Robbar

বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দে মাতরম্‌’ ঘিরে ধর্মীয় সংকীর্ণতার আবাহন দেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 12, 2025 4:14 pm
  • Updated:December 12, 2025 7:29 pm  

‘বন্দে মাতরম্‌’ এই স্তোত্র ও ধ্বনি যে বিশ শতকে উগ্র জাতীয়তাবাদের হাতিয়ার হয়ে উঠে দেশপ্রেমের দীপ্তিকে দেশপ্রেমের দাহে রূপান্তরিত করতে পারে এই সত্য রবীন্দ্র-উপলব্ধিতে ধরা পড়েছিল। এর অর্থ কিন্তু এই নয় যে, বঙ্কিম ও রবীন্দ্রনাথ দুই বিপরীত শিবিরের মানুষ ছিলেন। এর অর্থ এই যে উনিশ শতকে বঙ্কিম যা দেখে যাননি, বিশ শতকে রবীন্দ্রনাথ তা দেখতে পাচ্ছিলেন।

বিশ্বজিৎ রায়

১৮৮৩ সাল। জানুয়ারি মাস। বঙ্কিমচন্দ্র জানুয়ারি মাসের ৬ তারিখে কালীপ্রসন্ন ঘোষকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘আমিই বা আনন্দমঠ লিখিয়া কি করিব আর আপনিই বা তাহার মূলমন্ত্র বুঝাইয়া কি করিবেন? এই ঈর্ষ্যাপরবশ, আত্মোদরপরায়ণ জাতির উন্নতি নাই। বল “বন্দেউদরং”।’

উদর কখনও ব্যক্তিগত, কখনও বা দলগত। ভোটের রাজনীতিতে দলগত উদর পরিপূর্ণ করার জন্য কখনও কখনও সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের আবেগ উসকে দেওয়ার জন্য কিছু একটা মন ভোলানোর মন্ত্র লাগে। ‘বন্দে মাতরম্‌’ নানা সময় সেই মন ভোলানোর মন্ত্র হয়ে উঠেছিল, এ বঙ্কিমচন্দ্রের দুর্ভাগ্য! সুরেশচন্দ্র সমাজপতি সম্পাদিত ‘বঙ্কিম প্রসঙ্গ’ (১৯২২) বইতে দীনবন্ধু মিত্রের পুত্র ললিতচন্দ্র মিত্রের ছোট্ট লেখা ‘বন্দেমাতরম্‌’ সংকলিত হয়েছিল। ললিতচন্দ্র সেখানে জানিয়েছিলেন, ‘বন্দে মাতরম্‌’ গানটি ভবিষ্যতে বাঙালি গ্রহণ করবেন কি না, সে সম্বন্ধে বঙ্কিমচন্দ্রের মনে গভীর আশা ছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘যদি পঁচিশ বৎসর জীবিত থাক, তখন দেখিবে, এই গানে বঙ্গদেশ মাতিয়া উঠিবে।’

দীনবন্ধু মিত্র

বঙ্গদেশ মেতে উঠেছিল, ভারতবর্ষও। কিন্তু মেতে ওঠা কি সবসময় ভালো? বঙ্কিমচন্দ্র নিজেই তো ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের প্রথমবারের বিজ্ঞাপনে লিখেছিলেন, ‘সমাজবিপ্লব অনেক সময় আত্মপীড়ন মাত্র। বিদ্রোহীরা আত্মঘাতী।’ মেতে উঠলে আত্মপীড়ন ও পরপীড়ন দুই সহজ হয়। অনেকটা একালের আত্মঘাতী বোমার মতো। উনিশ শতকে বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন ওই বিজ্ঞাপনেই, ‘ইংরেজরা বাঙ্গালা দেশ অরাজকতা থেকে উদ্ধার করেছেন।’ এ-কথা উনিশ শতকে বঙ্কিমচন্দ্রের কালে যে তাৎপর্যে ব্যবহৃত সেই তাৎপর্যে কি বাক্যটি বিশ শতকে পড়া সম্ভব? প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। সে প্রশ্ন উঠেছিল। উপন্যাস নিয়ে, গান নিয়ে।

‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র এই গানটি অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। এই উপন্যাসের দশম পরিচ্ছেদে ভবানন্দ এই গানটি গেয়েছে, ভবানন্দ সন্তান। সন্তান কারা? ভবানন্দ তার উত্তর দিয়েছে। তারা মায়ের সন্তান। মা কে? ‘জন্মভূমিই জননী, আমাদের মা নাই, বাপ নাই, ভাই নাই, বন্ধু নাই, – স্ত্রী নাই, পুত্র নাই, ঘর নাই, বাড়ী নাই, আমাদের আছে কেবল সেই সুজলা, সুফল্‌ মলয়জসমীরণ শস্যশ্যামলা…।’

সন্তান দলের এই দেশের জন্য আত্মত্যাগ কেবল দেশের মূর্তিকেই বড় করে তুলছিল না, দেশের শত্রুকেও চিহ্নিত করছিল। সন্তান দলের কাছে দেশের শত্রু সেই মুহূর্তে কারা? ‘আমাদের মুসলমান রাজা রক্ষা করে কই? ধর্ম্ম গেল, জাতি গেল, মান গেল, কুল গেল, এখন ত প্রাণ পর্য্যন্তও যায়। এই নেশাখোর দেড়েদের না তাড়াইলে কি হিন্দুর হিন্দুয়ানী থাকে?’ মনে হতে পারে এভাবেই তো ‘স্ত্রী নাই, পুত্র নাই, ঘর নাই, বাড়ী নাই’ মত্ততায় কাফের নিধনে কোনও দল মত্ত হয়ে উঠতে পারে। সেও তো আত্মঘাতী অমানবিক কাজ, বিপ্লবের নামে নিধনের যজ্ঞ!

‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে ভবানন্দের কণ্ঠে যখন এই গান ধ্বনিত হচ্ছিল তখন মহেন্দ্র তার চেহারার বদল লক্ষ করেছিল। ‘সেই স্থিরমূর্ত্তি, ধীরপ্রকৃতি সন্ন্যাসী আর নাই; সেই রণনিপুণ বীরমূর্ত্তি– সৈন্যাধ্যক্ষের মুণ্ডঘাতিনী মূর্ত্তি আর নাই। … ভবানন্দ হাস্যমুখ, বাঙ্ময়, প্রিয়সম্ভাষী হইলেন।’ ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের দশম অধ্যায়ে ভবানন্দের কথা আর মুখের ভাব, যা মনের ভাবেরই বাইরের রূপ, বদলের সূত্রে এই গানটি যদি বুঝতে চান তাহলে কয়েকটি কথা স্বীকার করতে হয়।

ভবানন্দ যখন দেশের মূর্তি কল্পনা করে গানটি গাইছেন তখন সেই দেশমাতৃকার প্রাকৃতিক শোভা তাঁকে প্রফুল্ল করে তুলছে। তিনি গাইছেন, ‘সুজলাং সুফলাং/ মলয়জ শীতলাং/ শস্যশ্যামলাং/ মাতরম্‌’ এ দেশের বন্দনা হতে পারে আবার শুধু এইটুকু ভাবলে পৃথিবীর, মাতা বসুন্ধরারও বন্দনা হতে পারে। এর পরের অংশে যে কথাগুলি আছে তা কেবল দেশের মাতৃমূর্তির বন্দনা নয়, সেই মাতৃমূর্তি প্রতিষ্ঠার কথা এসেছে। সেই প্রতিষ্ঠার উপায় কী? তখনই এসেছে ‘রিপুদলবারিণীং মাতরম্‌’। রিপু অর্থাৎ শত্রু কারা? ভবানন্দ উপন্যাসে জানিয়েছেন, ‘এই নেশাখোর দেড়েদের না তাড়াইলে কি হিন্দুর হিন্দুয়ানী থাকে?’ অর্থাৎ দেশের প্রতিমা, মূর্তির পাশাপাশি শত্রুবিশেষের কথা হল। সেই শত্রু কে? মুসলমান রাজা। শুধু কি মুসলমান রাজার কথা হল, ‘নেশাখোর দেড়েদের না তাড়াইলে কি হিন্দুর হিন্দুয়ানী থাকে?’ এই জিজ্ঞাসাও এল। তাহলে কেউ যদি হিন্দুয়ানির নামে সব মুসলমানদের শত্রু ভাবেন!

আর এখান থেকেই বিপদের সূত্রপাত। উনিশ শতকে দেশকল্পনায় বঙ্কিম সেই বিপদ কতটা টের পেয়েছিলেন সে প্রশ্ন তুলেই বলা যায় বিশ শতকে রবীন্দ্রনাথ কিন্তু বিপদ টের পেয়েছিলেন। ‘রাজসিংহ’-এর চতুর্থ সংস্করণের শেষে বঙ্কিমচন্দ্র ‘মুসলমান মাত্রই খারাপ’– এই সরলীকরণের বিরোধিতা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ পরের শতকে ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাস লেখার সময়েই টের পেয়েছিলেন পরিস্থিতি জটিলতর, বঙ্কিম তা দেখে যাননি। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতি রবীন্দ্রনাথের শ্রদ্ধার অভাব ছিল না। ঊনবিংশ শতাব্দীতে রবীন্দ্র-কণ্ঠে ‘বন্দে মাতরম্‌’ গানটি ধ্বনিত হয়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের মৃত্যুর পর যে প্রয়াণলেখ রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছিলেন তাতে বাংলা ভাষা-সাহিত্যের কর্মযোগীর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা নিবেদিত। এর অর্থ এই নয় যে, বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতি রবীন্দ্রনাথ প্রশ্নশীল ছিলেন না। খুবই ছিলেন। তবে সেই প্রশ্নশীলতায় শ্রদ্ধার অভাব ছিল না। ‘বন্দে মাতরম্‌’ এই স্তোত্র ও ধ্বনি যে বিশ শতকে উগ্র জাতীয়তাবাদের হাতিয়ার হয়ে উঠে দেশপ্রেমের দীপ্তিকে দেশপ্রেমের দাহে রূপান্তরিত করতে পারে এই সত্য রবীন্দ্র-উপলব্ধিতে ধরা পড়েছিল। এর অর্থ কিন্তু এই নয় যে, বঙ্কিম ও রবীন্দ্রনাথ দুই বিপরীত শিবিরের মানুষ ছিলেন। এর অর্থ এই যে উনিশ শতকে বঙ্কিম যা দেখে যাননি, বিশ শতকে রবীন্দ্রনাথ তা দেখতে পাচ্ছিলেন।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাস যখন লিখছেন রবীন্দ্রনাথ তার আগে তিনি নানা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছিলেন। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় রবীন্দ্রনাথের গান হয়ে উঠেছিল বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের মিলনের উদ্দীপক। সেই দেশের গান গেয়ে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে রাখীবন্ধনের দেশাচার পালন সম্ভব হয়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের স্বদেশগীতি বাংলা আর সংস্কৃত দুই ভাষার মিশেলে লেখা। রবীন্দ্রনাথের ‘বাউল’ বইয়ের অন্তর্গত দেশের গানগুলির সুর বাউলের ভাষা বাংলা।

গান যে দেশপ্রেমের, স্বাদেশিকতার, ঐক্যের সহায়ক হতে পারে নিজের সৃষ্টির প্রয়োগে রবীন্দ্রনাথ তা বুঝতে পেরেছিলেন। এও বুঝতে পারছিলেন, বঙ্গভঙ্গ পরবর্তী পর্যায়ে পরাধীন ভারতবর্ষের রাজনীতি হিন্দু-মুসলমান বিভেদের উপর আসন পেতেছে। মুসলমানদের মধ্যে যেমন হিন্দুদের মধ্যেও তেমন ঐক্যবাদী শক্তির পাশাপাশি স্বাতন্ত্র্যবাদী শক্তি বড় হয়ে উঠছে। সেই স্বাতন্ত্র্যবাদী শক্তিকে কেউ চাইলে দাঙ্গা লাগানোর জন্য ব্যবহার করতে পারে।

১৯০৬ সালে মুসলিম লিগের প্রতিষ্ঠা হল। বঙ্গদেশে যুগান্তর দলকে কেন্দ্র করে সশস্ত্রবাদী বিপ্লবীরা আত্মপ্রকাশ করলেন। এই সশস্ত্রপন্থী বিপ্লবীরা বঙ্কিমের সন্তান দলের ভবানন্দের মতো ভাবছিলেন, “আমাদের ইংরেজ রাজা রক্ষা করে কই? ধর্ম্ম গেল, জাতি গেল, মান গেল, কুল গেল, এখন ত প্রাণ পর্য্যন্তও যায়। এই নেশাখোর গোরাদের না তাড়াইলে কি হিন্দুর হিন্দুয়ানী থাকে?” বঙ্কিমের ভবানন্দের কথায় ‘মুসলমান’ আর ‘দেড়ে’ শব্দদ্বয়কে যথাক্রমে ইংরেজ আর গোরা দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা হল। প্রশ্ন হল, সশস্ত্র বিপ্লবীরা কি ‘হিন্দুর হিন্দুয়ানী’ রক্ষার জন্য বিপ্লব করছিলেন? বিশ শতকে রবীন্দ্রনাথের কাছে এ এক বড় প্রশ্ন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ঘরে বাইরে’, অনূদিত গ্রন্থ

ইংরেজদের এদেশ থেকে বিতাড়িত করার যে বাসনা তৈরি হয়েছে সেই সংগত বাসনার রূপায়ণে সাধারণ মুসলমানদের ও বড় ইংরেজদের প্রতি স্বাদেশিক হিন্দুদের মনোভাব কী হবে? শুধু সংকীর্ণ স্বাদেশিক হিন্দুদের কথাই রবীন্দ্রনাথ ভাবছিলেন না, সংকীর্ণ মুসলমানত্বও তাঁর সমালোচনার আওতার মধ্যে ছিল। ভারতবর্ষীয় অতীতে হিন্দু-মুসলমানের সামাজিক ও ধর্মীয় ঐক্যকে তিনি যেমন স্বীকার করতেন, ঐস্লামিক স্থাপত্যের শ্রী-কে যেমন মেনে নিয়েছেন, তেমনই মুসলমান শাসকদের ঔদ্ধত্যের ব্যভিচারেরও বিরোধী ছিলেন। তাঁর ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাস আর ‘জাপান যাত্রী’ দুয়ের মধ্যে সময়ের ব্যবধান খুব বেশি নয়, দুই-ই প্রমথ চৌধুরীর ‘সবুজ পত্র’ সাময়িকীতে প্রকাশিত। ‘জাপান যাত্রী’তে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘দিল্লিতে যেখানে প্রাচীন হিন্দু রাজার কীর্ত্তিকলার বুকের মাঝখানে কুতুবমিনার অহঙ্কারের মুষলের মত খাড়া হয়ে আছে, সেখানে সেই ঔদ্ধত্য মানুষের মনকে পীড়া দেয়, কিম্বা কাশীতে যেখানে হিন্দুর পূজাকে অপমানিত করবার জন্যে আরঙজীব মসজিদ স্থাপন করেচে, সেখানে না দেখি শ্রীকে, না দেখি কল্যাণকে। কিন্তু যখন তাজমহলের সাম্‌নে গিয়ে দাঁড়াই তখন এ তর্ক মনে আসে না যে, এটা হিন্দুর কীর্ত্তি, না মুসলমানের কীর্ত্তি। তখন একে মানুষের কীর্ত্তি বলেই হৃদয়ে অনুভব করি।”

রবীন্দ্রনাথের আপত্তি সেই উদ্দীপকের প্রতি যা কেবল হিন্দুকে হিন্দু, মুসলমানকে মুসলমান, ইংরেজকে ইংরেজ করে রাখে। ‘বন্দে মাতরম্‌’ গানের মধ্যে দুই ভবানন্দ গড়ে তোলার উপাদানই মিশে আছে। এক ভবানন্দ দেশের মূর্তির কল্পনা করে মানুষের কীর্তির দিকে এগিয়ে যেতে চায়। সেখানে তার আত্মত্যাগের দীপ্তি। অন্যদিকে মাত্রা অতিক্রম করে সে ঔদ্ধত্য নিয়ে অন্য মানুষের বুকে মুষল বসাতে চায়, সেখানে তার সংকীর্ণতা। বিশ শতকে রবীন্দ্রনাথ ‘বন্দে মাতরম্‌’-কে ঘিরে এই সংকীর্ণতার আবাহন দেখছিলেন।

‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাসে নিখিলেশ আর সন্দীপ দুই বন্ধুর তর্ক হল ‘বন্দে মাতরম্‌’ মন্ত্র নিয়ে। নিখিলেশ সন্দীপকে বলেছিল, ‘দেশ-জিনিসকে আমি খুব সত্যরূপে নিজের মনে জানতে চাই এবং সকল লোককে জানাতে চাই– এতবড়ো জিনিসের সম্বন্ধে কোনো মন-ভোলাবার জাদুমন্ত্র ব্যবহার করতে আমি ভয়ও পাই লজ্জাও বোধ করি।’ আরও বলেছিল, “দেশকে দেবতা বলিয়ে যখন তোমরা অন্যায়কে কর্তব্য, অধর্মকে পুণ্য ব’লে চালাতে চাও তখন আমার হৃদয়ে লাগে বলেই আমি স্থির থাকতে পারি নে।”

‘ঘরে বাইরে’ ছবির একটি দৃশ্যে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত

নিখিলেশের এই কথার মধ্যে তথ্য ও যুক্তি ছিল। রবীন্দ্রনাথ খেয়াল করেছিলেন, বিশ শতকে ‘বন্দে মাতরম্‌’ মন্ত্র বহুক্ষেত্রে ঔদ্ধত্যের নির্বিচার মুষল চালানোর উদ্দীপক হয়ে উঠছে। হিন্দু ছাড়া অন্য মানুষদের ভারতবর্ষীয় সমাজ থেকে বাদ দেওয়ার সরব ধ্বনিতে পরিণত হচ্ছে।

শুধু তাই নয়, ‘বন্দে মাতরম্‌’ উচ্চারণ করে কোনও কাজ করলে তার দোষ ঢাকা দেওয়া সম্ভব। স্বাধীনতার পর কংগ্রেসের দুর্নীতির দিকে নির্দেশ করেছিলেন গান্ধীবাদী ও গান্ধীর প্রতি প্রশ্নশীল নির্মলকুমার বসু তাঁর ‘গণতন্ত্রের সংকট’ বইতে। সেখানে তিনি দেখিয়েছিলেন, কংগ্রেসি বস্ত্র (খাদি ও টুপি) কীভাবে দুর্নীতিপরায়ণদের দুর্নীতি ঢাকার ছদ্মবেশ হয়ে উঠেছে। ‘বন্দে মাতরম্‌’ মন্ত্র রবীন্দ্রনাথের মতে, সে-রকম দেশের নামে অন্যায় করার স্তোত্র হয়ে উঠেছে। ভারতবাসীর প্রতি সশ্রদ্ধ, ভারতে সামাজিক সহযোগের কাজে নিষ্ঠ, ঔপনিবেশিক ইংরেজ পুলিশের চোখে সন্দেহভাজন অকালপ্রয়াত পিয়ার্সনের কথা বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ‘বন্দে মাতরম্‌’-এর উদাহরণ টেনেছিলেন। লিখেছিলেন বক্তৃতানিবন্ধে, ‘স্বাজাত্য অভিমানকে’ পিয়ার্সন ‘জলাঞ্জলি’ দিয়ে এদেশের মানুষের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন। লিখেছিলেন, “যাঁরা বিশ্বের জন্য তপস্যা করেছেন এখানে [বিশ্বভারতীতে] তাঁদের আসন পাতা হোক। আমরা ‘বন্দে মাতরম’ বলে জয়ধ্বনি করলে কেবল স্বদেশকে ক্ষুদ্র করা হবে, আমরা এই কার্পণ্যের দ্বারা বড়ো হতে পারব না।”

‘বন্দে মাতরম্‌’ যেখানে উগ্র জাতীয়তাবাদের সহচর সেখানেই রবীন্দ্রনাথের আপত্তি। বঙ্কিমের প্রতি অশ্রদ্ধা নিয়ে নয়, হিন্দু-মুসলমান-ইংরেজ যেখানে ছোট ও সংকীর্ণ সেই অংশের প্রতি সচেতনতা থেকেই, বঙ্কিমচন্দ্রের এই গানটির অঙ্গচ্ছেদ করে গ্রহণের পক্ষপাতী ছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র ও বন্দে মাতরম্‌, স্রষ্টা ও সৃষ্টি– দুয়ের প্রতিই রবীন্দ্রনাথ পরিপ্রশ্নশীল। ‘পরিপ্রশ্ন’ এই শব্দটি ভারতবর্ষীয় জ্ঞানতন্ত্রের অন্তর্গত। প্রশ্ন উত্থাপন করার অর্থ অশ্রদ্ধা নয়, প্রশ্ন উত্থাপনের জন্য যথার্থ পরিশীলন লাগে। সেই পরিশীলন রবীন্দ্রনাথের ছিল। স্বাধীন ভারতে ‘বন্দে মাতরম্‌’ কি ভোরের গান হয়ে ওঠেনি? গত শতকের বেতার-সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল ‘বন্দে মাতরম্‌’। সকালবেলা আকাশবাণী কলকাতার অনুষ্ঠান প্রচার শুরু হত এই গানটি দিয়েই। দেশের ও বসুন্ধরার সুজলা-সুফলা-শস্যশ্যামলা মূর্তি কে না প্রার্থনা করেন? তবে আমার দেশ সুজলা-সুফলা থাকুক, অপর দেশ মরুভূমি হয়ে যাক– এই উগ্রতা তো প্রার্থনীয় হতে পারে না। যে রবীন্দ্রনাথ ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাসে ‘বন্দে মাতরম্‌’ মন্ত্রের মাধ্যমে দেশের সাধারণকে উসকে তোলার বিরোধী, সেই রবীন্দ্রনাথ যে কত তীব্র ভাবে স্বাদেশিক তা পাঞ্জাবের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ‘নাইট’ উপাধি ত্যাগের ঘটনায় বোঝা গিয়েছিল।

পাঞ্জাবের মর্মান্তিক জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড

যে মহাত্মা গান্ধী ‘বন্দে মাতরম্‌’ মন্ত্রের সমর্থক ছিলেন সেই মহাত্মাকে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা হত্যা করে। ন্যাশানালিস্ট মুসলমান যাঁরা, তাঁরা ‘বন্দে মাতরম্‌’ গানের মাধ্যমে দেশবন্দনার বিরোধী ছিলেন না। তবে স্বাতন্ত্র্যবাদী মুসলমানদের ও স্বাতন্ত্র্যবাদী হিন্দুদের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার অস্ত্র হিসেবে যখন ‘বন্দে মাতরম্‌’ ব্যবহৃত হল তখন তো সচেতন হওয়া জরুরি।

এ গানের দীপ্তিকে স্বীকার করে এ গানের দাহকে অস্বীকার করতে চাইলে সত্যের অপলাপ করা হবে।