Robbar

নিজের সবচেয়ে বড় শত্রুর কথাও ডায়েরিতে লিখতে ভোলেননি সলিল

Published by: Robbar Digital
  • Posted:November 23, 2025 9:40 pm
  • Updated:November 23, 2025 9:40 pm  

’৮৮-র ডায়েরির শেষাংশের ‘Cash Account’-এর পৃষ্ঠায় ৬৩ বছর বর্ষীয়ান একজন মানুষ ঠিক যেন সেই টানাপোড়েনেরই হদিশ দিচ্ছেন, বিগত কয়েক দশক জুড়ে মদ্যপানের অভ্যাস থেকে নিজেকে বিরত রাখতে না-পারার গ্লানির ওজন সেরিব্রাল কোষে বইতে বইতে! যেন আগামী প্রজন্মের জন্য রেখে যাওয়া এ কোনও বিধিবদ্ধ কিংবা আত্ম-উদ্যোগী সতর্কীকরণ– ‘মনে রাখবে তোমার সব চেয়ে বড়ো শত্রু হোল ‘মদ’– অতীতেও ছিল ভবিষ্যতেও থাকবে।…’

প্রিয়দর্শী চক্রবর্তী

৬.

১৯৮৩-৮৪ নাগাদ ‘প্রতিক্ষণ’-এ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত আত্মজীবনী ‘জীবন উজ্জীবন’ নিয়ে, যদিও সলিল চৌধুরী মাত্রই ১৯৪৩-৪৪ অবধি এগতে পেরেছিলেন, তথাপি এই অসমাপ্ত আখ্যানে– ফিল্মের পরিভাষায় যা ‘মেমোরি কাট’ নামে পরিচিত, তেমন ধাঁচের ন্যারেশনে মাঝেমধ্যেই তিনি বেশ কয়েক বছর পিছিয়ে থাকতে থাকতে অকস্মাৎ এগিয়ে গেছেন কয়েক ধাপ। আবারও এসেছেন পিছিয়ে। তেমনই বিশেষ একটি জায়গায় তিনি খানিক সিঁড়ি টপকে ১৯৫১-তে গিয়ে পৌঁছেছেন, যা সলিলের ১৯৮৮-র ডায়েরির অংশবিশেষের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ হয়ে উঠতেই পারে।

পাঁচের দশকের একদম প্রথম ভাগ– জীবন জুড়ে তখন অগ্রাধিকারে শুধুই গণনাট্য, আর সেই সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত বান্ধববর্গের দৈনন্দিন কিস্‌সা। তেমনতর সূত্রেই সলিলের বয়ানে ‘জীবন উজ্জীবন’-এ পাওয়া একটি ঘটনা–

‘…১৯৫১ সালেই গ্র্যান্ড হোটেলে আমি আর ঋত্বিক (ঘটক) পুডফকিন-চেরকাশভের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম এবং সেখানেই ওঁদের হাত থেকে রাশিয়ান পিবা বা বিয়ার পানই ঋত্বিকের ও আমার জীবনের প্রথম মদ্যপান। আজ কেউ বিশ্বাস করবেন না যে সেদিন ঋত্বিক সেই একটা ছোট টিন বিয়ার খেয়ে এমন নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ল যে ওঁরা একটি সম্বর্ধনায় বেরিয়ে যাবার পরও প্রায় আধঘণ্টা ব্যালকনিতে একটা সোফায় বসে রইল। বলল, “আমার ভীষণ মাথা ঘুরছে– চলতে পারছি না।” সেই ঘটনা নিয়ে ভবিষ্যৎ জীবনে আমাদের অনেক হাসাহাসি হয়েছে। গ্র্যান্ড হোটেল থেকে বেরিয়ে ঋত্বিক বলল, “চল, একটু ফাঁকা হাওয়ায় যাওয়া যাক।” হাঁটতে হাঁটতে আমরা ইডেন গার্ডেন্স ছাড়িয়ে গঙ্গার ধারে গিয়ে বসলুম। ঋত্বিক বলেছিল, “দূর শালা! মহা বাজে জিনিষ! আর কোনোদিন নয়।” অদৃশ্য থেকে নিয়তি বোধহয় সেদিন অট্টহাস্য করেছিল।… সেই মদ্যপানই ঋত্বিকের জীবনের অভিশাপ হয়ে দেখা দিল এবং আমার জীবনেরও বহু অমূল্য মুহূর্তের জলীয় সমাধি ঘটাল। ১৯৪৭ সাল থেকেই ঋত্বিক, মৃণাল (সেন) এবং আমি ছিলাম অবিচ্ছেদ্য বন্ধু।… উত্তর-জীবনে আমি আর ঋত্বিক দু’জনেই বয়ে গেলাম– মৃণালটাই কী করে জানি সচ্চরিত্র রয়ে গেল। মদ ছুঁল না জীবনে।…’

বন্ধু মৃণাল সেনের সঙ্গে

আর্নেস্ট হেমিংওয়ে একসময় পরিহাসের ছলেই হয়তো বলেছিলেন– ‘I drink to make other people more interesting’! অথবা ফ্রাঙ্ক সিনাত্রা-র মতে– “Alcohol may be man’s worst enemy, but the Bible says love your enemy”! এ সবই অবশ্য মদ্যপানের মতো দুর্দমনীয় অভ্যাসকে নিজেদের সৃজন-প্রক্রিয়ার মাধ্যম হিসাবে বৈধ করে তোলার ফিকির মাত্র। অন্যদিকে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির চত্বরে বহু দিকপাল মানুষের সৃষ্টিশীল দক্ষতার প্রতি মুগ্ধতাকে ছাপিয়ে তাঁদের বোহেমিয়ান মাতাল সত্তাকে অনাবশ্যক প্রশ্রয়ের প্রবণতারও তো কিছু কমতি নেই গড়পড়তা চেতনায়, এমনকী আমাদের বঙ্গবলয়েও তেমন কবি-সাহিত্যিক-সংস্কৃতিকর্মীর দৃষ্টান্ত রীতিমতোই বিদ্যমান। শৈল্পিক স্বেচ্ছাচারের মধ্যেই শিল্পধর্মের তথাকথিত আধুনিকতাকে খুঁজে নেওয়ার ঝোঁক। অথচ স্বাস্থ্যবিধি অনুসারী এই কু-অভ্যাস নিয়ে শিল্পীমননের অভ্যন্তরে নিরন্তর চলতে থাকা টানাপোড়েন বা দ্বন্দ্ব– ‘তার খবর কে রাখে’! ’৮৮-র ডায়েরির শেষাংশের ‘Cash Account’-এর পৃষ্ঠায় ৬৩ বছর বর্ষীয়ান একজন মানুষ ঠিক যেন সেই টানাপোড়েনেরই হদিশ দিচ্ছেন, বিগত কয়েক দশক জুড়ে মদ্যপানের অভ্যাস থেকে নিজেকে বিরত রাখতে না-পারার গ্লানির ওজন সেরিব্রাল কোষে বইতে বইতে! যেন আগামী প্রজন্মের জন্য রেখে যাওয়া এ কোনও বিধিবদ্ধ কিংবা আত্ম-উদ্যোগী সতর্কীকরণ– ‘মনে রাখবে তোমার সব চেয়ে বড়ো শত্রু হোল ‘মদ’– অতীতেও ছিল ভবিষ্যতেও থাকবে।…’ একমাত্র মানসিক দৃঢ়তাই যে অভ্যাসে যবনিকা নামাতে পারে। আর, সলিলেরই বয়ান অনুযায়ী ‘বহু অমূল্য মুহূর্তের জলীয় সমাধি’ ঘটার পথ তবেই না সঙ্কুচিত হয়ে ‘গান-গীতিকাব্য-উপন্যাস নাটক গল্প কবিতার প্লাবন’ ঘটবে যাবতীয় শারীরিক-মানসিক জাড্যকে ছিঁড়ে ফেলে।

পাঠান্তে অবশ্য এমন ইঙ্গিতেরও রেশ খানিক থেকে যায়– কেবলই আগামী প্রজন্মের জন্য নয়, সতর্কীকরণের ভেতর হয়তো নেশার শৃঙ্খল থেকে মুক্তিলাভের আশে নিজেকে শাসনে রাখার নিমিত্তও এই আয়োজন। সলিল চৌধুরীর মতো সাফল্যের শিখরছোঁয়া ব্যক্তিত্বকেও যে পাকচক্র স্থবির বন্দিদশায় ছটফটিয়ে মারে প্রতিটি মুহূর্তে, যা তাঁরই গানের শব্দবন্ধে–

‘…আমি সপ্তসিন্ধু পার হয়ে
গোষ্পদে বাঁধা পড়ে গেছি,
এ ব্যথা কাহারে বলব?…’

………………..

বিশেষ কৃতজ্ঞতা: অন্তরা চৌধুরী, শুভঙ্কর দে

………………..

ডায়েরির ৯টি পাতা, পড়ুন এক ক্লিকে

প্রথম পর্ব সলিল চৌধুরী নোটবইয়ে এঁকেছিলেন রবীন্দ্রনাথের স্কেচ

 দ্বিতীয় পর্ব জাপানি খাতায় লিখতে গিয়ে সলিল চৌধুরীর প্রথম মনে পড়েছিল জাপানি বোমার কথা

তৃতীয় পর্ব ফ্যাসিজম কাব্যের মৃত্যু ঘটাতে পারে, ডায়েরিতে লিখে রেখেছিলেন সলিল

চতুর্থ পর্ব সাম্যই প্রকৃতির অন্তরের কথা, এই বিশ্বাস সলিল চৌধুরীর ডায়েরির পাতায় পাতায়

পঞ্চম পর্ব মশলাদার নয়, ‘পার্সোনাল’ ফিল্ম করতে চান রাজ কাপুর, জানিয়েছিলেন তুই-তোকারির বন্ধু সলিলকে