যেহেতুক বেহারাদের ঘড়ী নাই আরোহকেদের ঘড়ী আছে এবং ইতরলোক অপেক্ষা মান্যলোকের কথা প্রায় সর্ব্বত্ত্রই অধিক মান্য। এমন অনেক মান্যলোক আছেন যে তাঁহারা দেড় ঘণ্টা কিম্বা ততোধিককাল পর্য্যটন করাইয়া ঘড়ী দেখাইয়া এক ঘণ্টার বেতন দান করিবেন বেহারা বেচারা তাহাতে বাক্য কহিতে পারিবে না কহিলে আইনানুসারে দণ্ডনীয় হইবেক সুতরাং মাদারির মৃত্যু।
ঘড়ি ধরে সময় দেখা নিতান্তই ইউরোপীয় রীতি, ভারতীয় বেহারাদের সে বিষয়ে বিশেষ কোনও ধারণাই ছিল না এই সময়ে। ফলে সরকারের এই নির্দেশ যে তাঁদের পক্ষে বুঝে নিয়ে নিজেদের ‘কায়িক শ্রমের’ উপযুক্ত মূল্য নির্ধারণ করার উপায় হতে পারে না, সেই নিয়ে এই মানুষগুলির মনে কোনও সংশয় ছিল না। বেহারাদের অনুপস্থিতিতে ‘সমাচার দর্পণ’ লিখেছে যে, ‘ইতোমধ্যে কলিকাতা নগরে ঘোড়া সকল পালকী বেহারা হইয়াছে এবং বোধ হয় যে দুই তিন হপ্তার মধ্যে ঘোড়ারদেরও সভা হইয়া এক দরখাস্ত উপস্থিত হইবেক। ইহাও অসম্ভব নয় যেহেতুক হিতোপদেশ প্রভৃতি গ্রন্থের মধ্যে ষাঁড় শৃগালাদি কথা কহিয়াছে।’
খানিক হালকা চালে খবরের শেষ দু’লাইনে যে, কথা বলা হল তার মধ্যে লুকিয়ে ছিল অন্য এক গল্প। না, ঘোড়াদের সভার কথা পাওয়া যায় না নথিপত্রে, কিন্তু পালকি না চললে যে অন্য ব্যবস্থা সম্ভব, সেই পথ দেখায় ১৮২৭-এর মে-জুন মাসের কয়েক দিন। বেহারাদের ধর্মঘট বেশিদিন চলেনি। কিন্তু আইন করে শহরের রাস্তায় যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করার প্রক্রিয়া এখানেই থেমে থাকেনি। ১৮৬৪ সালে নতুন করে উত্তেজনা তৈরি হল যখন প্রস্তাব আসে নতুন এক আইনের, Hackney Carriage Act of 1864। এই আইনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল পালকি এবং ঘোড়ার গাড়ির নথিভুক্তিকরণ, নম্বর প্লেট লাগানো, গাড়িগুলিকে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় শ্রেণিতে ভাগ করা, নির্দিষ্ট ভাড়া ও যাত্রী, এবং নির্দিষ্ট গতিবেগে গাড়ি চালানো। এই আইনের ফলে যে তাঁদের বিশেষ ক্ষতি হবে তা খুব বুঝতে পেরেছিলেন পালকি বাহকরা। আইন চালু হওয়ার দু’দিন আগে, ১৮৬৪-র ২৬ ফেব্রুয়ারি, কলকাতার বেহারারা ধর্মঘটের ডাক দেন। সরকারি এক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয় এই আন্দোলন সংগঠনের কৌশল: ‘The movement originated in the Chattawallah Gully, north end of Chitpore Road. In the course of a few hours, that very night a circular, scratched upon bits of palm leaves, was received in every palankeen stand in the town and suburbs, and the next morning not a single palankeen was to be had.’
কিন্তু সরকারের চাতুরিতে এই আন্দোলন বেশিদূর দানা বাঁধতে পারেনি। বেহারাদের দাবির বিপরীতে ছ্যাকরা গাড়ির মালিক আর চালকদের সঙ্গে বোঝাপড়া করে ফেলে তারা। মার্চ মাসের প্রথম আর দ্বিতীয় দিনের ভোরবেলা সরকারের কর্তা নিজে চলে যান ওয়াটারলু স্ট্রিট, ওয়েলেসলি স্ট্রিট, উড স্ট্রিট, সাউথ কলিঙ্গা স্ট্রিট, থিয়েটার রোড, আর ক্যামাক স্ট্রিটের আস্তাবলগুলিতে মালিকদের সঙ্গে কথা বলতে। এইসব মালিকরাই শহরের গাড়িগুলি নিয়ন্ত্রণ করতেন। তাঁদের সঙ্গে সরকার ঠিক কী চুক্তি করেছিল, তা জানা যায় না কিন্তু এই মালিকরা সিদ্ধান্ত নেন যে, পালকি বেহারাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাঁরা ধর্মঘট করবে না, নতুন আইন মোতাবেক গাড়ি চালানো হবে। বলা বাহুল্য, বেহারাদের কর্ম বিরতির সময়ে ঘোড়ার গাড়িগুলি বিশেষ রকম লাভ করেছিল।
তবে এই চাপান-উতোর চলতেই থাকে। কর ফাঁকি দেওয়া, বেশি যাত্রী নেওয়া, ভুল নম্বর প্লেট লাগানো, বা অন্য উপায় বের করতে সবসময়েই ফন্দিফিকির খুঁজত বেহারার দল। ১৮৭৩-’৭৪ সালে হুগলির ওপর ঝুলন্ত ব্রিজ তৈরি হয়। বেশ কিছু পালকি আর গাড়ি হাওড়ায় গিয়ে নিজেদের নাম নথিভুক্ত করিয়ে নেয়। কলকাতায় রেজিস্ট্রেশনের দর ছিল ৪ টাকা, আর হাওড়ায় মাত্র ১ টাকা। এই পালকি বা গাড়ি দিব্যি হাওড়া-কলকাতা যাতায়াত করত, পুলিশের বিশেষ কিছু করার ছিল না। শহরের অন্যান্য গাড়ি-ঘোড়াও যে অনেক সময়েই নিয়মের তোয়াক্কা করত না, তা বোঝা যায় পুলিশের খাতায় ‘অপরাধের’ সংখ্যা দেখলে। ১৮৭১-এ ছিল ৯৪৩, ১৮৮৬-তে ১৮২৩, আর ১৮৯২-তে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩২১৯-এ। ১৮৬৪ সালের আইন অনুসারে, সবরকম নিয়মই ভঙ্গ করে থাকত এই পালকি আর ছ্যাকরা গাড়িগুলি। গোটা পর্ব জুড়ে ঔপনিবেশিক সরকার বারবার টের পেয়েছিল যে কলকাতার রাস্তা নিয়ন্ত্রণ সহজ ছিল না।
ঋণস্বীকার: Sumanta Banerjee, The Wicked City: Crime and Punishment in Colonial Calcutta (2009)
…কলিকথা–র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ২৭: কোনটা কলকাতা, কোনটা নয়!
পর্ব ২৬: দ্বীপের মতো করেই যেন গড়ে তোলা হয়েছিল কলকাতাকে
পর্ব ২৫: কালো ভিক্টোরিয়া ও থমথমে কলকাতা
পর্ব ২৪: ঘোড়ার কলকাতা: ট্রাম থেকে রেসের মাঠ
পর্ব ২৩: গোলদীঘি গণ আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল হিসেবে জেগে উঠেছিল স্বদেশি সময়ে
পর্ব ২২: স্মৃতিদের এক বিশাল সমাধিক্ষেত্র
পর্ব ২১: কলকাতার কেল্লা এবং ময়দানি মতবিরোধ
পর্ব ২০: সঙের গানে শতবর্ষের পুরনো কলকাতা
পর্ব ১৯: দেশভাগ ও উদ্বাস্তু মানুষদের শিয়ালদা স্টেশন
পর্ব ১৮: কলের গাড়ি ও কলকাতার নিত্যযাত্রীরা
পর্ব ১৭: বাবুদের শহর যেভাবে বদলে গেল আবেগের শহরে
পর্ব ১৬: ঘর-বন্দি হয়েও নাগরিক কলকাতার স্বাদ
পর্ব ১৫: গৃহভৃত্যর বেশিরভাগই ছিলেন পুরুষ, দু’দশকে বদলে যায় পরিস্থিতি
পর্ব ১৪: স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা সিনেমায় চাকরির ইন্টারভিউয়ের দৃশ্য সেই সময়ের আয়না
পর্ব ১৩: দাঙ্গা ও দেশভাগ বদলে দিয়েছে কলকাতার পাড়া-বেপাড়ার ধারণা
পর্ব ১২: প্রাচীন কলকাতার বোর্ডিং হাউস
পর্ব ১১: সারা বিশ্বে শ্রমিক পাঠানোর ডিপো ছিল এই কলকাতায়
পর্ব ১০: কলকাতার যানবাহনের ভোলবদল ও অবুঝ পথচারী
পর্ব ৯: বৃষ্টি নিয়ে জুয়া খেলা আইন করে বন্ধ করতে হয়েছিল উনিশ শতকের কলকাতায়
পর্ব ৮: ধর্মতলা নয়, ময়দানই ছিল নিউ মার্কেট গড়ে তোলার প্রথম পছন্দ
পর্ব ৭: সেকালের কলকাতায় বাঙালি বড়মানুষের ঠাঁটবাটের নিদর্শন ছিল নিজের নামে বাজার প্রতিষ্ঠা করা
পর্ব ৬: কলকাতার বহিরঙ্গ একুশ শতকের, কিন্তু উনিশ-বিশ শতকের অসহিষ্ণুতা আমরা কি এড়াতে পেরেছি?
পর্ব ৫: কলকাতা শহর পরিকল্পনাহীনভাবে বেড়ে উঠেছে, একথার কোনও বিশেষ ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই
পর্ব ৪: ঔপনিবেশিক নগর পরিকল্পনার বিরুদ্ধ মত প্রকাশ পেয়েছিল যখন প্লেগ ছড়াচ্ছিল কলকাতায়
পর্ব ৩: ঔপনিবেশিক কলকাতায় হোয়াইট টাউন-ব্ল্যাক টাউনের মধ্যে কোনও অলঙ্ঘনীয় সীমানা
পর্ব ২: ‘জল’ যেভাবে ‘জমি’ হল এ কলকাতায়
পর্ব ১: চেনা কলকাতাকে না পাল্টেই বদল সম্ভব, পথ দেখাতে পারে একটি বাতিল রিপোর্ট
১৯৩৭ সালে পিল কমিশন প্যালেস্তাইনে ধর্মের ভিত্তিতে ভূখণ্ড ভাগের প্রস্তাব দেয়। এটাও ভারতের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে গান্ধীজির পক্ষে মেনে নেওয়া অসম্ভব ছিল। কারণ এদেশেও তখন ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ অর্থাৎ ‘টু নেশন’ তত্ত্ব ধীরে ধীরে দানা বাঁধছে।