রাস্তায় বেরলে দেখবেন, অনেকেই মাস্কায়ন জানে না। কেউ কেউ নাকের ওপরে পরছে। মুখ ফাঁকা। এগুলোর নাম ‘নাস্ক’। জানতাম না, হোয়াটসঅ্যাপের মাস্কানরা আমাকে শিখিয়েছে। একটা কান থেকে একদিকে ঝুলে আছে, এমন ভুলঝুল মাস্কের নাম কানাস্ক। যদি দুই প্রান্ত কানে আর আসল জায়গাটা মুখ-নাকে নয়, থুতনিতে– এগুলো ‘থুতনাস্ক’। রাজনৈতিক নেতা এবং মাছওয়ালারা বেশিরভাগই থুতনাস্ক হয়ে থাকেন। এইসব অমাস্কিকরাই ভাইরাস ছড়াচ্ছে।
প্রচ্ছদের ছবি: শান্তনু দে
২৯.
আমরা এখন মাস্কাচ্ছন্ন। মাস্কাবৃত হয়ে এখন বেশ স্বচ্ছন্দই বলা যায়। ‘উনিশে এপ্রিল’ শব্দটা শুনলে আগামিকালে শুধু ঋতুপর্ণ ঘোষ পরিচালিত বিখ্যাত চলচ্চিত্রটির কথাই মনে পড়বে না, মাস্কায়নের কথাও মনে পড়বে। ‘উনিশে এপ্রিল’ থেকেই আমরা মাস্কায়িত হয়েছি বলা যায়। এর আগে, ডাক্তারবাবুদেরই মাস্ক পরতে দেখেছি, তাও সিনেমার অপারেশন শটে। কয়েক মুহূর্তের। ধূলিধূসর বইমেলাতেও কেউ কেউ মাস্কু থাকতেন। যাদের ধূলার্জি আছে, আমরা যারা ‘ধুলো খাই যদি প্রেম পাই’ পন্থী, আদৌ ধূলিভীত ছিলাম না। কাশতাম, তবু হাসতাম। এখন আমি নাশবন্দি, থুড়ি নাসাবন্দি– ভাবা যায়?
গত মার্চের শেষ থেকেই মাস্কারা দিয়ে গিয়েছেন ডাক্তারবাবুরা, টেলিভিশনে। ভীষণ নাকি বিপদ হবে নিমাস্ক থাকলে। নাকের ভিত দিয়া হৃদয়ে পশিবে ভাইরাস। অগত্যাই মাস্কাভ্যাস। মাস্কাবরণে নিজেদের মুখ ঢাকি, ঠিক যেন ঘোমটা! ঠাকুরমা-দিদিমাদের দেখতাম, ঘরে থাকলে অনেক সময় ঘোমটা দিতেন না। ঘোমটা সরে গেলেও বাইরের কেউ এলে সঙ্গে সঙ্গে ঘোমটা টেনে দিতেন। সেই অভ্যেস দেখছি ফিরে এল ফের! আমরা, হুমদো ব্যাটাছেলেগুলো মুখের ঘোমটা টেনে দিচ্ছি, বাইরের লোক এলেই। ধোপা, জমাদার– ওদের যোগ্য সম্মান দেখাচ্ছি– দেখেই সাত তাড়াতাড়ি মুখঘোমটা টেনে দি’। ঠাকুরমা-দিদিমারা যেমন শ্বশুর-ভাসুরদের সম্মান দেখাতেন। আমাদের এই নাকমুখ ঢাকার নব অবগুণ্ঠনের নাম মাস্কুণ্ঠন। অফিস যাওয়ার সময় মায়েদের দুগ্গা দুগ্গা বলার সঙ্গে এখন নতুন জুড়েছে ‘সব নিয়েছিস তো? স্যানিটাইজার, মাস্ক…?’ একটা তো মুখে পরাই আছে, সঙ্গে অতিরিক্ত একটা রাখা এখন কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। যে মাস্ক নিতে ভুলে যায়, সে হল মাস্কভোলা। আবার মুখে মাস্ক আছে, সেটা ভুলে যায় এমন মাস্কভোলাও আছে। হাতের জলের বোতলটা নিয়ে মুখে জল ঢেলে দিল মুখে যে মাস্ক আছে, সেটা বেমালুম ভুলে গিয়ে। মাস্কভোলা লোকেরা তখন মাস্কর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। অন্য এক মাস্কভোলা পিচিক করে পানমশলার পিক ফেলে দিল মুখের মাস্কের অস্তিত্ব ভুলে গিয়ে। মাস্কটি হঠাৎ রাঙা হয়ে গেল। তাই দেখে কেউ ভয় পেল, ‘মুখ থেকে রক্ত বেরচ্ছে দাদা’। মাস্কর্তব্যবিমূঢ় লোকটি মাস্কামারা ভঙ্গিতে বলল, ‘সরি, ভুলে গেছিলাম যে আমি সমাস্ক ছিলাম।’
দু’-চারজন মাস্কারমশাই থাকেন, যাঁরা মাস্ক নিয়ে বেশি জ্ঞান দিয়ে থাকেন। ওঁরা কট্টর মাস্কবাদী। বলেন, ‘দেখুন মাস্কবাদ একটা বিজ্ঞান। এর প্রয়োগগত ত্রুটি থাকতে পারে– যেটা আপনারা করছেন, ঠিকমতো ব্যবহার করতে শেখেননি। ঠিক ব্যবহার শিখুন। প্রকৃত মাস্কু হন।’ আবার কপালে ফোঁটা পরা কেউ কেউ বলেন, ‘হলুদ দুধ গোমূত্র– যাই খান না কেন, যতই ইমিউনিটি বাড়ানোর চেষ্টা করুন না কেন– মাস্কায়ন জানতেই হবে!’
রাস্তায় বেরলে দেখবেন, অনেকেই মাস্কায়ন জানে না। কেউ কেউ নাকের ওপরে পরছে। মুখ ফাঁকা। এগুলোর নাম ‘নাস্ক’। জানতাম না, হোয়াটসঅ্যাপের মাস্কানরা আমাকে শিখিয়েছে। একটা কান থেকে একদিকে ঝুলে আছে, এমন ভুলঝুল মাস্কের নাম কানাস্ক। যদি দুই প্রান্ত কানে আর আসল জায়গাটা মুখ-নাকে নয়, থুতনিতে– এগুলো ‘থুতনাস্ক’। রাজনৈতিক নেতা এবং মাছওয়ালারা বেশিরভাগই থুতনাস্ক হয়ে থাকেন। এইসব অমাস্কিকরাই ভাইরাস ছড়াচ্ছে।
এবারের দুর্গাপুজোটা পুরোটাই মাস্কামারা ছিল। রাস্তায় অল্পস্বল্প সমাস্ক মানুষ, মুখে কথা নেই, ফুচকাওয়ালারা, আইসক্রিমওয়ালারা বিমর্ষ। খদ্দের নেই তেমন, নিমাস্ক না হ’লে লোকজন কী করে খাবে ওসব? তবে প্রায় সবাই নতুন শাড়ি-জামা-কুর্তার সঙ্গে নতুন মাস্ক পরেছে। ডিজাইনার মাস্কও বুটিকে পাওয়া যায়। মধুবনী স্টাইল, শান্তিনিকেতনী, আবার নানা রঙের এমব্রয়ডায়রি করা প্রজাপতি। এক শিশু ওর মাকে মাস্কাভ্যন্তর থেকে বলল, ‘ও মা, দেখো, কী সুন্দর পোজাপতি’ আমাকে কেন পোজাপতি মাক্ কিনে দাওনি? কেন দাওনি? কেন?’ মায়ের হাতে খামচি দিতে থাকে শিশু। মায়ের মাস্কের ভিতরে থাকা কণ্ঠ থেকে নির্গত হয়, ‘থামতো এবার থাম, সামনের বছর দেবখনে।’ মেয়ের বাপ রেগে যায়। খামচি মেরে নিজের মাস্কটা টেনে নামাতে গিয়ে মাস্কটি ছিঁড়ে যায়। এই ছিঁড়ে যাওয়া ভ্রুক্ষেপ না করেই বলে, ‘কী বলে উঠলে? যখন-তখন যা-তা বলার অভ্যেস মুখে মাস্কচাপা দিয়েও রোখা গেল না? কী কুকথা বললে তুমি? সামনের বছর?’ ‘সরি সরি’, বলে শিশুর মা। ‘কিন্তু এত রাগ কেন? ছিঁড়লে তো মাস্কটা!’ শিশুর বাবা বলে, ‘ছিঁড়বেই তো, ওটা মেড ইন চায়না।’ শিশুর মা বলে, ‘তা হলে ও করোনাও টিকবে না, ওটাও তো মেড ইন চায়না।’
এদিকে ফ্যাশনদুরস্ত মহিলাদের খুব চাপ হয়ে যাচ্ছে। শাড়ি মিলিয়ে লিপস্টিক পরার অভ্যেস। কিন্তু ওষ্ঠ যদি মাস্কে থাকে ঢাকা, বৃথাই হবে রং-লিপস্টিক আঁকা। কেউ আছেন মেজাজ-মর্জি অনুযায়ী লিপস্টিক লাগান। যথা, মেজাজ ফুরফুরে থাকলে অরেঞ্জ, তিরিক্ষি থাকলে বেগুনি, নেব-নেব ভাব থাকলে লাল, দেব-দেব ভাব থাকলে পিংক। আগে লিপস্টিক, সেই অনুযায়ী ম্যাচিং শাড়ি পরে। ঠোঁট যদি মাস্কেটে, লিপস্টিক থাকে বাস্কেটে। আবার করোনা কালে রাস্তায় বেরলে কেউ বলেন, ‘কী দাদা কেমন আছেন, কুশল তো?’ কুশলপ্রার্থীকে চিনতে পারি না, কারণ মুখের আসল অংশই তো মাস্কাবৃত। বলি, ‘সরি, চিনতে পারছি না যে…।’ মাস্কাবরণে থাকলে চিনতে না পারা অমাস্কনীয় অপরাধ নয়, তাই না? কারও দেখি, দামাস্কাস প্রতিভা আছে। মাস্কভেদী দৃষ্টি আছে, নইলে আমাকে চিনে ফেলেন কী করে!
এদিকে দাদা-বউদিদের টিভি অনুষ্ঠানে নানা ধরনের মাস্টিপস দেওয়া হচ্ছে। পুরনো গেঞ্জি ফেলে না দিয়ে কীভাবে ওটা দিয়ে মাস্ক বানিয়ে ফেলা যায়, পুরনো ব্রা দিয়ে কীভাবে একজোড়া মাস্ক বানিয়ে ফেলা যায়, ‘এক একটি ব্রা কাপ এক একটি মাস্ক’– বলছে ‘ব্রা কাপ প্রেজেন্ট করে ব্রেকআপ মিটিয়ে ফেলা যায়।’ বলছে, যদি হঠাৎ করে বিগতমাস্কা হয়ে যায়, মানে মাস্ক হারিয়ে ফেলেন, তখন ওড়না দিয়ে কিংবা রুমাল দিয়ে কীভাবে সঙ্গে সঙ্গে জরুরি মাইস্কো বানানো যায়! ছোট মাস্ক বোঝাতে ‘মাইস্কো’, বড় মাস্ক বোঝাতে ‘মাস্কো’ শব্দটা বলা হচ্ছে। এবং এই শব্দগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরছে । ডিজাইনার মাস্কও বেরিয়েছে। ফুল-প্রজাপতি ছাড়াও মাস্কেও ওষ্ঠস্থলে ওষ্ঠচিহ্ন আঁকা। স্বচ্ছ মাস্কও বেরিয়েছে। একটা বিজ্ঞাপনে সৌরভ গাঙ্গুলির মুখে দেখেছি। তবে সব সময় পরার জন্য ‘বারোমাস্কা’ অত ডিজাইনার না হয়ে সাদামাটা হওয়াই ভালো। পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে পরতে হবে বইকি। লিপস্টিকের সিন যখন নেই, শাড়ি-ব্লাউজ-মাস্ক মিলিয়ে পরাই টাস্ক। আমার এক বৈজ্ঞানিক বন্ধু অমিতাভ প্রামাণিকের ভাষায় বলি–
তোমার শাড়িটি যারে দাও
(তারে) রাখিবারে দাও বাক্সো
ম্যাচিং ব্লাউজ কিনে দিও
সঙ্গে ম্যাচিং মাস্কও।
…পড়ুন ব্লটিং পেপার-এর অন্যান্য পর্ব…
২৭. স্বামীর গঞ্জনা, প্রেমিক ডিচ করেছে, এসব নালিশও জানানো যায় টুসুর কাছে
২৬. বাঙালদের কাছে ডালের খাতির বেশি, ঘটিদের কাছে মাছটাই প্রিয়
২৩. হীনম্মন্য বাঙালি সমাজে শব্দের প্রমোশন হয় মূলত ইংরেজি বা হিন্দিতে
২১. বাঙালির বাজার সফর মানেই ঘ্রাণেন অর্ধভোজনম
২০. জাত গেল জাত গেল বলে পোলিও খাব না!
১৯: ধোঁয়া আর শব্দেই বুঝে গেছি আট-তিন-পাঁচ-দেড়-দেড়!
১৮: নামের আগেপিছে ঘুরি মিছেমিছে
১৭: টরে টক্কার শূন্য এবং ড্যাশের সমাহারে ব্যাঙের ‘গ্যাগর গ্যাং’ও অনুবাদ করে নিতে পারতাম
১৬: ছদ্মবেশী পাগলের ভিড়ে আসল পাগলরা হারিয়ে গেল
১৫. ধূমপান নিষেধের নিয়ম বদলান, আকাশবাণীর স্টেশন ডিরেক্টরকে বলেছিলেন ঋত্বিক ঘটক
১৪. এমএলএ, এমপি-র টিকিট ফ্রি, আর কবির বেলা?
১২. ‘গাঁধী ভগোয়ান’ নাকি ‘বিরসা ভগোয়ানের পহেলা অবতার’
১১. কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্টের চক্করে বাঙালি আর ভোরবেলা হোটেল থেকে রওনা দেয় না
৫. তিনটে-ছ’টা-ন’টা মানেই সিঙ্গল স্ক্রিন, দশটা-পাঁচটা যেমন অফিসবাবু
৪. রাধার কাছে যেতে যে শরম লাগে কৃষ্ণের, তা তো রঙেরই জন্য
৩. ফেরিওয়ালা শব্দটা এসেছে ফার্সি শব্দ ‘ফির’ থেকে, কিন্তু কিছু ফেরিওয়ালা চিরতরে হারিয়ে গেল
২. নাইলন শাড়ি পাইলট পেন/ উত্তমের পকেটে সুচিত্রা সেন
১. যে গান ট্রেনের ভিখারি গায়কদের গলায় চলে আসে, বুঝতে হবে সেই গানই কালজয়ী
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved