আগুনরঙা আকাশপটে কালো সিলহুয়েট গাছের নিচে বসে থাকা এক নারী। হাত দিয়ে সে যেন ঢাকতে চায় তার মুখমণ্ডল। আরও দেখি, সেই উপবিষ্ট ক্রন্দনরত নারীর ক্রোড়ে কালো কাপড়ে ঢাকা একটা শরীর। কী অর্থ এই ছবির, কী বলতে চায় এ ছবি? এ কি তবে মৃত সন্তানকে কোলে নিয়ে অসহায় জননীর বোবা কান্না? তাছাড়া আর কী-ই বা হতে পারে?
২৩.
রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবির বিষয়ে আমাদের একটা ধারণা আছে। তথাকথিত ভারতীয় চিত্রকলা থেকে একেবারে আলাদা। তাঁর নিজের ভাষায় ‘দলছুট’। তাঁর সময়কালে এমন ছবি আর কোনও শিল্পী আঁকেননি। আজকের দিনে দাঁড়িয়েও রবিঠাকুরের ছবি আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সম্পূর্ণ এক নতুন জগৎ মেলে ধরেছিল। ভাবনা আর প্রকাশের নিজস্বতা ছাড়াও আঙ্গিকের দিকটাও খেয়াল করে দেখার। প্রথাগত কোনও টেকনিকের মোহ নির্দ্বিধায় ছুড়ে ফেলেছিলেন তিনি। এমনকী, আজকের শিল্পীরা যে কথায় কথায় ছবির নির্মাণ প্রক্রিয়াকে ‘মিশ্র মাধ্যম’ বা ‘মিক্স মিডিয়া’ বলে থাকেন, এবং একাধিক চিত্রপদ্ধতিকে একত্রে একটি ছবিতে প্রয়োগ করতে চান– তার জনক রবীন্দ্রনাথ। আমাদের সামনে তিনিই প্রথম উদাহরণ– যার ছবিতে একইসঙ্গে সাধারণ কলমের কালি, পেলিক্যান পেন ইংক, প্যাস্টেল, জলরং ইত্যাদি একত্রে ব্যবহার হয়েছে। আঙ্গিকের দক্ষ নিপুণ ব্যবহার নয়, শিল্পীর অভিব্যক্তির প্রয়োজনে উঠে এসেছে উপকরণ। সীমাবদ্ধতাকে এমনভাবে ‘শৈলী’ হিসেবে গড়ে নিতে আর কেউ পেরেছেন বলে জানি না। তাই তাঁর ছবির ভাষা একেবারে অন্যের চেয়ে আলাদা।
চিত্রপটে ছড়ানো গভীর কালো থেকে উজ্জ্বল আলোকে এমনভাবে ফুটিয়ে তুলতে আমাদের আর কেউ পেরেছেন কি না, জানি না। সেই আশ্চর্য আলোক উদ্ভাসিত হয় নিসর্গচিত্রের সোনালি আভায়, বিচিত্র জান্তব আকারের গঠনে, ফিগারের দৃঢ় ধাতব পাতের মতো দ্বিমাত্রিক চরিত্রে, রঙের প্যালেটের স্বতন্ত্র বৈভবে, আবার কখনও-বা অনায়াস রেখার চলনে। এই স্টাইল, এই বৈশিষ্ট রবীন্দ্রচিত্রের চাবিকাঠি। একেবারে নিজস্ব তকমায় একান্ত ভঙ্গিমায় সে ‘রাবীন্দ্রিক’। শিল্পীর গোপন অনুভবের তুলিতে সে জারিত। দেখতে দেখতে দর্শকের সেই শৈলীকে চিনে নিতে পারে, সহজেই চিহ্নিত করতে পারে। কিন্তু এখানেই কি রবি ঠাকুরের ছবির শেষ কথা?
শিল্পীর নিজস্ব ভাবনার প্রধান আবরণ সরিয়েও এমন বেশ কিছু ছবি দেখতে পাই– যেগুলো একেবারে আলাদা মেজাজের। আঙ্গিকের দিক থেকে নয়, ভাবনার প্রেক্ষিত থেকে। এমনই কিছু ছবি যেন ঝলসে ওঠে চাবুকের মতো! মহারুদ্রের রাগী মেজাজের মতো আমাদের থমকে দাঁড় করিয়ে দেয় সেসব ছবি। নিদারুণ অপ্রস্তুতে ফেলে কবির সংযত সংহত আভিজাত্যের একেবারে উল্টোদিকে অবস্থান করে। কেমন সে ছবি? মনে মনে তারা কী ভাবনা লালন করে চলে?
প্রধানত একগুচ্ছ নারীপ্রতিমায় এমন আশ্চর্য উত্তেজনা ছড়িয়ে দেয়! এখানে সমগ্র চিত্রপট জুড়ে কেবল ডিম্বাকৃতি কোমল মুখমণ্ডলের মেয়েরা নেই, নেই তাদের আয়ত চোখের অনিমেষ দৃষ্টি। দর্শকের দিকে তাকিয়ে থাকা নীরব অব্যক্ত চাহনি নিয়ে ফুটে ওঠে না এদের মুখমণ্ডল! কপাল থেকে কপোলে গড়িয়ে পড়া মায়াবী আলোকের স্নিগ্ধ বিভা এখানে অনুপস্থিত। বরং বলতে হবে, সেসব হেলায় সরিয়ে এই একগুচ্ছ নারীপ্রতিমা সারা পট জুড়ে কী এক আন্দোলিত আহ্বানে উদ্বেল হয়ে ওঠে। কী বলতে চায় রবির ছবির সীমানা ছাড়িয়ে এই একদল নারীপ্রতিমা? ‘প্রতিমা’ শব্দটাও এখানে যেন বেমানান, তার স্নিগ্ধ ধ্বনিমাধুর্যে।
কীভাবে ব্যাখ্যা করব এদের? তাদের আকাশের দিকে উঁচু করে রাখা উদ্যত হাতে যে জ্বলে উঠতে চায় বিদ্রোহের আগুন? কীসের বিরুদ্ধে এ বিদ্রোহ? কখনও-বা দেখি দগদগে লাল আগুন ঝরানো পটের সামনে উদ্ধত দু’হাত তুলে তীব্র হাহাকারের আর্তি! আগুনের শিখার মতো জ্বলে ওঠা রঙের প্রেক্ষিতে ঘন কালো রঙে আঁকা সেই নারী-অবয়ব কোন চিত্রভাষা বয়ে আনে? অথবা সেই মেয়ে– যার নগ্নতাকে ছাপিয়ে উঠেছে উদ্যত বাহুর নিঃশব্দ চিৎকার, মুখের অভিব্যক্তিতে ঝলসে উঠেছে ক্রোধের প্রবল জিজ্ঞাসা। কী বলতে চায় সেই মেয়েটি? তার উদ্যত বাহুভঙ্গিমায় কীসের প্রতিবাদ?
এ ছবি আঁকার সময় রবীন্দ্রনাথের মনের মধ্যে কী তোলপাড় চলেছে, কোন ভাবনায় তিনি এমন উদ্বিগ্ন– সেকথা জানতে ইচ্ছে করে আমাদের। এখানেই শেষ নয়। অন্য এক ছবির দিকে ভালো চোখ রাখলে দেখি, এখানেও সেই আগুনরঙা আকাশপটে কালো সিলহুয়েট গাছের নিচে বসে থাকা এক নারী। হাত দিয়ে সে যেন ঢাকতে চায় তার মুখমণ্ডল। আরও দেখি, সেই উপবিষ্ট ক্রন্দনরত নারীর ক্রোড়ে কালো কাপড়ে ঢাকা একটা শরীর। কী অর্থ এই ছবির, কী বলতে চায় এ ছবি? এ কি তবে মৃত সন্তানকে কোলে নিয়ে অসহায় জননীর বোবা কান্না? তাছাড়া আর কী-ই বা হতে পারে?
রবীন্দ্রনাথ আমাদের বারবার বলেন, ছবিটা দেখার জিনিস, চেয়ে দেখো ছবিটা ‘ছবি’ হয়ে উঠেছে কি না। সে কোনও উপদেশ দেয় না, কোনও নৈতিক বাণী বয়ে আনে না, ধর্মকথা বলে না, শুধু বলে– চেয়ে দ্যাখো। সে বলে ‘অয়ম অহম ভো, এই যে আমি এই’। কিন্তু এই ছবির সিরিজ আমাদের শুধু চেয়ে থাকতে দেয় না, ছবিটা ছবি হয়ে ওঠার বাইরে সে আরও অনেক কথা বলে। কেবল রং-রেখা-আকারের বিন্যাসে চিত্রপটের দ্বিমাত্রিক দৃশ্যকাব্য এরা নয়, এদের অন্দরের ভাষা আমাদের চিত্তকে ঝাঁকিয়ে দেয়, মনকে আন্দোলিত করে। কেন এমন ছবি আঁকলেন রবীন্দ্রনাথ? বিশ্বময় পূবের বাণী প্রচার করে চলা প্রাচ্যের প্রফেট– তিনি কোন বেদনায়, কোন প্রতিবাদে রং-তুলিকে এমন আগুনের মশাল করে তুললেন? তাঁর গহন অন্দরমহলে কীসের প্রতিবাদ এমন উচ্চকিত হতে চায়? কোন যন্ত্রণা তাঁকে এমন করে কুরে কুরে খায়? ছবিঠাকুরের এই দলছুট দেখতে দেখতে এসব কথাই বারবার মনে হচ্ছে। বিশেষ করে এই সময়ে, এই মুহূর্তে যখন দেশজুড়ে প্রতিবাদের ভাষা আছড়ে পড়েছে। সেইসব ভেবেই রবি ঠাকুরের একগুচ্ছ চমকে ওঠা ছবি পাঠকের সামনে মেলে দিতে ইচ্ছে হল– প্রায় শতবর্ষ অতিক্রান্ত একরাশ ছবি। যেগুলো রবিঠাকুরের প্রতিবাদের ভাষা, ছবিঠাকুরের বিদ্রোহের ছবি।
লেখার সঙ্গে ব্যবহৃত প্রতিটি ছবিই রবীন্দ্রনাথের।
…পড়ুন ছবিঠাকুর-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ২১: চিত্রকলার বোধ যত গাঢ়তর হচ্ছে, ততই রবীন্দ্রনাথ চোখের দেখার ওপরে ভরসা করছেন
পর্ব ২০: ছবি বুঝতে হলে ‘দেখবার চোখ’-এর সঙ্গে তাকে বোঝার ‘অনেক দিনের অভ্যেস’
পর্ব ১৯: ছবি-আঁকিয়ে রবীন্দ্রনাথ কোন রংকে প্রাধান্য দিয়েছেন?
পর্ব ১৮: ছবি আঁকিয়ে রবিঠাকুরও সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন
পর্ব ১৭: রবীন্দ্রনাথের নারী মুখমণ্ডলের সিরিজ কি কাদম্বরী দেবীর স্মৃতিজাত?
পর্ব ১৬: ট্যাক্স না দেওয়ায় রবীন্দ্রনাথের ছবি আটক করেছিল কাস্টমস হাউস
পর্ব ১৫: বাইরে সংযত রবীন্দ্রনাথ, ক্যানভাসে যন্ত্রণাদগ্ধ ছবিঠাকুর
পর্ব ১৪: অমৃতা শেরগিলের আঁকা মেয়েদের বিষণ্ণ অভিব্যক্তি কি ছবিঠাকুরের প্রভাব?
পর্ব ১৩: আত্মপ্রতিকৃতির মধ্য দিয়ে নতুন করে জন্ম নিচ্ছিলেন রবীন্দ্রনাথ
পর্ব ১২: আমেরিকায় কে এগিয়ে ছিলেন? ছবিঠাকুর না কবিঠাকুর?
পর্ব ১১: নন্দলাল ভেবেছিলেন, হাত-পায়ের দুয়েকটা ড্রয়িং এঁকে দিলে গুরুদেবের হয়তো সুবিধে হবে
পর্ব ১০: ১০টি নগ্ন পুরুষ স্থান পেয়েছিল রবীন্দ্র-ক্যানভাসে
পর্ব ৯: নিরাবরণ নারী অবয়ব আঁকায় রবিঠাকুরের সংকোচ ছিল না
পর্ব ৮: ওকাম্পোর উদ্যোগে প্যারিসে আর্টিস্ট হিসেবে নিজেকে যাচাই করেছিলেন রবি ঠাকুর
পর্ব ৭: শেষ পর্যন্ত কি মনের মতো স্টুডিও গড়ে তুলতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ?
পর্ব ৬: রবীন্দ্র চিত্রকলার নেপথ্য কারিগর কি রানী চন্দ?
পর্ব ৫: ছবি আঁকার প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ পরলোকগত প্রিয়জনদের মতামত চেয়েছেন
পর্ব ৪: প্রথম ছবি পত্রিকায় প্রকাশ পাওয়ামাত্র শুরু হয়েছিল বিদ্রুপ
পর্ব ৩: ঠাকুরবাড়ির ‘হেঁয়ালি খাতা’য় রয়েছে রবিঠাকুরের প্রথম দিকের ছবির সম্ভাব্য হদিশ
পর্ব ২: রবীন্দ্রনাথের আঁকা প্রথম ছবিটি আমরা কি পেয়েছি?
পর্ব ১: অতি সাধারণ কাগজ আর লেখার কলমের ধাক্কাধাক্কিতে গড়ে উঠতে লাগল রবিঠাকুরের ছবি