
কোথাও জলের নাবিক মেঠো গন্ধ পায়, কোথাও বা তেলের গন্ধ আসে জলে। আবার কোথাও পদ্মনাভির গন্ধ। এসবের সঙ্গেই পথ হারানোর রোজের বদ হাওয়ার উৎপাত। এমন বদ বাতাসের হাত থেকে নাবিকদের রক্ষা করার জন্যই একদিন এগিয়ে এলেন ‘হজরত ইলিয়াস পয়গম্বর, জনাবে খাজা খিজির’। এখনও বাংলার লোকমুখে শোনা যায়, কোনও এক সমুদ্দুর পাগলা নাবিককে খাজাখিজির স্বপ্ন দিয়ে বলেছিলেন জলযাত্রায় তাঁকে স্মরণ করতে। সেই থেকে তিনি হলেন জলের ‘জিন্দা পীর’।
সেই কোন যুগ থেকে নাবিক পথ হারায়। সে চাঁদ দেখে, তারা দেখে, কিন্তু স্থির করতে পারে না নিজের পথের দিশা। দিশা হারায় তার নিজের ভাগ্য রেখাও। ময়ূরপঙ্খী, পাটেলা, গয়নার মতো হাজার মাফিক নৌকো জাহাজ লবঙ্গ লতিকার দেশে যেতে পারল কই। বলা, বদর জল মাপে, আকাশ মাপে তবু স্রোতের পাগলামিতে পথ হারানোই দস্তুর। ওদের মনের কথা এখনও সমুদ্রের আনাচ-কানাচে কান পাতলে শোনা যায়। ঢেউয়ের সঙ্গে সঙ্গে ফিরে আসে সেই কথা– ‘লবঙ্গ লতিকার দ্যাশে যাবার ছিল বাসনা’। মশলা দ্বীপের হাতছানি। ফলাফল পথ হারিয়ে ‘মাঝ দরিয়ায় নাও ভাঙিল উপায় যে আর দেখি না’। এরকম আরও অনেক আছে। তখনও কম্পাস নামক পকেট যন্ত্রটি জাহাজি বাজারে হাজির হয়নি। ধ্রুবতারা, সপ্তর্ষি মণ্ডল, কালপুরুষের তীরন্দাজ অথবা পশুকূলের সদস্যরাই ছিল কম্পাস যুগের আগে নাবিক ও সারেঙের সম্বল। তার সঙ্গে অঞ্চলভেদে বদলে যাওয়া জলের গন্ধ। কোথাও জলের নাবিক মেঠো গন্ধ পায়, কোথাও বা তেলের গন্ধ আসে জলে। আবার কোথাও পদ্মনাভির গন্ধ। এসবের সঙ্গেই পথ হারানোর রোজের বদ হাওয়ার উৎপাত। এমন বদ বাতাসের হাত থেকে নাবিকদের রক্ষা করার জন্যই একদিন এগিয়ে এলেন ‘হজরত ইলিয়াস পয়গম্বর, জনাবে খাজা খিজির’।

এখনও বাংলার লোকমুখে শোনা যায়, কোনও এক সমুদ্দুর পাগলা নাবিককে খাজাখিজির স্বপ্ন দিয়ে বলেছিলেন জলযাত্রায় তাঁকে স্মরণ করতে। সেই থেকে তিনি হলেন জলের ‘জিন্দা পীর’। ইন্দাস নদীর ভিস্তিরাও এই জিন্দা পীরকে দেবতা মানতেন। দেখতে দেখতে বাংলার জল সীমানাতেও পীরের প্রতি হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে অগাধ শ্রদ্ধার প্রকাশ দেখা যায়।
সেই শ্রদ্ধার পথ বেয়ে এখনও মুর্শিদাবাদে ‘বেরা’ উৎসব পালিত হয়। এই উৎসব পালনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে জিন্দা পীরের কাহিনি। ‘বেরা’ হল নদীর জলে ভেলা ও প্রদীপ ভাসিয়ে জলদেবতা ‘হজরত ইলিয়াস পয়গম্বর, জনাবে খাজা খিজির’-কে তুষ্ট করার একটি প্রাচীন অনুষ্ঠান। ফারসি শব্দ ‘বেরা’র অর্থ হল– ‘কোনও মহৎ উদ্দেশ্যে নৌকো বা জলজাহাজে যাত্রা করা’। আর সেই যাত্রা সুরক্ষিত রাখতেই স্মরণ করা হয় খাজা খিজিরকে। এখনও মুর্শিদাবাদ জেলায় ‘বেরা’ উৎসব হয়ে আসছে। এই উৎসবের সূচনা হয়েছিল মুঘল সময়কালের বাংলার রাজধানী ঢাকায়। পরে যখন ১৭০৫ সালে সুবে বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত হয় তখন সুবেদার মুর্শিদকুলি খাঁ ভাদ্র মাসের শেষ বৃহস্পতিবার ভাগীরথী নদীর বুকে এই ‘বেরা’ উৎসব নিয়মিতভাবে পালন করতে শুরু করেন। মুর্শিদকুলি খাঁ মনে করেছিলেন সুবে বাংলার রাজস্ব যেহেতু জলপথেই দিল্লিতে পাঠাতে হয় তাই পথে জলদস্যু ও নৌকাডুবির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য খাজা খিজিরই ভরসা। যাতে জলপথে কোনও দুর্গতি না হয় তাই রাজস্ব পাঠানোর নিরাপত্তা প্রার্থনাতেই মুরশিদকুলি খাঁ এই শুভ উৎসব পালন করা শুরু করেন।

নবাবি নথিতে জানা যায়, উৎসবের দিন মুর্শিদকুলি খাঁ নিজে শোভাযাত্রা সহকারে এসে রাজকর্মচারীর হাতে সোনার থালায় ১৫টি সোনার মোহর ও ১৪টি সোনার প্রদীপ (চিরাগ) তুলে দিতেন। তখন থেকেই এই উৎসব হয়ে উঠেছিল ছিল হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নিদর্শন। এই উৎসবের আরেকটি দিক জড়িয়ে রয়েছে অতি বৃষ্টি ও বন্যার সঙ্গে। বন্যার প্রকোপ থেকে রক্ষা করতে হবে বজরা, পাটেলা প্রভৃতি ধরনের নৌকো ও দেশের শস্য জমিকে। বজরা বা নৌকোকে রক্ষা করা এবং ভরা নদীতে সহজে নৌ-বাণিজ্য শুরুর সুবিধা– এই উভয় মনস্কামনা থেকেই বেরা উৎসবটি অনুষ্ঠিত হওয়ার রীতি তৈরি হয়েছিল যা এখনও বহমান।

এখন নদীপথে সেই অর্থে আর বাণিজ্য হয় না। তাছাড়া পলাশীর যুদ্ধের পর একদিকে যেমন নবাবি আমলের আর কোনও জৌলুশ রইল না অন্যদিকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রেলপথের সূচনা নৌ-বানিজ্য পথে মুর্শিদাবাদের গুরুত্বকে খর্ব করেছিল। বলতে গেলে তখন থেকে বহু দিন এই উৎসব বন্ধ থাকে। যদিও পরে বাংলার শেষ নবাব নাজিমের মা রইসুন নিশা বেগম জনগণের দাবিতে বন্যার কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এই বেরা উৎসব পুনরায় চালু করেন।

বর্তমানে এই উৎসব প্রতীকী অর্থে আলোর উৎসবের ‘বড় দিন’ হিসেবে পালিত হয়। ভাদ্র মাসের শেষ বৃহস্পতিবারের আগেই হাজারদুয়ারি প্যালেস লাগোয়া ইমামবাড়ায় বাঁশ দিয়ে তৈরি করা হয় চারটি নৌকো ও কলাগাছ দিয়ে বানানো হয় বিশাল ভেলা। বাঁশের নৌকোগুলি রঙিন কাগজের নকশায় মুখর করে তোলা হয়। উৎসবের দিন নৌকোগুলি নিয়ে আসা হয় ওয়াসিফ মঞ্জিলে। সেখানে আজও নবাব পরিবারের সদস্যরা নৌকোতে ফুলের ‘সেহরা’ (মালা) দান করেন। তারপর রঙিন নকশা সম্বলিত নৌকোগুলিকে ইমামবাড়ার কাছে তোপপখানা ঘাটে আনা হয়। সেখানে থাকে জলে ভাসানোর ভেলা। প্রদীপ জ্বালিয়ে, সুজির ‘রোট’ ও ‘হালুয়া’ দিয়ে নিয়াজ করার পর ভেলাটি খাজা খিজিরের নাম নিয়ে ভাগীরথীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। নবাবি আমল থেকেই দক্ষ কারিগরেরা ভেলা ও অভ্রের পাতের প্রদীপ তৈরি করে আসছেন বেরা উৎসবের জন্য। এই প্রদীপে কোরানের বাণী, মসজিদ, গাছপালা ইত্যাদি নকশা করাই ছিল রীতি। আজ অবশ্য সময়ের হাত ধরে নকশায় নানা বদল এসেছে। এই বেরা উৎসবের একটি ঐতিহাসিক চিত্র রক্ষিত আছে লালবাগের হাজারদুয়ারি প্যালেসে। সেই ছবিটি ইংরেজ শিল্পী হাডসনের আঁকা। ছবিতে দেখা যায় দু’টি রাজকীয় স্থাপত্যের স্তম্ভের মধ্যে দিয়ে বেরা উৎসবের দৃশ্য। ছবিটিকে এই উৎসবের একটি দলিল হিসেবে দেখা যেতে পারে। আসলে এই ছবি যখন শিল্পী এঁকেছেন তখনও ফোটোগ্রাফির মুখ দেখেনি পৃথিবী। তাই প্রি- ফটোগ্রাফিক এরা-র একটি উৎসবের নথি হল এই ছবি। আবার একই ভাবে খাজা খিজিরের যে ছবি মুঘল সালতানাতে ও নবাবি আমলে রচিত হয়েছে তাতে দেখা যায় এক প্রজ্ঞ বৃদ্ধ পয়গম্বর মাছের ওপরে দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে রয়েছে লাঠি আর তসবি। পরনে তাঁর সবুজ আলখাল্লা।

আজ নবাবের আমল নেই কিন্তু মানুষের মধ্যে রয়ে গিয়েছে সেই পরম্পরার প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস। যে বিশ্বাসের মধ্যেই অবচেতনে লালিত হয়ে আসছে সেই যুগের নাবিকের পথ হারানোর কাহিনি। তাই আজকের দিনেও ভাদ্র মাসের শেষ বৃহস্পতিবার বেরা উৎসবে যে পরিমাণ লোকের সমাগম হয় তা হাতে গোনা যায় না।
ঋণ স্বীকার:
স্বরূপ ভট্টাচার্য (নৃতত্ত্ববিদ, শিল্পী, নৌকো বিশেষজ্ঞ, কলকাতা)
সৈয়দ আতাহার আলী (ওয়াসিফ মঞ্জিল, মুর্শিদাবাদ)
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved