মাঞ্জা আর মোমসুতোর দৈর্ঘ্যের ব্যালেন্স এদিক-ওদিক হলেই ভোকাট্টা– দ্রাবিড় এই ব্যালেন্সের কমল গুহ। পিছনে দাঁড়িয়ে যে বুঝতে পারছিল সবটুকু, কেবল চাইছিল, কোনও এক মহানায়ক এসে সুতোটা ধরুক– তিনি কেবল পিছন থেকে লড়ে যাবেন। নিঃশব্দে। কিন্তু ওই যে নিয়তি– কাকে যে কোথায় টেনে নিয়ে যায়; সে সুতো শেষ অবধি এলও দ্রাবিড়ের হাতে।
টালমাটাল হাওয়ায় দেদার দুলছে ঘুড়িখানা। সুতোর ঢিল আর নিক্তি মাপা হ্যাঁচকা টানে সামাল দিয়ে চলেছে দুঁদে ঘুড়িয়াল– বিকেলের আকাশের নীল গাঢ় হয়ে এলে মাঞ্জার প্যাঁচ কেটে যাওয়ার অপেক্ষা ফুরিয়ে আসে; এমন ছবিই রং-পেনসিলে আঁকে মুগ্ধ কিশোর। চাঁদোয়ার মতো ঘুড়িভরা আকাশ, মনখারাপিয়া ছাদ, ভ্রু-কুঁচকে সুতো ধরে থাকা বালকের সঙ্গেই সে ছবির এককোণে চিরকাল ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে একজন, হাতে লাটাই, চোখে একমুঠো অপেক্ষা যারা সেভাবে সুতোয় হাত দিতে পারেনি কোনও দিন, তিনটানে পেটকাটি ঘুড়ি বেড়ে ফেলার কারসাজি রপ্ত করতে পারেনি ততটা, প্যাঁচ খেলায় দড় নয়, কয়েকবার চেষ্টা করলেও যাদের চাঁদিয়াল বারবার আটকে গিয়েছে নারকেল গাছের মাথায়– তাদেরই কপালে জুটেছে ঢাউস লাটাই।
সরাসরি লড়াইয়ের আকাশে যারা থেকেও নেই। অথচ তার হাতেই ধরা আছে খেলার স্নায়ু। মাঝে মধ্যে ঘুড়ির সুতো ছেড়ে কেবল লাটাইয়ের টানেই যেমন ব্যালেন্স করে ওড়ানো হয় ঘুড়িখানা– তেমনই। তেমনই, যেমনটা রাহুল দ্রাবিড়।
মুলতান। ২০০৭। সেই যে ইনিংস ডিক্লেয়ার দিলেন, লোকে ভাবল– এ ছেলে সচিনের সাফল্যে হিংসায় জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। গ্রেগ চ্যাপেল অধ্যায়। সৌরভের হাতে ঘুড়ির সুতো। মিডিয়ার সমস্ত লাইমলাইট নিজের দিকে টেনে নেওয়া বঙ্গতনয়ের ঠিক পিছনে, নিঃশব্দে লাটাই হাতে দ্রাবিড়– বাঙালি ভাবল নিশ্চিত লাটাইয়ের কোথাও সুতো কাটা, কিংবা নায়কের পিছনে থাকা ওই গোবেচারা মুখের ক্যামোফ্লেজে নিজেকে আড়াল করা দ্রাবিড়ই আসল খলনায়ক।
বেপাড়ার ছেলে লাটাই ধরতে এসে হাত শক্ত করে দিলে, কিংবা সুতো কেটে দিলে যে চড়-থাপ্পড় বরাদ্দ– সে ভাগ তো পেলেন দ্রাবিড়ও। ২০০৩ অ্যাডিলেড তখন বিস্মৃতপ্রায়, ফ্যাকাসে হয়ে আসছে ডারবানে ডোনাল্ডের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কোনও শীর্ণকায় তরুণের সামান্য প্রতিরোধ– কেবল লাটাইয়ের সুতো ছেড়ে চলেছেন দ্রাবিড়, রাজনীতির হ্যাঁচকা টানে অনেকটা সুতো মাটিতে লুটিয়ে গেলে জড়িয়ে যাচ্ছে মাঝে মাঝে, কখনও এমন সময় আসে; রাজনীতির ময়দান থেকে, কোলাহল থেকে দূরে থাকা ঝামেলাহীন মানুষও এসে পড়ে মঞ্চে, সমস্ত স্পটলাইটের আলো এসে পড়ে তার ওপর– সন্দেহের চোখ কুরে খায়– সে অস্বস্তির ভেতরেই তখন শুরু করে নিজস্ব জাদুখেলা; স্বভাববিরুদ্ধভাবে হাত নাড়তে হয় তাকেও। এ যেন ‘গডফাদার’ ছবিতে গডফাদার ডন কার্লেওনের ছোট ছেলে মাইকেল কর্লিওন– ক্ষমতার লড়াইয়ে কোথাও না থাকা মানুষ হয়েও যে এসে পড়বে এই যুদ্ধের মঞ্চের একেবারে কেন্দ্রে। পরিস্থিতি। সময়। সব কিছু হিসেব রেখে দেয়– রাহুল জানেন।
২০০৭ বিশ্বকাপে ওই ভয়াবহ ব্যর্থতার পর ফের তিনি লাটাই হাতে। পিছনে। পানসে মুখে। যেন, নিজের কমফোর্ট জোনে ফিরছেন। অথচ, সময়েরও তো কিছু ফিরিয়ে দেওয়ার থাকে। দ্রাবিড়ের কোচ হয়ে ফেরা যেন অনেকটা সেই দায়েই। ভারতের তরুণ ক্রিকেটারদের নিয়ে দ্রাবিড় দেখিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর ক্ষমতা, যা ক্রিকেটার জীবনেও তার সপক্ষে থেকেছে বরাবর– কিন্তু সমস্যা হল দ্রাবিড়ের ওপর জনতার অধিনায়কত্বের ভরসা, যা টুকরো হয়েছিল ১৭ বছর আগে, তা কীভাবে ফিরে আসবে ফের? আমেদাবাদে ওই সোনায় মোড়া বিশ্বকাপ পারফরম্যান্সের সলিল সমাধির পর তো লাটাই হাতে দ্রাবিড়কেও ফেলা হল স্ক্যানারের নিচে, সন্দেহ-অবিশ্বাস– নিশ্চিত কোনও গোলমাল আছে। ঘুড়ির গা বেয়ে নেমে আসা মাঞ্জাসুতোর ওড়া শেষ হলে লাটাই থেকে বনবন করে বেরিয়ে আসে সাদা মোমসুতো। মাঞ্জা আর মোমসুতোর দৈর্ঘ্যের ব্যালেন্স এদিক-ওদিক হলেই ভোকাট্টা– দ্রাবিড় এই ব্যালেন্সের কমল গুহ। পিছনে দাঁড়িয়ে যে বুঝতে পারছিল সবটুকু, কেবল চাইছিল, কোনও এক মহানায়ক এসে সুতোটা ধরুক– তিনি কেবল পিছন থেকে লড়ে যাবেন। নিঃশব্দে। কিন্তু ওই যে নিয়তি– কাকে যে কোথায় টেনে নিয়ে যায়; সে সুতো শেষ অবধি এলও দ্রাবিড়ের হাতে। থতমত দ্রাবিড়, এই শেষবার ঢিল দিয়ে, হাওয়ায় ভাসিয়ে, প্যাঁচের টান বুঝে সোজা ওপরে তুললেন সুতো– যে নায়ক কিংবা মহানায়কের প্রত্যাশা তিনি করেছেন এত গুলো বছর, সচিনের আড়ালে ব্যাটিং অর্ডারের এক পাশে থেকে কিংবা সৌরভের ক্যাপ্টেন্সির ঝাঁঝের পিছনে বন্ধু হয়ে থেকে– চিরভরসায় তিনি করে যেতে চেয়েছিলেন– সে ভূমিকায় আপাতত যবনিকা। সময়ের লাটাই হাতে এবার জয়ীর ভূমিকায় তিনি। এ ভূমিকাতেও সমানে লড়ে যাওয়ায় তিনি কি স্বাচ্ছন্দ্য? নাহ! কারণ বিশ্বজয়ী কোচ হিসেবে তার মিডিয়ার সামনে আসার পরিমাণ নগণ্য, ব্যক্তিগত পাবলিক রিলেশনের তাগিদ পাতলা, তিনি যেন বিশ্বকর্মা পুজোর ভরা আকাশ খালি করে দিয়েও নিঃশব্দে সুতো ফেলে লাটাই ধরে পিছনেই থেকে যেতে চান এখনও!
বেপাড়ার লাটাইধারীর মতো ফ্যাকাসে দ্রাবিড়, আমাদের ইচ্ছের চাঁদমারি ভেদ করে যাওয়া দ্রাবিড়, অপেক্ষার সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতানো এই সমস্ত দ্রাবিড়ীয় চরিত্র কত কত নির্মাণের অন্তরাত্মাকে যে আগলে আগলে রাখে; আকাশের লড়াইতে তারা কেবলই মাটির প্রতিনিধি যেন, সমস্ত উড়ান জমিয়ে রাখছে লাটাইতে, কখনও ছাড়ছে, গোটাচ্ছে, একবার মুখ তুলে আকাশ দেখে নিয়ে ফের মাটির দিকেই তাকিয়ে থাকছে হাজার হাজার বছর…
………………………. পড়ুন ‘হাতে লাটাই’ ………………………..
শুদ্ধসত্ত্ব ঘোষ-এর লেখা: সুতোর দায়িত্বে অর্জুন বা যুধিষ্ঠির থাকলেও মহাভারতের লাটাইধারী কিন্তু কৃষ্ণই