
জোহরানের বিরোধিতা করেছে ডেমোক্র্যাটদের বিরাট অংশ। আবার যাঁরা তাঁকে সমর্থন করেছেন, তাঁদেরও বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে। ডেমোক্র্যাট গভর্নর ক্যাথি হোচুলই যেমন। তিনি জোহরানকে এন্ডোর্স করলেও ‘ট্যাক্স দ্য রিচ’ পলিসি মানতে নারাজ। গত মাসেই তাঁকে একটি জনসভায় বিদ্রুপ করেছে জনতা। তিনি জোহরানের সমর্থনে কথা বলতে গেলেই শ্রোতারা গর্জন করে উঠেছেন ‘ট্যাক্স দ্য রিচ’। এখানেই ব্যক্তিকে ছাপিয়ে গিয়েছে সমষ্টিগত প্রত্যাশা। জোহরান মামদানিকে ছাপিয়ে গিয়েছে তাঁকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা গণআন্দোলন।
নিউ ইয়র্ক শহরের মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথম বক্তৃতার একদম শুরুতেই জোহরান মামদানি স্মরণ করেছেন ইউজিন ডেবস-কে। উনিশ শতকের শেষ এবং বিশ শতকের শুরুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমাজতন্ত্রীদের একজন ছিলেন ইউজিন, যাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল কার্ল মার্কসের চিন্তা। ডেবস বলেছিলেন, মার্কিন রাজনীতিতে রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে খুব বেশি ফারাক নেই। দু’ পক্ষই পুঁজিপতি শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করে।
ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিসাবে মেয়র নির্বাচিত হয়ে কেন বক্তৃতার শুরুতেই রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাটদের একই কয়েনের দু’টি পিঠ মনে করা ডেবসকে স্মরণ করলেন জোহরান মামদানি? এই প্রশ্নের উত্তর রয়েছে জোহরান এবং তাঁর সহকর্মীদের রাজনীতিতে। মামদানি ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিসাবে মেয়র হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তিনি কেবল রিপাবলিকানদের পরাজিত করেননি। তিনি হারিয়ে দিয়েছেন তাঁর নিজের দল ডেমোক্রেটিক পার্টির অলিগার্কদেরও। বস্তুত গোটা নির্বাচনী প্রচারপর্বে মামদানিকে রিপাবলিকানদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আক্রমণ করেছেন তাঁর নিজের দল ডেমোক্রেটিক পার্টির দক্ষিণপন্থীরা। অতিধনীদের পক্ষে থাকা ডেমোক্র্যাটরা, যাঁরা প্যালেস্তাইনের বিপক্ষে, খোলাবাজার অর্থনীতির পক্ষে, তাঁরা সরাসরি সমর্থন করেছেন মামদানির প্রতিপক্ষ ‘অভিজাত’ অ্যান্ড্রু কুওমোকে৷

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির রীতি হল, কোনও নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী কে হবেন– তা স্থির হয় দলগুলির অভ্যন্তরীণ নির্বাচনের মাধ্যমে। কয়েক মাস আগে নিউ ইয়র্কের মেয়র পদপ্রার্থী নির্বাচনের ডেমোক্র্যাট প্রাইমারিতে অ্যান্ড্রু কুওমোকে হারিয়ে দেন ৩৩ বছরের মামদানি। দলীয় নির্বাচনে হেরে গিয়ে দীর্ঘদিনের ডেমোক্র্যাট নেতা কুওমো মেয়র নির্বাচনে তাঁর দলেরই প্রার্থী মামদানির বিরুদ্ধে নির্দল প্রার্থী হিসাবে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তাঁকে সমর্থন করলেন দক্ষিণপন্থী ডেমোক্র্যাটরা। ভোটের ঠিক আগে ডেমোক্র্যাটদের প্রবল বিরোধী রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভোটারদের কাছে রিপাবলিকান প্রার্থীর পরিবর্তে মামদানির নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কুওমোকে ভোট দেওয়ার আর্জি জানালেন! কারণ রিপাবলিকান প্রার্থীর পক্ষে মামদানিকে হারানো সম্ভব নয় এবং ট্রাম্প মনে করেন ‘একজন খারাপ ডেমোক্র্যাটও একজন কমিউনিস্টের চেয়ে অনেক ভালো’ অর্থাৎ, মামদানির বিরুদ্ধে তৈরি হল ডেমোক্র্যাট, রিপাবলিকান নির্বিশেষে বড়লোকদের রামধনু জোট। একজন বিলিওনেয়ার বললেন, তাঁরা মামদানিকে বুঝিয়ে দেবেন নিউ ইয়র্ক আর উগান্ডা এক নয়। নিউ ইয়র্ক হল ‘ক্যাপিটাল অফ ক্যাপিটালিজম’– পুঁজিবাদের রাজধানী। মামদানির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পলিটিক্যাল এলিট এবং বিলিওনেয়াররা। প্রচার শুরু হল মামদানি একজন ‘জিহাদি কমিউনিস্ট’। ট্রাম্প এই ভারতীয় বংশোদ্ভূত যুবককে চিহ্নিত করলেন ‘উন্মাদ কমিউনিস্ট’ হিসাবে। মামদানিকে ‘জঙ্গি’ এবং ‘ইহুদি-বিদ্বেষী’ তকমা দেওয়া হল। উগান্ডায় জন্মানো মামদানিকে নিয়ে বলা হল তিনি ড্রাগের কারবারিদের সমর্থনপুষ্ট, তিনি যথেষ্ট ‘আমেরিকান’ নন, কারণ তিনি হাত দিয়ে খাবার খান।

মামদানি তাঁর প্রচারে নিউ ইয়র্কের হাউজিং সমস্যা মেটানোর কথা বললেন, বড় কর্পোরেশনগুলির ওপর ট্যাক্স চাপানো এবং ১% অতিধনীকে বেশি করের আওতায় আনার কথা বললেন। তাঁর প্রচারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল বিনামূল্যে চাইল্ডকেয়ার, বিনামূল্যে দ্রুতগতিসম্পন্ন বাস পরিষেবা এবং নিউ ইয়র্ক শহরের বিপুল বাড়িভাড়ার সমস্যার সমাধান। সঙ্গে সঙ্গে ত্রাহি ত্রাহি রব করে উঠল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক স্ট্যাবলিশমেন্ট। বিলিওনেয়ারদের একাংশ জানালেন, মামদানি ভোটে জিতলে তাঁরা শহর ছেড়ে চলে যাবেন।
অথচ এক বছর আগেও জোহরান মামদানিকে প্রায় কেউই চিনতেন না। অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞানী বাবা এবং চিত্রপরিচালক মায়ের সন্তান জোহরানের ডেমোক্র্যাট প্রাইমারিতে তাঁর জয়ের সম্ভাবনা ছিল মাত্র ১ শতাংশ। তিনি ফুটপাতে দাঁড়িয়ে হ্যান্ডমাইক হাতে প্রচার করেছেন। পথচারীদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছেন। কেউ শুনেছেন, কেউ উপেক্ষা করে চলে গিয়েছেন। সেখান থেকে যাত্রা শুরু করা মামদানি এবং তাঁর সহকর্মীরা একটি রূপকথার জন্ম দিলেন। ধীরে ধীরে মামদানির প্রচারাভিযান নিজেই একটি গণ আন্দোলনের চেহারা নিল। নিউ ইয়র্ক শহরের শ্রমজীবী জনতা তাঁর সঙ্গে একাত্মতা বোধ করলেন। হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবক অংশ নিলেন প্রচারে। এক বছর আগে শূন্য থেকে শুরু করা এই বামপন্থী যুবক যখন ইতিহাস গড়ে নিউ ইয়র্কের মেয়র নির্বাচিত হচ্ছেন, তখন তাঁকে ঘিরে রয়েছে ৯০ হাজার স্বেচ্ছাসেবকের বাহিনী। এই সাফল্য কেনওভাবেই ডেমোক্র্যাটদের নয়, বরং তুলনামূলকভাবে কম চর্চিত একটি রাজনৈতিক সংগঠন ডেমোক্রেটিক সোশালিস্টস অফ আমেরিকা বা ডিএসএ-র।

মামদানি ডেমোক্র্যাট ঠিকই, কিন্তু একইসঙ্গে তিনি ডিএসএ-র সদস্য। ডিএসএ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বামপন্থীদের সবচেয়ে বড় সংগঠন। এই সংগঠনে বিভিন্ন ধরনের বামপন্থীরা আছেন। সোশাল ডেমোক্র্যাট থেকে শুরু করে মার্কসবাদী লেনিনবাদী, ট্রটস্কিপন্থী কমিউনিস্ট– সকলেই। ডিএসএ-র সদস্যরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে সক্রিয় আছেন। জোহরান মামদানি যেমন ডেমোক্র্যাটদের ভিতরে কাজ করেন, ঠিক তেমনই ডিএসএ-র অন্য অনেক সদস্য গ্রিন পার্টি বা অন্য রাজনৈতিক দলের ভিতরে ক্রিয়াশীল। ভারতীয় উপমহাদেশে কয়েক বছর আগে এই ধরনের রাজনৈতিক অনুশীলনের চর্চা ছিল। কংগ্রেস সোশালিস্ট পার্টি বা ফরওয়ার্ড ব্লকের সদস্যরা যেমন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ভিতরে কাজ করতেন। কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিআই) কিছু সদস্যেরও জাতীয় কংগ্রেসের সদস্যপদ ছিল। পাকিস্তান আমলে কমিউনিস্টরা আওয়ামি লিগ বা ন্যাপের ভিতরে সক্রিয় থাকতেন। তাঁরা চেষ্টা করতেন নিজেদের রাজনীতির মাধ্যমে কংগ্রেস, আওয়ামি লিগ বা ন্যাপের মতো বড় রাজনৈতিক দলগুলিকে প্রভাবিত করতে। ঠিক তেমনই জোহরান মামদানি একজন ডেমোক্রেটিক সোশালিস্ট, যিনি ডিএসএ-র সদস্য হিসাবেই ডেমোক্রেটিক পার্টিতে সক্রিয়। এমনিতে শ্রমিক শ্রেণি বা সাধারণ মানুষের অধিকারের প্রশ্নে মার্কিন রাজনীতিতে ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকানদের মধ্যে অধিকাংশ সময়েই প্রায় কোনও ফারাক থাকে না। ঠিক যেমন ব্রিটেনের যুযুধান দু’টি রাজনৈতিক দল কনজারভেটিভ (টোরি) এবং লেবার-ও বড়লোকদের স্বার্থরক্ষার প্রশ্নে প্রায় একইরকম ভূমিকা পালন করে। কিন্তু কোনও কোনও সময় প্রচলিত রাজনৈতিক সমীকরণ বদলে গিয়ে জেরেমি করবিন, বার্নি সার্ন্ডার্স বা জোহরান মামদানির মতো চরিত্র আবির্ভূত হন গণ আন্দোলনের ফসল হিসাবেই।

কয়েক বছর আগে যখন বার্নি সার্ন্ডার্স ডেমোক্র্যাট পার্টির প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হওয়ার লড়াইতে ছিলেন, সেই সময় বিপুল শক্তিবৃদ্ধি হয় ডিএসএ-র। সংগঠনের সদস্য সংখ্যা হাজার ছয়েক থেকে বেড়ে প্রায় ৮০ হাজারে পৌঁছে যায়। এই সময়ই দলে দলে ‘হার্ড লেফট’ তরুণ-তরুণী ডিএসএ-তে যোগ দেন। এর ফলে ডিএসএ-র অন্দরেও কিছু মৌলিক পরিবর্তন ঘটে যায়। ডিএসএ কোনও নতুন সংগঠন নয়। বেশ কয়েক দশক ধরেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে ডিএসএ সক্রিয়। এর আগেও ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিসাবে নিউ ইয়র্কের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন ডিএসএ সদস্যরা। কিন্তু এখনকার ডিএসএ-র সঙ্গে সেই ডিএসএ-র আকাশ-পাতাল ফারাক।
২০২৩ সালে ২৪ জন গুরুত্বপূর্ণ ডিএসএ নেতা সংগঠন ছেড়ে দেন। তাঁরা প্রত্যেকেই সোশাল ডেমোক্র্যাট বা ‘সফট লেফট’ হিসাবে পরিচিত ছিলেন। দলত্যাগের কারণ হিসাবে তাঁরা দাবি করেন, ডিএসএ-র নিয়ন্ত্রণ চলে গিয়েছে মার্কসবাদী এবং অতিবামপন্থীদের হাতে। প্যালেস্তাইনের মুক্তিসংগ্রাম সমর্থনের প্রশ্নেও তাঁরা ডিএসএ-র অন্দরে নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠা বামপন্থীদের অবস্থানের সঙ্গে একমত হতে পারেননি। এই সময় থেকেই ডিএসএ আরও বেশি বাঁদিকে সরতে থাকে। জোহরান মামদানি এই ‘বামপন্থী’ ডিএসএ-র সদস্য হিসাবেই নিউ ইয়র্কের মেয়র নির্বাচিত হলেন। ফলে জোহরানের এই ঐতিহাসিক বিজয় ডেমোক্র্যাটদের অন্দরেও প্রত্যাশিতভাবেই বিরাট ভূমিকম্পের সৃষ্টি করেছে।

জোহরান কমিউনিস্ট নন। তিনি ডেমোক্রেটিক সোশালিস্ট। আর্ন্তজাতিক রাজনীতির প্রশ্নে, বিশেষ করে কিউবা, ভেনেজুয়েলার মতো ‘সমাজতান্ত্রিক’ দেশগুলি নিয়ে তাঁর অবস্থানের সঙ্গে বহু বামপন্থী বা কমিউনিস্টেরই মতের ফারাক হবে যথেষ্ট। কিন্তু জোহরান আদতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে গড়ে ওঠা বহুমাত্রিক বামপন্থী আন্দোলনের ফসল। জোহরান একজন মুসলিম, একজন ডেমোক্রেটিক সোশালিস্ট, একজন দক্ষিণ এশীয়, একজন তরুণ। এই পরিচয়গুলির কোনওটিই তিনি লুকিয়ে রাখতে চান না। তিনি এই প্রতিটি পরিচয় নিয়েই গর্বিত। জোহরান তাঁর প্রচারের মাধ্যমে নিউ ইয়র্কের শ্রমজীবী জনতার বিভিন্ন অংশের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ স্থাপন করতে পেরেছেন। তাঁর নির্বাচনী প্রচারাভিযান ছিল বার্নি স্যার্ন্ডাসের মতো। জোহরান বারবার শ্রমিক শ্রেণি বনাম বিলিওনেয়ারদের সংঘাতের কথা বলেছেন। ডেটা নির্ভর প্রচারের যে মডেল গোটা পৃথিবীতেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, তার বিপ্রতীপে জোহরান একেবার তৃণমূল স্তরে পৌঁছে গিয়েছেন। বাড়ি বাড়ি গিয়েছেন। কথা বলেছেন নিউ ইয়র্কের দরিদ্র, নিম্নবিত্ত জনগোষ্ঠীর সঙ্গে। জোহরানকে লড়তে হয়েছে ‘সংগঠিত টাকা’র বিরুদ্ধে। একঝাঁক বিলিওনেয়ার জোহরানকে হারাতে কোটি কোটি ডলার খরচ করেছেন। এই অসম যুদ্ধে তাঁর হাতিয়ার হয়ে উঠেছে নিউ ইয়র্কের শ্রমজীবীদের সক্রিয় সমর্থন।

২০১৬ এবং ২০২০ সালের প্রচারাভিযানে বার্নি যা অর্জন করতে পারেননি, কিন্তু ২০২৫ সালে এসে জোহরান পারলেন, তা হল ট্র্যাডিশনাল ডেমোক্র্যাটদের বড় অংশের সমর্থনের পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক তরুণদের সমর্থন নিশ্চিত করা।

ইস্ট নিউ ইয়র্ক বা ব্রাউনসভিলের মতো শ্রমিক শ্রেণি অধ্যুষিত জায়গায় নিবিড় জনসংযোগ করেছেন জোহরান। গত কয়েক মাসে জোহরানের ছবি দেওয়া টি-শার্ট পরে রাস্তায় বেরনো মেইনস্ট্রিম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বড় মিডিয়ার অধিকাংশই তাঁর পক্ষে ছিল না, কিন্তু জোহরানের টিম সোশাল মিডিয়াকে দুর্দান্ত ব্যবহার করেছেন।

সেন্টার ফর ওয়ার্কিং ক্লাস পলিটিক্সের গবেষণা স্পষ্ট দেখাচ্ছে, ট্রাম্পিজমকে হারানোর অমোঘ ফরমুলা হচ্ছে একজন ‘অথেন্টিক্যালি অ্যান্টি এলিট’ প্রার্থী এবং ‘ইকোনমিক পপুলিস্ট’ প্রচার। নিউ ইয়র্কের মেয়র নির্বাচনে জোহরান মামদানি এই দু’টি শর্তই পূরণ করেছেন। তিনি নিজেকে কেবল অ্যান্ড্রু কুওমো নয়, সার্বিকভাবে মার্কিন রাজনীতির অভিজাততন্ত্রের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের প্রার্থী হিসাবে তুলে ধরেছেন। প্যালেস্তাইনের স্বাধীনতা বা অভিবাসীদের অধিকারের পক্ষে কথা বলতে তিনি ভয় পাননি। আবার একইসঙ্গে সোচ্চারে এলজিবিটিকিউ অধিকার আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। নিজের পরিচিতি এবং রাজনীতিকে লুকিয়ে রাখেননি, বরং সেগুলিকেই হাতিয়ারে পরিণত করেছেন।

জোহরানের বিরোধিতা করেছে ডেমোক্র্যাটদের বিরাট অংশ। আবার যাঁরা তাঁকে সমর্থন করেছেন, তাঁদেরও বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে। ডেমোক্র্যাট গভর্নর ক্যাথি হোচুলই যেমন। তিনি জোহরানকে এন্ডোর্স করলেও ‘ট্যাক্স দ্য রিচ’ পলিসি মানতে নারাজ। গত মাসেই তাঁকে একটি জনসভায় বিদ্রুপ করেছে জনতা। তিনি জোহরানের সমর্থনে কথা বলতে গেলেই শ্রোতারা গর্জন করে উঠেছেন ‘ট্যাক্স দ্য রিচ’। এখানেই ব্যক্তিকে ছাপিয়ে গিয়েছে সমষ্টিগত প্রত্যাশা। জোহরান মামদানিকে ছাপিয়ে গিয়েছে তাঁকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা গণ আন্দোলন। ১১,৩০০ জন ডিএসএ সদস্য নিউ ইয়র্কে জোহরানের পক্ষে প্রচার করেছেন। কিন্তু মোট স্বেচ্ছাসেবীর সংখ্যা ছিল এর ৯ গুণেরও বেশি। অর্থাৎ ডিএসএ-র বামপন্থী রাজনীতি আর কোনও ‘ফ্রিঞ্জ এলিমেন্ট’ নয়, ধীরে ধীরে মেইনস্ট্রিমে জায়গা করে নিচ্ছে।
নির্বাচনে জয়ী হয়ে জোহরান মামদানি স্মরণ করেছেন নিউ ইয়র্কের ওয়্যার হাউজগুলির মেঝেতে একটার পর একটা বাক্স তুলতে তুলতে থেঁতলে যাওয়া আঙুলের শ্রমজীবীদের। স্মরণ করেছেন ডেলিভারি দিতে দিতে হাতের তালুতে কড়া পড়ে যাওয়া যুবকদের। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রেস্তোরাঁর রান্নাঘরে গনগনে আঁচে কাজ করা মানুষটিকে তিনি স্মরণ করেছেন। স্মরণ করেছেন ইয়েমেন এবং সেনেগাল থেকে আসা শ্রমজীবী মানুষ এবং ট্যাক্সিচালকদের, ‘ইথিওপিয়ান আন্টি’দের। জোহরান স্মরণ করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে চাকরিচ্যুত হওয়া কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের, ট্রান্স কমিউনিটির মানুষজনকে। মধ্য তিরিশের ডেমোক্রেটিক সোশালিস্ট মামদানি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি নিউ ইয়র্কের সব শ্রমজীবী জনগণের জন্য একটি বাসযোগ্য শহর গড়ে তুলবেন, এমন একটি শহর যেখানে নিম্ন আয়ের মানুষজন সম্মানজনকভাবে বাঁচতে পারবেন।
জোহরান মামদানির কাজটি কঠিন। ইতিমধ্যেই ডোনাল্ড ট্রাম্প হুমকি দিয়েছেন নিউ ইয়র্কের ফেডারেল ফান্ড বন্ধ করে দেবেন। রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাট অলিগার্করা এই তরুণ সমাজতন্ত্রীর ওপর নিঃসন্দেহে প্রবল চাপ তৈরি করবেন, যাতে তিনি প্রতিশ্রুতিগুলি থেকে সরে যেতে বাধ্য হন। জোহরান আদৌ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক স্ট্যাবলিশমেন্টের দানবিক চাপ সামলাতে পারবেন, নাকি তিনি পিছু হটতে বাধ্য হবেন– সেই প্রশ্নের উত্তর সময় দেবে। কিন্তু জোহরান ও তাঁর সহকর্মীরা যে রূপকথা নির্মাণ করলেন, তা আগামী বহু দশক কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয়, গোটা বিশ্বের শ্রমজীবী জনতার সংগ্রামকে অনুপ্রাণিত করবে। একুশ শতকের তৃতীয় দশকে দেশে দেশে অভিজাততন্ত্রের বিরুদ্ধে সংসদীয় এবং অসংসদীয় পথে যে লড়াই গড়ে উঠছে, জোহরান মামদানির নির্বাচনী সাফল্যকে সেগুলির থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা সম্ভব নয়।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved