এখন শরৎ আসতে না-আসতেই ফোটোগ্রাফার আর ব্লগারদের তাণ্ডব! ট্রাম দোকানের চা, ঢাকেশ্বরী মন্দির, কুমোরটুলি ঘাটের পাড়ে বসা আর জ্যান্ত দুর্গার ফোটোশুট– সব মিলিয়েই দুর্গাপুজোর কুমোরটুলি সরগরম হয়ে ওঠে। তবে দিন যাচ্ছে যত, নিজেকে বদলাচ্ছে কুমোরটুলি। যাদের দেখে বড় হয়েছি, কুমোরপাড়ার গলির ধারে নিজেদের ঘরের দরজায় বসে মা দুর্গার মুখ সারছেন, তাঁরাই আজ হারিয়ে যাচ্ছেন। কাকে দেখে মানুষ আর কুমোরটুলির টানে ছুটবে! জানি না।
২৭.
কুমোরটুলি। কলকাতার প্রতিমাপাড়া। প্রতিমা শিল্পীরা গড়ে তুলছেন মায়াবী প্রতিমা। মাটি শিল্পীর আঙুলের কথা শুনছে। মাটি স্পর্শযোগে হয়ে উঠছে ভাস্কর্য। মাটি যেন জাদুমন্ত্রে হয়ে উঠছে প্রতিমা। সেই মাটির গন্ধতে লেগে আছে আগমনী সুর। মা আসছেন। সেই অপেক্ষা কালজয়ী। কালোত্তীর্ণ সেই পথে আনন্দের ধারাস্নান। সেই পুণ্যফলের আশায় মাটির সোঁদা গন্ধে ম-ম করে কুমোরটুলি। পাঁচদিন যে মৃন্ময়ীকে চিন্ময়ী রূপে পুজো করা হবে, তাঁর বায়না দেওয়াটাও কিন্তু পুজো-প্রস্তুতির একান্ত অঙ্গ। অতএব, ভাসাও পানসি, চলো কুমোরটুলি। এ শুধু আমার নয়, আপামর বাঙালির অন্তরের ডাক।
কুমোরটুলিতে এক সময় একচালার মূর্তি তৈরি হত। কালের নিয়মে সেই পথ ও প্রথায় লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। ভাঙাগড়ার খেলায় এসেছে নতুনত্বের নকশিকাঁথা। এই ভাঙাটাই এক্সপেরিমেন্ট। কারণ পুতুল পুতুল রূপ, তা থেকে প্রতিমা পেয়েছে মানবী রূপ। মৃণ্ময়ী মা হয়ে উঠেছেন চিন্ময়ী মহামায়া। প্রতিমা যদিও এত দর্শনের কচকচানি নয়। প্রতিমা আসলে হৃদয়ের সমীপবর্তী, দূরের কেউ নয়। আমাদের পাড়া-প্রতিবেশী, এমনকী, আমার ঘরের মা, বোন, নারীকুল– তার সঙ্গে বিরাট কোনও ফারাক নেই।
আমাদের যে দুই মহাকাব্য, বেদ, উপনিষদ– কত রসদ রয়েছে তাতে, মাতৃ-আরাধনার। তাতে কি শুধু ঈশ্বরের কথা আছে? আছে জীবনবোধের কথা, চিন্তা ও দর্শনের কথা। সেই রসদের টানে আমাদের ফিরতে হয় মাটির কাছাকাছি, প্রকৃতির কোলে। কুমোরটুলি সেই মৃত্তিকার উপাদানের ধাত্রীভূমি। শিল্পের সেই ভূমিতে শিল্পীর আসল পরীক্ষা– বিনির্মাণের। পুরনোকে ভেঙে নতুনের উপস্থাপন। তবে সহজলভ্য যা, তাকে আঁকড়ে ধরাটা আলসেমি। ‘নকল’ করে যাওয়াটা বোকামি। সেই চালাকি শিল্পের পথে টিকে থাকতে পারে না। মানুষের চোখে ধরা পড়ে যায়। ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়েই আত্তীকরণ ঘটে শিল্পীর, সে রপ্ত করতে শেখে শিল্পের ইতিহাস। দুর্গাপুজো সেই যৌথ নির্মাণের মঞ্চ। সেই শিল্প যৌথতা বোধের কথা বলে, কুমোরটুলি সেই সহজপাঠের পাঠশালা।
কুমোরটুলি বলতে ঠিক কী বোঝায়? সেই ছবিটা অনেকেরই মনে বেশ ভাসা-ভাসা। তার একটাই কারণ যে, কুমোরটুলির মানচিত্র আমাদের কাছে দূরের পৃথিবী। পুজো নিয়ে আমাদের এত আনন্দ-আবেগ, এত উৎসাহের ঘনঘটা, বাঙালির এত নস্ট্যালজিয়া– এর অনেকটাই কিন্তু প্রতিমার অন্দরমহল থেকে দূরে। পুজোর ঢাকে কাঠি না পড়লে কুমোরপাড়ার কথা মনে পড়ে না। সে যেন রাজার দুয়োরানি। বছরের নির্দিষ্ট এই দিনকয়েক ছাড়া আর ক’জনই বা যায় সে তল্লাটে! অতএব যে প্রাঞ্জল প্রতিমা দেখে আমাদের মনে শরতের সোনা-রোদ খেলে, সেই নির্মাণের পাঠশালা আমাদের কাছে ততটা পরিচিত নয়। আজকাল অবশ্য ইনস্টাগ্রাম, রিল্স আর ফেসবুকে ফোটোগ্রাফারদের ছবিতেই অধিকাংশের কুমোরটুলি দর্শন। তবে ভার্চুয়াল সেই প্রতিমা-পদাবলিতে আর মাটির গন্ধ বহু দূরে!
কুমোরটুলির সঙ্গে যে সংযোগ তার শিকড় চাড়িয়ে পৌঁচে গিয়েছে অনেক গভীরে। সেই অতলান্তে মনে পড়ে যায় অনেক চেনা মুখ। মনে পড়ে যায়, ঠাকুমার কথা। তাঁর হাত ধরেই তো প্রথম কুমোরটুলি যাওয়া। তখন যেতাম, কিন্তু কী হচ্ছে, আর না হচ্ছে, তা বুঝতে পারতাম না। পেরেছি ধীরে ধীরে, অন্তরের টানে। আমাদের বাড়ির ঠাকুর যে বেদিতে বসে, তাঁর মাপটা ঠিকঠাক রাখতে হয়। বড় হলে আবার সিংহাসনে মূর্তি বসানো যাবে না। ঠাকুরের খুটিনাঁটি বিষয়ে খোঁজখবর নিতেন ঠাকুরমা। সেই অভ্যাস ঢুকে পড়েছে নিজের মধ্যেও, সময়ের পাতা উল্টে টের পাই তা গভীরভাবে। মনে পড়ে যায়, প্রতিমায় চোখ আঁকার কথা। উহুঁ, চোখ আঁকা নয়, লেখা। এমনটাই তো বলে ‘কুমোরপাড়া’। আমরাও। চক্ষুদান বলে না, কারণ চক্ষুদান হয় মহাসপ্তমীর সকালবেলা। আসলে প্রতিটা অঞ্চলের কিছু নিজস্ব ভাষা থাকে, যা মিশে থাকে সেই এলাকার জল-হাওয়ায়। কুমোরটুলির ছবি দেখে তা আয়ত্ত করা সম্ভব নয়। এই যে প্রতিমার হয়ে-ওঠা তার সাক্ষী না থাকলে পুজোর আমেজ যেন অসম্পূর্ণ।
সেই ছোটবেলা থেকে আজ পর্যন্ত– কুমোরটুলির ওই সরু গলি ধরে যে কতবার হেঁটে গিয়েছি তাঁর হিসাব নেই। দু’-পাশে দেবতাদের অধিষ্ঠান। বিশ্বাস করুন মনে হয়, মাটিতে স্বর্গ যদি কিছু থাকে, তবে তা এই কুমোরটুলিতেই। আর শিল্পের এমন উন্মুক্ত প্রদর্শনশালা বা আর কোথায় বা আছে! বাংলার যে স্বাভাবিক সৌন্দর্য, তার নেপথ্যে মিশে থাকা শিল্পীদের অক্লান্ত পরিশ্রম, সবই যেন ভাস্বর হয়ে ওঠে কুমোরটুলির গলিতে গলিতে। ছোটবেলায় দেখা কুমোরটুলি, আর আজকের কুমোরটুলির মধ্যে ফারাক অনেক। তখন ভিড়, উৎস্যুক জনতার কোলাহল থেকে বিমুক্ত এক শিল্প-সাধন ক্ষেত্র ছিল কুমোরটুলি। মাটি-মাখা হাতের জাদুস্পর্শ দু’চোখ ভরে দেখার বিস্ময় ছিল ঘোর। বাড়ির প্রতিমা সঙ্গে ছবি তোলার ঝোঁক– সব মিলিয়ে কুমোরটুলি যেন হৃদয়ের নিভৃতকোণ, যেখানে প্রাণের আরাম, মনের শান্তি। কত মানুষের সঙ্গে যে আলাপ হয়েছে এই পরিক্রমায়!
প্রতিমাশিল্পের ছোট থেকে ছোটতর জিনিসের ভিতরও যে এত রোমাঞ্চ লুকিয়ে আছে, তা এই শিল্পীদের সঙ্গে না মিশলে বোঝা যায় না। আর শিল্পীদের কথা বললেইমনে পড়ে যায় সকলের প্রিয় শিল্পী ভোলাদার কথা। মানুষটার মনের ভিতর যেন আস্ত এক আকাশ লুকিয়ে রাখা ছিল। গল্পে-কথায়, আদরে-আপ্যায়নে, ভালবাসা-আন্তরিকতায় সেই আকাশের আলোয় আমি অনুভব করতাম অনবদ্য শরৎ। আজও কুমোরটুলি যাই, তবে ভোলাদা আর নেই। তবে আত্মীয়তার সেই অনুভব, সেই বিশ্বাস আজও আছে।
এখন শরৎ আসতে না-আসতেই ফোটোগ্রাফার আর ব্লগারদের তাণ্ডব! ট্রাম দোকানের চা, ঢাকেশ্বরী মন্দির, কুমোরটুলি ঘাটের পাড়ে বসা আর জ্যান্ত দুর্গার ফোটোশুট– সব মিলিয়েই দুর্গাপুজোর কুমোরটুলি সরগরম হয়ে ওঠে। তবে দিন যাচ্ছে যত, নিজেকে বদলাচ্ছে কুমোরটুলি। যাদের দেখে বড় হয়েছি, কুমোরপাড়ার গলির ধারে নিজেদের ঘরের দরজায় বসে মা দুর্গার মুখ সারছেন, তাঁরাই আজ হারিয়ে যাচ্ছেন। কাকে দেখে মানুষ আর কুমোরটুলির টানে ছুটবে! জানি না। ফোটোগ্রাফারদের কাছেও আর নতুন কোনও ‘ক্যারেক্টার’ নেই, যাকে ঘিরে একটা ভাল ছবি হবে। এক জিনিসের ছবি তুলতে মানুষের কতদিন আর ভাল লাগে! কিন্তু যত পরিবর্তনই আসুক পটুয়াপাড়ার গলিতে, আমার কুমোরটুলি বদলায় না। পুজোর ওই চারটে দিন, তার সমারোহের নেপথ্য জুড়ে থাকে কুমোরটুলি। আপন জৌলুসে তা চির উজ্জ্বল। ইনস্টাগ্রাম রিলস তার মুহূর্তকে ধরতে পারে, সমগ্রকে ধরে রাখে মুগ্ধ হৃদয়।
…………………… পড়ুন ওপেন সিক্রেট-এর অন্যান্য পর্ব …………………….
পর্ব ২৬: আমার মূর্তির অনতিদূরে যদি রমার একটা মূর্তি করা যায়
পর্ব ২৫: তাহলে কি রবীন্দ্রনাথ ‘বাংলাদেশি’ ভাষায় ‘সোনার বাংলা’, আর বাংলায় ‘জনগণমন’ লিখেছিলেন?
পর্ব ২৪: বর্ষাকাল মানেই বাঙালির কনফিউশনের বন্যা!
পর্ব ২৩: ও ক্যাপ্টেন! মাই ক্যাপ্টেন!
পর্ব ২২: শচীন-বিরাটরা আসেন-যান, ভারত থেকে যায়
পর্ব ২১: কিং কোহলি দেখালেন, ধৈর্যের ফল বিরাট হয়
পর্ব ২০: মনকে শক্ত করো টেস্ট, রাজা আর ফিরবেন না
পর্ব ১৯: মুকুল কিংবা ফিলিস্তিনি বালক, খুঁজে চলেছে যে যার ঘর
পর্ব ১৮: ধোনিবাদ: ধাঁধার চেয়েও জটিল তুমি…
পর্ব ১৭: সাদা সাদা কালা কালা
পর্ব ১৬: গতবারের বিক্রি প্রতিবারই ছাপিয়ে যায় বইমেলা, কারণ দামবৃদ্ধি না পাঠকবৃদ্ধি?
পর্ব ১৫: সেন ‘মায়েস্ত্রো’কে ভুলে বাঙালি দেখিয়েছে, সে আজও আত্মবিস্মৃত
পর্ব ১৪: শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসই বাঙালির প্রকৃত সান্তা
পর্ব ১৩: প্রবাসে, দোতলা বাসে, কলকাতা ফিরে আসে
পর্ব ১২: না-দেখা সেই একটি শিশিরবিন্দু
পর্ব ১১: ঘোর শত্রুর বিদায়বেলায় এভাবে বলতে আছে রজার ফেডেরার?
পর্ব ১০: অভিধানের যে শব্দটা সবচেয়ে বেশি মনুষ্যরূপ ধারণ করেছে
পর্ব ৯: জোট-অঙ্কে ভোট-রঙ্গ
পর্ব ৮: দক্ষিণ বিসর্জন জানে, উত্তর জানে বিসর্জন শেষের আগমনী
পর্ব ৭: পুজো এলেই ‘সর্বজনীন’ নতুবা নিঃসঙ্গ?
পর্ব ৬: এক্সক্লুসিভের খোয়াব, এক্সক্লুসিভের রোয়াব
পর্ব ৫: শাসন-সোহাগের দ্বন্দ্বসমাস
পর্ব ৪: পাঁকাল সাধনায় নাকাল
পর্ব ৩: দেখা ও না-দেখার সিদ্ধান্ত
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved