ছবির শুরুতে দেখা যায় স্থপতি ‘লাসলো টথ’ ওরফে এড্রিয়ান ব্রডি একজন উদ্বাস্তু হিসেবে হাঙ্গেরি থেকে আমেরিকা আসা মানুষ। দেখা যায় এড্রিয়ান ব্রডি একটা অন্ধকার জাহাজের ডেক থেকে হেঁটে জাহাজের জানালা দিয়ে প্রথমবার ‘স্ট্যাচু অফ লিবার্টি’ দেখে। একটা দীর্ঘ অন্ধকার ও মানুষের ভিড় পেরিয়ে আলো এসে পড়ে তার মুখে, দিনের আলো, মুক্ত আকাশের আলো। এই শর্টটিই যেন সিনেমার সারাংশ বলে দেয় দর্শককে। কীভাবে একটা নোংরা পরিবেশে কীভাবে ‘লাসলো টথ’কে একের পর এক অপমান মুখ বুজে সহ্য করে যেতে হয়েছে নিজের যোগ্য কাজ পেতে। ছবিটির চিত্রনাট্যকার ব্রডি করবেট ও মোনা ফাসভোল্ট ছবিটির চিত্রনাট্য লেখার সময় হয়তো আমেরিকার আসল রূপ দেখাতেই চেয়েছিলেন।
১৯৫০ সালের কথা, ইউরোপে বিভিন্ন দেশ যুদ্ধে ক্লান্ত। তাদের বিখ্যাত ইমারতগুলো ভেঙে পড়েছে নাৎসি বোমার আঘাতে। সেই সময় ব্রিটিশ আর্কিটেকট আলিসন আর পিটার স্মিথসন একটা নতুন ধারা নিয়ে আসলেন বিশ্বের আর্কিটেকট জগতে, নিও ব্রুটালিজম। শব্দটি সুইডিশ, কিন্তু ইউরোপের গণ্ডি ছাড়িয়ে তা পারি দিল আমেরিকাতেও। কিন্তু এই ব্রুটালিস্ট কেমন আর্কিটেকচার?
বিশ্বযুদ্ধের পরে প্রয়োজন ছিল এমন এক আর্কিটেকচারের যা দ্রুত ও কম খরচে যুদ্ধের সময়ে ভেঙে যাওয়া বিল্ডিংগুলোকে আবার সারিয়ে তুলতে পারবে অথবা দ্রুত বানিয়ে ফেলতে পারবে এমন স্থাপত্য, যাতে মানুষের জায়গার প্রয়োজন মেটাবে। ব্রুটালিস্ট আর্কিটেকচার সেই উপায় নিয়ে এল। যেখানে বাড়ি তৈরি হতে শুরু করল মিনিমালিজম প্র্যাকটিসের মাধ্যমে। যেখানে শুধু সিমেন্ট, লোহা এবং সাধারণ উপাদান ব্যবহার করেই বানিয়ে ফেলা যায় নতুন শহর। যুদ্ধের আগের ডেকরেটিভ আর্কিটেকচারের পুরো ধারণাকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে এই আর্কিটেকচার ধারা এল ইউরোপ এবং আমেরিকায়। এই ধারায় এল রং না করা, সিমেন্ট, ইট দিয়ে বানানো বিল্ডিং, যা মানুষের চাহিদা মেটাবে কিন্তু বিলাসিতা থাকবে না মোটেই।
ব্রুটালিস্ট কেন? কারণ এই বিল্ডিংগুলো দেখতে একেবারেই যুদ্ধের আগের সাজানো সুন্দর ইমারতের মতো নয়, বরং রং না করা, লোহা আর সিমেন্ট দিয়ে বানানো, রুক্ষ চেহারা। কেমন এক পাশবিক স্ট্রাকচারের মতো। সেই থেকে ব্রুটালিস্ট নাম হল এই বিশেষ ধারার।
এই ব্রুটালিস্ট আর্কিটেকচারের জগতে একজন স্থপতির কথা বলা এখানে খুবই জরুরি, তিনি হাঙ্গেরীয়-জার্মান স্থপতি মার্সেল ব্রুয়ার। ২০২৫ সালের শ্রেষ্ঠ অভিনেতা চরিত্রে অস্কার পাওয়া আয়ড্রিয়ান ব্রডি ‘দ্য ব্রুটালিস্ট’ সিনেমায় ‘লাসলো টথ’ চরিত্রটি হাঙ্গেরীয়-জার্মান স্থপতি মার্সেল ব্রুয়ারের জীবন দ্বারা অনুপ্রাণিত।
ব্রুটালিস্ট সিনেমা অনেকে দেখেছেন, অনেকে শুনেছেন, অনেকে ট্রেলার দেখে ভেবেছেন এই সিনেমা হয়তো নাৎসি অত্যাচার নিয়ে বানানো। কিন্তু ছবিটি দেখলে বুঝতে পারবেন যে, এই সিনেমা আসলে সেই চিরায়িত আমেরিকান সত্যকে সামনে এনে দেয়। ঠিক যেভাবে আমেরিকা আজকের দিনে আমাদের দেশের রিফিউজিদের হাতে-পায়ে শিকল বেধে, দেশে ফেরত পাঠাল, ঠিক একই ব্যবহার তারা তাদের দেশে আসা সমস্ত ‘বৈধ’ শরণার্থীর সঙ্গেও করেছে। এই সিনেমা মূলত তাই নিয়েই, ইউরোপ ছেড়ে প্রাণ বাঁচিয়ে আমেরিকায় পালিয়ে আসা মানুষরা ভেবেছিল হয়তো এক নতুন দেশ নতুন স্বপ্ন তাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে, কিন্তু ধীরে ধীরে তারা বুঝেছিল তারা আসলে নাৎসি কনসেনট্রেশন ক্যাম্প থেকে পালিয়ে এক নতুন ধরনের ক্যাপিটালিস্ট খাঁচায় ঢুকে পড়েছে, যেখানে তাদের প্রতি মুহূর্তে মনে করিয়ে দেওয়া হবে, তারা উদ্বাস্তু।
…………………………………….
সিনেমাটির কয়েকটি জিনিস না বললে এই লেখাটি অসমাপ্ত থেকে যেতে পারে। আমেরিকায় আসার পরে লাসলো টথ তার এক আত্মীয় এটিলা আর তার স্ত্রী অড্রের বাড়িতে থাকতে শুরু করে। প্রতিটি ব্যবহারে টথ লক্ষ করে কীভাবে তার আত্মীয় এটিলা তার ব্যবহারে ধীরে ধীরে আমেরিকান হয়ে যেতে শুরু করেছে, তার শব্দ উচ্চারণ থেকে শুরু করে লাসলোর নামটিও সে আমেরিকান ভঙ্গিতে উচ্চারণ করা শুরু করে।
…………………………………….
এই ‘উদ্বাস্তু’ শব্দটির সঙ্গে আমাদের খুব ভালোই পরিচয় আছে। আমার মাঝেমঝেই এদিক-এদিক বলে ফেলি ‘উদ্বাস্তু’ সমস্যার কথা। আজকাল আর ‘বাঙাল’দের উদ্বাস্তু এবং ওরা পশ্চিমবঙ্গকে কীভাবে নোংরা কলোনিতে পরিণত করেছে– সে কথাও শোনা যেত কলকাতার বিভিন্ন আড্ডায় আটের দশক অবধি। আমেরিকাতেও তাই হয়েছিল। একদিকে সরকার তাদের আশ্রয় দিচ্ছে বলে ক্রেডিট নিচ্ছে আর অন্যদিকে তাদের অপমানিত হতে হয়েছে প্রতিনিয়ত। এই সিনেমা সেই অপমান নিয়েই।
ছবির শুরুতে দেখা যায় স্থপতি ‘লাসলো টথ’ ওরফে এড্রিয়ান ব্রডি একজন উদ্বাস্তু হিসেবে হাঙ্গেরি থেকে আমেরিকা আসা মানুষ। দেখা যায় এড্রিয়ান ব্রডি একটা অন্ধকার জাহাজের ডেক থেকে হেঁটে জাহাজের জানালা দিয়ে প্রথমবার ‘স্ট্যাচু অফ লিবার্টি’ দেখে। একটা দীর্ঘ অন্ধকার ও মানুষের ভিড় পেরিয়ে আলো এসে পড়ে তার মুখে, দিনের আলো, মুক্ত আকাশের আলো। এই শর্টটিই যেন সিনেমার সারাংশ বলে দেয় দর্শককে। কীভাবে একটা নোংরা পরিবেশে কীভাবে ‘লাসলো টথ’কে একের পর এক অপমান মুখ বুজে সহ্য করে যেতে হয়েছে নিজের যোগ্য কাজ পেতে। ছবিটির চিত্রনাট্যকার ব্রডি করবেট ও মোনা ফাসভোল্ট ছবিটির চিত্রনাট্য লেখার সময় হয়তো আমেরিকার আসল রূপ দেখাতেই চেয়েছিলেন।
সিনেমাটির কয়েকটি জিনিস না বললে এই লেখাটি অসমাপ্ত থেকে যেতে পারে। আমেরিকায় আসার পরে লাসলো টথ তার এক আত্মীয় এটিলা আর তার স্ত্রী অড্রের বাড়িতে থাকতে শুরু করে। প্রতিটি ব্যবহারে টথ লক্ষ করে কীভাবে তার আত্মীয় এটিলা তার ব্যবহারে ধীরে ধীরে আমেরিকান হয়ে যেতে শুরু করেছে, তার শব্দ উচ্চারণ থেকে শুরু করে লাসলোর নামটিও সে আমেরিকান ভঙ্গিতে উচ্চারণ করা শুরু করে। ধীরে ধীরে টথ বুঝতে পারে যে, এটিলা অড্রেকে বিয়ে করার জন্য তার ধর্ম পরিবর্তন করে ক্যাথলিক হয়েছে। সে এড্রিয়ান ব্রডিকে বোঝায় কীভাবে এই নতুন দুনিয়ায় মানিয়ে নিতে গেলে নিজের ফেলে আসা সব কিছু ছেড়ে দিয়ে ‘নতুন আমেরিকান’ হয়ে উঠতে হবে।
ছবির এক জায়গায় আছে, যেখানে টথ-কে একসময়ে অপমান করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া এক ধনী আমেরিকান বিজনেসম্যান টথ-এর সঙ্গে দেখা করতে আসে, সেই সময় যখন টথ কয়লার গুদামে কাজ করে এবং নিজে নেশাগ্রস্থ হয়ে পড়েছে। সেই দৃশ্য সেই বিজনেসম্যান তাকে একটি খামে টাকা দিতে যান। সেই সময় এড্রিয়ান ব্রডির অভিনয় আবার ‘পিয়ানিস্ট’-কে মনে করিয়ে দিল। কাঁপা কাঁপা হাতে, তার চোখ দুটো কেমন যেন জ্বলে ওঠে। মনে হয় এ হয়তো এক্ষুনি কেঁদে ফেলবেন এড্রিয়ান ব্রডি।
এবার আসি এড্রিয়ান ব্রডির অভিনয়ে। যারা ‘পিয়ানিস্ট’ দেখেছেন, তাঁদের নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না এড্রিয়ান ব্রডি কে এবং কী মাপের অভিনেতা। ‘ব্রুটালিস্ট’ প্রায় তিন ঘণ্টা একুশ মিনিট লম্বা একটি ছবি। আজকের দর্শকের কাছে যা সত্যিই খুব লম্বা একটি সিনেমা। কিন্তু পুরো সিনেমায় এড্রিয়ান ব্রডির অভিনয় দক্ষতা এতটাই প্রবল যে, দর্শক এক মুহূর্ত নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারবে না। সিনেমাটি দেখতে দেখতে একপ্রকার বোঝা যাচ্ছিল যে, অস্কার কমিটির কোনও উপায় নেই অন্য কাউকে সেরা অভিনেতার শিরোপা দেওয়ার। এডিয়ান ব্রডির অভিনয় দক্ষতা এমনই প্রবল যে দর্শক ছবিটি দেখতে দেখতেই বুঝতে পারবেন যে, এ বছরের ‘অস্কার ফর বেস্ট অ্যাক্টর’ এড্রিয়ান ব্রডি ছাড়া অন্য কারও প্রাপ্য হতেই পারে না। ২০০৩ সালে ‘দ্য পিয়ানিস্ট’ ছবিটির জন্য অস্কার পেয়েছিলেন এড্রিয়ান ব্রডি, তারপর দীর্ঘ ২২ বছর পরে অপেক্ষায় অবসান হল। এবার আবার অস্কার পেলেন এড্রিয়ান ব্রডি সেরা অভিনেতার ভূমিকায়।
‘দ্য ব্রুটালিস্ট’ সিনেমার নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে অনেক কিছু। যে যুদ্ধ পরবর্তী আমেরিকান সমাজ আমরা সিনেমায় দেখতে পাই, তার মধ্যে অবশ্যই এক নীরব পাশবিক মুড রয়েছে। যা প্রতি মুহূর্তে আমাদের চোখের সামনে ‘রিফিউজি’ শব্দটির এক ভয়ংকর উপাখ্যান তুলে ধরে। আমরা যারা ভাবি নাৎসিদের অত্যাচার থেকে পালিয়ে ইহুদিরা আমেরিকায় গিয়ে সুখে ছিল, এই সিনেমা তাদের দেখা উচিত, তাহলে বোঝা যাবে ‘আমেরিকান ড্রিম’ আসলে কতটা ফাঁপা ছিল সেই সময়েও।