Robbar

পথকুকুরদের সরানোর রায় আসলে নিরাপত্তার মুখোশের আড়ালে হিংসার স্বীকৃতি

Published by: Robbar Digital
  • Posted:August 19, 2025 6:47 pm
  • Updated:August 19, 2025 7:48 pm  
On Supreme Court order about street dogs of Delhi

ঢিল মেরে, ল‌্যাজে কালীপটকা বেঁধে, অত‌্য‌াচার করে, মুখে চকোলেট বোম ফাটিয়ে, ধর্ষণ করে, মাংস হিসাবে খেয়ে ব‌্যবহার করার মতো কোনও নরম শিকারের অস্তিত্ব নেই শহরের রাস্তায়। ফুটপাথে শুয়ে থাকা লোকটা কিন্তু সেদিন অপ্রয়োজনীয়, কিংবা নরম শিকার; তারাও ক্রমশ শেষ হয়ে এল একদিন, তারপর নিম্নবিত্তরা, তারপর মধ‌্যবিত্তরা– আমি আপনি সবাই। সবাই অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাব একদিন, হয়ে যাব বিপজ্জনক, হয়ে যাব নরম শিকার– এই শিকার শিকার খেলায়।

তথাগত মুখোপাধ্যায়

‘কলকাতা এখন এক অসাড়, অপেক্ষমাণ পিঁজরাপোল, তার শাস্তি মৃত্যু।’

(লুব্ধক, নবারুণ ভট্টাচার্য)

কলকাতার পরিবর্তে শহরটার নাম অনায়াসে দিল্লি হতে পারে, কিংবা কেরল, অথবা ভারতের যে-কোনও জায়গা। কিন্তু না, কোনও ‘লুব্ধক’ নামের উল্কাপিণ্ড পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসছে না, আজ অন্তত নয়। আজ সেই দিন, যেদিন সুপ্রিম কোর্ট নিজের পূর্ববর্তী রায়কে নস‌্যাৎ করে দিয়ে নতুন রায় দেবে, যাতে নির্ভর করে থাকবে ১০ লক্ষ নিশ্বাসের ভবিষ‌্যৎ। ১০ লক্ষ পথকুকুর, যাদের প্রত্যেকদিনের বেঁচে থাকাটুকু অর্জন করতে হয়। ডাস্টবিন খুঁটে, খাবার দোকানগুলোর সামনে অপেক্ষা করতে করতে গরমে যখন সবটা নিভে আসে, তখন এক-আধটা বিস্কুটের দয়া যেন ভেতরে ভেতরে আস্ত নেবুলার বিস্ফোরণ। সেরকম ১০ লক্ষ ব্রহ্মাণ্ডের মৃত্যুর ফরমান জারি করেছে কয়েকজন মানুষ। যেভাবে হিটলার ইহুদিদের জন‌্য ক‌্যাম্প সাজানোর এক চমৎকার অভিনয় আয়োজন করেছিলেন, ঠিক সেভাবে দেশের সর্ব্বোচ্চ আদালত নির্দেশ জারি করেছে শেলটার তৈরি করার। সব ঢাকা পড়ে যাবে কনসেনট্রেশন শেলটারের আড়ালে। এক্ষেত্রে আসলে টেরিটোরিয়াল কয়েক লক্ষ প্রাণীকে ঠেলে দেওয়া হবে পাঁচিল ঘেরা পরিখার ভেতর, একসঙ্গে। তারপর প্রয়োজনে, তাগিদে, অভাবে একে অপরের মাংস ছিঁড়ে খাক। যে ১০ লক্ষ কুকুরের অস্তিত্ব নিয়েই সচেতন নয়, তাদের নিছক টিকিয়ে রাখার তাগিদে, প্রাণরক্ষার তাগিদে যে একটা টাকাও খরচ হবে না, তা সন্দেহের অবকাশ রাখে না। যদিও বা কিছু টাকা বরাদ্দ হয়, অন্তত সোশ‌্যাল মিডিয়ায় ইমেজ রক্ষার খাতিরে– তবে নিশ্চিত তা কোনও মন্ত্রীর সন্তানের বিয়ের বাৎসরিক বাজেটের অন্তর্ভুক্ত।

প্রয়োজনের চেয়ে যা কিছু উদ্বৃত্ত তাই ক্ষমতা, আর ক্ষমতার চোখে সবসময়ই লোভের ঠুলি। ঘটনাচক্রে এবার সুপ্রিম কোর্টের এই সুয়োমোটো অর্থাৎ নিজেই কেস গ্রহণ এবং ১০ লক্ষ পথপশুর মৃত্যু পরোয়ানার কারণ দুই রাজনৈতিক ব‌্যক্তিত্বের ইগোর সংঘাত। অবহেলিত, উপেক্ষিত এই কুকুরেরা নিছক চরিত্র মাত্র, যাদের ব‌্যক্তিগত ইগো ডুয়েলের বুলেটের সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাস্তায় অহেতুক এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ানো ওই চলমান লেজগুলোর ভালোবাসাটুকুই সার, বাকি সব– অক্ষমদের যেমনটা হয়, বাজারের তাগিদে গুরুত্ব।

এই মুহূর্তে ভারতবর্ষের বাজার আসলে কুকুর নামক পণ্যের বিজ্ঞাপনে ক্লান্ত। এ ক্লান্তির কারণ কুকুরদের গ্রহণযোগ‌্যতা নয়, ভারতের মানুষের এই মুহূর্তের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম। যে অস্তিত্ব সংগ্রামে স্বাধীনতা দিবসে পাঁঠার মাংসের দোকান মাছি তাড়ায়, ঠিক সেই অস্তিত্বের তাগিদে কুকুর আজ বাড়তি। জিডিপি তলানিতে এসে ঠেকা একটা দেশে, যেখানে পছন্দসই শাকসবজি বাজার থেকে কেনা কে. সি. নাগের অংক কষার মতোই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে অন‌্য প্রাণীদের প্রতি সংবেদনশীলতা নিছকই কষ্টকল্পনা।

মানুষ বরাবরই হিংস্র প্রাণী, আর তার সেই হিংস্র স্বভাবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মেধা; ফলত অপেক্ষাকৃত অনুন্নত দুর্বল প্রাণীকে দূর থেকে বন্ধুকের গুলি মেরে খুন করাকে ‘খেলা’ বলতে দ্বিতীয়বার ভাবতে হয়নি মানুষকে। যেখানে সালটা ২০২৫, বন্দুকের গুলির চেয়ে বেশি শক্তিশালী ট্রোলিং। বারুদের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ‘শব্দ’, মেধার চেয়ে জরুরি ‘ফলোয়ার্স’, প্রতিবাদের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ‘ভাইরাল’ আর জীবনের চেয়ে দামি সাামজিক অবস্থান– এহেন পরিস্থিতিতে ভাবা যাক সেইসব না-মানুষদের কথা যাদের ভোট দেওয়ার ক্ষমতা নেই, স‌্যর ডারউনের তত্ত্বে যারা এই মুহূর্তে ভারতের উন্নয়নশীল সমাজে সাধারণ নির্বাচনের বাইরে। অথচ প্রকৃতির কাছে তাদের অস্তিত্বের গুরুত্ব নেহাৎ কম নয়, শুধু তারা অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে ভারতের উন্নয়নশীল বাজারে। মধ‌্যবিত্তরা দরিদ্র, দরিদ্ররা হতদরিদ্র, আর হতদরিদ্ররা আজ মৃত্যুপথযাত্রী; সেখানে চারপেয়ে বোবা কুকুরেরা অবান্তর।

আশেপাশে আর একটাও চড়াই নেই এ-শহরে, কে খবর রেখেছে তার! ভারতীয় চিতারা অবলুপ্ত বহুদিন, কারওর খাবার পাতে মাংসের টুকরো বাড়েনি বা কমেনি তাতে; বরং অনুপ্রবেশকারীরা সরকারী অনুমোদনে বৈধ বা অবৈধভাবে জঙ্গলের ভেতরে, ক্রমশ ভেতরে বাড়ি তৈরি করেছে; সরকার তৈরি করেছে রাস্তা, ট্রেনলাইন, সংরক্ষিত বন, শিল্পপতিরা তৈরি করেছে মোচ্ছবের রিসর্ট, সাফারি, বাঘের সঙ্গে সেলফি; আর তারপর যখন বাঘ বা হাতির হাতে মানুষ মরেছে, তখন খবরের কাগজের প্রথম পাতায় বিজ্ঞাপন হয়েছে– ‘বন‌্যপ্রাণীর হাতে মানুষের মৃত্যু’।

মানুষই এ পৃথিবীতে সেই বিরল প্রাণী যে সহাবস্থানে কোনওদিন বিশ্বাস করেনি। ইতিহাস সাক্ষী– কলম্বাসের জাহাজ যেদিন অধুনা আমেরিকার তটে নোঙর ফেলল, সেদিনই ওই দ্বীপের সমস্ত ডোডো পাখির মৃত্যুর এপিটাফ লেখা হয়ে গিয়েছিল। প্রাকৃতিক নির্বাচনের চেয়ে ঢের দ্রুতগতিতে মানুষ অজস্র প্রাণী প্রজাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। একমাত্র প্রজাতি, যারা অন‌্যকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পায়– প্রয়োজন ছাড়া, কারণ ছাড়া, মৃতদেহের বুকে পা রেখে গর্বিত ছবি তুলতে ভালোবাসে বরাবর। তাই সুপ্রিম কোর্টে দিল্লির সমস্ত পথ-কুকুরদের ‘সাফ’ করে ফেলার এই রায় একেবারেই নতুন কিংবা আশ্চর্য কিছু নয়। প্রবণতা বরাবর এটাই ছিল, শুধু সুযোগের অপেক্ষা। সোশ‌্যাল মিডিয়ার যুগে হিংসাকে নিরপত্তার মুখোশ পরানোর সুযোগ। প্রয়োজনে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স দিয়েও কুকুরদের শিশু আক্রমণের ভিডিও নির্মাণ করা হচ্ছে। কেরালাতে ২০১৬-১৭ সালে নির্বিচারে কুকুরদের পিটিয়ে মারার সময় সে দায়টুকুও ছিল না।

১৯৯২-৯৩ সালে যখন শেয়ালের ডাকে কুকুরের ডাকে তৎকালীন মুখ‌্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর ঘুমের ব‌্যাঘাত ঘটত, তখন উনি সমস্ত কুকুরদের শেলটারে আটকে রাখার একই উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। কলেজের ছাত্রছাত্রীদের লড়াইয়ে সেবার কলকাতার কুকুরেরা বেঁচে যায়, নইলে সেসময়েই কলকাতা কুকুরশূন‌্য হয়ে যাওয়ার কথা। ভাগ্যিস! আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স থাকলে বেশ কিছু ভিডিও তখনও দেখা যেত যে, বাগবাজারে, ভবানীপুরে, গল্ফ ক্লাবে কুকুরেরা দল বেঁধে আক্রমণ চালাচ্ছে অসহায়, নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষদের ওপর। সম্পূর্ণ আজকের দিল্লি হতে পারত কলকাতা।

বিগত তিন বছরে দিল্লিতে কুকুরজনিত রোগ রেবিসে মৃতের সংখ‌্যা শূন‌্য, বাকি অপরাধের সংখ‌্যার পরিসংখ‌্যান বাদ দিয়ে যদি শুধু ধর্ষণের সংখ‌্যা গোনা হয়– হয়তো একই নিয়মে দিল্লির সমস্ত পুরুষদের শেলটারে বন্দি করে রাখা উচিত। এবং কোনও অবস্থাতেই ছাড়া সম্ভব নয়। এসবই যুক্তির কাঠগড়া, সেখানে না-মানুষ তথা কুকুরদের হয়ে সওয়াল জবাবের জন‌্য কেউ নেই।

ধরে নেওয়া যাক ১০-১৫ বছর পরের ভারত, যেখানে শহরে কোনও অপ্রয়োজনীয় প্রাণ জীবিত নেই। ঢিল মেরে, ল‌্যাজে কালীপটকা বেঁধে, অত‌্য‌াচার করে, মুখে চকোলেট বোম ফাটিয়ে, ধর্ষণ করে, মাংস হিসাবে খেয়ে ব‌্যবহার করার মতো কোনও নরম শিকারের অস্তিত্ব নেই শহরের রাস্তায়। ফুটপাথে শুয়ে থাকা লোকটা কিন্তু সেদিন অপ্রয়োজনীয়, কিংবা নরম শিকার; তারাও ক্রমশ শেষ হয়ে এল একদিন, তারপর নিম্নবিত্তরা, তারপর মধ‌্যবিত্তরা– আমি আপনি সবাই। সবাই অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাব একদিন, হয়ে যাব বিপজ্জনক, হয়ে যাব নরম শিকার– এই শিকার শিকার খেলায়। যেন শ্রীকৃষ্ণের সেই যদুবংশ, আর এই ভারতবর্ষ দ্বারকা। শিকার শেষ হয়ে গেলেও শিকারের অভ্যেস আমাদের রক্তের প্রতিটা কণিকায় থেকে যাবে, তাই শিকার না পেলে একদিন নিজেদের শিকার করব আমরা। আপাতত দিল্লির পথকুকুরদের শিকার হোক আইনসম্মতভাবে। আরশোলা, মশা, মাছি মেরে ফেলতে হাত কাঁপে না একবারও, প্রজাপতি মারতে কাঁপে। মানুষের নৈতিকতা এতটাই ভণ্ড।

আমি জানি কোনও লুব্ধক চ‌্যাটার্জি কুকুরের মুখোশ পরে শহরের রাস্তায় অপরাধীদের শাস্তি দেবে না। তাই অপেক্ষা লুব্ধকের জন‌্য নয়, কালপুরুষের। নক্ষত্রমণ্ডলে যার পায়ের কাছে লুব্ধকের অবস্থান। সেই বিশ্বস্ত বন্ধুকে রক্ষা করতে কালপুরুষ নিশ্চয়ই আসবে এবার। খাদ‌্যশৃঙ্খলের যে নিয়মে হরিণ ঘাস খায়, বাঘ হরিণকে খায়– সেই নিয়মকে জ‌্যান্ত রাখতে কালপুরুষকে এবার আসতেই হবে। নইলে সর্বাগ্রাসী মানুষ পুরাণের দৈত্যের মতো সবটা গ্রাস করতে উদ‌্যত– প্রকৃতি-প্রাণ সবটা। এবার যুদ্ধ প্রয়োজন। নিয়মের, যুক্তির, মানবিকতার তাৎপর্য আজ বিলুপ্ত হয়েছে। তাই যুদ্ধ প্রয়োজন। আর এ-লেখা সে যুদ্ধেরই ঘোষণা মাত্র। দিকভ্রষ্ট জাহাজ যেভাবে শুকতারার অবস্থানে দিক খুঁজে নিত, ঠিক সেভাবে কালপুরুষ আমাদের দিকনির্দেশ করবে।

কারণ এ কালপুরুষ কোনও কাল্পনিক চরিত্র নয়, রক্তমাংস অস্থিমজ্জার জ‌্যান্ত মানুষ। নিজেদের সামান‌্য প্রাপ‌্য থেকে যারা অসহায়, অবলা, বঞ্চিতদের মুখে খাবার তুলে দিয়েছে, যারা ভালোবাসার বদলে শুধুই ভালোবাসা ফেরত দিয়েছে কোনও স্বার্থ ছাড়া, যাদের চেতনা সংবেদনশীল হয়েছে অপরিচিত, অপ্রয়োজনীয়দের ব‌্যথায়– তারাই ‘কালপুরুষ’, অনন্ত বসন্তের সম্ভাবনা। আমি দেখেছি তাদের– গাড়ি নেই, এসি নেই, দু’ বেলা দু’ মুঠো খাবার টাকা নেই– তবু বালতি হাতে রাস্তার অবলাদের মুখের সামনে খাবার তুলে দেন রোজ। প্রয়োজনে টাকা চান মানুষের কাছে– কোনও পথকুকুর দুর্ঘটনায় আহত হয়ে পড়ে আছে রাস্তার ধারে, তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে বুকে ধরে প্রাণ দেন এঁরা। আমি চিনি এদের, দেখি রোজ। এঁরা কালপুরুষ, এঁরাই সেই অনন্ত সম্ভাবনা– যা হয়তো এবার মানব সভ‌্যতাকে বাঁচালেও বাঁচিয়ে দিতে পারে।

কোভিড প্রমাণ করেছে মানুষ ছাড়া পৃথিবী কত তাড়াতাড়ি আরোগ‌্য লাভ করতে পারে। এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে যারা একটি প্রাণ রক্ষার জন‌্যও লড়াই করতে পারেন– তাঁরাই ভবিষ‌্যত, তাঁরাই সম্ভাবনা, তাঁরাই কালপুরুষ। তাঁরা সংখ‌্যায় কম হতে পারেন কিন্তু এই দিকভ্রষ্ট দেশে তাঁরা ধ্রুবতারা। এই কঠিন সময়ে সংবেদনশীলতার চেয়ে বড় কোনও ধর্ম নেই, যুক্তি নেই, চেতনা নেই। ভালোবাসার চেয়ে বড় কোনও জ্ঞান নেই এ মুহূর্তে, এ পৃথিবীতে। কালপুরুষরা আসবে, কালপুরুষরা আসুক, সাম‌্য প্রতিষ্ঠা হোক। যে সাম্যের চোখ বাঁধা নয়, হাতে তরবারি নেই, দাঁড়িপাল্লা নেই, আছে শুধুই হৃদয়।