ওরাল হাইজিন আর দাঁত নিয়ে হাজার বছরের গবেষণার সাময়িক নিষ্পত্তি হল ১৮৭৩ সালে, যখন কলগেট কোম্পানি প্রথম জার ভর্তি সুগন্ধি টুথপেস্ট বাজারে নিয়ে এল এবং তা মানুষ সানন্দে গ্রহণ করল। বয়ামভর্তি টুথপেস্ট কারণ টিউব তখনও অন্ধকারে। কিন্তু প্রায় একই সময়ে ১৯০৮ সালে এক আমেরিকান ডেনটিস্ট এন. এস. জেনকিনস ‘কলিনস’ (Kolynos) নামে এক টুথপেস্ট বাজারে আনলেন, যা সঙ্গে সঙ্গে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠল। ১৯৩০ থেকে ১৯৪০ পর্যন্ত বিশ্বের বহু বাজারে আধিপত্য বিস্তার করল।
দাঁত নিয়ে কে না পাগল! যুগ যুগ ধরে দাঁত সুরক্ষিত করতে মানুষের কত চেষ্টা, কত পরীক্ষা-নিরীক্ষা। তারই ফলস্বরূপ একটি দাঁতাল ব্র্যান্ড তৈরির গল্প বলি।
ব্র্যান্ড বাজানোর গল্প বলতে গিয়ে দেখলাম, সেই সিন্ধু সভ্যতার যুগ থেকে অর্থাৎ ৫-৭ হাজার বছর আগেও প্রাচীন ভারতীয়রা তাঁদের যে কোনও প্রয়োজন মেটাতে প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। দাঁত পরিষ্কার বা ওরাল হাইজিন-এর ব্যাপারে তাঁরা খুবই সতর্ক থাকতেন। এবং তা সুরক্ষিত করতে ব্যবহার করতেন নিম, পিপুলের মতো ঔষধিগুণ সম্পন্ন গাছের সরু ডাল, যা ব্যবহারিক ভাষায় দাঁতন হিসেবে প্রচলিত। সেই ডালের মাথাটা চিবিয়ে ব্রাশের মতো ব্যবহার করা হত (যা এখনও এদেশের গ্রামেগঞ্জে ব্যবহৃত হয়)। এই প্রকৃতিনির্ভর সহজ সরল জীবনযাত্রার ফলে তাদের রোগভোগও ছিল কম।
কিন্তু ওই একই সময়ে ইজিপশিয়ানরা দাঁতের সুরক্ষায় একটা কমপ্লিকেটেড ভেষজ পাউডার তৈরি করে দাঁত মাজতেন। সেই পাউডার তৈরি হত ষাঁড়ের খুর পোড়ানোর ছাই এবং তার সঙ্গে ঝিনুক, রকসল্ট, গোলমরিচ, শুকনো ফুল, মিন্ট ইত্যাদির গুঁড়ো দিয়ে। এটিও ছিল প্রাকৃতিক সম্পদ নির্ভর, কিন্তু দাঁতের সুরক্ষার ব্যাপারে হয়তো দাঁতনের মতো সহজ ছিল না। তবু বোঝা যায় দাঁতের যত্নের ব্যাপারে হাজার হাজার বছর আগেও মানুষ কত সচেতন ছিলেন এবং ব্যবহারযোগ্য মাজন উদ্ভাবনে সদা ব্যস্ত ছিলেন।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপিয়ানরা কিন্তু নিজেদের উদ্ভাবনী শক্তি দেখাতে এক অতি হাস্যকর মাজন ব্যবহার করতে শুরু করলেন।
পাউরুটি টোস্ট করে পোড়ানোর পর সেটা গুঁড়ো করে দাঁত মাজার পাউডার হিসেবে ব্যবহার করতেন। তবে এই উদ্যোগ বেশিদিন টেকেনি। এইসব নিরলস আবিষ্কার চলতে চলতেই টুথপেস্টের ভাবনার আবির্ভাব। কারণ শক্ত জিনিসের গুঁড়ো দাঁতের পক্ষে যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠেছিল। সাবান, চক বা খড়িমাটি, কাঠকয়লার গুঁড়ো তার সঙ্গে একটু জল মিশিয়ে পেস্ট তৈরি শুরু হল, কিন্তু তাও জুতসই হল না।
শেষমেশ ওরাল হাইজিন আর দাঁত নিয়ে এইসব হাজার বছরের গবেষণার সাময়িক নিষ্পত্তি হল ১৮৭৩ সালে, যখন কলগেট কোম্পানি প্রথম জার ভর্তি সুগন্ধি টুথপেস্ট বাজারে নিয়ে এল এবং তা মানুষ সানন্দে গ্রহণ করল। বয়ামভর্তি টুথপেস্ট কারণ টিউব তখনও অন্ধকারে। কিন্তু প্রায় একই সময়ে ১৯০৮ সালে এক আমেরিকান ডেনটিস্ট এন. এস. জেনকিন্স ‘কলিনস’ (Kolynos) নামে এক টুথপেস্ট বাজারে আনলেন, যা সঙ্গে সঙ্গে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠল। ১৯৩০ থেকে ১৯৪০ পর্যন্ত বিশ্বের বহু বাজারে আধিপত্য বিস্তার করল। ‘কলিনস’ নামটা দুটো গ্রিক শব্দের সমন্বয়। শব্দ দু’টির অর্থ সৌন্দর্য বৃদ্ধি ও রোগ নিরাময়। চমৎকার নাম, প্রচুর বিজ্ঞাপন এবং বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত স্লোগান ‘Kolynos Smile’ তখন লোকের মুখে মুখে ঘুরে বেড়াত। এমনকী, বহুকাল পরেও সলমন রুশদির বিখ্যাত ‘মিডনাইটস চিলড্রেন’ বা বিক্রম শেঠের জনপ্রিয় উপন্যাস ‘এ সুটেবল বয়’-তে Kolynos Smile-এর উল্লেখ আছে। এত কাণ্ডর পরও টুথপেস্টের জগতে আজও প্রথম ব্র্যান্ড ‘কলগেট’।
পরে অবশ্য ‘কলিন্স’ ব্র্যান্ডটি ‘কলগেট’ কিনে নেয় এবং কলিনস নামটি সরিয়ে শুধু ‘Smile’ বা ‘Sorriso’ নাম দিয়ে কলিনসের বিশাল জনপ্রিয়তা নিজেদের কুক্ষিগত করে নেয়।
ইতিহাস বলে, যে কোনও প্রোডাক্ট বা ব্র্যান্ডকে প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে গেলে নতুন নতুন উদ্ভাবন শক্তির প্রয়োজন। টুথপেস্ট তেমনই একটা প্রয়োজনীয় প্রোডাক্ট, যাকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োগে নবকলেবরে সুসজ্জিত করে বিভিন্ন কোম্পানি বাজারে আনতে ব্যস্ত। সেই গবেষণা চলছে এবং চলবে। এমনকী, মার্কিন মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরাও এই টুথপেস্ট গবেষণায় যুক্ত হয়ে ১৯৮৭ সালে মহাকাশচারীদের ব্যবহারের জন্য ‘Edible Toothpaste’ উদ্ভাবন করেন, যা এখন শিশুদের ও পোষ্যদের দাঁত পরিষ্কারে খুবই প্রয়োজনীয়।
আরও গবেষণা চলছে। কোথায় থামবে কেউ জানে না। তাই শেষ করি বিশ্বের প্রথম টুথপেস্ট ব্র্যান্ড ‘কলগেট’-এর আজকের বিজ্ঞাপনের স্লোগান দিয়ে, ‘স্মাইল করো অউর শুরু হো যাও’, ‘Get Started with a Smile.’
রবীন্দ্রনাথ চিঠিতে নন্দলালকে লিখেছেন, ‘আমার ছবিগুলি শান্তিনিকেতন চিত্রকলার আদর্শকে বিশ্বের কাছে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেচে’। এ কি ভারি আশ্চর্যের কথা নয়? এখানে ‘শান্তিনিকেতন চিত্রকলার আদর্শ’ বলতে তিনি কি বোঝাতে চেয়েছেন?