Robbar

কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতিভা নিয়ে যতবার প্রশ্ন উঠবে, ততবারই সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে ক্ষমতার কাছে

Published by: Robbar Digital
  • Posted:June 17, 2025 7:40 pm
  • Updated:June 17, 2025 7:40 pm  

তথ্য বলবে– দক্ষিণ আফ্রিকার সমগ্র জনসংখ্যার মাত্র ৮% অ-কৃষ্ণাঙ্গ। তারপরেও কোটা নির্মাণ করতে হবে কেন কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য? কোটা যদি রাখতেই হয় অ-কৃষ্ণাঙ্গদের জন্যই রাখা উচিত। কোথাও কি ভুল হচ্ছে না হিসাবে? কথা উঠবে ট্যালেন্ট নিয়েও। ঠিক কথা। ট্যালেন্ট ছাড়া ক্রিকেটের মতো প্রথম সারির খেলাতে তল পাওয়া দায়। কিন্তু যত ট্যালেন্ট– সব অ-কৃষ্ণাঙ্গদের? তথাকথিত কৃষ্ণাঙ্গদের কি ট্যালেন্টের এতই অভাব? নাকি দায়ভারে থেকে ঠিকঠাক দায়িত্ব পালন করছেন না ক্ষমতাবানেরা?

অভিজিৎ হালদার

১ নভেম্বর ১৯৯৮। দক্ষিণ আফ্রিকা প্রথমবার আইসিসি নক আউট ট্রফি জিতেছিল হ্যান্সি ক্রোনিয়ের নেতৃত্বে। তারপর থেকেই ‘চোকার্স’ তকমা গ্রাস করে প্রোটিয়াদের। আইসিসি টুর্নামেন্টের নক আউট পর্যায়ে যাওয়ার পরেও অধরা থেকেছে ট্রফি। ১৪ জুন ২০২৫– দ্বিতীয়বার আইসিসি ট্রফি জিতে সেই চোকার্স তকমা ঘুচিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা। প্রতিপক্ষ শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে ইতিহাস রচনা করেছে তেম্বা বাভুমার দল।

হ্যান্সি ক্রোনিয়ের নেতৃত্বে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়ী দক্ষিণ আফ্রিকা টিম

অথচ কয়েকমাস আগে এই দক্ষিণ আফ্রিকা টিম অন্তর্দ্বন্দ্বে জেরবার হয়েছিল, বর্ণবিদ্বেষের কারণে। ঠিকঠাক ১১ জন প্লেয়ারও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না দলগঠনের জন্য। ২০২১ সালে প্রথমবার কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে থেকে স্থায়ী ক্যাপ্টেন হিসাবে তেম্বা বাভুমা দায়িত্ব পাওয়ার পরেও অপমানিত হতে হয়েছিল তাঁকে। বারবার শুনতে হয়েছে ‘কোটার ক্যাপ্টেন’। দৈহিক গঠন ও বর্ণ নিয়েও কম লাঞ্ছিত হতে হয়নি তেম্বা-কে। এই টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের লড়াইয়েও তাঁর ক্যাপ্টেন্সি নিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠেছে। তারপরেও টানা আট ম্যাচ জিতে আইসিসি ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ট্রফি তুলেছে প্রোটিয়া বাহিনী।

Image
বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ী দক্ষিণ আফ্রিকা, মধ্যমণি অধিনায়ক তেম্বা বাভুমা

ইতিহাসের পূর্বধারা বলবে– দক্ষিণ আফ্রিকা টানা ২১ বছর (১৯৭০-১৯৯১) বর্ণবিদ্বেষের কারণে ক্রিকেট থেকে নির্বাসিত ছিল। ১৯৯৯ সালে ‘কৃষ্ণাঙ্গ প্লেয়ার নিয়ম’-এর পরিবর্তন ঘটে, প্রবর্তিত ধারায় সুনিশ্চিত করা হয় ‘কোটার প্লেয়ার’ হিসাবে টিমে কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান প্লেয়ার থাকতেই হবে। বিগত দশকের শুরুর দিকে ২০১৩ সাল নাগাদ আফ্রিকান সরকারের চাপের মুখে পড়ে ক্রিকেট দক্ষিণ আফ্রিকা প্রাদেশিক পর্যায়ে ‘কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান’ খেলোয়াড়দের জন্য বিশেষ কোটা চালু করে এবং নির্ধারিত হয় প্রতি ম্যাচে দলে কমপক্ষে একজন কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান এবং ৫ জন কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটার থাকা বাধ্যতামূলক। ২০১৫ সালের অক্টোবরের মধ্যে এই সংখ্যা এসে দাঁড়ায় ৩ জন কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান এবং ৬ জন কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়ে। প্রাথমিকভাবে পরের দিকে জাতীয় দল থেকে কোটা বর্জন করা হয়েছিল। কিন্তু ২০১৬ সালে প্রাদেশিক দলে ৫৪% কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড় নির্বাচনের লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করা হয়েছিল, যার মধ্যে ১৮% কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান থাকতেই হবে বলে নির্ধারিত হয়।

প্রশ্ন উঠবে– নিয়ম কিংবা কোটার জাঁতাকলে পড়ে কি দক্ষিণ আফ্রিকার দলকেই খেসারত দিতে হচ্ছে? তথ্য যদিও অন্য কথা বলবে। একথা ঠিক যে, কোটার ফলে দক্ষিণ আফ্রিকা টিমে সিংহভাগ স্থান কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানদের জন্য নির্ধারিত। কিন্তু খাতায়-কলমে কতজন প্রথম এগারোতে স্থান পাচ্ছে? ২০২৪ সালের আইসিসি টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম একাদশে মাত্র একজন কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান প্লেয়ার নির্বাচিত হয়েছিল।

T20 World Cup 2024 SF 1 SA vs AFG highlights: South Africa break semis jinx, enter first-ever final | News - Business Standard

তথ্য বলবে– দক্ষিণ আফ্রিকার সমগ্র জনসংখ্যার মাত্র ৮% অ-কৃষ্ণাঙ্গ। তারপরেও কোটা নির্মাণ করতে হবে কেন কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য? কোটা যদি রাখতেই হয় অ-কৃষ্ণাঙ্গদের জন্যই রাখা উচিত। কোথাও কি ভুল হচ্ছে না হিসাবে? কথা উঠবে প্রতিভা নিয়েও। ঠিক কথা। ট্যালেন্ট ছাড়া ক্রিকেটের মতো প্রথম সারির খেলাতে ঠাঁই পাওয়া দায়। কিন্তু যত প্রতিভা– সব অ-কৃষ্ণাঙ্গদের? কৃষ্ণাঙ্গদের কি প্রতিভার এতই অভাব? নাকি ঠিকঠাক দায়িত্ব পালন করছেন না ক্ষমতাবানেরা?

আসলে তথাকথিত কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতিভা নিয়ে যতবার প্রশ্ন উঠবে, ততবারই সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে ক্ষমতার কাছে। এর উত্তর দিতে কৃষ্ণাঙ্গরা বাধ্য নয়। স্পষ্ট কথা: দায়িত্বপ্রাপ্ত ক্রিকেট প্রশাসকদের এমন এক পরিকাঠামো নির্মাণ করতে হবে যে, প্রতিভা বিষয়ক কোনও প্রশ্ন না উঠতে পারে। ‘ট্যালেন্ট হান্টার্স’-রা কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে থেকে ট্যালেন্ট খুঁজে বের করুক, তারপর না হয় এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কথা ভেবে দেখবে তথাকথিত কৃষ্ণাঙ্গরা।

………………………….

পড়ুন অম্লান চক্রবর্তী-র লেখা: ক্রিকেটের শাপমোচন কি আদৌ বদলাতে পারবে দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ-বিদ্বেষ?

…………………………..

প্রায় ২৭ বছর পর দক্ষিণ আফ্রিকার শাপমোচন ঘটল আইসিসির মঞ্চে। ‘চোকার্স’ তকমাও ঘুচল তেম্বা বাভুমার হাত ধরে। তারপরেও শোনা যাবে– ‘লাক ফ্যাক্টর কাজ করেছে’! সত্যিই কি তেম্বা ভাগ্যবান? টানা আট ম্যাচ তাঁর নেতৃত্বে জয় আর যাই হোক, শুধু ভাগ্য দিয়ে হয় না। দক্ষিণ আফ্রিকার ভালো টিম নির্বাচন এবং অনবদ্য ক্যাপ্টেন্সির নিদর্শন মাঠেই স্পষ্ট হয়েছে। আর সে-কারণেই দক্ষিণ আফ্রিকা টেস্ট ফরম্যাটে শ্রেষ্ঠত্বের তকমা অর্জন করতে পেরেছে। অজিদের আশাহত হয়ে মাঠ ছাড়তে হয়েছে।

Temba Bavuma makes history as first unbeaten captain to lift WTC mace
টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ী প্রোটিয়া অধিনায়ক তেম্বা বাভুমা

এরপরেও তেম্বা বাভুমার ক্যাপ্টেন্সি নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। প্রশ্ন উঠবে প্রতিভা নিয়েও। এবারের টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে তথাকথিত কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানের সংখ্যা সর্বসাকুল্যে তিনজন। কাগিসো রাবাডা, লুঙ্গি এনগিডি ও তেম্বা বাভুমা। রাবাডা, এনগিডির অভাবনীয় বোলিং, বাভুমার লড়াকু ব্যাটিংয়ের পাশে স্মরণীয় শতরানের ইনিংস উপহার দিয়েছেন এইডেন মার্করামও। তারপরেও কি বলা থামবে– কাগিসো রাবাডা, লুঙ্গি এনগিডিরা ‘কোটা’র প্লেয়ার? কিংবা তেম্বা বাভুমা ‘কোটা’র ক্যাপ্টেন? এত ভালো পারফরম্যান্সের পরেও তাঁরা ‘কোটা’হীন হবেন না?

আসলে তাঁরা ‘কোটা’র প্লেয়ার হয়ে থাকলেই লাভ বোধহয় অন্যপক্ষের। তাঁরা ‘কোটা’ বহির্ভূত হলেই বিপদ, তাহলেই যে আবার তথাকথিত প্রতিভাহীন কৃষ্ণাঙ্গরা জায়গা পাবে! খেলার মাঠের পারফরম্যান্সের নিরিখে ‘কোটা’ বিরোধীদের সওয়ালগুলোকে গুরুত্ব দিলে তথাকথিত ‘কোটা’র প্লেয়াররা কিন্তু ‘কোটা’হীন স্থানের দাবিদার হবে। তখন আবার স্থান সংকুলান হবে না তো ‘কোটা’ বহির্ভূত প্লেয়ারদের?

…………………………………

ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার ডিজিটাল

…………………………………