রবীন্দ্রনাথের শেষ আঁকা ছবি? সেইটে আমরা চিহ্নিত করতে পেরেছি কি? সে বড় একটা সহজ কাজ নয়। ছবির ধরন-ধারণ দেখে তা আন্দাজ করে নিতে হয়। তবে এটুকু বোঝা যায়, শেষ বেলায় তাঁর ছবি অত্যন্ত সহজ সাদামাটা রেখায় গড়ে উঠছিল। একেবারে আতিশয্যহীন ছবি, এমনকী, রংও সেখানে অনুপস্থিত। কেবল বা প্যাস্টেলের সামান্য কয়েকটা আঁচড়ে, দ্রুত রেখার টানটোনে তৈরি হয়েছে ছবি। ছবি না বলে তাকে অঙ্কন বা ড্রয়িং বলাই সংগত। এ এক ধরনের রানিং-স্কেচ। সাদা কাগজে, খাতা পাতায় যা ফুটিয়ে তুলেছে চিত্রগত অবয়বের সংক্ষিপ্ত আভাস।
২৬.
জীবনের শেষপ্রান্তে লেখা রবীন্দ্রনাথের কবিতাগুচ্ছ আমাদের তেমন অজানা নয়। সে প্রসঙ্গ উঠলে ‘আরোগ্য’ বা ‘শেষ লেখা’র কবিতারা আমাদের চোখের সামনে ভিড় এসে দাঁড়ায়। এমনকী, ‘শেষ লেখা’র সেই ১৫ নম্বর কবিতা– ‘তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি/ বিচিত্র ছলনাজালে,/ হে ছলনামইয়ী’– যা রবীন্দ্ররচনাবলি নির্দেশিত রবি ঠাকুরের ‘সর্বশেষ কবিতা’ বলে জানি– তা আমরা অনেকেই স্মৃতি থেকে গড়গড় করে মুখস্থ বলেতে পারি। মৃত্যুর মাত্র সাত দিন আগে লেখা এ কবিতা আমাদের বুকের মধ্যে কি এক অদৃশ্য ঘা দিয়ে যায়!
সেদিন জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ৩০ জুলাই সকাল সাড়ে নটায় এমন এক আশ্চর্য কবিতা লেখার কিছু পরেই শান্তিনিকেতনে অসুস্থ প্রতিমা দেবীকে লেখা কবির শেষ চিঠি অনুলিখন করেছিলেন রানী চন্দ। সে চিঠির লেখার নিচে কলমের কাঁপা আঙুলের আঁচড়ে পড়েছে কবির শেষ স্বাক্ষর ‘বাবামশায়’– সেও আমাদের অজানা নয়। কিন্তু তাঁর শেষ আঁকা ছবি? সেইটে আমরা চিহ্নিত করতে পেরেছি কি? সে বড় একটা সহজ কাজ নয়। ছবির ধরন-ধারণ দেখে তা আন্দাজ করে নিতে হয়। তবে এটুকু বোঝা যায়, শেষ বেলায় তাঁর ছবি অত্যন্ত সহজ সাদামাটা রেখায় গড়ে উঠছিল। একেবারে আতিশয্যহীন ছবি, এমনকী, রংও সেখানে অনুপস্থিত। কেবল বা প্যাস্টেলের সামান্য কয়েকটা আঁচড়ে, দ্রুত রেখার টানটোনে তৈরি হয়েছে ছবি। ছবি না বলে তাকে অঙ্কন বা ড্রয়িং বলাই সংগত। এ এক ধরনের রানিং-স্কেচ। সাদা কাগজে, খাতার পাতায় যা ফুটিয়ে তুলেছে চিত্রগত অবয়বের সংক্ষিপ্ত আভাস। ওই যে রবি ঠাকুর বলেন, ‘সহজ কথা লিখতে আমায় কহ যে/ সহজ কথা যায় না লেখা সহজে’– এ বুঝি সেই অভিব্যক্তির ছবি, সহজ করে বলতে চাওয়া রেখা আর আকারের চিত্রভাষ। খেয়াল করে দেখলে, রেখার এমন চলন আমরা দেখতে পাই ‘খাপছাড়া’ বা ‘সে’ পর্ব থেকে, যা আলাদা করে নজরে কাড়ে। নিজের লেখার সঙ্গে নিজের ছবি আঁকার সেই সময়টা উনিশশো ছত্রিশ-সাঁইত্রিশ সাল। প্রথমে কথা ছিল ‘খাপছাড়া’র ছবি আঁকবেন নন্দলাল। তারপর সিদ্ধান্তের বদল হয়, ঠিক হয় এর ছবি আঁকবেন রবি ঠাকুর স্বয়ং। এখানে বলা নিষ্প্রয়োজন সে ছিল একেবারে সঠিক সিদ্ধান্ত। ‘খাপছাড়া’র ওই ছবি আর কারও হাত থেকে বেরতে পারা সম্ভব ছিল না। যার ‘ঠিকানা নেই আগুপিছুর,/ কিছুর সঙ্গে যোগ না কিছুর,/ ক্ষণকালের ভোজবাজির’ সেই ‘ঠাট্টা’ রবি ঠাকুর ছাড়া আর কেই বা করতে পারতেন?
তারপর জীবনের একেবারে প্রান্তে ১৯৪০ নাগাদ রবিঠাকুরের ছবিতে রেখার অনায়াস চলনের সঙ্গে যে ক্ষিপ্র এলোমেলো আঁচড়, তা যেন ছবিকে অন্যদিকে টেনে এনেছে। একটু একটু করে পাল্টেছে তাঁর ছবির ভাবনা আর প্রকাশিত চেহারা। সময়ের ক্রম অনুসারে এইসব ছবিকে একেবারে পর পর সাজিয়ে তালিকা তৈরি করতে পারা বেশ কঠিন। কারণ অধিকাংশ ছবিতে সম্পূর্ণ তারিখ নেই। কখনও শুধু সাল লেখা হয়েছে কখনও-বা কেবল স্বাক্ষর। যথাযথ তারিখের অভাবে সময়টা কিছু হাতে রেখে আন্দাজে বুঝে নিতে হয়। ১৯৪০ বা তার আশপাশে আঁকা কয়েকটা ছবি খুঁটিয়ে দেখা যাক। ওই বছরের এপ্রিলে তিনি মংপুতে মৈত্রেয়ী দেবীর আতিথ্যে বেশ কিছুদিন কাটিয়েছেন। তবে ছবি আঁকায় ছেদ পড়েনি সেখানেও। মৈত্রেয়ীর কাছে কবি গেলে অনেক সময় সেখানে চলে আসতেন মৈত্রেয়ীর মাসি সুব্রতা, তিনিই মৈত্রেয়ী দেবীর শ্রীমতী মাসি। তিনি বোম্বের জে জে স্কুল অফ আর্ট-এ ছবি আঁকা শিখেছেন। মাসি মংপুতে এসে আর্টিস্ট রবিঠাকুরের সান্নিধ্যে কয়েকটা দিন কাটিয়ে যেতে ভালোবাসতেন। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ভারতীয় সিনেমার অন্যতম দিকপাল, বম্বে টকিজের কর্ণধার হিমাংশু রায় ছিলেন মৈত্রেয়ীর মাতুল। তিনি ছিলেন শান্তিনিকেতনের ছাত্র। অন্যদিকে তাঁর স্ত্রী, ভারতীয় চলচ্চিত্রের সে যুগের হার্টথ্রব দেবীকারানী আবার সম্পর্কে রবিঠাকুরের নাতনী স্থানীয়া। তাই মাঝে মাঝে মনে হয়, সাহিত্য বাদ দিলেও চিত্র আর চলচ্চিত্র এই দুটোই সেখানে দৌড়ে সমানভাবে শামিল।
ছবির প্রসঙ্গে আসি। একবার এই মংপুতেই রবীন্দ্রনাথ আর সুব্রতা দেবী যৌথভাবে একটি তেল রঙের ছবি এঁকেছিলেন। শুরুতে রবীন্দ্রনাথ কিছুতেই অয়েল পেন্টিং করতে রাজি নন, তাঁর বরাবর মনে হয়েছে, তেল রঙের মাধ্যমটা কোনওভাবেই তাঁর ছবি আঁকার পক্ষে উপযুক্ত নয়। তারপর অনেক জোরাজুরি অনেক সাধ্যসাধনায় নিমরাজি হয়ে উভয়ে মিলে শেষ করেছিলেন সে ছবি। এক অবগুণ্ঠিতা নারীপ্রতিমা। তেল রঙে রবীন্দ্রনাথ একেবারেই ছবি আঁকেননি। তাঁর যে সামান্য দুয়েকটি তেল রঙে আঁকা ছবির খবর পাওয়া যায়, এই যৌথভাবে রচিত ছবিটি তার মধ্যে অন্যতম। আরেকটি ছবি আছে রবীন্দ্রভারতী সংগ্রহে।
মংপুতে আঁকা কয়েকটা ছবির প্রসঙ্গ মৈত্রেয়ী তাঁর ‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথ’ বইতে লিখে রেখেছেন। সেখানে ছবির হদিশ পাওয়া যায় না, তবে গল্প-রসিকতায় মোড়া ছবি আঁকার অসাধারণ আবহ সেখানে বেশ কয়েকবার ফুটে উঠেছে। তেমনই একটা ঘটনার এখানে কথা বলা যাক। রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজের কিছু ক্রিয়েটিভ রান্নার নানারকম রেসিপির কথা বলতে গিয়ে মৈত্রেয়ীকে বলছেন, ‘যাক গে এসব কথা বলে তোমাকে আর চঞ্চল করে দেব না। তার চেয়ে তুমি চুপ ক’রে বোসো, গোলমাল করো না,– হ্যাঁ তোমার ছবি আঁকবো; তবে সে দেখলে কেউ সন্দেহও করবে না যে তোমার। সে হয়তো ঠিক দেখাবে সুধাকান্তর মতো’। এখানে বলে রাখা ভালো, সুধাকান্ত রায়চৌধুরী সেই পর্বে কবির সঙ্গে মংপুতে আসা বিরল-কেশ সেক্রেটারি। তাঁর মতো দেখালে সে মৈত্রেয়ী দেবীর পক্ষে সে যে মোটেও গৌরবের হবে না, তাই এই নির্মমঠাট্টা। যাই হোক–
‘ছবি আঁকা চলছে। গৃহস্বামী এলেন।
‘দেখ ডাক্তার, তোমার গৃহিণী এমন কৃপণ। কলম চাইলুম ছবি আঁকব বলে, জানে তাতে কলম খারাপ হয়ে যায়, তাই চট করে নিজেরটা সরিয়ে আমারটা দিলে,– যাক শত্রু পরে পরে’। ডাক্তার তাড়াতাড়ি নিজের কলম এগিয়ে দিলেন।
‘কৃপণতা মোটেই নয়, আমার সরু নিবে আপনার ছবি আঁকা চলত না’। নতুন কলমটা নিয়েও অসুবিধা হচ্ছিল,– আমি বললুম– ‘আপনি বাঁকা করে ধরেছেন, সোজা করে ধরুন তাহলে মোটা হবে’, বলে হাতের কলমটা ঘুরিয়ে দিলুম। উনি ভীষণ মজার মুখ করে আমাদের দিকে চাইলেন, বললেন,– ‘বাবা, আজ পঁচাত্তর বছর কলম ধরছি, আমায় কলম ধরতে শেখাবে এখনও? আর কি আমার উন্নতির কিছু আশা আছে? এ জন্মের মত কি হয়ে যায় নি’? তারপর সবাই মিলে উচ্চৈঃস্বরে হাসি’।
এই হচ্ছে রবিঠাকুরের ছবি আঁকার সরস সজীব পরিবেশ। মৈত্রেয়ী দেবীর এই প্রতিকৃতি আমাদের হাতে আসেনি, তবে মংপুতেই এর বছর দুয়েক আগে আঁকা একটি নারী মুখ দেখে মনে হয়, সে তাঁরই প্রতিকৃতি। সে ছবিটা এখানে রইল, রইল মংপুতে আঁকা কবির আরও কয়েকটা ছবি। রইল আরও পরে শান্তিনিকেতনে আঁকা দুয়েকটা ছবির নমুনা– একেবারে অসুস্থ অবস্থায় বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাঙা রেখার কয়েকটা ড্রয়িং। সেখানে ছবির সঙ্গে লিখে রেখেছেন মজাদার মন্তব্য। সে ছবির কোনওটায় লেখা ‘উত্থান পতন চলছে’ আবার কোথাও– ‘বিছানায় শুয়ে শুয়ে ছেলেমানুষি করা গেল’ ইত্যাদি। এগুলো সবই ১৯৪১-এর জুন মাসের ছবি। তবে রবি ঠাকুরের তারিখযুক্ত শেষ ছবি বোধহয় ১৯ জুন ১৯৪১, এখানে কোনও মন্তব্য নেই। কাগজের পাতার ওপরের দিকে একটা গাছ আর তার পাশে একজন মানুষের মূর্তি। গাঢ় বাদামি পেনসিলের রেখায় আবছায়া সে অবয়ব, সঙ্গে কালো কালির কলমে কাঁপা অক্ষরে লেখা স্বাক্ষর আর তারিখ। বোধহয় এইটিই তাঁর শেষ ছবি। পরের মাসে ২৫ জুলাই অপারেশনের জন্য তাঁকে শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতায় চলে যেতে হয়।
…পড়ুন ছবিঠাকুর-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ২৫: রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবি সংরক্ষণ করা সহজ নয়
পর্ব ২৪: জাল ছবি ও রবীন্দ্র-ব্যবসা
পর্ব ২৩: ছবি-আঁকিয়ে রবীন্দ্রনাথের বিদ্রোহের ছবি
পর্ব ২২: চিত্রকলার বোধ যত গাঢ়তর হচ্ছে, ততই রবীন্দ্রনাথ চোখের দেখার ওপরে ভরসা করছেন
পর্ব ২১: কলাভবনে নন্দলালের শিল্পচিন্তার প্রতি কি সম্পূর্ণ আস্থা রাখতে পারছিলেন না রবীন্দ্রনাথ?
পর্ব ২০: ছবি বুঝতে হলে ‘দেখবার চোখ’-এর সঙ্গে তাকে বোঝার ‘অনেক দিনের অভ্যেস’
পর্ব ১৯: ছবি-আঁকিয়ে রবীন্দ্রনাথ কোন রংকে প্রাধান্য দিয়েছেন?
পর্ব ১৮: ছবি আঁকিয়ে রবিঠাকুরও সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন
পর্ব ১৭: রবীন্দ্রনাথের নারী মুখমণ্ডলের সিরিজ কি কাদম্বরী দেবীর স্মৃতিজাত?
পর্ব ১৬: ট্যাক্স না দেওয়ায় রবীন্দ্রনাথের ছবি আটক করেছিল কাস্টমস হাউস
পর্ব ১৫: বাইরে সংযত রবীন্দ্রনাথ, ক্যানভাসে যন্ত্রণাদগ্ধ ছবিঠাকুর
পর্ব ১৪: অমৃতা শেরগিলের আঁকা মেয়েদের বিষণ্ণ অভিব্যক্তি কি ছবিঠাকুরের প্রভাব?
পর্ব ১৩: আত্মপ্রতিকৃতির মধ্য দিয়ে নতুন করে জন্ম নিচ্ছিলেন রবীন্দ্রনাথ
পর্ব ১২: আমেরিকায় কে এগিয়ে ছিলেন? ছবিঠাকুর না কবিঠাকুর?
পর্ব ১১: নন্দলাল ভেবেছিলেন, হাত-পায়ের দুয়েকটা ড্রয়িং এঁকে দিলে গুরুদেবের হয়তো সুবিধে হবে
পর্ব ১০: ১০টি নগ্ন পুরুষ স্থান পেয়েছিল রবীন্দ্র-ক্যানভাসে
পর্ব ৯: নিরাবরণ নারী অবয়ব আঁকায় রবিঠাকুরের সংকোচ ছিল না
পর্ব ৮: ওকাম্পোর উদ্যোগে প্যারিসে আর্টিস্ট হিসেবে নিজেকে যাচাই করেছিলেন রবি ঠাকুর
পর্ব ৭: শেষ পর্যন্ত কি মনের মতো স্টুডিও গড়ে তুলতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ?
পর্ব ৬: রবীন্দ্র চিত্রকলার নেপথ্য কারিগর কি রানী চন্দ?
পর্ব ৫: ছবি আঁকার প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ পরলোকগত প্রিয়জনদের মতামত চেয়েছেন
পর্ব ৪: প্রথম ছবি পত্রিকায় প্রকাশ পাওয়ামাত্র শুরু হয়েছিল বিদ্রুপ
পর্ব ৩: ঠাকুরবাড়ির ‘হেঁয়ালি খাতা’য় রয়েছে রবিঠাকুরের প্রথম দিকের ছবির সম্ভাব্য হদিশ
পর্ব ২: রবীন্দ্রনাথের আঁকা প্রথম ছবিটি আমরা কি পেয়েছি?
পর্ব ১: অতি সাধারণ কাগজ আর লেখার কলমের ধাক্কাধাক্কিতে গড়ে উঠতে লাগল রবিঠাকুরের ছবি