শুধু ওদের কেন, বাইরের কোনও মানুষকেও আমি আর জাজ করি না। খালি চেষ্টা করি অন্য মানুষটার জুতোতে পা গলাতে। সে কারণেই আমার নাচের স্কুলে কোনও পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। নাচ তো আনন্দের জিনিস, আমাকে তো নাচ মুক্ত করেছিল, সেখানে কেন পরীক্ষা থাকবে? পরীক্ষা থাকলেই পাশের জনের সঙ্গে একটা প্রতিযোগিতার ধারণা তৈরি হবে। তার চেয়ে বরং সবাই একসঙ্গে নাচুক আমার কাছে।
৫.
একটা জিনিস তৈরি করা কঠিন, তার থেকেও বেশি কঠিন সেটাকে ধরে রাখা। এটা ধরে রাখার জন্য আমাকে যতটা দিতে হচ্ছে, ওদেরকেও ততটাই দিতে হচ্ছে। ওদের আবদান কোথাও কম নয়। মাঝে মাঝে মনে হয় পারব তো আমি? যখন শুরু করেছিলাম, তখন অনেকে ছিলেন, এখনও বেশ কিছুজন আছেন, তবে সংখ্যাটা কম। আর তাছাড়া আমি ভেতরে না গেলে ওরা ততটা খুলতে পারে না নিজেদের। আজ ১৭ বছর হয়ে গিয়েছে, আমি ভিতরে যাচ্ছি, আজও আমাকে গিয়ে প্রথম আধঘণ্টা বসে থাকতে হয়। সবাই সবার কাজ সেরে আসে। ওদের জীবনটাই তো ওখানে ওরকম। আমি বুঝি সেটা। অনেক সময়ই আমি রেগে গিয়ে বেরিয়ে যাই, ওরা আটকাতে আসে। কিন্তু দিনের শেষে ওরা জানে, আমিও জানি যে পরদিন আমি ঠিক আসব। আমার জীবনটাও তো বদলে গেল ওদের জন্য। এই ঘটনাটা যে আমাকে এতটা প্রভাবিত করবে, বুঝিনি আগে।
আমার মুক্তি যে হবে জেলে গিয়ে, এটা ভাবতে পারিনি। নিঃস্বার্থ ভালোবাসা তো আমি প্রথমে জেলে গিয়েই জানতে পারলাম। যারা ভালোবাসতে জানে না বলে আমাদের ধারণা, তারাই আমাকে ওই ভালোবাসাটা দিল। আমিও সেটা ওদের থেকে ধারণ করলাম। ভালো না বাসলে কি আমি এতদিন এই কাজটা করতে পারতাম? অনেকেই জেল থেকে বেরিয়ে গেলে, আমার সঙ্গে তেমন যোগাযোগটা আর থাকে না। কারণ বেরিয়ে গিয়ে ওদের নতুন একটা জীবন শুরু করতে হয়। নতুন একটা দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ওরা বেরয়। ওই জীবনযুদ্ধে অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ হারিয়ে যায়, কিন্তু তবু আমাদের মধ্যে যে টান, তা কমে না। আমি ওদের কথা ভাবি, ওরা আমার কথা ভাবে– আমি জানি।
আরেকটা জিনিস আমার মধ্যে তৈরি হয়েছে ওদের সঙ্গে থেকে থেকে, সেটা হল কাউকে বিচার না করার ক্ষমতা। আমি কাউকে জাজ করি না। এই ঘটনাটা আমাকে মুক্তি দিয়েছে ওভাবেও। শুধু ওদের কেন, বাইরের কোনও মানুষকেও আমি আর জাজ করি না। খালি চেষ্টা করি অন্য মানুষটার জুতোতে পা গলাতে। সে কারণেই আমার নাচের স্কুলে কোনও পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। নাচ তো আনন্দের জিনিস, আমাকে তো নাচ মুক্ত করেছিল, সেখানে কেন পরীক্ষা থাকবে? পরীক্ষা থাকলেই পাশের জনের সঙ্গে একটা প্রতিযোগিতার ধারণা তৈরি হবে। তার চেয়ে বরং সবাই একসঙ্গে নাচুক আমার কাছে। আমি এইটুকুই চাই। সে কারণে আমি কোথাও জাজ হয়ে যাই না।
আরেকটা বড় পরিবর্তন আমার মধ্যে এসেছে, সেটা হল আমি ক্ষমা করে দিতে শিখেছি। আমি আর রাগ ধরে রাখি না, আমি কাউকে অসম্মান করি না। যেন মনে হয় সেই মানুষটার হয়তো একটা দেওয়াল আছে, সেটা খুললে অন্য দুনিয়া। সেখানে পৌঁছলেই সোনা পাওয়া যাবে।
কতখানি আত্মশুদ্ধি যে আমার হয়েছে, তার কোনও পরিমাপ হয় না। সেই জন্যই বারবার আমি উচ্চারণ করি, ‘আমার মুক্তি সর্বজনের মনে মাঝে/ দুঃখ বিপদ তুচ্ছ করা কঠিন কাজে’। আমি ওদের সবার মধ্যে নিজের মুক্তি পেয়েছি। যারা বেরিয়ে আসছে ওখান থেকে, তারা আজ অন্য মানুষ। আমি আজ অন্য মানুষ। এত বড় একটা ঘটনা আমার সঙ্গে ঘটেছে, এটা আজও আমার কাছে বিস্ময়ের।
কাগজ বেরনোর পর দেখা গেল উপন্যাসের নাম হয়ে গেছে ‘শালিকার ঠোঁট’! পূর্ণেন্দুদা রেগে আগুন। পিঠে হাত দিয়ে সন্দীপন তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন, ‘কী করবে ভাই বল! ছাপাখানার ভূত কাউকেই রেহাই দেয় না রে।’ পরে জানা গিয়েছিল এটা সন্দীপনদারই সূক্ষ্ম হাতের কাজ।