টেবিলের উচ্চারণ শুনতে পেয়েছেন মিলান। তাঁর হৃদয়ে ঝিলমিল করে উঠেছে আর্দ্র কৃতজ্ঞতা লেখার টেবিলটার প্রতি। আর অমনি বিষয়টি চুইয়ে নেমেছে তাঁর কলম থেকে। তাঁর এসেইস্টিক উপন্যাসের দুরন্ত বিষয়। এক মাঝবয়সি সুন্দরীর, বিবাহিত সুন্দরীর, সদ্য বিধবা সুন্দরীর ব্রা-হীন স্তন। উপন্যাস শুরু করার জন্যে এর চেয়ে ভালো বিষয় কী হতে পারে? এই মেয়েটিকে মিলান চেনেন। তার সঙ্গে শুয়েছেন মিলান। মেয়েটি যখন ঘনঘোর বিবাহিত তখন তাকে বিছানায় পেয়েছেন। আবার মেয়েটি যখন সদ্য বিধবা, স্বামীমুক্ত তখনও শুয়েছেন তার সঙ্গে! এসব ঘটেছে চেকোস্লোভাকিয়ার হোটেলে। এখন মিলান প্যারিসে।
২৭.
মিলান কুন্দেরা তাঁর লেখার টেবিলে বসার সঙ্গে সঙ্গে একটা কাণ্ড ঘটল। কখনও এমন হয় না। আজ হল। টুকরো টুকরো বিষয়ের একটা ঢেউ ঝাঁপিয়ে পড়ল তাঁর ওপর। এক বৃদ্ধার ঠোঁটে অনেক বছর আগের এক তরুণীর হাসি। হারানো চিঠির জন্যে মনকেমন। নারীর এক স্তনে পাপ। অন্য স্তনে পুণ্য। শয়তান-ঈশ্বর মিশে যাচ্ছে ক্রমাগত। পুরুষহীন পৃথিবী। ব্রা-হীন কুচযুগ।
যে কোনও একটি বিষয় নিয়ে শুরু হতে পারে কুন্দেরার উপন্যাস। তারপর ডালপালা ছড়াতে ছড়াতে কোথায় পৌঁছবে সেই লেখা, লেখকের পক্ষে এক্ষুনি জানা সম্ভব নয়। বিশেষ করে এসেইস্টিক নভেলে। ঠিক তাই, টেবিলটাই পথ দেখিয়েছে মিলানকে প্রাবন্ধিক উপন্যাসের। লিখতে লিখতে প্রবন্ধ হয়ে উঠবে উপন্যাস। লিখতে লিখতে উপন্যাস পিছলে যাবে প্রবন্ধে। মিলান, এটাই হবে তোমার শৈলী। তোমার স্বাক্ষর। তোমার হিরণ্ময় নিজস্বতা। টেবিলের এই উচ্চারণ শুনতে পেয়েছেন মিলান। তাঁর হৃদয়ে ঝিলমিল করে উঠেছে আর্দ্র কৃতজ্ঞতা লেখার টেবিলটার প্রতি। আর অমনি বিষয়টি চুইয়ে নেমেছে তাঁর কলম থেকে। তাঁর এসেইস্টিক উপন্যাসের দুরন্ত বিষয়। এক মাঝবয়সি সুন্দরীর, বিবাহিত সুন্দরীর, সদ্য বিধবা সুন্দরীর ব্রা-হীন স্তন। উপন্যাস শুরু করার জন্যে এর চেয়ে ভালো বিষয় কী হতে পারে? এই মেয়েটিকে মিলান চেনেন। তার সঙ্গে শুয়েছেন মিলান। মেয়েটি যখন ঘনঘোর বিবাহিত তখন তাকে বিছানায় পেয়েছেন। আবার মেয়েটি যখন সদ্য বিধবা, স্বামীমুক্ত তখনও শুয়েছেন তার সঙ্গে। এসব ঘটেছে চেকোস্লোভাকিয়ার হোটেলে। এখন মিলান প্যারিসে। তখন মিলান লিখতেন চেক ভাষায়। এমন লেখেন ফরাসি ভাষায়। মেয়েটার নাম তামিনা।
তামিনা একটি লাল টি-শার্ট পরে এসে দাঁড়াল, কত বছরের ওপার থেকে, টি-শার্টের তলায় ব্রা-হীন দু’টি পরম ডাক ফুটিয়ে তুলে। মিলান লেখেন, একসময় ব্রা ছিল না। ব্রা শিল্প, ব্রা বাণিজ্য, ব্রায়ের আশ্রয় ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা, ব্রায়ের স্পর্ধা ও ঔদ্ধত্য, এসব কিছুই ভাবতে পারেনি সভ্যতা। তাই তখন ব্রা-হীন স্তনের ডাক আলাদা ভাবে পুরুষ দেখতে শেখেনি। এই হল এসেইস্টিক উপন্যাসের চলন। একই সঙ্গে প্রবন্ধ আর গল্প, যার নায়িকা তামিনা।
টি-শার্টের তলায় দুপুর তিনটে নাগাদ ব্রা-হীন নায়িকার দু’টি বৃন্ত কী চমৎকার মনে পড়ে মিলানের! পুরো একটা প্রবন্ধ লিখতে পারেন মিলান ইচ্ছে করলে ব্রা-হীন নায়িকার স্তনবৃন্তের ডাকের ওপর, চেকোস্লোভাকিয়ার সস্তার হোটেল ঘরে। ওই ডাক ফুটিয়ে সে তো তার যুবক স্বামীর কাছে যেতে পারত। কিন্তু সেই নিশ্চিন্ত পথে না গিয়ে নায়িকা এসেছে লেখকের ঘরে ব্রা-হীন বুকের ছবি নিয়ে, টি-শার্টের পাতলা আড়াল টেনে।
মেয়েটা আসলে অসতী হতে চায়! অসতী হওয়ার মধ্যে যে উত্তেজনা আছে, সতী হওয়ার মধ্যে তা কোথায়? সতীত্ব তো পানাপুকুর! উত্তেজনার ঢেউ নেই। মিলান তাকান লেখার টেবিলটার পানে। একটা অদ্ভুত আলো কেমন যেন আয়নার মায়া ছড়িয়ে টেবিলটার ওপর। সেই আয়নায় সুন্দরী নায়িকা। মিলান এইবার একটি প্রশ্ন নিয়ে আসেন তাঁর উপন্যাসে। এই মেয়ে তো স্কুলে পড়ায়। কিন্তু তিনি কি উপন্যাস লিখতে চান এক স্কুল-টিচারকে নিয়ে? যে শিক্ষিকা সবে বিধবা হয়েছে? এবার সে তো স্বামীমুক্ত। স্বাধীন। যা খুশি করতে পারে। স্কুলে পড়াতে পড়াতে মেয়েটা অন্যমনস্ক হয়ে যায়। সে পরপুরুষের স্বপ্ন দেখে। মিলান আসেন তার স্বপ্নে। সে মিলানের সামনে টি-শার্ট অর্ধেক তোলে। প্রায় বোঁটা পর্যন্ত সরে তার টি-শার্টের আড়াল। মিলান দেখতে পান গোলাপি বৃত্তের এক ঝলক। অমনি তমিনা নামিয়ে দেয় টি-শার্ট। আর আঁতকে উঠে বলে, দেখলে দেখলে আবার এসেছিল! কে এসেছিল? ঘরে তো শুধু তুমি আর আমি! আমার স্বামী এসেছিল। তোমার স্বামী? সে তো মৃত। তিন-চার মাস আগে সে তো মারা গেছে! যখন জীবিত ছিল তখন তো কত পুরুষের সঙ্গে বিছানায় গেছি। তোমার সঙ্গেও কতবার। আমি স্কুলটিচার না বেশ্যা? এ প্রশ্নও আমার মধ্যে খটকা জাগিয়েছে। তারপর ভাবতে বেশ লেগেছে, আমি দুটোই। আমি স্কুলটিচার পেশায়। আর আমি বেশ্যা কারণ অসতী হওয়ার উত্তেজনা আমার শরীর চায়। কিন্তু এখন অন্যরকম।
এখন কীরকম? স্বামীর মৃত্যুর পরে অসতী হওয়ার উত্তেজনাটা আর তেমন আসছে না। দেখলে তো। শুনশান দুপুরবেলা। হোটেলের ঘর। স্বামীর নজরদারির কোনও ব্যাপার নেই। আমার গায়ে যত খুশি চুমুর দাগ করে দিতে পারো। যে কাজটা করতে তুমি ভালোবাসো। কিন্তু আমি ন্যাংটো হতে পারলাম না। ও এসে দাঁড়াল! ক’দিন আগে আর এক পুরুষের কাছে গেলাম। আমার সমস্ত অঙ্গে অসতী হওয়ার তীব্র ইচ্ছে নিয়ে।
–তুমি তো বিধবা, বললেন মিলান। ‘অসতী’ শব্দটা ব্যবহার করছ কেন?
–আমার তো মনে হচ্ছে ও সর্বত্র সবসময় আমাকে দেখতে পাচ্ছে। আমি অন্য পুরুষের কাছে পোশাকটা আমার গা থেকে তীব্র উত্তেজনায় আর উপড়ে ফেলতে পারছি না!
এই কথা শোনা মাত্র মিলান দেখলেন তাঁর লেখার টেবিলে দু’টি অমোঘ শব্দ ভেসে উঠল– posthumous fidelity. মিলান লিখলেন: It’s true that Tamina had not made love since the death of her husband. Not on principle. Her posthumous fidelity, on the contrary, seemed almost ridiculous to her, and she never boasted about it. But whenever she imagined undressing before a man (and she imagined it often), she saw her husband’s image before her. She knew she would she would see him if she actually did so.
কিন্তু মৃত স্বামীকে নিয়ে এই ন্যাকামিতে আটকে থাকার লেখক নন মিলান। তাঁর নায়িকার অচিরে মনে হয়, এ আবার কী! আমি এসব পাগলের মতো কী প্রলাপ বকছি। মিলান ওই অসতী বিধবা সুন্দরীকে জড়িয়ে ধরেন। প্রাবন্ধিক উপন্যাসে মিলান লিখছেন: Tamina did not push him away. He gripped her with frenzy and tried to tear off her clothes. For three years now she has fearfully been imagining such a moment. And now it has arrived, and just as she imagined it. That is why she did not defend herself… and then she was entirely naked.
নারী কিন্তু পুরুষটিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে না। পুরুষটি চেষ্টা করছে নারীর শরীরের সমস্ত ঢাকনা ছিঁড়ে ফেলতে। এতদিন এই নারী, এই অমল অসতী এই রকম একটা মুহূর্তই চাইছিল। এটাই ছিল তার যৌন স্বপ্ন। এতদিন পরে এল সেই স্বপ্নের মুহূর্ত। পুরুষটি জোরে জাপটে ধরে নারীর শরীর থেকে পোশাক ছিঁড়ে ছিঁড়ে খুলে ফেলল। এই পরমলগ্ন উপোসি বছরগুলো ধীরে নারীটির দেহে সমানে সম্মোহন দৃষ্টি ফেলেছে। তাই সে কোনও ভাষা দিল না। শেষ পর্যন্ত সে দাঁড়াল সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে। অপূর্ব উদম!
That is the beauty that vanished under the surface of the noise- the noise of words, the noise of cars, the noise of music, we live in constantly. It has been crowned like Atlantis, লিখেছেন মিলান, ঢাকনাহীন নারীদেহের এই সৌন্দর্য লুপ্ত হয়েছে অজস্র শব্দের তলায়, ডুবে গেছে আটলান্টিস-এর মতো। এর পরেই মিলানের মাস্টারস্ট্রোক: নগ্ন নারীর যোনি সম্পূর্ণ শুকনো! অসতীর অসংখ্য পুরুষস্মৃতির সঙ্গে মিশে আছে তার যোনির আর্দ্র হওয়ার এই অপারগতা।
………………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………………..
মনে পড়ে যায় শিলা কিটজিঙ্গার-এর লেখা– “Woman’s Experience of Sex” বইতে শিলার এই উক্তি: a girl likes it slow with a lot of hugging and kissing. Making love to a woman is a creative process quite different from the idea of being programmed for orgasm. The female orgasm, unlike male ejaculation, need not be an isolated event. A woman is capable of reaching climax over and over again.
নারীর রাগমোচন কতবার কতভাবে এসেছে মিলানের লেখায়, জানে তাঁর কালো লেখার টেবিলের মায়াবী আলো!
…………………….. পড়ুন কাঠখোদাই-এর অন্যান্য পর্ব ……………………
পর্ব ২৬: ভালোবাসা প্রকাশের সমস্ত শব্দ পেরিয়ে গিয়েছিল এলিয়টের লেখার টেবিল
পর্ব ২৫: যে টেবিলে জন্ম নেয় নগ্নতা আর যৌনতার নতুন আলো
পর্ব ২৪: প্রেমের কবিতার ভূত জন ডানকে ধরেছিল তাঁর উন্মাদ টেবিলে, মোমবাতির আলোয়
পর্ব ২৩: যে টেবিল আসলে বৈদগ্ধ আর অশ্লীলতার আব্রুহীন আঁতুড়ঘর!
পর্ব ২২: মহাবিশ্বের রহস্য নেমে এসেছিল যে টেবিলে
পর্ব ২১: গাছ আমাদের পূর্বপুরুষ, লেখার টেবিল বলেছিল হোসে সারামাগোকে
পর্ব ২০: টেবিলের কথায় নিজের ‘হত্যার মঞ্চে’ ফিরেছিলেন সলমন রুশদি
পর্ব ১৯: প্রতিভা প্রশ্রয় দেয় অপরাধকে, দস্তয়েভস্কিকে শেখায় তাঁর লেখার টেবিল
পর্ব ১৮: বিবেকানন্দের মনের কথা বুঝতে পারে যে টেবিল
পর্ব ১৭: ‘গীতাঞ্জলি’ হয়ে উঠুক উভপ্রার্থনা ও উভকামনার গান, অঁদ্রে জিদকে বলেছিল তাঁর টেবিল
পর্ব ১৬: যে লেখার টেবিল ম্যাকিয়াভেলিকে নিয়ে গেছে শয়তানির অতল গভীরে
পর্ব ১৫: যে অপরাধবোধ লেখার টেবিলে টেনে এনেছিল শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে
পর্ব ১৪: লেখার টেবিল গিলে নিচ্ছে ভার্জিনিয়া উলফের লেখা ও ভাবনা, বাঁচার একমাত্র উপায় আত্মহত্যা
পর্ব ১৩: হ্যামনেট ‘হ্যামলেট’ হয়ে বেঁচে থাকবে অনন্তকাল, জানে সেই লেখার টেবিল
পর্ব ১২: রবীন্দ্রনাথের লেখার টেবিল চিনতে চায় না তাঁর আঁকার টেবিলকে
পর্ব ১১: আর কোনও কাঠের টেবিলের গায়ে ফুটে উঠেছে কি এমন মৃত্যুর ছবি?
পর্ব ১০: অন্ধ বিনোদবিহারীর জীবনে টেবিলের দান অন্ধকারের নতুন রূপ ও বন্ধুত্ব
পর্ব ৯: বুড়ো টেবিল কিয়ের্কেগার্দকে দিয়েছিল নারীর মন জয়ের চাবিকাঠি
পর্ব ৮: অন্ধকারই হয়ে উঠলো মিল্টনের লেখার টেবিল
পর্ব ৭: কুন্দেরার টেবিলে বসে কুন্দেরাকে চিঠি
পর্ব ৬: মানব-মানবীর যৌন সম্পর্কের দাগ লেগে রয়েছে কুন্দেরার লেখার টেবিলে
পর্ব ৫: বিয়ের ও আত্মহত্যার চিঠি– রবীন্দ্রনাথকে যা দান করেছিল লেখার টেবিল
পর্ব ৪: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের টেবিল আর তারাপদ রায়ের খাট, দুই-ই ছিল থইথই বইভরা
পর্ব ৩: টেবিলের গায়ে খোদাই-করা এক মৃত্যুহীন প্রেমের কবিতা
পর্ব ২: লেখার টেবিল ভয় দেখিয়েছিল টি এস এলিয়টকে
পর্ব ১: একটি দুর্গ ও অনেক দিনের পুরনো নির্জন এক টেবিল