
এই সময়ে দাঁড়িয়ে অতনু ঘোষ রচনা করছেন নিঃসঙ্গ নাগরিকের যন্ত্রণার কথা। তিনিও কি কোনও ‘ভয়াবহ, বিস্ময়কর সংগীত’ রচনা করতে চেয়েছেন সেলুলয়েডে? এই প্রশ্ন জাগে পরিচালকের তিনটি ছবির চিত্রনাট্য সংবলিত গ্রন্থ ‘নিঃসঙ্গ নাগরিক’ হাতে নিয়ে। কেবল চিত্রনাট্য নয়। ‘চিত্রনাট্য ও পরিক্রমা’ দুই-ই।
‘আমার সঙ্গে চলো মহানগরে– যে মহানগর ছড়িয়ে আছে আকাশের তলায় পৃথিবীর ক্ষতের মতো…’।
এভাবেই শুরু হয় প্রেমেন্দ্র মিত্রর অসামান্য ছোটগল্প ‘মহানগর’। খানিক পরেই লেখক লিখেছেন, ‘এ-মহানগরের সংগীত রচনা করা উচিত– ভয়াবহ, বিস্ময়কর সংগীত।’

বহু দশক আগে লেখা সেই গল্পের পর সময় অনেকটা বয়ে গিয়েছে। এই সময়ে দাঁড়িয়ে অতনু ঘোষ রচনা করছেন নিঃসঙ্গ নাগরিকের যন্ত্রণার কথা। তিনিও কি কোনও ‘ভয়াবহ, বিস্ময়কর সংগীত’ রচনা করতে চেয়েছেন সেলুলয়েডে? এই প্রশ্ন জাগে পরিচালকের তিনটি ছবির চিত্রনাট্য সংবলিত গ্রন্থ ‘নিঃসঙ্গ নাগরিক’ হাতে নিয়ে। কেবল চিত্রনাট্য নয়। ‘চিত্রনাট্য ও পরিক্রমা’ দুই-ই।
এই সময়ের উল্লেখযোগ্য এক কথক অতনু ঘোষ। তাঁর নগরদর্পণে ধরা পড়ে কোন ছবি? সেখানে যে ভয়াবহতা, তা আসলে বিস্ময়কর একাকিত্বের। পরিচালকের ‘অ্যাবি সেন’ আটের দশকের পৃথিবীতে গিয়ে পড়া এক হালফিলের মানুষের গল্প। সেখানেও এই একাকিত্বই ছিল। কিংবা ‘শেষ পাতা’। এক রাগী লেখকের আড়ালে নিঃসঙ্গ মানুষের যন্ত্রণার আখ্যান। কিন্তু এই বইয়ে যেহেতু বলা হয়েছে অন্য তিন ছবির কথা, আমরাও সেদিকেই চোখ রাখব। তিনটি ছবিই বহু পুরস্কার, অগণন স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। নিঃসঙ্গতা, বলা ভালো নাগরিক নিঃসঙ্গতা এখানেও অনুপম জলছবির মতোই সোচ্চার হয়ে রয়েছে।
‘ময়ূরাক্ষী’র সুশোভন ক্রমশ স্মৃতি হারাচ্ছেন। এ এমন এক একাকিত্ব, যেখানে মানুষ নিজেকেও হারিয়ে ফেলছে। অশীতিপর এক বৃদ্ধ নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন খবরের ‘হিংস্র দুনিয়া’ থেকে। আঁকড়ে ধরছেন হাজার মাইল দূরে থাকা ছেলে আর্যনীলকেই! অথচ ছেলের বয়সটা কত, সেই হিসেবও তাঁর গুলিয়ে যাচ্ছে। ছেলে ও তাঁর মাঝে বিস্মৃতির এক প্রাচীর গড়ে ওঠে। এছাড়াও থাকে এক নারী। অদৃশ্য অথচ অলৌকিক সেই নারী… ময়ূরাক্ষী। সুশোভন মনে করেন, জীবনে কিছু মুহূর্তে ‘ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক’ দরকার হয়। সেই শ্রুত-অশ্রুত সুর যেন এই ছবির পরতে পরতে গাঢ় করে তোলে একাকিত্বের আলপনা।
‘বিনি সুতোয়’ ছবির দুই প্রধান চরিত্র শ্রাবণী বড়ুয়া ও কাজল সরকার। এক গল্প তৈরির খেলায় নামে তারা। যে জীবন হাতের মুঠোয়, তাকে কোথাও নামিয়ে রেখে একটা অন্য জীবনকে আঁকড়ে ধরতে চাওয়া। এক বিপজ্জনক খেলা। নিজেদের আপাত সুখী ও নিস্তরঙ্গ সুখের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলেও এই খেলার নেশা তাদের পেয়ে বসে। তাদের মিলে যাওয়া হয়তো কাকতালীয়, কিন্তু আসলে তা অবধারিতই বোধহয়। দু’জনে মিলে যে গল্পটা গড়ে তুলতে থাকে, তা ক্লাইম্যাক্সে এসে এক অন্য মাত্রায় পৌঁছে যায়। নাগরিক নির্জনতা বিষ-নীল ছায়ার আড়ালে বিনি সুতোয় বাঁধা পড়ে যায় দুটো জীবন।

‘রবিবার’ ছবিতেও রয়েছে ‘আকস্মিকের খেলা’। এক রবিবার সকালে নিজের পাড়ার কফিশপে গিয়ে অসীমাভ মুখোমুখি হয় সায়নীর। সায়নী পেশায় ল’ অফিসার। অন্যদিকে অসীমাভ একজন ফ্রডস্টার। একসময় সম্পর্ক ছিল তাদের। আজ দু’জন পরস্পরের প্রাক্তন। ‘জীবন গিয়েছে চলে…’ মুখোমুখি দেখা হয় তাদের। সায়নী আসলে জানত, অসীমাভর পরিণতি এদিকেই যাবে। সোমবার হয়তো গ্রেপ্তার হবে সে। তার আগে এই রবিবার। এক অনন্ত কালখণ্ডের মতো জেগে থাকে। নাগরিক শূন্যতার আশ্চর্য বয়ান এই ছবি সেই অর্থে কোনও মীমাংসায় শেষ হয় না। কেবল শেষের গানের কথায় আমরা শুনতে পাই, ‘কাল কী হবে/ জানে না কেউ/ কথা ফিরে আসে/ ফেরে কি সেও?’
এই তিন ছবির চিত্রনাট্য পরপর পড়তে পাওয়া এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। ছবি দেখার অভিজ্ঞতার চেয়ে টেক্সট হিসেবে তাকে পড়তে পাওয়াটা আলাদা। এই বই সেই সুযোগ করে দেয়। যেন ম্যাজিক লণ্ঠনের ছায়ায় ঘরে বসে গড়ে নেওয়া নিজস্ব সেলুলয়েড। কিন্তু কেবল সেইটুকুতেই এই বইয়ের নির্মাণ শেষ হয়ে গেলে, পাঠক হিসেবে প্রাপ্তির ঝুলি যে সম্পূর্ণ ভরত না, হলফ করেই বলা যায়। ভাগ্যিস তা করা হয়নি।
এই বইয়ে রয়েছে প্রতিটি ছবি নিয়ে এখনও পর্যন্ত প্রকাশিত আলোচনাগুলিও। বইয়ের ভূমিকায় এক স্বাদু গদ্য লিখেছেন সুরকার দেবজ্যোতি মিশ্র। কেবল বইয়ের ভূমিকা নয়, তা হয়ে উঠেছে আলাদা এক গদ্য। ‘প্রত্যাখ্যাত হতে হতে শহর ক্লান্ত হয়ে আসে। খালি পায়ে হাঁটার মতো কোনও ঘাস নেই কোথাও। পিচরাস্তার কালোয় বর্ষার জল আরও খানিকটা কালো করে দেয় মনপৃথিবীর চৌহদ্দি।’
আবার শান্তনু চক্রবর্তীর দীর্ঘ লেখায় প্রতিটি ছবিকে চিরে চিরে দেখা। আর্যনীল মুখোপাধ্যায়ের ‘তিন অক্ষে নিঃসঙ্গতা, অন্তরাল, কল্পপরিচিতি’ লেখাটিও চমৎকার। মস্তিষ্কের ধূসর কোষে নানা চিন্তার রেণু ছড়িয়ে দেয়। এছাড়া রয়েছে গ্যালারি। ছবিগুলির দৃশ্যাবলি, শুটিংয়ের মুহূর্তের রঙিন ঝকঝকে ছবি বইটিকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। যদিও এই অংশটি বইয়ে না থাকলে যে পাঠকের প্রাপ্তির মাত্রা কমত, তা মনে হয় না।
মানতেই হবে এমন বই বাংলা ভাষায় অন্তত বিরল। পরিপাটি মুদ্রণ, প্রায় নির্ভুল ছাপা ও ঝকঝকে কাগজের সমন্বয়ে এই বই হাতে তুললেই সিনেপ্রেমীদের আনন্দ হবে। বাংলা ভাষায় চলচ্চিত্র-সংক্রান্ত বইয়ের সংখ্যা নেহাত কম নয়। কিন্তু কিংবদন্তি সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল কিংবা বিদেশি বার্গম্যান-হিচককদের মধ্যেই যেন তা সীমাবদ্ধ। রাবণ প্রকাশনা এর বাইরে ভেবেছে। সমসময়কে সমসময়ে উচ্চারণ করার চ্যালেঞ্জ অন্যরকম। তারা সেটা করতে পেরেছে। কেবল একটা আক্ষেপ থেকে যায়। অতনু কিংবা ছবিগুলির কলাকুশলীদের কারও কারও মন্তব্যটুকু অন্তত রাখতে পারলে বইটির অভিনবত্ব আরও বাড়ত নিঃসন্দেহে।
সবশেষে বলি মলাটটির কথা। অরিন্দম নন্দীর করা প্রচ্ছদে জেগে থাকে রিক্ত করতল। সেই করতলই হয়ে ওঠে নগরদর্পণ। নিঃসঙ্গ নাগরিকের ছায়া পড়ে তাতে।
——————
নিঃসঙ্গ নাগরিক
চিত্রনাট্য ও পরিক্রমা: ময়ূরাক্ষী, রবিবার, বিনিসুতোয়
অতনু ঘোষ
রাবণ
৬৫০/-
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved