Robbar

মানসিক রোগী, যৌনকর্মীদের তাড়া করছে বেনাগরিক সাব্যস্ত হবার আতঙ্ক

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 6, 2025 8:45 pm
  • Updated:December 6, 2025 8:45 pm  

জার্মান এবং আমেরিকার ঐতিহাসিক এবং দার্শনিক হানা আরডেন্ট একটি বিখ্যাত বইতে লিখেছিলেন, ‘The Right to have Rights’। ঘটনাচক্রে বইটির নামও তাই। পরবর্তীতে রাষ্ট্রপুঞ্জ এই ভাবনাকে স্বীকৃতিও দিয়েছে। আরডেন্ট বিশ্বাস করতেন যে নাগরিকত্বের অধিকার, ‘প্রত্যেকের জন্য সমান উদ্বেগের বিষয়গুলিতে একসাথে কাজ করার বহুসংখ্যক মানুষের অধিকার’, কেবলমাত্র সর্বগ্রাসী ধারণাকে অস্বীকার করে না, যেমনটি প্রতিটি স্বৈরাচারীতন্ত্র দ্বারা করা হয়, বরং সেই নীতির বিরোধিতা করে যা ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডকে প্রশ্রয় দেয়।

সুমন সেনগুপ্ত

দোলা দাস, প্রায় ৪৬ বছর বয়স। দীর্ঘদিন ঘরবাড়ি ছাড়া, কারণ তাঁর মানসিক সমস্যা ছিল। ছোটবেলায় বাবা-মা দু’জনকেই হারিয়েছেন। মামা-মামির কাছে বড় হয়েছেন। ছোট থেকেই তাঁর অস্বাভাবিক আচরণের জন্য পরিবারের অন্য মানুষদের কাছে শুনতে শুনতে একসময়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। তারপরে ধামাখালি অঞ্চল থেকে পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করে প্রথমে হাসপাতালে ভর্তি করে। সেখানে চিকিৎসকেরা পরীক্ষা করে দেখে নিশ্চিত হন, তাঁর জটিল মানসিক রোগ আছে। তারপর তাঁকে ভর্তি করা হয় সরকারি মানসিক হাসপাতালে। সেখানে দীর্ঘদিন চিকিৎসা চলার পরে তিনি সুস্থ হলে, ‘অঞ্জলি’ বলে একটি বেসরকারি সংস্থার সদস্যদের সহায়তায় তিনি তাঁর পরিবারের মানুষদের কাছে ফিরে যেতে পারেন। তবে বাড়ি ফিরলেও, তাঁকে কিন্তু তাঁর পরিবারের মানুষজন মেনে নিতে পারেননি। ফলে তাঁকে অঞ্জলির সাহায্যে আবার একটি বেসরকারি হোমে ফিরে যেতে হয়। এখন দোলা ঐ হোমেই থাকেন, হাতের কাজ করেন। ঝুড়ি বোনেন, গয়না বড়ি বানান, শাড়িতে ব্লক প্রিন্টের কাজ করেন। সেগুলোর প্রদর্শনী হয়।

এখন দোলা ভালোই আছেন। তাঁর এখন অনেক বন্ধু। তাঁর পরিবার অনেক বড় হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে তাঁর একটা সমস্যা হয়েছে। দোলা শুনেছেন যে, ভোটার তালিকায় কী না কি, বিশেষ নিবিড় সংশোধনী চলছে। দোলার ঠিকানা এখন বারাসাতের হোম। আগে তাঁর বাড়ি ছিল দক্ষিণ ২৪ পরগনায়। গত ১০ বছর ধরে দোলার ঠিকানা ঐ বারাসাতের হোম। সেখানেই তাঁর ভোটার কার্ড। সেখানেই তাঁর আধার। গত ’২৪ সালের লোকসভার নির্বাচনেও ভোট দিয়েছেন। অঞ্জলির দিদিরা খুঁজে দেখেছেন নির্বাচন কমিশনের নতুন নিয়ম অনুযায়ী ২০০২ সালের ভোটার তালিকা। যতটা মনে করতে পারেন, দোলা বলেছেন। বয়সের হিসেব বলছে, ২০০২ সালের তালিকায় তাঁর নাম থাকার কথা ছিল, কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে না। বাবা-মা তো ছোটবেলায় মারা গেছেন। রক্তের সম্পর্ক স্থাপন করে দেখাতে হবে বলেছে কমিশন, ২০০২ সালের তালিকায় মামা কিংবা মামির নাম থাকলেও তা গ্রাহ্য হবে না। তবে কি দোলার আর ভোটাধিকার থাকবে না? ভোটাধিকার তো শুধু ভোট দিয়ে বিধায়ক বা সাংসদ নির্বাচিত করা নয়, ভোটাধিকার তো অন্তর্ভুক্তির আশ্বাস, নাগরিকত্বের আশ্বাস, সর্বোপরি ভোটাধিকার তো সাংবিধানিক অধিকারও। যদি আজকে দোলার এই ভোটাধিকার চলে যায়, তাহলে তাঁর কী হবে? তিনি কি অন্যান্য নাগরিক সুযোগসুবিধা আর পাবেন? যদি তিনি অসুস্থ হন, তাহলে কি তাঁকে আর সরকারি হাসপাতাল ভর্তি নেবে? 

শুধু দোলা নয়, এইরকম অজস্র মানুষের জন্য ‘অঞ্জলি’ বা ওইরকম অন্যান্য বেসরকারি সংস্থা দীর্ঘদিন লড়াই করেছে। তাঁদের ভোট দেওয়ার অধিকার আদায় করে দিয়েছে। একসময়ে তাঁদের কোনও সরকারি পরিচয়পত্র ছিল না। ২০০৯ সালে তাঁদের জন্যেই বিগত কেন্দ্রীয় সরকার আধার প্রকল্প এনেছিল। তখন সরকার থেকে বলা হয়েছিল, দেশের যে ০.০৩ শতাংশের কোনও পরিচয়পত্র নেই, যাঁদের আক্ষরিক অর্থে কোনও ঠিকঠিকানা নেই, তাঁদের জন্যেই আধার হবে একটি সচিত্র পরিচয়পত্র। আধার যে নাগরিকত্বের পরিচয় নয়, তা বলা থাকলেও, তারপর দেখা গেছে বহু মানুষ বা বলা ভালো দেশের প্রায় সমস্ত মানুষের আধার করানো হয়েছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যিনি ২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ অবধি এই আধারের বিরোধিতা করেছেন, ক্ষমতায় আসার পরে সেই তিনিই দেশের সমস্ত মানুষের আধার যাতে তাঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বা গ্যাসের সংযোগের সঙ্গে সংযুক্ত হয়– সেই আইন বানিয়েছেন। প্যান কার্ড এবং ভোটার কার্ডের সঙ্গেও যাতে আধার সংযুক্ত থাকে, সেই আইনও লাগু করেছেন। এই প্রক্রিয়াতেও প্রচুর দুর্নীতি হয়েছে, ফলে রেশন থেকে শুরু করে নানান ক্ষেত্রে নানান রকমের জালিয়াতি চক্রের রমরমার খবর এসেছে দেশের নানান প্রান্তে। আসলে সরকার চেয়েছে, মানুষের পরিচিতি একটা সংখ্যায় পরিণত করে দিতে। যাতে কোনও একটি সুইচ বন্ধ করলে, সেই মানুষের অস্তিত্ব মুছে যায়। ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধনের মাধ্যমে যে কোনও মানুষকে যাতে একটি সুইচের মাধ্যমে মুছে ফেলা যায়, তার ব্যবস্থাই সরকার করতে চাইছে। সমস্ত কিছু দরকারি এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনার সঙ্গে আধারকে সংযুক্ত করা তারই পদক্ষেপ। 

এই ঘটনা যে শুধু দোলা দাসদের মতো মানসিক স্বাস্থ্যের রুগীর ক্ষেত্রেই হবে এমনটা নয়। এশিয়ার সর্ববৃহৎ যৌনকর্মী অঞ্চল সোনাগাছি বা অন্যান্য রেড লাইট অঞ্চলের মহিলাদের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটবে। পেশায় যাঁরা যৌনকর্মী, তাঁদের বাড়ি থেকে আসা, তাঁদের কথা একবারও শোনা হবে না। তাঁদের হয়ে যাঁরা কাজ করেন, সেই সংস্থা ‘দুর্বার মহিলা সমন্বয় সমিতি’র কর্মীরা দীর্ঘদিন তাঁদের হয়ে লড়াই করে তাঁদের ভোটাধিকার আদায় করেছিলেন। সেই ভোটাধিকার কিছু আমলার ইচ্ছায় কি এবার চলে যাবে? এই প্রশ্নই ঘুরছে টুসি, লক্ষ্মী বা অন্য যৌনকর্মীদের মনে। বাংলার নির্বাচন কমিশনের মুখ্য আধিকারিকের সাক্ষাতের সময় অবধি পাওয়া যাচ্ছে না। কোনও বাড়িই, তার সন্তানের এই পেশা মেনে নিতে রাজি নয়, অথচ বহু যৌনকর্মী কিন্তু নিয়ম করে তাঁদের বাড়িতে টাকা পাঠিয়ে থাকেন। আজকে যদি এই যৌনকর্মীরা পরিচয়বিহীন হয়ে যান, যদি তাঁদের ভোটাধিকার না থাকে, তাহলে তাঁরা কি আর নাগরিক থাকবেন? তখন কি তাঁদের আর কোনও সরকারি সুবিধা থাকবে? যদি কোনও যৌনরোগ হয়, তার চিকিৎসাই বা কোথায় হবে?

আসলে সমস্যা হচ্ছে, আজকের সরকার শুধু নিজেরটুকু ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে যাতে মানুষ না ভাবে, সেই সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাইছে। যে কাজ নোটবন্দীর সময়ে হয়েছিল, প্রতিটি মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছিল, সেই একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। কোভিডের সময়ে আমরা দেখেছি, বিভিন্ন বড় বড় আবাসনে বাড়ির পরিচারিকা কিংবা অন্যান্য জরুরি পরিষেবার মানুষদের যাতায়াতের ওপর প্রতিবন্ধকতা জারি হয়েছিল। তাঁদের ছোঁয়ায় যেন ঐ আবাসনের মানুষেরা সংক্রামিত হতে পারেন। মানুষকে ভয় পাইয়ে দিতে পারলে, মানুষ প্রশ্ন করার কথা ভুলে যায়। যা কোভিডের সময়ে হয়েছিল, তা আবার এখন হচ্ছে। প্রতিটি মানুষকে প্রমাণ করতে বলা হচ্ছে, তিনি এই দেশের নাগরিক কি না। সরকারের যেমন এই বিষয়ে সংবেদনশীলতা নেই, তেমনই যাঁরা সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপকে প্রশ্নাতীতভাবে সমর্থন করেন তাঁদের মধ্যেও সংবেদনশীলতার অভাব দেখা যাচ্ছে, যার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাচ্ছি সামাজিক মাধ্যমে। 

শুধু নিজেরটুকু হয়ে গেলেই সব হয়। সামাজিক মাধ্যমের যে কোনও আলোচনা দেখে সেটাই মনে হচ্ছে। বাড়ির গৃহ পরিচারিকা কী করে তাঁর নাম খুঁজে পাবেন, তা নিয়ে ভাবনা নেই। শুধু নিজেরটুকু বুঝে নেওয়াই যেন কাজ। যদিও রাজনৈতিক দলগুলো পাড়ায় পাড়ায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, কিন্তু তাতেও কি মানুষের মনে আতঙ্ক কমছে? সমস্ত কিছু ঠিকঠাক করলেও খসড়া তালিকায় নাম ওঠার কি কোনও নিশ্চয়তা আছে? একজন মানুষ এতদিন এই দেশে থাকার পরে, এই দেশের অর্থনীতিতে তাঁর রক্ত, ঘাম আর শ্রম দেওয়ার পরেও, যদি তাঁকে একদিন সকালে প্রশ্ন করা হয় যে, তিনি এই দেশের নাগরিক কি না– তখন কী অবস্থা হতে পারে সেই মানুষটার? সেই আতঙ্কেই আছেন এখন মানসিক স্বাস্থ্য, বা যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার কর্মীরা। এতদিন লড়াই করে যে মানুষদের তাঁরা সমাজের মূলস্রোতে ফিরিয়ে নিয়ে আসার কাজ করেছেন, সেই কাজটাই তো বৃথা হয়ে যায়। একজন মানুষ যদি একদিন সকালে উঠে দেখেন, তিনি সরকারের খাতায় বেনাগরিক হয়ে গেছেন, তাঁর মনের ওপর কী প্রভাব পড়তে পারে? 

জার্মান এবং আমেরিকার ঐতিহাসিক এবং দার্শনিক হানা আরডেন্ট একটি বিখ্যাত বইতে লিখেছিলেন, ‘The Right to have Rights’। ঘটনাচক্রে বইটির নামও তাই। পরবর্তীতে রাষ্ট্রপুঞ্জ এই ভাবনাকে স্বীকৃতিও দিয়েছে। আরডেন্ট বিশ্বাস করতেন যে নাগরিকত্বের অধিকার, ‘প্রত্যেকের জন্য সমান উদ্বেগের বিষয়গুলিতে একসাথে কাজ করার বহুসংখ্যক মানুষের অধিকার’, কেবলমাত্র সর্বগ্রাসী ধারণাকে অস্বীকার করে না, যেমনটি প্রতিটি স্বৈরাচারীতন্ত্র দ্বারা করা হয়, বরং সেই নীতির বিরোধিতা করে যা ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডকে প্রশ্রয় দেয়। আজকে যখন তথ্য বলছে বিহারে বহু মানুষের ভোটাধিকার চলে গেছে, যখন আশঙ্কা করা হচ্ছে বাংলা-সহ ১২টি রাজ্যে বহু সঠিক মানুষদের নাম বাদ পড়তে পারে, তখন আবার হানা আরডেন্টের সেই লড়াইয়ের কথা মনে পড়ছে, মনে পড়ছে কবীর সুমনের সেই বিখ্যাত গান, ‘…অধিকার বুঝে নেওয়া প্রখর দাবিতে’। এবার অধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য লড়াইয়ের সময় হয়েছে।