সেই ১৯৮৯ থেকে আলাপ উস্তাদ জাকির হুসেনের সঙ্গে। মাঝে কেটে গিয়েছে ৩৪-৩৫ বছর। সেই সম্পর্কের গভীরতা কতখানি, তা বলে বোঝাতে পারব না। আমার কাছে উস্তাদজি ছিলেন দাদা, আমি তাঁকে জাকিরজি বলেও ডাকতাম। ’৮৯-তে আমার সঙ্গে প্রথম বাজান। তারপর কত যে স্মৃতি জমা হয়েছে! অবিস্মরণীয়। এবার, ১১ আগস্ট মুম্বই-তে দেখা হয়েছিল। ওই শেষ দেখা। সেদিন গুরুপূর্ণিমা ছিল। জাকিরজির আব্বা মানে ওঁর গুরুজিকে নিয়ে একটা অনুষ্ঠান ছিল। আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। অনুষ্ঠানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বসে, সকলের বাজনা শুনলেন, মগ্ন হয়ে। সবার শেষে নিজে পারফর্ম করলেন। কী অসাধারণ সেই পরিবেশনা!
আমার গুরুজি আলি আকবর খাঁ-র বড়পুত্র আশিস খাঁ চলে গেলেন ঠিক এক মাস আগে। সেই শোকের আঘাত সামলে উঠতে না উঠতে আবার একটা শোকের সম্মুখীন হলাম। এবার উস্তাদ জাকির হুসেন। এত বড় আঘাতের মুখোমুখি হব, কল্পনা করিনি। আজ সকালেই ফোন করেছিল আমার গুরুজির আরেক পুত্র আলম। বলছিল, ‘দাদা, আশিসদা চলে গেল গত মাসে। এবার উস্তাদজি। আমাদের মনের কী অবস্থা, বুঝতে পারছ!’ সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাইনি তখন। এখনও নেই। শুধু মনের কষ্টটা অনুভব করতে পারছিলাম।
সেই ১৯৮৯ থেকে আলাপ উস্তাদ জাকির হুসেনের সঙ্গে। মাঝে কেটে গিয়েছে ৩৪-৩৫ বছর। সেই সম্পর্কের গভীরতা কতখানি, তা বলে বোঝাতে পারব না। আমার কাছে উস্তাদজি ছিলেন দাদা, আমি তাঁকে জাকিরজি বলেও ডাকতাম। ’৮৯-তে আমার সঙ্গে প্রথম বাজান। তারপর কত যে স্মৃতি জমা হয়েছে! অবিস্মরণীয়। এবার, ১১ আগস্ট মুম্বই-তে দেখা হয়েছিল। ওই শেষ দেখা। সেদিন গুরুপূর্ণিমা ছিল। জাকিরজির আব্বা মানে ওঁর গুরুজিকে নিয়ে একটা অনুষ্ঠান ছিল। আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। অনুষ্ঠানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বসে, সকলের বাজনা শুনলেন, মগ্ন হয়ে। সবার শেষে নিজে পারফর্ম করলেন। কী অসাধারণ সেই পরিবেশনা! আসলে জাকিরজি অসাধারণ শিল্পী, কোনও সন্দেহ নেই সেব্যাপারে। তবে তার চেয়েও বেশি করে অসাধারণ একজন মানুষ, যাঁর সান্নিধ্য পেয়ে আমি ধন্য হয়েছি। এতটাই শিক্ষণীয় ওঁর জীবন।
আজ এমন একটা দিন, আমার স্বর সম্রাট ফেস্টিভ্যালের (এসএসএফ) ১২ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম উস্তাদজি এলেন না। এবার তো আমার সঙ্গে বাজানোরও কথা ছিল। তবে গত মাসে ওঁর সেক্রেটারি জানিয়ে ছিলেন, উস্তাদজি আসতে পারবেন না। চিকিৎসকরা ওঁকে দু’মাস বিশ্রামে থাকতে বলেছেন। তারপরেও ওঁর সঙ্গে অনেকবার কথাবার্তা হয়েছে। প্রত্যেকবার বলতেন, ‘আই অ্যাম গেটিং বেটার। চিন্তা করো না। সুস্থ হয়েই তোমার প্রোগ্রামটা করব।’ আমিও অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিলাম। উস্তাদজির ভারতে আসার কথাও ছিল। কারণ, জানুয়ারিতেই বেলা ফ্লেক, এডগার মেয়ারের সঙ্গে গ্র্যামি-ট্যুর করার কথা ছিল ওঁর। কিন্তু, তার আগেই সব শেষ হয়ে গেল। নিমেষে।
জাকিরজির সঙ্গে যেখানে যতবার দেখা হয়েছে, আন্তরিকতায় ভরিয়ে দিতেন। ছোট থেকে বড়– সকলের সঙ্গে যখন কথা বলতেন, একটা মার্জিত, শ্রদ্ধামিশ্রিত ব্যবহার ঝরে পড়ত, যা দেখে মুগ্ধ হয়ে যেতাম। এত বড় মাপের মানুষ, অথচ লেশমাত্র অহংকার ছিল না। বরং ওঁর কাছে থেকে অনেককিছু আমরা শিখতাম। এতটাই আগলে রাখতে জানতেন। সাধনায় সিদ্ধিলাভ বলে বাংলায় একটা কথা আছে। শেষের দিকে যখন মঞ্চে জাকিরজিকে বাজাতে দেখতাম, মনে হত, সেই সিদ্ধি তিনি অর্জন করেছেন। তালবাদ্যের সাধনায় এক অন্যস্তরে বিচরণ করতেন। তালের আবেশে যেন অন্য কোনও জগতে চলে যেতেন। যে শিল্পীর সঙ্গে যখন বাজাতেন, তার সঙ্গে যোগ্যসঙ্গত করা ছিল দেখার মতো। আমার সঙ্গে যখন বাজাতেন, মনে হত, আজ নয়, অনেকদিন ধরে যেন আমার সঙ্গে তবলা বাজাচ্ছেন! ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভা বোধহয় একেই বলে!
জাকিরজির চলে যাওয়া সারা বিশ্বের সংগীত জগতের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। এই বয়স মোটেই চলে যাওয়ার বয়স নয়। আসলে সংগীতই ছিল ধ্যানজ্ঞান, জাকিরজির ভুবন। তার জন্য শারীরিক ধকলও সহ্য করতেন হাসি মুখে। ২১ দিনে ১৮টা কনসার্ট করেছিলেন। এমন প্রাণচঞ্চল, সদাহাস্যময় মানুষ আর আসবে না। হাজার বছরে জাকির হুসেনের মতো এক-আধটা শিল্পী জন্ম নেয়। তাঁকে দেখতে পাওয়া, তাঁর সঙ্গে স্টেজে পারফর্ম করা, বাজানো– আমার সৌভাগ্য।
…………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………