নিজের ভূমিকাতেই বিজন অবতীর্ণ হন ঋত্বিকের ছবিতে, গণনাট্যের একজন নায়ক, ঋত্বিকের একজন সতীর্থ হিসেবে, যেমনটা বাস্তবে ছিলেন। পরিচালকের হয়ে ছবিতে প্রবেশ করেন কখনও কথক, কখনও বিদূষক হিসেবে। ‘কোমল গান্ধার’ আর ‘যুক্তি তক্কো’-তে ঋত্বিক যখন আত্মজীবনী রচনা করলেন, তখন, একটু লক্ষ করলে দেখব, অনেকখানি বিজনের উপস্থিতির জন্যেই সেটা একজনের না হয়ে একাধিক সত্তার আত্মকথন হয়ে উঠল। এ জিনিস খুব একটা দেখা যায় না।
প্রচ্ছদ অর্ঘ্য চৌধুরী
চারের দশকের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কেন্দ্র ‘৪৬ নং ধর্মতলা’ বিষয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে চিন্মোহন সেহানবীশ লিখেছেন বিজন ভট্টাচার্য ওই কার্যালয়ের জমায়েতে হাজির হয়ে কীভাবে তাঁর নাটক পড়ে শোনাতেন, আলাদা করে প্রতিটি চরিত্রের মধ্যে একেবারে মিশে গিয়ে কেমন হেসে-কেঁদে ঘর মাতিয়ে তুলতেন। শোনা যায়, সেখানে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ওঁর ‘নবান্ন’ নাটক পড়া শুনে বলেছিলেন, আপনি তো মশাই চাষা! মানিক নিজে ৪৬ ধর্মতলায় যখন তাঁর গল্প পড়ে শোনাতেন তখন চরিত্র থেকে দূরে খানিকটা নিষ্পৃহ থাকত তাঁর স্বর।
একটু ভাবলে কিন্তু দেখব, ‘কোমল গান্ধার’-এর গগন, ‘সুবর্ণরেখা’-র হরপ্রসাদ বা ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’-র জগন্নাথ চরিত্রায়নের যে রীতি অনুসরণ করে, তাতে অভিনেতা চরিত্রের মধ্যে নিজেকে বিলীন না করে বরং উদবৃত্তের মতো নিজের অল্প কিছুটা বাইরে রেখে দেন, কিছুটা বিজন ভট্টাচার্য হয়ে থেকে যান। বুঝতে অসুবিধে হয় না এ পরিচালক আর অভিনেতার যৌথ শৈলী। ওঁরা একসঙ্গে বসে এটা ঠিক করেছেন তা নয়, কিন্তু এইসব ক্ষেত্রে ওঁরা যে একভাবে ভাবতেন, তা অনুমান করা যায়। ‘মেঘে ঢাকা তারা’ থেকে ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ অবধি বিজনকে দেখি পূর্ববঙ্গ থেকে আসা উদ্বাস্তুর ভূমিকায়। চারপাশে অন্যদের হয়তো একই রকম পরিচয়; কিন্তু মুখের ভাষায় গগন, হরপ্রসাদ, জগন্নাথকে বাকিদের থেকে আলাদা করে দেওয়া হয়েছে, যাতে তারা বারবার একটাই চরিত্র হয়ে উঠতে পারে, এক গল্প থেকে আরেক গল্পে, এক ছবি থেকে অন্য ছবিতে যাতায়াত করতে পারে। এইভাবে চরিত্র ঝুঁকে পড়ে রূপকের দিকে, কিছুটা রক্ত-মাংসের, কিছুটা বক্তব্যের অবয়ব ধারণ করে।
অন্যদিকে, যেমন বলছিলাম, নিজের ভূমিকাতেই বিজন অবতীর্ণ হন এইসব ছবিতে, গণনাট্যের একজন নায়ক, ঋত্বিকের একজন সতীর্থ হিসেবে, যেমনটা বাস্তবে ছিলেন। পরিচালকের হয়ে ছবিতে প্রবেশ করেন কখনও কথক, কখনও বিদূষক হিসেবে। ‘কোমল গান্ধার’ আর ‘যুক্তি তক্কো’-তে ঋত্বিক যখন আত্মজীবনী রচনা করলেন, তখন, একটু লক্ষ করলে দেখব, অনেকখানি বিজনের উপস্থিতির জন্যেই সেটা একজনের না হয়ে একাধিক সত্তার আত্মকথন হয়ে উঠল। এ জিনিস খুব একটা দেখা যায় না।
………………………………….
ঈশ্বর যখন বোন সীতা আর অনাথ অভিরামকে নিয়ে ঘাটশিলার কাছে চাকরি করতে চলে যায় হরপ্রসাদ তাকে ‘ডেসারটার’ বলে অভিসম্পাত করেছিল, কলোনি গড়ে তোলার লড়াই ছেড়ে যাওয়ার জন্য। বহু বছর পরে সীতা যখন অভিরামের সঙ্গে পালিয়ে যায়, একা বৃদ্ধ ঈশ্বর আত্মহত্যায় উদ্যত, তখন কোথা থেকে সেই জনহীন দেশে বহুদিন পরে হরপ্রসাদের আবির্ভাব ঘটে।
………………………………….
কিন্তু এছাড়া আরও অন্য পথ বেয়ে বাস্তবের বিজন ভট্টাচার্য ছবিতে প্রবেশ করেন। ১৯৫৬-’৫৭ সাল নাগাদ তিনি ‘গোত্রান্তর’ নাটক লেখেন, যার মূল চরিত্র ছিল রিফিউজি কলোনিতে আশ্রয় নেওয়া পূর্ববঙ্গের হরেন মাস্টার। সেই ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন বিজন নিজে। ‘সুবর্ণরেখা’-র হরপ্রসাদ শুরুতে হরেনের মতোই এক চরিত্র, পরে সে অন্য রূপ ধারণ করে।
ঈশ্বর যখন বোন সীতা আর অনাথ অভিরামকে নিয়ে ঘাটশিলার কাছে চাকরি করতে চলে যায় হরপ্রসাদ তাকে ‘ডেসারটার’ বলে অভিসম্পাত করেছিল, কলোনি গড়ে তোলার লড়াই ছেড়ে যাওয়ার জন্য। বহু বছর পরে সীতা যখন অভিরামের সঙ্গে পালিয়ে যায়, একা বৃদ্ধ ঈশ্বর আত্মহত্যায় উদ্যত, তখন কোথা থেকে সেই জনহীন দেশে বহুদিন পরে হরপ্রসাদের আবির্ভাব ঘটে। রাত্রির অন্ধকারে জানলা দিয়ে উঁকি মেরে সে জানায় সে নিজের প্রেতাত্মা, বায়ুভূত, নিরালম্ব। ভয়-ধরানো পরাভবের শব্দ তার মুখে: ‘প্রতিবাদই কর আর পলাইয়াই যাও, কিছুতেই কিছু যায় আসে না… আমরা মিইট্যা গেছি।’
বিজন-হরপ্রসাদকে অবলম্বন করে ঈশ্বরের ব্যক্তিগত সংকট এক জনগোষ্ঠীর সামূহিক বিপর্যয়ের মাত্রায় জুড়ে দেওয়া হল। কিছুটা ভাঁড় আর কিছুটা পুরোহিতের মতো তার উপস্থিতি। এই দুই ভূমিকাতেই সে কাহিনির ভিতরে-বাইরে থেকে কথক হিসেবে কাজ করে। কিন্তু এই ছবিতে আড়ালে আরেক কথক আছেন। যে দৃশ্যের কথা বলছি তার শুরু আর শেষে দু’বার হরপ্রসাদ বলে, ‘রাত কত হল? উত্তর মেলে না’– ‘শিশুতীর্থ’ কবিতার প্রথম দুই লাইন। ঋত্বিকের ছবি রবীন্দ্রনাথে ডুবে থাকে– গানের ব্যবহারে শুধু নয়, বহু প্রচ্ছন্ন অনুষঙ্গে। এই ছবিতে হরপ্রসাদকে সামনে রেখে ‘শিশুতীর্থ’-র সঙ্গে সংলাপ চলেছে। কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ প্রথমে লিখেছিলেন ইংরেজিতে, ‘দ্য চাইল্ড’ শিরোনামে। ১৯৩০ সালে জার্মানিতে বসে চিত্রনাট্যের কথা মাথায় রেখে লিখেছিলেন; ওঁর সেদিনের সফর-সঙ্গী কবি অমিয় চক্রবর্তীর ভাষায়, ‘নূতন রকম টেকনিকে ফিল্মের জন্য নাটক।’ সেই কবিতা বাংলায় আবার লেখা হয় বছর দুয়েক পরে।
হরপ্রসাদের মুখে আবার শুনব ‘শিশুতীর্থ’-র পঙক্তি। শেষবার তাকে দেখি যখন সে সীতার ছেলে বিনুকে ঈশ্বরের কাছে পৌঁছে দিতে আসে। দরজায় অপেক্ষমাণ সাংবাদিককে সে বলে, ঈশ্বর নিজেকে সীতার মৃত্যুর জন্যে দোষী বলে আদালতে মিথ্যা দাবি করেছে কারণ অন্তর্জলীর ডাক দিয়ে সে বলতে চাইছে, ‘মাতা দ্বার খোলো’। সাংবাদিক বুঝতে পারে এ প্রলাপ; সে নোটবই বন্ধ করে। কিন্তু হরপ্রসাদ ‘শিশুতীর্থ’ থেকেই ওই লাইনটা তুলে এনেছে। ছবিতে মাঝে মাঝে জড়ানো পটের মধ্যে কাহিনির পর্বান্তরের উল্লেখ করা আছে। শিল্পী খালেদ চৌধুরী যত্ন করে এই পটগুলো তৈরি করেছিলেন। তার শেষটিতে লেখা আছে: ‘জয় হোক মানুষের/ ঐ নবজাতকের/ ঐ চিরজীবিতের’– ‘শিশুতীর্থ’-র শেষ কয় লাইন।
গলায় দড়ি দিয়ে ঈশ্বরকে ঝুলতে দেয় না হরপ্রসাদ, তাকে সে নরকদর্শনে নিয়ে যায়। কলকাতায় ‘বীভৎস মজা’ দেখতে দেখতে সে গভীর রাতে আলোর মালার উপরে প্রথম শোনায় অন্তর্জলী যাত্রা করার কথা। মৃত্যুর পরপারে ঈশ্বরকে পৌঁছে দিতে চায় সে? ওই দীর্ঘ রাত্রির মধ্য দিয়ে, বোনের মৃত্যুর চরম অন্ধকারের মধ্য দিয়ে যাত্রা করে তারপরেই একমাত্র বালক বিনুর হাত ধরে আবার খোলা প্রান্তরে এসে দাঁড়াতে পারবে ঈশ্বর। এই যাত্রার ইমেজ ‘শিশুতীর্থ’ থেকে ‘সুবর্ণরেখা’-য় সঞ্চারিত হয়েছে। হেরে যাওয়া, মিটে যাওয়া হরপ্রসাদ হাত ধরে তাকে এই রাত্রির গর্ভে এগিয়ে দেয়, রেসের মাঠ থেকে পানশালা হয়ে বেশ্যালয় অবধি সে-ই তার ফিলজফার গাইড।
এই বিদূষককে ছাড়া ঋত্বিক কীভাবে মেট্রোপোলিস, চলচ্চিত্র আর উপনিষদ প্রদক্ষিণ করতেন, রাত্রির আলোর উপর সভ্যতার অবসানের ধারাবিবরণী শোনাতেন? ঋত্বিক আর বিজন– দুই মার্কসবাদীর প্রিয় বিষয় ছিল উপনিষদ। এখানে একজন আরেকজনের হয়ে তার অবতারণা করেন। পানশালার ফূর্তির মধ্যে বসে হরপ্রসাদ কঠোপনিষদের নচিকেতা-যমরাজ আর বৃহদারণ্যকের মৈত্রেয়ী-যাজ্ঞবল্ক্য সংলাপ স্মরণ করে: আত্মজ্ঞান আর অমরত্বের সন্ধান করা fool-দের কথা বলে। আমরা জানি হরপ্রসাদও একজন ‘ফুল’, শেক্সপিয়রের নাটকে যেমন দেখা যায়– একই সঙ্গে নির্বোধ ও জ্ঞানী।
………………………………….
পড়ুন ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরীর লেখা: জগদ্দল মানুষ হয়, বিমল হয়ে যায় যন্তর, যার পোড়া পেট্রোলের গন্ধে নেশা লাগে
…………………………………
আর ছবির মধ্যে সিনেমার পরিক্রমা ঘটছে শব্দপথে: ফেদেরিকো ফেলিনির ‘লা দোলচে ভিতা’-র (১৯৬০) থিম সংগীত ‘পাত্রিচিয়া’-কে স্মরণ করে। ‘লা দোলচে ভিতা’ আরেক সভ্যতার অবসানের গল্প। ঋত্বিক এক প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘ফেলিনি ভদ্রলোকটি ক্রতো স্মর-ও বলছেন, কৃতং স্মর-ও বলেছেন, আমাদের কঠোপনিষদের মন্ত্রদ্রষ্টা কবির মতোই।”
এই রাত্রির দৃশ্যাবলিই ‘সুবর্ণরেখা’র সবচেয়ে স্মরণীয় পর্ব। সেখানে বিস্ময়কর কথকতা হরপ্রসাদ-বিজনের। পানশালা থেকে বেরিয়ে ঈশ্বর ও হরপ্রসাদ দুই মাতাল ট্যাক্সি করে যাত্রা করে। তাদের ঘোলাটে দৃষ্টি থেকে রাজপথের আলোর মালা লো-অ্যাঙ্গল শটে পেরিয়ে যায়। আমরা সেই বিখ্যাত সংলাপ শুনি:
হরপ্রসাদ: অ্যাটম বোমা দ্যাখে নাই
ঈশ্বর: দ্যাখে নাই। দ্যাখে নাই?
হরপ্রসাদ: নেভার। যুদ্ধ দ্যাখে নাই, মন্বন্তর দ্যাখে নাই, দাঙ্গা দ্যাখে নাই, দেশভাগ দ্যাখে নাই…। অকারণ সেই পুরাতন সূর্যবন্দনা মন্ত্র…।
তারপরে সে অন্তর্জলী করার কথা বলে, বলে ‘ক্রুতো স্মর, কৃতং স্মর’।
‘সুবর্ণরেখা’-র গল্পে পটের লেখায় সময় পেরিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়। লক্ষ করলে দেখব এইসব যতিচিহ্নের মধ্যে কালের বৃহৎ পরিক্রমার ইঙ্গিত রয়েছে। লেখায় পড়ছি ‘কয় বৎসর কাটিয়া গেল’, ‘আরো কয় বৎসর কাটিয়া গেল।’ তারপরেই দেখছি কেউ একজন উন্মাদ হয়ে যাচ্ছে, অথবা গাগারিনের মতো মহাশূন্যে চলে যাচ্ছে। নীরব এই অন্য কাঠামোর কথা মাথায় রাখলে হয়তো হরপ্রসাদের উন্মার্গ-যাত্রাকে ছবির বিরতির বিন্যাসে সাজাতে পারব। দুই ঘণ্টার ছবি থেকে সওয়া এক ঘণ্টা তাকে সরিয়ে রাখেন পরিচালক। যখন সে ফিরে আসে মনে হয় যেন একটা গোটা যুগের ধ্বংসাবশেষ পেরিয়ে এসেছে।