প্রথম চলচ্চিত্র বিষয়ক পত্রিকা যেটিই হোক না কেন, কেবলমাত্র বিপুল তথ্যভাণ্ডার, নানাবিধ তালিকা এবং সংলগ্ন বিজ্ঞাপনগুলির জন্য ‘চিত্রপঞ্জী’র গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এর প্রত্যেকটি পাতার প্রত্যেকটি শব্দ বাংলা চলচ্চিত্রের আদি যুগের যথাযথ ইতিহাস নির্মাণে প্রয়োজনীয়। যে চারটি সংখ্যার কথা এই প্রসঙ্গে আলোচনা করা গেল তাদের মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে বাংলা ছায়ালোকের নিখুঁত প্রতিচ্ছবি। অতঃপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, দেশভাগ বাঙালির জীবনকে চিরকালের মতো পরিবর্তিত এবং জটিলতার ধাঁধায় নিক্ষেপ করেছে। ‘চিত্রপঞ্জী’ বা এই ধরনের পত্রিকায় তথ্যবাহুল্য ইত্যাদি ছাড়িয়ে যা এখন দৃষ্টি আকর্ষণ করে, তা এর অবিশ্বাস্য সারল্য।
ক.
“রবীন্দ্রনাথ ও নটীর পূজা– রবীন্দ্র জয়ন্তী উপলক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথের জোড়াসাঁকোর বাড়ীতে কয়েকরাত্রি ধরিয়া ‘নটীর পূজা’ অভিনয় হইয়া গিয়াছে। শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রীরা ও রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং এই অভিনয়ে পাদপ্রদীপের সামনে বাহির হইয়াছিলেন। অভিনয় সুন্দর হইয়াছিল। সম্প্রতি নিউ থিয়েটার্স লিঃ সেই অভিনয়ের সবাক্ ছবি তুলিয়াছেন। শীঘ্রই কলিকাতায় প্রদর্শিত হইবে। আমরা প্রতীক্ষায় রহিলাম।”
খ.
“… এ বৎসর কবিবরের ‘জয়ন্তী’ উপলক্ষ্যে আবার তাঁহারই নিজগৃহে নাটিকাখানির পুনরভিনয় আয়োজন হইয়াছিল। এবারও অভিনয় করিয়াছিলেন শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রীরা। সে অভিনয় খুবই সুন্দর হইয়াছিল। সম্প্রতি নিউ থিয়েটার্স-এর কর্তৃপক্ষগণ সেই অভিনয়ের অবিকল সবাক ছবি তুলিয়াছেন। গত ৯ই চৈত্র (২০শে মার্চ্চ) সেই ছবি ‘চিত্রায়’ প্রথম প্রদর্শিত হইয়াছে।
…আমাদের পাঠকবর্গের অবগতির জন্য ‘পূজারিণী’ কবিতাটি সম্পূর্ণ এই প্রবন্ধের পূর্ব্বে মুদ্রিত হইল। ‘সেদিন শারদ-দিবা অবসান’ হইতে আরম্ভ করিয়া শেষ পর্যন্ত কবি ‘নটীর পূজা’-র সূচনায় আবৃত্তি করিয়াছেন।”
উপরোক্ত সংবাদ দু’টি প্রকাশিত হয়েছিল বাংলা ছায়াছবির আদি যুগে, বিভাস রায়চৌধুরী (এম.এ) সম্পাদিত ‘চিত্রপঞ্জী’ পত্রিকার দ্বিতীয় এবং তৃতীয় সংখ্যায় (মাঘ, ১৩৩৮/ জানুয়ারি, ১৯৩২ এবং বৈশাখ, ১৩৩৯/ এপ্রিল, ১৯৩২) সংখ্যায়। প্রায় সাড়ে ন’দশক আগে এই পত্রিকা যখন প্রকাশিত হচ্ছে, বাংলা চলচ্চিত্রের তখন প্রকৃত অর্থেই ঊষাকাল– নির্বাক ছবি ক্রমশ সবাককে স্থান করে দিচ্ছে এবং এই দু’টি সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ মাধ্যমের তুলনামূলক গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে নানা গণবিতর্ক এই পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যায় প্রকাশিত হচ্ছে।
বাংলা ভাষায় সম্পূর্ণ চলচ্চিত্রের প্রতি উৎসর্গীকৃত প্রথম পত্রিকা কোনটি, তা বর্তমান লেখকের জানা নেই। হেমেন্দ্রকুমার রায় (এবং প্রেমাঙ্কুর আতর্থী) সম্পাদিত ‘নাচঘর’ পত্রিকায় চলচ্চিত্র বিষয়ক আলোচনা প্রকাশিত হত বটে, কিন্তু, সম্ভবত সম্পাদকদের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের কারণে নাটক এবং নাট্যবিষয়ক আলোচনাই সেখানে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রধান আলোচ্য ছিল। প্রথম চলচ্চিত্র বিষয়ক পত্রিকা যেটিই হোক না কেন, কেবলমাত্র বিপুল তথ্যভাণ্ডার, নানাবিধ তালিকা এবং সংলগ্ন বিজ্ঞাপনগুলির জন্য ‘চিত্রপঞ্জী’র গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এর প্রত্যেকটি পাতার প্রত্যেকটি শব্দ বাংলা চলচ্চিত্রের আদি যুগের যথাযথ ইতিহাস নির্মাণে প্রয়োজনীয়।
প্রথম সংখ্যাটি প্রকাশের সময় সম্পাদকের বক্তব্য ছিল কিঞ্চিৎ দ্বিধাজড়িত। একটি পৃথক গ্রন্থ হিসাবেই সংখ্যাটিকে ভাবছিলেন তাঁরা। সম্পাদকের নিবেদনে সেই সংশয় স্পষ্ট– ‘আগামীবারে এই বই আরও বিরাট আকারে বাহির করিবার ইচ্ছা রহিল। হয়তো সুবিধা হইলে ত্রৈমাসিক করিয়াও বাহির করিতে পারি। তবে এর সাফল্যের সবটাই নির্ভর করিতেছে চিত্র-প্রিয়দের সহানুভূতির উপর।…’ সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৩৩৮ (১৯৩১) সনের পুজোর সময়। এর মাস-তিনেক পরে মাঘ, ১৩৩৮-এ পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যা প্রকাশিত হয়। সেখানে সম্পাদকের সংশয় দূর হয়েছে, সানন্দে তিনি জানাচ্ছেন, ‘প্রথম সংখ্যা বাহির হইবার মাসাধিককালের মধ্যে যখন আমাদের আশাতিরিক্ত সংখ্যা বিক্রয় হইয়া গেল, তখনও আমরা চুপ করিয়া বসিয়াছিলাম, পরবর্ত্তী সংখ্যার কোন কার্য্যই আরম্ভ করি নাই। কিন্তু কাগজ বিক্রেতাদের উপর্য্যুপরি তাগাদায় ও পাঠকবর্গের বিশেষ অনুরোধে আবার আমরা দ্বিতীয় সংখ্যা বাহির করিতে বাধ্য হইলাম।…’
এরপর পত্রিকাটি মোটামুটি নিয়মিতভাবেই তিন মাসের ব্যবধানে প্রকাশিত হতে থাকে, অন্তত প্রথম এক বছর। লেখার বৈচিত্র বেড়েছে, ক্রমশ সংযোজিত হয়েছে একটি-দু’টি গল্প, অবশ্যই চলচ্চিত্র সংক্রান্ত এবং কিছু ব্যঙ্গচিত্র, কিন্তু যে কারণে পত্রিকাটি অবশ্যস্মতর্ব্য, তা হচ্ছে, এর বিভিন্ন সংখ্যায় প্রকাশিত বিবিধ তালিকাধর্মী রচনা। মাঝেমধ্যে চমকে দিয়ে যায় কুমার প্রমথেশ বড়ুয়ার যৌবনের একটি-দু’টি ছবি, কার মহলানবিশ কোম্পানির বিজ্ঞাপন হয়তো বা, ‘জগদ্বিখ্যাত জার্ম্মান স্কেড্লার-মার্স ফ্যাক্টরি’র ফাউন্টেন পেনের বিজ্ঞাপন, যার প্রতিটি নিবের ‘গ্যারান্টি ২৫ বৎসর’ এবং দাম তখনকার দিনে ১২ টাকা ও ১৬ টাকা, যখন এই পত্রিকার প্রতি সংখ্যার দাম মাত্রই ‘চারি আনা’!
এই রচনা সীমাবদ্ধ থাকবে পত্রিকার প্রথম বছরের চারটি সংখ্যার মধ্যেই।
প্রথম সংখ্যার শুরুতেই তিনকড়ি চক্রবর্তী, সে সময়ের নাটক এবং চলচ্চিত্রের একজন প্রধান অভিনেতা, তাঁর ‘মঙ্গল-ভাষণ’ -এ জানাচ্ছেন, ‘…পশ্চিমের মোহ আমাদের মনকে সব দিক থেকে এমনি ছেয়ে ফেলেছে যে আমরা স্বদেশী ঠাকুরকে ভুলে বিদেশী কুকুরকেও ভালবাসতে শিখেছি, কিন্তু আমাদের দেশে সত্যিকারে ভালবাসবার জিনিষ কি কোনদিন ছিল না, এবং আজও কি নেই? আমাদের সাহিত্য ও শিল্পের সৌন্দর্য যে অনবদ্য।…’ চক্রবর্তী মহাশয় এরকম দাবি করতেই পারেন, কারণ, দু’টি বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সেই সমৃদ্ধ সময়ে রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র শাসিত বাংলা সাহিত্যে দ্রুত উঠে আসছেন তিনের দশকের সুবিখ্যাত সাহিত্যকরা এবং শিল্পক্ষেত্রে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর-নন্দলাল বসু প্রমুখ তখনও নিজস্ব মহিমায় উজ্জ্বল। শিশিরকুমার ভাদুড়ী-শ্রীমতী প্রভা-মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য বাংলা নাটকে চমৎকৃত করছেন প্রতিনিয়ত। চলচ্চিত্র– বাংলা চলচ্চিত্র– ক্রমশ রূপ পাচ্ছে। নিউ থিয়েটার্স সদ্য একটি-দু’টি ছবি বাজারে এনেছে। বস্তুত যে কোম্পানিগুলি ছবি বানায়, সবাক বা নির্বাক, তাদের নামের একটি তালিকা এবং সংযোজনী তালিকা প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকার প্রথম দু’টি সংখ্যায়, যেখানে দেখা যাচ্ছে তালিকায় অধুনাতম সংযোজনের নাম ‘বড়ুয়া ফিলম কোম্পানী’, যার একটিই মাত্র ছবি প্রযোজিত হয়েছে তখনও পর্যন্ত। দেবকীকুমার বসু রচিত এবং পরিচালিত ‘অপরাধী’ নামের সেই ছবির প্রধান ভূমিকায় অভিনয় করেছেন প্রমথেশ বড়ুয়া, রাধিকানন্দ মুখোপাধ্যায় এবং শ্রীমতী শান্তি।
বাঙালি পোশাকে সৌম্যকান্তি প্রেমাঙ্কুরের ছবি দেখতে অভ্যস্ত আমরা পত্রিকায় বিলিতি সাজে তাঁকে দেখে চমকে যাই। প্রথম সংখ্যায় আছে আরেকটি বিস্তৃত বিবরণমূলক তালিকা, সেই সময়ের পরিচালক, আলোকচিত্রশিল্পী, ‘নট’ এবং ‘নটী’-দের পরিচয়। এই সুদীর্ঘ তালিকায় অনেকেই আজ স্বাভাবিক নিয়মে বিস্মৃত, তবে পরিচালক হিসাবে ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, নরেশ মিত্র, চারু রায়, দেবকীকুমার বসু, শিশিরকুমার ভাদুড়ী, প্রফুল্ল রায়, নিরঞ্জন পাল, মধু বসু, অহীন্দ্র চৌধুরী, হরেন্দ্র ঘোষ, অভিনেতাদের মধ্যে ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, নরেশ মিত্র, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, ধীরাজ ভট্টাচার্য্য, সুরেন্দ্রনাথ ঘোষ (দানীবাবু), নির্মলেন্দু লাহিড়ী, ভূমেন রায়, অমৃতলাল বসু (তখনই ‘স্বর্গীয়’), অমর মল্লিক এবং অভিনেত্রীদের মধ্যে পেসেন্স কুপার, রাধারাণী, চন্দ্রাবতী, মিস লাইট প্রমুখদের সুখ্যাতি প্রজন্মান্তরে বাহিত হয়ে এসেছে। উক্ত কলাকুশলীদের যে সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া হয়েছে তা দস্তুরমতো কৌতুকপ্রদ।
‘শ্রী শিশিরকুমার ভাদুড়ী – ইনি একজন উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি। অধ্যাপকের পদ ত্যাগ করে, নটনাথের সেবায় আত্মসমর্পণ করেন।…’
‘শ্রী হরেন্দ্র ঘোষ – ইনি খুব করিৎ-কর্ম্মা লোক। এঁর মতো Organiser বাংলাদেশে খুব কম লোক আছেন।…’
‘শ্রী দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় – বাঙলার চিত্ররাজ্যে ইনি একজন শক্তিমান নট, এঁর মতো সুশ্রী চেহারা বাঙালায় এমনকী ভারতীয় চিত্রজগতে নেই বললেই হয়।…’
‘শ্রী দীনেশরঞ্জন দাশ – ইনি একজন উদীয়মান সাহিত্যিক এবং চিত্রশিল্পে বিশেষ অভিজ্ঞ।…’
‘শ্রীমতী সুশীলা – এঁর পূর্বে কোনও বাঙালী মহিলা ছায়াচিত্রে অবতীর্ণ হননি।…’
‘শ্রীমতী পেসেন্স কুপার – ইনি ফিরিঙ্গীর মেয়ে…’
‘শ্রীমতী রাধারাণী – ইনি উচ্চ-শিক্ষিতা ইংরাজ মহিলা। এঁর পিতা কলিকাতা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সুপারিন্টেডেন্ট।…’
‘শ্রীমতী চন্দ্রাবতী – ইনি অপূর্ব সৌন্দর্য্যের অধিকারিণী।…’
‘শ্রীমতী পারুল গঙ্গোপাধ্যায় – ইনি শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত বংশের মেয়ে। এঁর পিতা সুপ্রসিদ্ধ চিত্র পরিচালক শ্রীযুক্ত ধীরেন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়।…’ ইত্যাদি।
এ সেই সময়ের কথা, যখন কলিকাতা শহরের নাম প্রাকৃততর হয়ে ‘কলকাতা’ হয়ে যাওয়া অকল্পনীয় ছিল। নাগরিক বাঙালি তৎসমলালিত বাংলায় কথা বলতে শ্লাঘা অনুভব করতেন, নিজের ভাষা নিয়ে যথোচিত গর্ববোধ ছিল। সুতরাং, Scenario-কে প্রয়োগ-লিপি, ক্যামেরার Distance Determination-কে ক্যামেরার মহান নির্দেশ ইত্যাদি সুখশ্রাব্য শব্দ দিয়ে প্রতিস্থাপিত করতে অস্বস্তিবোধ ছিল না। এই ধরনের চমৎকার পরিভাষার একটি তালিকা আবার প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকার চতুর্থ সংখ্যায়, যার কিছু উদাহরণ দেওয়া কাম্য মনে করছি:
Iris-in – গোল-বিকাশ,
Iris-Out – গোল-বিনাশ,
Expose – ছায়াপাত,
Continuity Man – ধারারক্ষী,
Dissolve – বিলয়,
Image – প্রতিরূপ,
Track-Shot – চল্তিচিত্র,
Fade-in – ক্রমবিকাশ,
Fade-out – ক্রমবিনাশ, ইত্যাদি।
প্রথম সংখ্যায় প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘ছায়ালোক’ নামের প্রবন্ধটি হয়তো তাঁর যে কোনও সংকলনে এখনও অগ্রন্থিত। চলচ্চিত্রজগতের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত প্রেমেন্দ্র মিত্র জানাচ্ছেন, ‘…বাংলা ফিল্ম্-শিল্পের উন্নতি করতে গেলে এখন সত্যিকারের প্রতিভার প্রয়োজন। ফিল্ম্ নিয়ে ছেলেখেলার দিন শেষ হয়ে এসেছে। অক্ষম অযোগ্যের হাতে আর বেশীদিন এ শিল্পটি ছেড়ে রাখলে পরে একে উদ্ধার করা কঠিন হয়ে পড়বে।…’ শ্রীযুক্ত শশিভূষণ বারিক (বি.এ) মহোদয় তাঁর ‘মফঃস্বলে ছায়াচিত্র ব্যবসা’ প্রবন্ধে হাতে মাত্র আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা থাকলেই এই ব্যবসার পক্ষে যথেষ্ট পুঁজি বলে আশ্বস্ত করছেন। কারণ, “দু’টি মাত্র যন্ত্র কিনতে হবে। একটি প্রোজেক্টিং-মেশিন, অন্যটি লাইটিং মেশিন। প্রথম যন্ত্রটির দাম এক হাজার থেকে দু’হাজারের মধ্যে। কিন্তু এক হাজারের কম হলে চলবে না। জিনিষের ভাল-মন্দের জন্য এই তারতম্য। লাইটিং যন্ত্রটির মূল্য পাঁচশো থেকে হাজার। তারপর সাজসরঞ্জামের জন্য আরও পাঁচশো…।’’ মফস্বলে গিয়ে নিঃসঙ্কোচে জমিদারের কাছে আত্মসমর্পণ করলে প্রদর্শনের ব্যবস্থা তিনিই করে দেবেন। সুতরাং নিশ্চিন্ত।… ‘গ্রামের দিকে জমিদারবাবুর অনুমতি নিয়ে তাঁর দালানঘরে ছায়াছবি দেখানো ভালো।…’
দ্বিতীয় সংখ্যায় ‘কল্লোল’ খ্যাত দীনেশরঞ্জন দাশ (অভিনেতাও বটে, কিন্তু অসুস্থতার কারণে সেসময়ে বাধ্যত দর্শকের ভূমিকায় সীমাবদ্ধ) তাঁর ‘দর্শকের নিবেদন’ প্রবন্ধে বিনীতভাবে কয়েকটি প্রস্তাব দিয়েছেন:
১। ছবির নির্মাতাদের নিরহঙ্কার হওয়া প্রয়োজন।
২। রূপসজ্জায় অস্বাভাবিক আতিশয্য পরিত্যজ্য।
৩। একটি ছবিতেই হাতের সমস্ত কৌশল উজাড় করে দেখাতে গেলে ভরাডুবি হবার সম্ভাবনা প্রবল।
৪। ‘আমাকে সকলে চিনুক’– এই কথাটি যেন অভিনেতার হাবেভাবে ধরা না পড়ে।
৫। ছবির জন্য গল্প লেখা কেউ পৃথকভাবে শিক্ষা করছেন না। ঘটনাটি পরিতাপসূচক।
৬। প্রয়োগ-লিপি (Scenario) যেন কোন ‘অভিজ্ঞ ও সুদক্ষ ব্যক্তিকে’ ছবি তোলার পূর্বে ভাল করে দেখিয়ে নেওয়া হয়।
৭। বাংলা ছবিতে Close-up বা semi close-up বড় কম দেখা যায়। কেন?… ইত্যাদি।
আগে যেমনি বলা গিয়েছে, সবাক চিত্র না নির্বাক, কোন মাধ্যমটি দর্শক এবং চলচ্চিত্রের পক্ষে যথাযথভাবে গ্রহণযোগ্য হবে, সে বিষয়ে বিবিধ তাত্ত্বিক আলোচনা এই পত্রিকার নানা সংখ্যায় প্রকাশিত হচ্ছে। দ্বিতীয় সংখ্যা দেবকীকুমার বসুর ‘মূক ও মুখর’, অমিয়া দেবীর ‘মুখর ছবির ভবিষ্যৎ’ (যেখানে কিছুটা আক্ষেপের সুরে, হাল ছেড়ে দেওয়া ভঙ্গিতে মন্তব্য করা হচ্ছে, ‘…মুখর ছবিকে আমরা কোনও প্রকারেই ঠেকাইয়া রাখিতে পারিব না…’) অথবা তৃতীয় সংখ্যায় (বৈশাখ, ১৩৩৯) মোহিনীমোহন মুখোপাধ্যায়, (এম এ) মহাশয়ের ‘বাংলা ভাষায় মুখর ছবি’ (‘…দর্শকদের বেশীরভাগ অশিক্ষিত এবং অল্পশিক্ষিত, তাহাদের দাবী করিবার শক্তি এখনও পুষ্ট হয় নাই…’) অথবা রোসি মুখার্জির ‘টকী বনাম সাইলেন্ট’ প্রবন্ধে সেই বিতর্কের ধারাবাহিক ইঙ্গিত। নতুন ছবির খবরে জানানো হচ্ছে নিউ থিয়েটার্স থেকে প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর পরিচালনায় নির্মীয়মাণ ছবি ‘চিরকুমার সভা’র কথা। সে ছবিতে অক্ষয়, রসিক, চন্দ্র, পূর্ণ এবং শ্রীশ এর ভূমিকায় অভিনয় করছেন যথাক্রমে তিনকড়ি চক্রবর্তী, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য্য, অমর মল্লিক, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ইন্দু মুখোপাধ্যায়। শৈলবালার ভূমিকায় থাকছেন নিভাননী। প্রথম সংখ্যায় শিল্পী কলাকুশলীদের যে তালিকা প্রকাশিত হয়েছিল, তৃতীয় সংখ্যায় তাতে সংযোজন করা হয়েছে কুমার শ্রী প্রমথেশ বড়ুয়া, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, তারাকুমার ভাদুড়ী, জহরলাল গঙ্গোপাধ্যায়, শ্রীমতী কাননবালা, শ্রীমতী লীলা এবং নিভাননীর নাম, যাঁদের মধ্যে অন্তত তিনজন এর পর দীর্ঘদিন বাংলা ছায়াছবিকে শাসন করে যাবেন। অর্থাৎ, পত্রিকাটি মোটামুটি ঠিক ঘোড়াগুলির উপরেই বাজি ধরতে পেরেছিল।
আরও একটি দু’টি প্রবন্ধের উল্লেখ প্রয়োজনীয়। তৃতীয় সংখ্যায় শ্রী সতু সেন লিখছেন প্রবন্ধ, ‘রঙ্গমঞ্চের আলোক-সজ্জা’ এবং চতুর্থ সংখ্যায় (শ্রাবণ, ১৩৩৯) চারু রায়ের প্রবন্ধ ‘ছবি ও ছবির সীমানা’, ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘এ দেশে চলচ্চিত্রের ভবিষ্যৎ’ এবং রাজেন্দ্রনাথ ঘোষের ‘বাঙ্লা চলচ্চিত্রে নারী-শিল্পীর স্থান’ (‘…আমাদের চিত্রশিল্পে নারীর প্রকৃত অবস্থান কোথায়…’) সংখ্যায় অল্প কয়েকজন বাঙালী বা অবাঙালী নিপুণা নটী বা ভদ্রমহিলার কথা বাদ দিয়ে আমরা দেখতে পাই সাধারণত সমাজের যে স্তর থেকে এইসব নারী শিল্পী আমদানী করা হয়, তাঁদের সামাজিক প্রতিষ্ঠা, শিল্প, রুচি, সংস্কৃতি যে কত নীচে তা সবাই জানেন। চলচ্চিত্র অভিজ্ঞতার কথা স্বতন্ত্র, প্রাথমিক শিক্ষাও এঁদের অধিকাংশের নেই।…) প্রবন্ধগুলিতে সেসময়ের বাংলা চলচ্চিত্রের যথাযথ অবস্থার কিছু প্রতিফলন পাওয়া যায়।
কৌতুকের উপকরণ অবশ্য প্রতি সংখ্যাতেই কিছু না কিছু আছে! সম্পাদকীয় মন্তব্য করা হয়েছে, “…কাগজে দেখা গেল, রবীন্দ্রনাথ Talking picture-এর নাম দিয়েছেন – ‘রূপ-বাণী’। ‘রূপ-বাণী’ কথাটি শুনিতে মিষ্ট হইলেও ব্যবহারিক দিক দিয়া খুব ভাল হইয়াছে বলিয়া আমাদের মনে হয় না। রূপ-বাণী যদি পোষাকী ধুতি হইত, তাহা হইলে ইহাকে পাট করিয়া গ্লাস-কেসে তুলিয়া রাখিলে বেশ দেখাইত, কিন্তু যে শব্দকে আটপৌরে ধুতির মত সদা-সর্ব্বদা ব্যবহার করিতে হইবে, তাহার মধ্যে, সূক্ষ্মতার চেয়ে রুক্ষতা থাকিলেও ক্ষতি নাই…” (চতুর্থ সংখ্যা, শ্রাবণ, ১৩৩৯)।
তৃতীয় সংখ্যায় প্রকাশিত অখিল নিয়োগী লিখিত এবং চিত্রিত (তখনও তিনি ‘স্বপনবুড়ো’ হননি) ‘চলচ্চিত্রে জিনিয়াই’ গল্পে চলচ্চিত্রে অভিনয় অভিলাষী জনৈক হতভাগ্য যুবকের হেনস্তার কথা বলা হয়েছে। অনেক পরে লেখা নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের বহু পঠিত ‘ন্যাংচাদার হাহাকার’ (’দেবদেউল’, দেব সাহিত্য কুটীর, ১৯৫৯) গল্পে আবার যেন সেই কাহিনিরই প্রতিধ্বনি। চলচ্চিত্র জনপ্রিয় হচ্ছে, ক্রমশ জনপ্রিয়তর হয়ে দর্শকদের প্রাণ-মন অধিকার করছে কিন্তু গোটা ব্যবসার প্রতি জনমানসের হাস্যমিশ্রিত সন্দিগ্ধ ভাবটিও যেন বজায় রয়েছে!
‘চিত্রপঞ্জী’ পত্রিকা কতদিন প্রকাশিত হয়েছিল, এই লেখকের সে বিষয়ে কোনও ধারণা নেই। কিন্তু যে চারটি সংখ্যার কথা এই প্রসঙ্গে আলোচনা করা গেল তাদের মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে বাংলা ছায়ালোকের নিখুঁত প্রতিচ্ছবি। অতঃপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, দেশভাগ বাঙালির জীবনকে চিরকালের মতো পরিবর্তিত এবং জটিলতার ধাঁধায় নিক্ষেপ করেছে। ‘চিত্রপঞ্জী’ বা এই ধরনের পত্রিকায় তথ্যবাহুল্য ইত্যাদি ছাড়িয়ে যা এখন দৃষ্টি আকর্ষণ করে, তা এর অবিশ্বাস্য সারল্য। চিরবিলীন সেই জগতের প্রতি এই স্মৃতিচারণ একটি ব্যক্তিগত শ্রদ্ধার্ঘ্য।
রবীন্দ্রনাথ চিঠিতে নন্দলালকে লিখেছেন, ‘আমার ছবিগুলি শান্তিনিকেতন চিত্রকলার আদর্শকে বিশ্বের কাছে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেচে’। এ কি ভারি আশ্চর্যের কথা নয়? এখানে ‘শান্তিনিকেতন চিত্রকলার আদর্শ’ বলতে তিনি কি বোঝাতে চেয়েছেন?