আমাদের অভিনয় জগতে, বিশেষ করে নাটকে একটা চালু কথা আছে, তা হল– ‘মুখ আঁকা’। এখন আর সেভাবে এই কথাটা কানে আসে না, কিন্তু একটা সময় পেশাদার থিয়েটারে কথাটা খুব ব্যবহৃত হত। এখন শব্দটা ক্রমশ হারিয়ে যেতে বসেছে, কিন্তু ওকে হারিয়ে যেতে দেওয়া চলবে না। আমাদের সিনিয়র আর্টিস্টরা বলতেন, এমনকী আমার বাবাকেও বহুবার বলতে শুনেছি যে, ‘এখন আমি মুখ আঁকব।’ আমার তখন অবাক লাগত। ভাবতাম, মুখ তো আছেই, তাহলে আবার মুখ আঁকবেন কীভাবে! ব্যাপারখানা কী? আসলে এই ‘মুখ আঁকা’ মানে মেক আপ করা।
২২.
‘নাটুয়া’ কলামের শুরুর কথা আপনাদের মনে আছে? আমার বাবা, অভয় হালদার, যাত্রার প্রথিতযশা শিল্পী, তাঁর কথা বলেছিলাম সেই পর্বে। আমি জন্ম-ইস্তক বাবাকে দেখেছি অভিনয় করতে। বাবাকে দেখতাম, ট্রাঙ্কের ওপর আসন পেতে, হাতে আয়না ধরে নিজের চোখ আঁকছেন, রং মাখছেন, নিজেই নিজের মেকআপ করছেন। আমি দূর থেকে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকতাম, আর ভাবতাম, বাবা কি নিজের মুখের ওপর আঁকছেন? না কি সামনে ধরা আয়নায় ছবি আঁকছেন? সেই আঁকা অর্থাৎ, মেকআপের সূত্র ধরেই আজ কিছু কথা ভাগ করে নিতে চাই।
আমাদের অভিনয় জগতে, বিশেষ করে নাটকে একটা চালু কথা আছে, তা হল– ‘মুখ আঁকা’। এখন আর সেভাবে এই কথাটা কানে আসে না, কিন্তু একটা সময় পেশাদার থিয়েটারে কথাটা খুব ব্যবহৃত হত। এখন শব্দটা ক্রমশ হারিয়ে যেতে বসেছে, কিন্তু তা হারিয়ে যেতে দেওয়া চলবে না। আমাদের সিনিয়র আর্টিস্টরা বলতেন, এমনকী আমার বাবাকেও বহুবার বলতে শুনেছি যে, ‘এখন আমি মুখ আঁকব।’ আমার তখন অবাক লাগত। ভাবতাম, মুখ তো আছেই, তাহলে আবার মুখ আঁকবেন কীভাবে! ব্যাপারখানা কী? আসলে এই ‘মুখ আঁকা’ মানে মেক আপ করা। আমাদের সিনিয়র অর্থাৎ, অগ্রজ আর্টিস্টরা ‘মুখ আঁকা’র মধ্যে দিয়ে ওই রূপসজ্জাকেই বোঝাতেন। ওটা আসলে থিয়েটারে বহু যুগ ধরে চলে আসা একটা চলতি কথা। আমরাও সেটাই বলতে অভ্যস্ত। প্রসেনিয়াম থিয়েটার বা মঞ্চে অভিনয়ের সময় একজন অভিনেতাকে মেক আপের আশ্রয় নিতেই হয়, মুখ আঁকতেই হয়।
এই মুখ আঁকা কীরকম? হয় যে চরিত্রে আমি অভিনয় করছি, তার মতো করে মেক আপ করা। অথবা আমার প্রকৃত চেহারা নিয়েই আমি মঞ্চে উপস্থিত হব, তবু মঞ্চে ওঠার আগে সাজঘরে মুখে কিছুটা রং মেখে, চোখ এঁকে, কিংবা গায়ের রং উজ্জ্বল অথবা অনুজ্জ্বল করে নিজের রূপসজ্জা সেরে ফেলা। এভাবেই অভিনেতারা নিত্যদিন মুখ আঁকেন। হয় সেই মুখটা আমার মুখাবয়বের কাছাকাছি, নতুবা সম্পূর্ণ আলাদা, অন্যরকম দেখতে।
এ তো গেল বাইরের আঁকা। এর বাইরে আরও একটা আঁকা আছে। তা হল, অন্তরের। অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে অভিনেতা সেই মুখ ক্রমাগত এঁকে চলেন, নিরবিচ্ছিন্নভাবে। এই ‘মুখ আঁকা’ আসলে একটা মানুষকে আঁকা। অভিনয়ের শুরু থেকেই একটা কথা আমরা জানি, এ পৃথিবী দু’টো মুখ কখনও এক হয় না। দু’টো মুখ আলাদা, প্রত্যেকটা মানুষ আলাদা। কিন্তু অভিনেতা যে মুখ আঁকেন, তা কখনও রং-তুলিতে আঁকা, কখনও তা আঁকা শরীর-মন-আবেগ এবং অভিনেতার মেধা ও বৌদ্ধিক অবস্থানকে কেন্দ্র করে। অভিনয়ের এই খেলাটা খেলতে খেলতে অভিনেতা একদিন আবিষ্কার করেন, সব মুখগুলো একরকম হয়ে যাচ্ছে! একটা মুখের ওপর আরেকটা মুখকে জাগাতে গিয়ে অভিনেতা দেখেন, পুরনো কোনও মুখ যেন ফিরে ফিরে আসছে, আর সেটা যখন মঞ্চে ঘটে, তখন দর্শক বলে– অভিনেতার অভিনয়ে পুনরাবৃত্তি ঘটছে, রিপিটেশন হচ্ছে। এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে আমরা, অভিনেতারা প্রায়শই আতান্তরে পড়ে বইকি। আসলে অভিনেতা হিসেবে সে তো রিপিট করতে চায়নি, সে তো অন্য মুখই আঁকতে চেয়েছিল, চেয়েছিল নতুন কিছুকে মঞ্চে উপস্থাপিত করতে। তবু পুনরাবৃত্তি ঘটে।
……………………………………………………….
আসলে এই তারা-ছিটানো অন্ধকারে, যে মুখকে আমি অভিনয়কালে ‘আবিষ্কার করেছি’ বলে অহংকার করেছি, তা আমি প্রকৃত আবিষ্কার করতে পারিনি। খেয়ার নায়ের মতো নাটকের তরীতে, জীবনের নৌকায় যদি আমি চেপে বসে থাকি, তাহলে নিশ্চিন্তভাবে আমি অনেক মুখ আবিষ্কার করব, যা আমি আগে দেখিনি। কাউকে দেখাতে পারিনি। সেগুলো যখন আমি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করি আমার অভিনয়ের মাধ্যমে, তখন ওই একটা চেনা মুখ, ওই ভিড়ের মধ্যে থেকে আবিষ্কার করি, কোথায় যেন সেই মুখকে কাছে পেয়েছিলাম, কিন্তু তার সবটাকে ধরা সম্ভব হয়নি আমার পক্ষে।
……………………………………………………….
কথাপ্রসঙ্গে প্রেমেন্দ্র মিত্রর ‘মুখ’ কবিতার কথা মনে পড়ছে। সেই কবিতা আমাকে অভিনয়ের এই যাপনে তাড়া করে বেরয়। কবিতার শুরুটা এই রকম–
‘একটা মুখ কাঁদায় হয়ে শীতের রাতে পথে অনাথ শিশু,
মেলায় বাজিকরের খেলায় একটি মুখ মুখোশ প’রে হাসায়।
খেয়ার নায়ে ওপারে যেতে কবে যে কোন ভিড়ে
একটা মুখ এক নিমেষে অকূল স্রোতে ভাসায়!
কার সে মুখ, কার?
জানে কি তারা-ছিটানো অন্ধকার!’
আসলে এই তারা-ছিটানো অন্ধকারে, যে মুখকে আমি অভিনয়কালে ‘আবিষ্কার করেছি’ বলে অহংকার করেছি, তা আমি প্রকৃত আবিষ্কার করতে পারিনি। খেয়ার নায়ের মতো নাটকের তরীতে, জীবনের নৌকায় যদি আমি চেপে বসে থাকি, তাহলে নিশ্চিন্তভাবে আমি অনেক মুখ আবিষ্কার করব, যা আমি আগে দেখিনি। কাউকে দেখাতে পারিনি। সেগুলো যখন আমি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করি আমার অভিনয়ের মাধ্যমে, তখন ওই একটা চেনা মুখ, ওই ভিড়ের মধ্যে থেকে আবিষ্কার করি, কোথায় যেন সেই মুখকে কাছে পেয়েছিলাম, কিন্তু তার সবটাকে ধরা সম্ভব হয়নি আমার পক্ষে। ওই মুখের পূর্ণাবয়ব আঁকা সম্ভব হয়নি আমার পক্ষে। স্পর্শ করা হয়নি যথাযথ।
সেই মুখটাই আমার মনের মধ্যে নতুন করে ভেসে ওঠে, আমার নির্মাণের মধ্যে প্রতিভাত হয়। সেই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় অনেকক্ষেত্রে সমালোচকরা বলেন, আমার প্রিয় দর্শক বলেন, কখনও কখনও আমার শুভানুধ্যায়ী এমনকী আমিও বলি, কই নতুন মুখকে তো দেখতে পেলাম না। আগের মতোই তো হয়ে গেল খানিকটা। মনের মধ্যে তখন ধন্ধ তৈরি হয়। পরে আবিষ্কার করি বটে যে, আমি পুরোপুরি ব্যর্থ হইনি। আগের বারে সেই চরিত্রকে গড়ে তোলায় যে খামতি রয়ে গিয়েছিল, যে ফাঁকটুকু রয়ে গিয়েছিল, সেই হারানো মুখটাকে এবার যেন একটু একটু করে খুঁজে পাচ্ছি। মাঝে যদিও অনেকটা দিন কেটে গিয়েছে। আমার ধরে ফেলবার আকাঙ্ক্ষা যখন আলগা করে দিয়েছিলাম, তখনই সেই হারানো মুখ নতুন অনুভবে ধরা দিল মনে। প্রেমেন্দ্র মিত্রর ‘মুখ’ কবিতার বাকি লাইনগুলো মনে পড়ছে। কবি লিখছেন–
‘সে মুখ যারা দেখে নি তারা জানে না জ্বালা নিদান যার নেই।
শীতের দিনে পোহায় রোদ উঠোনে বসে আরামে কাঁথা গায়,
ঝুমকো লতা দেয়ালে তোলে, মরাই রাখে ভ’র,
ফল কি ফুল পাড়তে শুধু নাগাল ডাল নামায়।
হোক সে মুখ যার,
অনিদ রাতে কাঁপে না অন্ধকার।’
এই ‘নাগাল ডাল নামায়’ অর্থাৎ, আমার নাগালের মধ্যে যে মুখ আছে, তাকেই আমি গড়ে তুলি। যা নাগালহীন তাকে আর ধরি না। এ শুধু অভিনয়ে নয়, আমাদের জীবনের প্রতিফলন। আমরা নতুনকে আকঁড়ে ধরে যখন বাঁচতে চাই, তখন ভুলে যেতে চাই পুরাতনকে। আমাদের ভাব-ভালোবাসায়, গেরস্তালির সর্বত্র নতুনকে আঁকড়ে ধরে বাঁচাটাই সর্বস্ব হয়ে ওঠে। হয়তো সেই পুরাতনকে পেতে গেলে যন্ত্রণা পেতে হয়, তাকে আমরা এড়িয়ে যেতে চাই। এই নাগালের বাইরে আসা মুখ যখন আমার সামনে দেখা দেয়, তখন আবার তাকে অস্বীকার করতে পারি না। যখন স্বীকার করি, তখন আজকের মুখের ওপর তার ছায়া পড়ে। তাই তাকে খানিক চেনা চেনা লাগে। আদপে নতুন মুখ বলে কি কিছু তৈরি করা যায়?
বৈচিত্র বৈচিত্র করে আমরা অভিনেতারা যে লোভীর মতো ঘুরে বেরই, তখন মনে পড়ে প্রেমেন্দ্র মিত্র-র এই কবিতার কথা, মনে পড়ে এই মুখ আঁকার কথা। সবটাই বোধহয় নতুন হয় না। নতুনের ভিড়ে কিছু লুকিয়ে থাকা পুরনো মুখ থেকে যায়। সেই পুরনো মুখকে খুঁজে পেয়ে তাকে ধারণ করি। তাকে আসতে দেব না বললেও সে এসে পড়ে। ‘মুখ’ কবিতার শেষের দিকে কবি বলছেন,
“সে মুখ যার পড়েছে চোখে ঘরে-ই থাকে যায় না সেও বনে,
বসত করে পাঁচিল ঘিরে, হিসেব করে পুঁজি যা আছে ভাঙায়।
তবুও কোন হতাশ হাওয়া একটা ছেঁড়া ছায়া
তারার ছুঁচে সেলাই ক’রে রাত্রি জুড়ে টাঙায়।
কার সে ছায়া, কার?
প্রাণেশ্বরী পরমা যন্ত্রণার।”
…………………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………………….
আসলে প্রত্যেক মুখের যে একটা পরম যন্ত্রণা আছে, তা উপেক্ষা করা যায় না। যত সময় যায়, যত বেঁচে থাকার পথ দীর্ঘায়িত হয়, তত সেই যন্ত্রণা প্রাণেশ্বরী পরমা হয়ে কাছে আসতে থাকে, বারবার আসতে থাকে। সেই যন্ত্রণা এতই অমোঘ, সে ফুটে ওঠে মুখাবয়বে। মুখ আঁকার খেলার মধ্যে বৈচিত্র যতই থাক, আকাঙ্ক্ষা যতই থাক, যতই অভিনেতা নতুন করে চরিত্র আঁকার স্বপ্ন দেখুক না কেন, কখনও কখনও সেই পুরনো মুখ অভিনেতার মধ্যে দিয়ে উঁকি দিয়ে যায়। কেন-না এই জীবনে পুরনোকে একেবারে অস্বীকার করে, তাড়াতে চেয়ে, তাকেই আবার ‘তারার ছুঁচে সেলাই করে রাত্রি জুড়ে টাঙায়’ অভিনেতা। সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, ব্যথা-যন্ত্রণা এসব অনুভূতি দিয়ে সেলাই করতে করতে আমরা মুখ আঁকি। রাত জুড়ে তাকে টাঙিয়ে দিই। আসলে অভিনয়ের জন্য অভিনেতার একটু অন্ধকার চাই। অন্ধকারেই তো অভিনয় ফোটে।
…পড়ুন নাটুয়া-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ২১। নাটকে ‘আমি’ বলে কিছু নেই, আছে ‘আমরা’
পর্ব ২০। খালেদ চৌধুরীর আঁকা ক্যানভাসে প্রাণের আলো জ্বেলেছিলেন তাপস সেন
পর্ব ১৯। তাপস সেন কিংবা খালেদ চৌধুরী নিজের সৃষ্টির জন্য আপস করেননি কোনও দিন
পর্ব ১৮। প্রাণহীন উপকরণের স্পর্শেই প্রাণ পায় আমার অভিনয়
পর্ব ১৭। যে চশমায় নিজেকে মানানসই লাগে না, তবুও যা পরে থাকতে ইচ্ছে করে
পর্ব ১৬। মৃত্যুর পর কী ঘটছে, একমাত্র মঞ্চ অভিনেতার পক্ষেই জানা সম্ভব
পর্ব ১৫। মঞ্চ থেকে প্রস্থান মানেই অভিনেতার মৃত্যু ঘটল, এমন নয়
পর্ব ১৪। অভিনয়ে নতুন রং লাগে অভিজ্ঞতার স্পর্শে
পর্ব ১৩। অভিনয়ের বয়স প্রভাবিত করে অভিনেতার যাপনকে
পর্ব ১২। অভিনয় যেমন আনন্দ দেয়, তেমনই তৈরি করে আশঙ্কা
পর্ব ১১। অভিনেতার বিপদ লুকিয়ে থাকে ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ চরিত্রে
পর্ব ১০। ‘উইংকল-টুইংকল’-এর ১০০তম শো-এ আমি কি তাহলে ভুল সংলাপ বলেছিলাম?
পর্ব ৯। একটি মৃতদেহকে আশ্রয় করে ভেসে যাওয়ার নামই অভিনয়
পর্ব ৮। নাটক কি মিথ্যের প্রতিশব্দ, সমার্থক?
পর্ব ৭। আমার পুরনো মুখটা আমাকে দেখিয়ে তবেই সাজঘর আমাকে ছাড়বে
পর্ব ৬। মঞ্চে আলো এসে পড়লে সব আয়োজন ভেস্তে যায় আমার
পর্ব ৫। আমার ব্যক্তিগত রং আমাকে সাহস জোগায় নতুন রঙের চরিত্রে অভিনয় করতে
পর্ব ৪। একটা ফাঁকা জায়গা ও বদলে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা
পর্ব ৩। আমার অভিনয়ের গাড়িতে আমি অন্য সওয়ারি চড়িয়ে নিয়েছি আমার জন্যই
পর্ব ২। অন্যের চোখে দেখে নিজেকে রাঙিয়ে তোলা– এটাই তো পটুয়ার কাজ, তাকে নাটুয়াও বলা যেতে পারে
পর্ব ১। বাবা কি নিজের মুখের ওপর আঁকছেন, না কি সামনে ধরা আয়নাটায় ছবি আঁকছেন?