
৪ ডিসেম্বর, ২০২৫। রাইনার মারিয়া রিলকে ১৫০তম জন্মদিন স্পর্শ করলেন। তরুণ কবিকে তিনি যে চিঠি লিখেছিলেন, পরে তা বিশ্বজোড়া কবি, কবিতা-পাঠকদের কাছে আদৃত হয়। বই হয়ে প্রকাশিত হয় ‘লেটারস টু আ ইয়ং পোয়েট’ নামে। আজকে, কোনও তরুণ কবিকে যদি চিঠি লিখতে হয়, কী লিখবেন কবিতাবিশ্বে দীর্ঘকাল ঘর-সংসার করা কবি সুবোধ সরকার? লিখছেন আজকের তরুণ কবিকে লেখা চিঠি।
রাইনের মারিয়া রিলকে– জার্মানির কিংবদন্তি আধুনিক কবি, যিনি বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদে বাংলায় হয়ে উঠেছিলেন সাতের দশকের কাল্ট, তিনি একজন তরুণ কবিকে দশটি চিঠি লিখেছিলেন। সেই চিঠি এখন ইতিহাস। সেই চিঠি সরিয়ে রেখে কবিতার ইতিহাস লেখা যাবে না। কে সেই তরুণ কবি? কী লেখা হয়েছিল সেই চিঠিতে?

অস্ট্রিয়া-বোহেমিয়াতে জন্ম হলেও, কেউ কেউ তাঁকে ‘অস্ট্রিয়ার কবি’ বললেও রিলকের মালিকানা জার্মানির। হিটলারের সঙ্গে তাঁর এই একটিমাত্র মিল। সেই অস্ট্রিয়ার এক তরুণ রিলকের কাছে চিঠি পাঠালেন, সঙ্গে নিজের কবিতা এবং জানতে চাইলেন কবিতাগুলো কেমন হয়েছে। সব তরুণ কবিই তাই করতেন ফেসবুক আসার আগে পর্যন্ত। সেই তরুণের নাম ফ্রান্সজ জাভের কাপ্পাস। সেই তরুণের নাম কবি হিসেবে পরবর্তী সময়ে তেমনটা উঠে আসেনি, তিনি মিলিটারি অফিসার হিসেবে উঠে এসেছিলেন। আমি তাঁর কবিতা পড়িনি। তিনি বিখ্যাত হলেন চিঠি লিখে। রাইনের মারিয়া রিলকে-কে চিঠি লিখে। যেরকম রানু বিখ্যাত হয়েছিলেন ভানুকে চিঠি লিখে।
কী ছিল সেই চিঠিতে? এ তো আর কোনও লাস্যময়ী অষ্টাদশী চিঠি লিখছেন না কবিকে, লিখছেন একজন গুম্ফময় তরুণ কবি। তার উত্তরে রিলকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে কাপ্পাসকে উত্তর দিয়েছেন, প্যারিস থেকে, রোম থেকে, ব্রেমেন থেকে, সুইডেনের ফ্লাডি থেকে। দু’-তিনটে জরুরি উপদেশ আমি আজীবন অনুসরণ করে এসেছি। ৪০ বছর আগে চিঠিগুলো পড়ে মনে হয়েছিল রিলকে চিঠিগুলো আমাকে লিখেছেন। রিলকে তরুণ কবিকে বলেছিলেন, প্রথমেই প্রেমের কবিতা লিখবেন না। ওগুলো সহজে আসে। বলেছিলেন, কেউ আপনাকে বলে দিতে পারেন না আপনি কীভাবে লিখবেন। কেউ আপনাকে উপদেশ দিতে পারেন না। আপনাকে আপনার ভেতরে তাকাতে হবে। নিজের ভেতরে নামতে হবে। আপনি কী লিখবেন– সেটা আপনি আপনার ভেতর থেকে জানতে পারবেন। কেউ আপনাকে বাইরে থেকে বলতে পারবে না। বুদ্ধদেব বসু জ্যোতির্ময়ী গদ্যে আমাদের জানিয়েছিলেন– নক্ষত্র খচিত আকাশের নীচে দাঁড়ান, জিজ্ঞেস করুন নিজেকে, আমাকে কি লিখতেই হবে কবিতা? যদি উত্তর হয়, ‘না’, তাহলে আপনি বেঁচে গেলেন। আর যদি উত্তর পান ‘হ্যাঁ’, তাহলে সেই কুঠার তুলে নিন কাঁধে যা আপনাকে সারাজীবন বহন করে যেতে হবে। যিনি বাইবেল পড়তে বলছেন তরুণ কবিকে, তিনি কি আসলে একজন কবিকে যিশুর মতো দেখতে চেয়েছিলেন? একজন কবি কি সারাজীবন ক্রস বহন করে চলেন? রিলকের নিভৃত জীবন কি বরিশালের কবির জীবনে এসে মিলে যায় না?

এইবার আমি পড়েছি সন্দেহ ও শতভিষার খপ্পরে। রোববার ডট ইন আমাকে ভয় দেখিয়েছে এই বলে যে, আমাকে লিখতে হবে একটি চিঠি কোনও তরুণ কবিকে। সন্দেহ এই কারণে যে, আমি এখন আর কাউকে চিঠি লিখি না, গত দশ বছরে ব্যাঙ্ক ম্যানেজার ছাড়া আর কাউকে চিঠি লিখেছি মনে পড়ে না। সন্দেহ নম্বর দুই– তরুণ কবিকে উপদেশ? বাপরে বাপ! এর চেয়ে অনেক সোজা করাচিতে গিয়ে বোমা ফেলে আসা। আমি যদি কোনও তরুণ কবিকে লিখি সেই কুঠার আপনি কাঁধে তুলে নিন, তাহলে কুঠার কাঁধে না তুলে সেই কুঠার তুলে আমাকে মারতে আসবে। আর যদি সেই তরুণ কবি তরুণী কবি হন, তাহলে আমার কপালে ‘মি টু’ আছে! আর শতভিষা? রোববার ডট ইন আমাকে আর একবার রিলকের ভেতরে, রিলকের কবিতার ভেতরে, রিলকের অন্ধকার ও শতভিষার ভেতরে আমাকে নামিয়ে দিল। আমি কাউকে উপদেশ দিই না, কারওর উপদেশ নিই না। নীচে যে চিঠি আমি লিখেছি, সেটা কোনও ‘উপদেশ’ নয়। এটা হল কবিতা লেখা বিষয়ে আমার হেমন্তের কফিশপে একা বসে থাকা আর কলকাতা থেকে অনেক দূরে, কালচিনি নদীর পারে বসে থাকা একজন তরুণ কবি যিনি আমাকে তাঁর জীবনের প্রথম পাণ্ডুলিপি পাঠিয়েছেন। অস্ট্রিয়ার কাপ্পাসের মতো তিনিও কালচিনি থেকে জানতে চেয়েছেন, আমার কি লেখা হবে? এই বই কি ছাপতে দেব? আমি আত্মহত্যা করতে পারি, কিন্তু কবিতা লেখা ছাড়তে পারছি না। বলুন, কী করতে পারি?
তরুণ কবি
প্রীতিভাজনেষু,
আমি কালচিনিতে গিয়েছি। অপূর্ব একটা রোগা কিশোরী। আপনি সেখান থেকে আমাকে কবিতা পাঠিয়েছেন। ৫০টি কবিতা। আপনি চাইছেন বই করতে। আপনি আমার মতামত চেয়েছেন। সঙ্গে এ-ও লিখেছেন, কবিতা লেখার জন্য আমাকে কী করতে হবে? কী কী পড়তে হবে?
আপনার চিঠি পড়ে মনে হল, আপনার ভেতরে একটা ‘মর্বিডিটি’ প্রবেশ করেছে। আত্মহত্যার কথা লিখেছেন। আমি চমকে উঠলাম। মনে মনে আপনাকে ধমক দিলাম। তারপর নিজের দিকে তাকালাম। আমি যখন আপনার মতো তরুণ ছিলাম, তখন আমরাও অনেকে আত্মহত্যার কথা ভাবতাম। কিন্তু কবিতা না-লিখে মরে যাব? এটা ভাবলেই ফিরে আসতাম নিজের ঘরে, নিজের বিছানায়।
আপনি একটা প্রশ্ন করেছেন, কবিতা লেখার জন্য আমাকে কী করতে হবে?

আপনাকে বলি, টেনিস খেলতে হলে কী কী করতে হবে, একজন কোচ আপনাকে বলে দিতে পারেন। কম্পিউটার শিখতে হলে কী করতে হবে, তার প্রশিক্ষক আছে পাড়ায় পাড়ায়। ডাক্তার হতে গেলে কোন পথ নিতে হবে, সেটাও আপনাকে আপনার স্কুলের মাস্টারমশাই বলে দেবেন। কিন্তু কবিতা লিখতে হলে কী কী করতে হবে, তার কোনও ম্যানুয়াল নেই। কোনও গুগল ম্যাপ নেই। কোনও স্কুল নেই, বিশ্ববিদ্যালয় নেই যেখানে ঢুকে গেলে আপনি জন কিটস হয়ে বেরিয়ে আসতে পারবেন। এখনও কোনও হার্ভার্ড তৈরি হয়নি কবি তৈরি করার। যদিও বহু ক্রিয়েটিভ কোর্স চালু হয়েছে, কবিতা পড়ানো যায়, কবি করা যায় না কাউকে। আর্টিফিশিয়ালি কুয়াশা তৈরি করা যায়, কবিতা লেখা যায় না। আগামীতে বাইপাসের ধারে হাসপাতালগুলোতে ডাক্তারের বদলে এআই পরিচালিত হ্যান্ডসাম/সুন্দরী রোবট দেখতে পাবেন চিকিৎসার জন্য। কিন্তু এআই পরিচালিত কবি পাবেন না যিনি আপনাকে মুখের ওপর বলবেন, ‘আমাকে তুই আনলি কেন ফিরিয়ে নে’। কোনও অক্সফোর্ড শক্তি চট্টোপাধ্যায় তৈরি করতে পারবে না। শক্তি চট্টোপাধ্যায় নিজেই নিজের অক্সফোর্ড তৈরি করেছেন।
আপনাকে বলি, কবিতা লিখে আপনি কিছু পাবেন না। এই লাইনে টাকা নেই। নাম নেই।মিডিয়া নেই। কবিতা লেখার জন্য আপনি কোনও ব্যাঙ্ক লোন পাবেন না। হাতের বালা বিক্রি করে কোনও কবির প্রেমিকা বই ছাপিয়ে দিয়েছেন। কবিদের এই দুরবস্থার গরিমা এখনও যায়নি। কোনও বাবা চাইবেন না তাঁর মেয়েকে কোনও কবির হাতে তুলে দিতে। এইরকম ধূসর প্রেক্ষিতে কেন আপনি কবিতা লিখবেন? আপনি কম্পিউটার শিখুন, বাড়িতে আপনার দিকে তাকিয়ে থাকা বৃদ্ধ বাবা মা-র হাতে খালি ব্যাগ নয়, ভর্তি ব্যাগ তুলে দিতে পারবেন। কেন আপনি অভিশাপ কুড়োবেন? বড়লোকের ছেলে হলে তবু কথা ছিল, লিখতেন আর শোনাতেন। কিন্তু আশ্চর্যের কথা হল এই যে, বড়লোকের ছেলেরা কবিতা লিখতে আসে না। আমেরিকাতেও বড়লোকের ছেলেরা কবিতা লেখে না। কবিতা লেখেন তাঁরাই, যাঁদের ভেতরে খিদে আছে, সেই খিদে ধিকি ধিকি জ্বলতে থাকে যাঁদের, তাঁরাই লেখেন। যাঁদের ভেতরে কোনও রকম খিদে নেই তাঁরাই হল কবিতা-প্রুফ জাতি।

কবিতা লেখার জন্য কী কী করতে হবে?
কোনও শর্টকাট নেই। ফেসবুক আপনাকে কবি করতে পারবে না। রিলস আপনাকে মঞ্চ দেবে, কবিতা দেবে না। আপনাকে দুঃখ পেতে হবে। কবিতা হল দুঃখের জননী। তার আঁচলের স্পর্শ পেতে হলে আপনাকে বিষণ্ণতার নিমগ্ন পাঠক হতে হবে। ইন্টারনেটের যুগে কেউ আর দুঃখী হতে চায় না, সবাই সুখের মুখ দেখতে চায়। কাকে বলে সুখ? দামি গাড়ির পিছনে বসে এসকর্টের সঙ্গে কথা বলছেন যিনি তাঁকে ‘সুখ’ বলে? কবিতা লেখার জন্য আপনাকে পড়তে হবে। দু’রকম পড়া। এক হল বই। রিলকে বাইবেল পড়তে বলেছেন। আমি বলব, হাতের কাছে যা পাবেন গোগ্রাসে পড়ুন, লিপস্টিকের বিজ্ঞাপন থেকে উপনিষদ। কবি জানেন না কোন উৎস থেকে তিনি নেবেন। তাঁকে বলিভিয়ার চে গুয়েভারার কথা শুনতে হবে, কামারহাটির রামকৃষ্ণের কথাও শুনতে হবে। ইডিওলজি, যতই মহৎ হোক, শেষ পর্যন্ত একটি আলুর বস্তা। ওটা মাথায় তুললে কবিতা পালিয়ে যায়। কবিতা কখনও বামপন্থী হয় না। কবিতা কখনও ডানপন্থী হয় না। কবিতাই হল মানবতার শেষ বকুল ডাল যাকে আমরা বারবার প্রশ্ন করে চলেছি, ‘দোলায় কে আজি দুলিছে?’
পড়া দু’রকম। বই। আর মানুষ। যে মানুষ আপনার পাশে এসে বসল, সে আসলে একটা জ্যান্ত বই। আপনি সেই বইটাকে আস্তে আস্তে খুলুন। পাতা যেন ছিঁড়ে না যায়। আমি একবার মস্কো ইন্টারন্যাশনাল বিমানবন্দর থেকে ইস্তানবুলে আসছিলাম। আমার পাশের সিটে একজন সাহেব এসে বসল। তিনি বই খুলে পড়তে লাগলেন। কোনও কথা হল না। কেউ আমার পাশে এসে বসলে আমি কথা না বলে থাকতে পারি না। ‘টক ওপেন’ করতে হলে সূত্র চাই। কোনও সূত্র নেই। আমি যে কাগজের কাপে জল খাচ্ছিলাম, সেটা থেকে জল চলকে পড়ল তাঁর জামায়, ইচ্ছে করে আমিই ফেলেছি, ‘সো সরি সো সরি’ বলে খুব নাটক করছি, সাহেব ‘ডোন্ট ওরি ডোন্ট ওরি’ করে যাচ্ছেন আর জল মুছে চলেছেন, আমিও তার জল মুছে দিচ্ছি। ব্যাস জমে গেল। তিনি বই খোলা রেখেই আমার সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলেন। তিনি মস্কো থেকে ইস্তানবুল হয়ে আঙ্কারা যাচ্ছেন, সেখানে তাঁর দোকান আছে, তিনি কাশ্মীরি শালের ব্যবসা করেন। তাঁকে দেখতে সাহেবের মতো তিনি সাহেব নন, তিনি একজন কাশ্মীর থেকে পালিয়ে আসা কাশ্মীরি পণ্ডিত। চার ঘণ্টার যাত্রাপথে এর চেয়ে জ্যান্ত বই আর কী হতে পারে? ওর কাশ্মীরি শালের গল্প শুনতে শুনতে মনে হল ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস পড়ছি। কবিতা লিখতে হলে বই পড়তে হবে, মানুষ পড়তে হবে তার চেয়ে বেশি।
মানুষকে ভালোবাসতে হবে। সে মানুষ যতই আমাকে অপমান করুক। আঘাত করুক। ষড়যন্ত্র করুক। আমি ৪০ বছরে দুটো জিনিস দেখেছি, মানবসমাজে ‘মনোগ্যামি’ বলে কিছু নেই। ওটা হয় না। ওটা ধাপ্পা! আর কবিরাও মিথ্যা বলে। একটা ভালো কবিতা মানে একজন মিথ্যুকের হাত থেকে বেরিয়ে আসা অমোঘ সত্যকথন। জেনে-বুঝে বহুগামী স্বামীকে আদর করতে করতে যে রকম একজন স্ত্রী-র ভালোবাসা হয়ে ওঠে পবিত্র। বা উল্টোটাও। তেমনই একটি কবিতা মিথ্যার অগ্নিতে পুড়তে পুড়তে উঠে দাঁড়ায় মানুষের বাতিঘর হয়ে।
আপনি যদি পুড়তে চান। কষ্ট পেতে চান। আসুন, কবিতা লিখুন। কে বলতে পারে ওগো কালচিনির দুঃখী তরুণ কবি, স্টকহোম থেকে একদিন তোমার কাছে ফোন আসবে না? তবে কোনও ফোন আশা না করেই লিখতে হয়। রিলকে করেননি। স্টকহোমের ফোনের চাইতে বড় ফোন তাঁর জার্মানির বাড়িতে বেজে চলেছে– সেই ফোন অমরত্বের।
ইতি,
আপনার শুভার্থী
কলকাতা
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved