
কলকাতার অন্যতম স্কটিশ গির্জা সাবেক ডালহৌসি স্কোয়ার অঞ্চলের সেন্ট অ্যানড্রুজ গির্জা। গ্রিক স্থাপত্বে নির্মিত এই গির্জার জায়গায় আগে ছিল পুরনো মেয়র্স কোর্ট। ১৭২৭-এর রাজকীয় সনদ অনুসারে সেখানে একজন মেয়রের তত্ত্বাবধানে ইউরোপীয়দের বিচার হত। ১৭৭৪-এ সুপ্রিম কোর্ট স্থাপন হলে তা উঠে যায়, কিন্তু নতুন বাড়ি না-হওয়া অবধি কাজ চলত এখানেই। এই বিচারালয় আরও একটা কারণে ভারতবাসীদের কাছে কুখ্যাত হয়ে আছে। এই বাড়ির বিচারসভায় বসেই ১৭৭৫-এর জুন মাসে বিচারপতি এলিজা ইম্পে মহারাজা নন্দকুমারের বিচার করেন।
নানা জাতি, ধর্ম, বর্ণের এক অভূতপূর্ব মিলনস্থল এই কলকাতা শহর। এখানকার নানা জাতির মানুষদের মধ্যে খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীরা কলকাতার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। বড়দিনে তাদের উৎসবে শামিল হয় না, এমন কলকাতাবাসী খুঁজে পাওয়া ভার। ক্রিসমাস ডে-তে শহরের আলোকোজ্জ্বল গির্জাগুলিতে খ্রিস্টানরা ছাড়াও ভিড় করেন অগণিত অ-খ্রিস্টান মানুষ। সামাজিক বা ধর্মীয় কোনও বিধিনিষেধ মানুষের এই খুশিকে ভাগ করে নেওয়ার আনন্দকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। বড়দিনের প্রাক্কালে তাই কলকাতা কয়েকটি গির্জা কবে, কীভাবে, কার চেষ্টায় তৈরি হল– সেই ইতিহাসের একটু খোঁজ নেওয়া যাক।
আর্মেনিয়ান গির্জা: ব্রেবোর্ন রোড
তথ্য অনুসারে, এই মুহূর্তে কলকাতা শহরের প্রাচীনতম খ্রিস্টিয় গির্জা বলে মনে করা হয় ব্রেবোর্ন রোডের আর্মেনিয়ান গির্জাকে। বাণিজ্যের টানে পর্তুগিজ, দিনেমারদের মতো আর্মেনিরাও কলকাতায় এসেছিল ব্রিটিশদের আগে। আজকের ‘ব্র্যাবোন’ রোড, চিনাবাজার অঞ্চলে ছিল তাদের প্রধান বসতি এবং একটি গোরস্থানও ছিল সেখানে। এই গোরস্থানটি কলকাতার ইতিহাসে আরও একটি কারণে উল্লেখযোগ্য। এখানেই পাওয়া যায় শহরের প্রাচীনতম সমাধিলিপি। ‘রেজাবিবি’ নামে এক আর্মেনি মহিলা ১৬৩০ সাধারণাব্দের ১১ জুলাই মারা গিয়েছেন বলে লেখা আছে ওই ফলকে, যা আর্মেনিদের কলকাতাবাসের প্রাচীনত্বের প্রমাণ বলে মনে করেন অনেক ইতিহাসবিদ। তাছাড়াও সাবেক কলকাতার বাহির সিমলা এলাকাতেও থাকতেন কিছু আর্মেনি বণিক। তাঁদেরই পরিবারের একজন ছিলেন সুকিয়াস বিবি। তিনি ওই রাস্তা তৈরিতে অনেক টাকা দান করেন। সেই সূত্রে ‘সুকিয়াস স্ট্রিট’ হিসেবে একদা চিহ্নিত হয়েছিল সেখানকার একটা রাস্তা।

অনুমান করা হয়, সতেরো শতকের প্রথম ভাগেই আর্মেনিরা চুঁচুড়া হয়ে কলকাতায় আসে। ১৬৬৫-তে তাদের প্রথম চার্চ স্থাপিত হয় চুঁচুড়াতেই। কিন্তু কলকাতায় আসার পরে সমবেতভাবে উপাসনা করার জন্য তাদের কোনও গির্জা ছিল না দীর্ঘকাল। ১৭০৭-এ ইংরেজদের সহায়তায় আর্মেনিরা তাদের প্রধান বসতি অঞ্চলে গোরস্থানের ঠিক পাশেই নির্মাণ করে একটি উপাসনাগৃহ বা চার্চ। এটিই কলকাতার প্রাচীনতম গির্জা। আর ইংরেজদের প্রথম গির্জা সেন্ট অ্যান চার্চ স্থাপিত হয় তার দু’বছর পরে, ১৭০৯-এ। শহরের সব থেকে পুরনো আর্মেনিদের ওই গির্জাটি প্রথমে ছিল কাঠের তৈরি। ১৭২৪-এ আগা নাজার নামে এক আর্মেনি ব্যবসায়ীর টাকায় পারস্যের স্থপতি গাভোনের নকশা অনুযায়ী পাকা গির্জা-ভবন তৈরি হয় এবং গির্জাটি ‘আর্মানিয়ান হোলি চার্চ অফ নাজারেথ’ নামে পরিচিত হয়। ১৭৩৪-এ ম্যানুয়েল হজরমল নামে আর এক ব্যবসায়ী গির্জার চূড়াটি তৈরি করিয়ে দেন। পরে লোকসংখ্যা বাড়লে ট্যাংরা ও পার্কসার্কাস অঞ্চলে আর্মেনিদের আরও দুটি গির্জা তৈরি হয়। তবে ২৫ ডিসেম্বর নয়, আর্মেনিদের খ্রিস্ট-জন্মোৎসব হয় জানুয়ারির ৬ তারিখে।

সেন্ট অ্যান’স চার্চ: ফোর্ট উইলিয়াম
শহর কলকাতার দ্বিতীয় প্রাচীনতম গির্জা ছিল সেন্ট অ্যান’স চার্চ। এটি ছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তৈরি করা প্রথম প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চ। ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ তৈরির পর তার ভিতরে ইংরেজরা তাদের প্রার্থনা করার জন্য ১৭০৯-তে এই চার্চটি তৈরি করে। ইংরেজ ব্যবসায়ীদের চাঁদায় তৈরি এই চার্চের নাম রাখা হয় কুইন অ্যানের নামে– “সেন্ট অ্যান’স চার্চ”। এখনকার লালদিঘি বা বিনয়-বাদল দীনেশ বাগ-এর পশ্চিম দিকে, এখন যেখানে জিপিও, সেই জায়গায় ছিল ইংরেজদের পুরনো কেল্লা। তার মধ্যেই ছিল ওই গির্জার অবস্থান। চার্চের মিনার আর সিঁড়ি তৈরি করা হয় ১৭১৬ নাগাদ। ১৭৩৭ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে চার্চের চূড়া ভেঙে পড়ে। ১৭৫৬-এ সিরাজের কলকাতা আক্রমণের সময় নবাব-বাহিনীর গোলার আঘাতে চার্চটি ধ্বংস হয়ে যায়। প্রায় একতরফা যুদ্ধে ইংরেজ বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। দুর্গে বসবাসকারী ইংরেজরা কোনও ক্রমে দুর্গের পিছন দিকের দরজা দিয়ে নৌকা করে পালিয়ে যায়। নবাবের বাহিনী কলকাতা দখল করে ও লুটপাঠ চালিয়ে গোটা নগরের নাম পালটে ‘আলিনগর’ করে ফিরে যায়। সিরাজ মুর্শিদাবাদ ফিরে গেলে ইংরেজরা আবার আস্তে আস্তে কলকাতায় ফিরে আসে। ১৭৫৭-এ পলাশির যুদ্ধের পর পুনরায় ক্ষমতা ফিরে পেয়ে সাবেক গোবিন্দপুর অঞ্চলে নতুন কেল্লা তৈরি করে। পরে সেখানে নির্মাণ করে আলাদা উপাসনাগার।

ওল্ড অর মিশন চার্চ/ লাল গির্জা: লালবাজার
বর্তমান লালবাজার অঞ্চলের মিশন চার্চ বা লাল গির্জার প্রতিষ্ঠাতা রেভারেন্ড জন জ্যাকারিয়াস কিয়েরন্যানডার ছিলেন সুইডেনের বাসিন্দা। ১৭৩৯ সালে ভারতে এসে তিনি প্রথমে পণ্ডিচেরির দক্ষিণে কুডডালোর নামক একটা জায়গায় ধর্মপ্রচার আরম্ভ করেন। পলাশির যুদ্ধের পরে ওই অঞ্চলে ইঙ্গ-ফরাসি দ্বন্দ্ব আরম্ভ হলে কিয়েরন্যানডার কলকাতায় পালিয়ে এসে অ্যান উলি নামে এক মহিলাকে বিয়ে করে অনেক সম্পত্তির মালিক হন এবং নিজে মিশনারি হিসেবে একটা গির্জা স্থাপন করতে উদ্যোগী হন। বর্তমান বিনয়-বাদল-দীনেশ বাগের কাছাকাছি একটি জমিতে ১৭৬৭ সালের মে মাসে গির্জার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। নকশা তৈরি করেন ডেনমার্কের স্থপতি বনটো ডি মেলভিল। ওই গির্জা নির্মাণে সে যুগেই মোট খরচ হয় ৬৮,০০০ টাকা। ১৭৭০-এর ২৩ ডিসেম্বর বিশেষ প্রার্থনা দিয়ে উপাসনা শুরু হয় গির্জার কাজ। এই চার্চের নামেই পরবর্তীকালে সামনের রাস্তার নামকরণ করা হয় মিশন রো। প্রথমে গির্জার দেওয়ালে শুধু লাল ইঁট থাকায় লোকে ‘লাল গির্জা’ বলত।
উল্লেখ্য, গির্জার দেওয়ালে একটি পাথরে ‘ওল্ড মিশন চার্চ’ লেখা আছে বলে অনেকেই এটিকে ওই নামে চিহ্নিত করেন। কিন্তু গির্জার নাম প্রথমে ছিল ‘মিশন চার্চ’, পরে সেন্ট জনস চার্চ প্রতিষ্ঠা হলে সেটাকে লোকে বলত ‘নিউ চার্চ’ আর মিশন চার্চ লোকমুখে হয়ে গেল ‘ওল্ড অর মিশন চার্চ’। আদিতে গির্জার দেওয়ালে ‘Old or Mission Church’ লেখা থাকলেও প্রতিষ্ঠার সাল ভুল লেখা ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পরবর্তী কোনও এক সময়ে ওই ভুল সংশোধন করতে গিয়ে গির্জা কর্তৃপক্ষ নতুন একটা ভুল করে বসে। তারা পুরনো ফলক তুলে নতুন একটি ‘Old Mission Church. Founded 1770’ লেখা একটা ফলক বসিয়ে দেওয়ায় সেটাই নাম হয়ে দাঁড়ায়। উল্লেখ্য, এই মিশন চার্চেই ১৮৪৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি মধুসূদন দত্ত খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হন।

পর্তুগিজ চার্চ: মুরগিহাটা (ব্রেবোর্ন রোড)
পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো-দা-গামা প্রথম ভারতে আসেন ১৪৯৮ সাধারণাব্দে। তিনি বঙ্গদেশে না এলেও তাঁর আসার মাত্র ১৯ বছর পরেই, ১৫১৭-এ আর এক পর্তুগিজ নাবিক ডি জোয়াও সিলভেরিয়া বাণিজ্যতরী নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে আসেন এবং তৎকালীন গৌড়ের সুলতান হুসেন শাহর সঙ্গে দেখা করেন বাণিজ্যের অনুমতি পাওয়ার জন্য। কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক, তখন বাংলার শাসকের কাছ থেকে অনুমতি মেলেনি। হতোদ্যম না হলে পর্তুগিজরা বছর বছর নৌ-তরী পাঠাতে থাকে অনুমতির আশায়। তারপর নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে পর্তুগিজরা শেষ পর্যন্ত বাংলায় বাণিজ্য করবার অনুমতি লাভ করে।
ষোড়শ শতকের প্রথম দিকেই বাংলার পশ্চিম অংশে এসে সপ্তগ্রাম, হুগলি, ব্যান্ডেল প্রভৃতি অংশে ব্যবসা আরম্ভ করে হুগলি নদী ও সরস্বতী নদীপথ ব্যবহার করে। পর্তুগিজরা কলকাতায় বসতি স্থাপন করে সতেরো শতকের মাঝামাঝি সময়ে। ইংরেজ বণিক জোব চার্নক মুঘলদের সঙ্গে বিরোধ করে যখন সুতানুটি আসেন, পর্তুগিজরা ততদিনে এই অঞ্চলে ঘাঁটি তৈরি করে ফেলেছে। খানিকটা তাদের সহায়তা নিয়েই জোব চার্নক এখানে বসতি তৈরি করেন। সেখানে খড়ের চালা দেওয়া একটা অস্থায়ী উপাসনাগারও তৈরি করে তারা। প্রাচীনতম ধরলে সেটাই ছিল কলকাতার আদি খ্রিস্ট-উপাসনালয়। কেউ কেউ বলেন, ১৬৯৩-এ চার্নকের মৃত্যুর পর জন গোল্ডসবরো সুতানুটি থেকে কুঠি তুলে পর্তুগিজদের সেখান থেকে বিতাড়িত করে তাদের জায়গা দখল করে ঘাঁটি তৈরি করেন। সেই জায়গাটা হল এখনকার ডালহৌসির জিপিও এলাকা। বিতাড়িত পর্তুগিজরা খানিকটা দূরে এখনকার মুরগিহাটা অঞ্চলে চলে যায় এবং আর একটা উপাসনালয় তৈরি করে। তবে সেটি ছিল অস্থায়ী কাঠামো। পরে ১৭৯৭-তে নতুন গির্জাভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। জেমস্ ড্রাইভারের পরিকল্পনায় তৈরি গির্জা তৈরিতে খরচ হয় ৯০,০০০ সিক্কা টাকা। পর্তুগিজ ধনী ব্যবসায়ী ব্যারেটো অনেক টাকা দান করেন ওই গির্জার জন্য। নির্মাণকাজ সম্পূর্ণ হলে রোসারি ভার্জিন মেরির নামে উৎসর্গ করে, ১৭৯৯ সালের ২৭ নভেম্বর চার্চ খুলে দেওয়া হয়। ক্যাথলিক শৈলীতে নির্মিত এই গির্জাটিতে একটি ত্রিভুজাকার পেডিমেন্ট রয়েছে, যার দুই পাশে দু’টি গম্বুজযুক্ত টাওয়ার এবং খিলানযুক্ত প্রবেশপথ-সহ একটি বর্ধিত বারান্দা রয়েছে। গির্জার ভিতরের অংশটি খিলানযুক্ত লম্বা করিডোর রয়েছে। সেখানে যিশুর ক্রুশবিদ্ধ বিভিন্ন ভঙ্গির ১৪টি ছবিও রয়েছে। এই উপাসনালয়কে কলকাতার অন্যতম সুন্দর-দর্শন গির্জা বলা হয়।

সেন্ট জন’স চার্চ/ পাথুরে গির্জা: কাউন্সিল হাউস স্ট্রিট
১৭৫৬ সাধারণাব্দে সিরাজ-উদ-দৌল্লার কলকাতা আক্রমণের সময়ে সেন্ট অ্যানি’স চার্চ ধ্বংস হওয়ার পর ইংরেজরা সাময়িকভাবে মুরগিহাটায় পর্তুগিজ গির্জায় উপাসনা করত। ১৭৬০-এ গির্জাটি পুনরায় পর্তুগিজদের ফেরত দিয়ে দেওয়া হয়। ওই সময় থেকে পুরনো কেল্লার কাছে একটা ঘর তৈরি করে প্রেসিডেন্সি চার্চ বা উপাসনালয় হিসাবে ব্যবহার করতে থাকে।
লন্ডনের বোর্ড অফ ডাইরেক্টরস্ কলকাতায় বসবাসকারী ইংরেজদের অসুবিধার কথা মাথায় রেখে নতুন গির্জা তৈরির পরিকল্পনা আরম্ভ করে। খোঁজখবর করে লালদিঘির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে কোম্পানির পুরনো বারুদের গুদামের জায়গাতে গির্জা তৈরির পরিকল্পনা করা হল। কিন্তু ৬ বিঘা ১০ কাটা মাপের ওই জমি নবকৃষ্ণ দেব কিছুকাল আগে কিনে নিয়েছিলেন। হেস্টিংসের মারফত তাঁর কাছে গির্জা তৈরির কথা জানানো হলে, তিনি জমিটি চার্চ কমিটিকে দান করে দেন। ওই জমির ঠিক পাশেই ছিল ইংরেজদের প্রাচীন এক কবরখানা। জোব চার্নকের সমাধিসৌধ রয়েছে ওই কবরখানাতেই। ওই একই সমাধিসৌধে রয়েছে চার্নকের দুই কন্যা এবং বাদশাহ ফারুকশিয়রের কাছ থেকে ইংরেজদের জন্য বিনা শুল্কে বাণিজ্য করবার ফরমান নিয়ে আসা চিকিৎসক উইলিয়ম হ্যামিলটনের সমাধিও। উল্লেখ্য, চার্নকের মৃত্যু-সাল ১৬৯২ না ’৯৩, তা তর্কসাপেক্ষ। সেন্ট জনস গির্জার প্রাঙ্গণে চার্নকের সমাধিসৌধের ভিতরে ফলকে লেখা আছে ১৬৯২, ফার্মিঙ্গারের বইতেও তাই, কিন্তু পরবর্তীকালে পাওয়া জোব চার্নক ও তাঁর বাবার দু’খানা উইলের ওপর ভিত্তি করে কোনও কোনও গবেষক বলেছেন চার্নক মারা গিয়েছেন ১৬৯৩-এর ১০ জানুয়ারি।
সেন্ট জন’স গির্জা তৈরি হয় বিভিন্ন মানুষের দানে এবং কিছুটা লটারি করে তোলা টাকায়। ১৭৮৪-এর ৮ এপ্রিল এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। প্রাচীন গৌড়ের ধ্বংসাবশেষ থেকে চার্চ তৈরির জন্য নিয়ে আসা হয় মার্বেল পাথর। গ্রিক স্থাপত্য রীতিতে লন্ডনের ওয়াকব্লকের সেন্ট স্টিফেন চার্চের আদলে তৈরি গির্জার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় সেন্ট জন দ্য ব্যাপটিস্টের জন্মদিনে, ১৭৮৭-এর ২৪ জুন। সে জন্য গির্জার নাম হয় সেন্ট জন’স চার্চ। পুরো পাথরের তৈরি বলে লোকমুখে নাম হয়ে যায় ‘পাথুরে গির্জা’। গির্জার অভ্যন্তরে বেশ কিছু মর্মর মূর্তি রয়েছে এবং রয়েছে যোহান জেফানির আঁকা বিখ্যাত এবং বিতর্কিত ‘দি লাস্ট সাপার’ ছবিটাও।

সেন্ট অ্যানড্রুজ স্কটিশ চার্চ: বিবাদি বাগ
কলকাতার অন্যতম স্কটিশ গির্জা সাবেক ডালহৌসি স্কোয়ার অঞ্চলের সেন্ট অ্যানড্রুজ গির্জা। গ্রিক স্থাপত্বে নির্মিত এই গির্জার জায়গায় আগে ছিল পুরনো মেয়র্স কোর্ট। ১৭২৭-এর রাজকীয় সনদ অনুসারে সেখানে একজন মেয়রের তত্ত্বাবধানে ইউরোপীয়দের বিচার হত। ১৭৭৪-এ সুপ্রিম কোর্ট স্থাপন হলে তা উঠে যায়, কিন্তু নতুন বাড়ি না-হওয়া অবধি কাজ চলত এখানেই। এই বিচারালয় আরও একটা কারণে ভারতবাসীদের কাছে কুখ্যাত হয়ে আছে। এই বাড়ির বিচারসভায় বসেই ১৭৭৫-এর জুন মাসে বিচারপতি এলিজা ইম্পে মহারাজা নন্দকুমারের বিচার করেন। নন্দকুমারের ফাঁসি হয় ৫ অগস্ট ১৭৭৫। বিচারের কাজ ছাড়াও ওই বাড়িটির এক অংশ ইউরেশিয়ানদের মেলামেশা ও আমোদ-আহ্লাদ করার জায়গা হিসেবেও ব্যবহৃত হত। পরে, ১৭৯২-এ ওই আদালত বাড়িটি ভেঙে ফেলা হয় কিন্তু পুরনো আদালত ভবনকে স্মরণে রেখে সামনের রাস্তার নাম করা হয় ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রিট। ১৮১৫ সাল নাগাদ ওই জায়গাটি গির্জা তৈরির জন্য স্কটিশদের দেওয়া হয়। সেন্ট অ্যানড্রুজ ডে-তে লর্ড ময়রার উপস্থিতিতে মার্কুইস অফ হেস্টিংস গির্জার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। মেসার্স বার্ন ক্যুরি অ্যান্ড কোম্পানি তিন বছরের মধ্যে নির্মাণ কাজ শেষ করে। খরচ হয় ২,৪৬,০০০ টাকা, যার মধ্যে সরকার দেয় ১,০০,০০০ টাকা ও ৩০,০০০ টাকা মূল্যের জমিটি। ৮ মার্চ ১৮১৮-এ জেমস ব্রাইসি গির্জার উদ্বোধন করেন। তিনি সেন্ট অ্যানড্রুজ-এর নামে গির্জার নামকরণ করেন। ১৮৩৫ সালে ৫০০০ টাকা দামের ঘড়ি বসানো হয় গির্জার টাওয়ারে। ভিতরে আছে বেশ কয়েকটি মূল্যবান তৈলচিত্রও। কলকাতা পুরসভার উদ্যোগে এই গির্জা আলোকিত করা হয়েছে।

সেন্ট পলস্ ক্যাথিড্রাল, ক্যাথিড্রাল রোড
শহর কলকাতার অন্যতম সুন্দর-দর্শন ‘অ্যাংলিকান ক্যাথিড্রাল’ গির্জা হল সেন্ট পলস্ ক্যাথিড্রাল। ১৮১৪ পর্যন্ত সেন্ট জন্’স চার্চ প্রেসিডেন্সি চার্চ ছিল। তার পরে শহররের খ্রিস্টীয় সমাজকে বিশপের অধীনে আনা হয়। বিশপ মিডলটনের উদ্যোগে ১৮১৯ নাগাদ সেন্ট জনস গির্জার পাশাপাশি আরও একটা গির্জা নির্মাণের চিন্তা আসে কলকাতার খ্রিস্টীয় সমাজপতিদের। তারই ফলস্বরুপ শহর কলকাতার সাহেবপাড়ার কাছাকাছি কোথাও গির্জা তৈরি হবার সিদ্ধান্ত হয়। একসময়ে ওই অঞ্চল ছিল ঘন জঙ্গল। সেই জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করতেই সময় লেগে গেল প্রায় ২০ বছর। ১৮৩৯-এর ৮ অক্টোবর বিরজিতলাওয়ের পাশে কলকাতার ট্যাঁকশালের স্থপতি মেজর ক্যাপটেন ডবলিউ এন ও সহকারী সি কে রবিনসনের নকশা অনুসারে, সাত একর জমির উপরে নির্মীয়মান গির্জার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। ইন্দো-গথিক স্থাপত্যের ওই গির্জা নির্মাণ সম্পূর্ণ হল প্রায় আট বছর পরে। ১৮৪৭-এর অক্টোবরে গির্জা খুলে দেওয়া হল প্রার্থনার জন্য। খরচ হয়েছিল ৪,৩৫,৬৬৯ টাকা। নিয়ো-গথিক স্থাপত্য রীতিতে তৈরি ২৪৭ ফুট উঁচু ও ৮১ ফুট চওড়া ওই গির্জার টাওয়ারের উপরে রয়েছে বিখ্যাত ঘড়ি-নির্মাতা ভুলিয়ানির তৈরি প্রায় ৩ টন ওজনের একটি ঘড়ি। নরউইচ ক্যাথিড্রালের আদলে তৈরি হয় ২০১ ফুট উঁচু চুড়ো। কিন্তু ১৯৩৪-এর প্রচণ্ড ভূমিকম্পে ওই উঁচু চুড়োটি ভেঙে পড়ে এবং পরবর্তীকালে ক্যান্টারবেরি ক্যাথিড্রালের বেল হ্যারি টাওয়ারের আদলে তৈরি হয় নতুন একটি চুড়ো। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির টাকায় গড়ে ওঠে একটি লাইব্রেরিও। এছাড়াও ইংল্যান্ডের রানি ভিক্টোরিয়া, বিশপ কটন-সহ তৎকালীন কলকাতার বহু বিশিষ্টজনের দানে সজ্জিত হয় সেন্ট পলস্ ক্যাথিড্রাল গির্জা।

এই গির্জাগুলো শহর কলকাতার প্রথম যুগে তৈরি হয়েছিল কিন্তু সে যুগে এই সমস্ত গির্জাগুলিতে প্রবেশাধিকার ছিল শুধুমাত্র শ্বেতাঙ্গ অর্থাৎ সাহেব-মেমদের। ধর্মান্তরিত ভারতীয় এবং ইউরেশিয়ান সম্প্রদায়ের মানুষজনের জন্য ছিল আলাদা গির্জা। সেইসব নেটিভ গির্জার কয়েকটির কথা আমরা সংক্ষেপে আলোচনা করব।
ক্রাইস্ট চার্চ বা কৃষ্ণমোহনের গির্জা, বিধান সরণি
হেদুয়া উদ্যানের পশ্চিমদিকে বর্তমান বেথুন স্কুল ও কলেজের পাশের ক্রাইস্ট চার্চ তৈরি হয়েছিল রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে। সহপাঠীদের অন্যায় আচরণের কারণে নিজে কোনও দোষ না করেও পরিবার থেকে বিতাড়িত ডিরোজিওর প্রত্যক্ষ শিষ্য কৃষ্ণমোহন খ্রিস্টান মিশনারিদের আশ্রয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু কোনও গির্জায় নয়, আলেকজান্ডার ডাফের বাড়িতে দীক্ষা নিয়ে তিনি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন।
ব্যবসার ক্ষতি হবে মনে করে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথম যুগে মিশনারিদের বিশেষ গুরুত্ব দিত না। কিন্তু নানা কারণে ধর্মান্তরিত মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকায়, তারা ভারতীয়দের জন্য নেটিভ অঞ্চলে গির্জা স্থাপনে আগ্রহী হয়। স্থির হল, কলেজ স্কোয়ার অঞ্চলে তৈরি হবে ওই গির্জা; কিন্তু হিন্দু কলেজ কর্তৃপক্ষের বিরোধিতায় সে প্রস্তাব বাতিল হয় এবং শেষ পর্যন্ত ১৮৩৮ সালে হেদুয়ার সামনে একখণ্ড জমিতে ক্রাইস্ট চার্চ গির্জা নির্মাণ শুরু হয় এবং পরের বছরেই তা জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। খুব সাধারণ মানের গথিক শৈলীতে নির্মিত ৫০ ফুট উঁচু গির্জা; দু’পাশের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ যথাক্রমে ৬৪ ফুট ও ৫৮ ফুট। ভারতীয় খ্রিস্টানদের প্রার্থনার জন্য তৈরি ক্রাইস্ট চার্চ গির্জার আচার্য হলেন রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়।

হোলি ট্রিনিটি চার্চ বা লঙ সাহেবের গির্জা, আমহার্স্ট স্ট্রিট
ইংল্যান্ডের চার্চ মিশনারি সোসাইটির ধর্ম প্রচারক হিসেবে ভারতে আসেন রেভারেন্ড জেমস লঙ। তবে তিনি আর পাঁচজন ধর্ম প্রচারকের মতো ছিলেন না, এ দেশের সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দূর করবার কাজেও নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। ১৮২২ সাধারণাব্দে মধ্য কলকাতার সাবেক মির্জাপুর এলাকায় চার্চ মিশনারি একটি বড় জমি কেনে ও সেখানে একটি ইংরেজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। প্রথমে সেখানে পড়াতেন রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। পরে সেই বিদ্যালয়ে শিক্ষকরূপে যোগদান করেন রেভারেন্ড জেমস লঙ। ওই বিদ্যালয়ের পাশে ১৮১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এক গির্জা। প্রথমে তার নাম ছিল চার্চ মিশনারি চ্যাপেল, ১৯৩৯ সালে নতুন নাম হয় হোলি ট্রিনিটি চার্চ। এই গির্জাটিও গোড়া থেকেই ছিল ভারতীয় খ্রিস্টানদের প্রার্থনার জন্য। লঙ এই গির্জার প্রধান না হলেও এখানে তাঁর প্রভাব ছিল অনেকটাই। দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ ‘Nil Darpan, or The Indigo Planting Mirror’ গ্রন্থ তিনি প্রকাশ করেছিলেন। অনুবাদ করেছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত।

সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার চার্চ, বৌবাজার স্ট্রিট
মধ্য কলকাতার বেশ অনেকটা অংশ জুড়েই একদা ছিল ইউরেশিয়ান সম্প্রদায়ের মানুষজনের বাস। তাছাড়া কিছু দেশীয় খ্রিস্টান মানুষও থাকতেন সেখানে। তাঁরা ১৮৩৯ সালে ‘দি ক্যাথোলিক কমিউনিটি অফ বউবাজার’ নামে এক সমিতি তৈরি করেন। তাঁদের উদ্যোগে এক ভাড়া বাড়িতে একটি ক্যাথোলিক ফ্রি স্কুল ও সেই সঙ্গে একটি চ্যাপেল প্রতিষ্ঠা করেন। পরে ওই চ্যাপেলে ভিড় বাড়তে আরম্ভ করলে, ১৮৪২ সালে বাড়ির মালিক ওই সমিতিকে বাড়িটি দান করে দেন। ১৮৪৪ সালে লরেটো সংঘের সন্ন্যাসিনীরা পাশের জমিতে কনভেন্ট প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথমদিকে বড় কোনও গির্জা এখানে ছিল না। বেশ অনেক বছর পরে চাঁদা তোলা আরম্ভ হয় গির্জাঘর তৈরির জন্য।

শেষ পর্যন্ত ১৯০০ সালের জুন মাসে নবনির্মিত গির্জা তৈরি হয় ওই চ্যাপেলের জায়গায়। সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার ওই গির্জার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। তাঁর নামেই গির্জার নাম দেওয়া হয় সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার চার্চ। ডোরিক স্তম্ভের উপরে নির্মিত দ্বিতল বিশিষ্ট এই গির্জায় কোনও চুড়ো নেই। মধ্য কলকাতার অন্যতম অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান তথা ইউরেশিয়ান সম্প্রদায়ের বেশিরভাগ মানুষ বর্তমানে এই গির্জাতেই উপাসনা করেন।
……………………..
রোববার.ইন-এ পড়ুন গৌতম বসুমল্লিক-এর অন্যান্য লেখা
……………………..
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved