Robbar

শীতের প্রার্থনা, বসন্তের উত্তর: একদিন অথবা চিরদিন

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 28, 2025 6:09 pm
  • Updated:December 28, 2025 6:16 pm  

এই কাব্যগ্রন্থের শীত দুঃসহ, রিক্ত, জীর্ণ পাতা ঝরাবার বেলা নিশ্চয়ই। আবার মনে হয় কবিজীবনের দিকে তাকালে মধ্যবয়সের এক অকাল বৈধব্য। আবার এই শীত জন্মান্তর। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে নতুন বীজের বসন্তের বার্তা। আর তাই দুঃসহ এই শীত শেষ কথা নয় বরং জীবনের চড়াই উৎরাই চলার পথ। এইসব কবিতায় প্রার্থনা আছে, প্রতীক্ষা আছে, অপেক্ষা আছে, প্রতিজ্ঞার জোর আছে। আর বসন্তের উত্তর সেই প্রতীক্ষার প্রস্তুতি থেকেই যেন নির্বাচিত, এক জীবনেই জন্ম জন্মান্তর।

পঙ্কজ চক্রবর্তী

তাঁর দ্বাদশ কাব্যগ্রন্থ ‘শীতের প্রার্থনা: বসন্তের উত্তর’ (১৯৫৫) যখন প্রকাশিত হচ্ছে তখন বুদ্ধদেব বসুর কবিজীবনের বয়স ২৫ এবং ‘কবিতা’ পত্রিকার বয়স ২০ বছর। এ এমন এক সময় যখন ‘কবিতা’ পত্রিকার পাতায় পঞ্চাশের কবিদের প্রথম জীবনের অনেক কবিতা প্রকাশিত হচ্ছে বুদ্ধদেব বসুর সম্পাদনা এবং অভিভাবকত্বে। এই একই বছর প্রকাশিত হয় অমিয় চক্রবর্তীর ‘পালাবদল’ বা বিষ্ণু দে-র ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’। এর পাশাপাশি চল্লিশের কবি অরুণ মিত্র, কৃষ্ণ ধর, মণীন্দ্র রায়ের কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হচ্ছে এই বছরই। একই বছরে পঞ্চাশের কবি প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘অতলান্ত’ এবং দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নীলাম্বরী’ প্রকাশিত হল। এখানে উল্লেখ থাক গত পাঁচ বছরে পঞ্চাশের অনেক কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে: আলোক সরকার (‘উতল নির্জন’), আনন্দ বাগচী (‘স্বগত সন্ধ্যা’), অরবিন্দ গুহ (‘তিমির সীমান্তে’), জ্যোতির্ময় গঙ্গোপাধ্যায় (‘তেরো-চোদ্দোর কবিতা’), পূর্ণেন্দু পত্রী (‘একমুঠো রোদ’), দুর্গাদাস সরকার (‘অশোকের সময়ে গ্রাম’), শান্তিকুমার ঘোষ (‘মিতার জন্য রোমান্টিক কবিতা’) ইত্যাদি। অর্থাৎ চল্লিশের কবিদের পাশাপাশি পঞ্চাশের কবিদের পছন্দের ভাষার সঙ্গে বুদ্ধদেবের ভাষার সংগত বিরোধ তৈরি হচ্ছে আনুগত্য রেখেই। কিছুদিন আগে মৃত্যু হয়েছে জীবনানন্দ দাশের; এবং আরও পাঁচ বছর পর চলে যাবেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। এমন এক শূন্যতায় কৃত্তিবাস পত্রিকার (ত্রয়োদশ সংকলন, ১৩৬৭) সম্পাদকীয় মন্তব্য ছিল ‘অতঃপর যতদিন তিনি বেঁচে থাকবেন আধুনিকতা জীবন প্রার্থনা করবে কেবল বুদ্ধদেব বসুর কাছে।’ এই মন্তব্যের এক বছর পর রবীন্দ্র-জন্মশতবর্ষে বুদ্ধদেব বসু ‘কবিতা’ পত্রিকার প্রকাশ বন্ধ করে দিচ্ছেন। কৃত্তিবাস পত্রিকার বিতর্কিত ষোড়শ সংখ্যায় একটি কবিতার ভিতর গদ্য-মন্তব্যে সুনীল দুঃখ করে বলছেন, ‘এখন যারা কবিতা লিখতে শুরু করবেন– তাঁদের জন্য এ স্বর্গ রইল না।’ চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের দশক বাংলা কবিতায় বুদ্ধদেব বসুর অভিভাবকত্বের প্রধান জীবৎকাল।

বুদ্ধদেব বসু

সন্দেহ নেই, বুদ্ধদেব বসুর একটি প্রধান কাব্যগ্রন্থ ‘শীতের প্রার্থনা: বসন্তের উত্তর’। ৩৩টি ছোট-বড় কবিতা নিয়ে এই কাব্যগ্রন্থ যখন প্রকাশিত হল, তার অপ্রত্যাশিতের ধরন শুরু হয়ে গেছে কিছু আগেই। সম্পূর্ণ না-হলেও এই কাব্যগ্রন্থে গদ্যকবিতার বিস্তার, মধ্যবিত্ত সম্পন্নের খর জীবন একটি প্রধান ঘটনা। আর এই সূত্রে এসে পড়ছে কলকাতার নাগরিক জীবনের নানা উপাদান, এলোমেলো ঘটনা এবং কবির হৃদয়ের সংক্ষুব্ধ বাসনার দ্বন্দ্ব। এই খানিকটা এলোমেলো জীবনের বয়ানে কোনও কোনও কবিতায় এসে লাগছে আখ্যানের সুর। এর প্রাথমিক পরিচয় বুদ্ধদেবের মূলত ‘বিদেশিনী’ (১৯৪৩) কাব্যগ্রন্থ থেকে শুরু এবং ‘রূপান্তর’ (১৯৪৪) বা ‘দ্রৌপদীর শাড়ি’ (১৯৪৮)-তে প্রবলভাবে তা উপস্থিত। মাথায় রাখতে হবে এই পর্বে ‘২২শে শ্রাবণ’ (১৯৪২), ‘এক পয়সায় একটি’ (১৯৪২), ‘রূপান্তর’ (১৯৪৪) প্রতিটি কাব্যগ্রন্থ থেকেই কিছু কবিতা তিনি অন্তর্ভুক্ত করছেন ‘শীতের প্রার্থনা: বসন্তের উত্তর’ কাব্যগ্রন্থে। বলার কথা, এই ইতিপূর্বের কাব্যগ্রন্থ ‘দ্রৌপদীর শাড়ি’-তে কবির স্ত্রী, উদ্বাস্তু এবং বন্ধু নামে তিনি যে আখ্যানধর্মী দীর্ঘ কবিতা লিখছেন তার ধরন কিন্তু এই বইয়ে নেই। এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাকে আখ্যানধর্মী কবিতা বলা যাবে না। জীবনের নানা টুকরো ঘটনার ভিতর থেকে কখনও কখনও এমন অতর্কিত আলো এসে পড়েছে যাতে কাহিনির স্পর্শ আছে কিন্তু কোনও আবশ্যিক নাটকীয় টানাপোড়েনের মুগ্ধ শর্ত নেই।

ইতিপূর্বে বুদ্ধদেব বসুর কবিতায় শ্রাবণ বা বসন্তের কথা যত এসেছে, শীতের কথা তত নয়। এই পাতা ঝরাবার দিনগুলির অপরিমেয় ক্লান্তি এবং নিশ্চলতা বুদ্ধদেবের একটি কাব্যগ্রন্থে এত তীব্রভাবে আসেনি। রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতির গানে শীত এবং হেমন্তের গানের সংখ্যা যেমন সবচেয়ে কম, তেমনই বুদ্ধদেবের কাব্যে ইতিপূর্বে শীতও কৃপণ। তবে আছে এবং তা জীবনের ধর্মের সঙ্গে, বয়সোচিত বেদনার সঙ্গে মিশে আছে। বুদ্ধদেবের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘বন্দীর বন্দনা’ (১৯৩০) শুরু হয়েছিল ‘যৌবনের উচ্ছ্বসিত সিন্ধুতটভূমি’তে। সেখানে আলস্যের দগ্ধতা, অক্ষম, দুর্বলের সহস্র পঙ্গুতা ছিল। আর তীব্র হয়ে দেখা দিয়েছিল এই পঙক্তি ‘বাসনার বক্ষোমাঝে কেঁদে মরে ক্ষুধিত যৌবন।’ অথচ কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর কবিতায় এসে পড়ছে বার্ধক্যের অকাল জরা, মধ্যবয়সের স্মৃতিভারাতুর বেদনা। ‘দ্রৌপদীর শাড়ি’ কাব্যগ্রন্থের ‘শীতসন্ধ্যার গান’ কবিতায় বুদ্ধদেব বলছেন– ‘শীতের এ-ক্লান্ত আকাশ/আঁধারে রিক্ত একা। কুয়াশায় কুণ্ঠিত সে,/ হতাশায় গুণ্ঠিত সে,’ এরপরও ‘আছে তার স্বপ্ন আছে।’ আর এখানেই আরেকটি কবিতা ‘মধ্যবয়সের প্রার্থনা’য় লেগেছে প্রাথমিক ক্লান্তির সুর। ‘শীতের প্রার্থনা: বসন্তের উত্তর’ কাব্যগ্রন্থে শীতকে কেন্দ্র করে বুদ্ধদেবের একটি দার্শনিক অভিপ্রায় আছে। সে কথা বলবার আগে তার প্রাথমিক সলতে পাকানো পর্ব ঠিক কেমন দেখে নেওয়া যাক।

এই শীত যেমন প্রাকৃতিক তেমন দৈহিক। অন্তত দু’টি কবিতা এই সাময়িক ভাবনা থেকে সরে এসেছে। ‘মৃত্যুর পরে: জন্মের আগে’ এবং ‘শীতরাত্রির প্রার্থনা’ এই দু’টি প্রাথমিক বিপরীত বিভঙ্গ দিয়ে মনে হয় শেষ পর্যন্ত ভাবনার সামঞ্জস্যে এই কাব্যগ্রন্থের সামগ্রিক পরিচয় নির্মিত। প্রথম কবিতায় এই শীত আশা দুরাশা, হতাশায় মেশা একথা বলার পরও কবি বলতে ভোলেন না ‘তবু তো শীতেই আশা, দুরাশাও দাঁড়ায় আবার/ দাঁড়ায় মুমূর্ষু, মৃত নামমাত্র দিনের খবরে/ বৎসরের হ্রস্বতম দিনের কবরে জন্মে/ আবার দ্বিতীয় দিন, হ্রস্বতায় বৎসরে দ্বিতীয়।’ কিন্তু সাধারণ গৃহপালিত মানুষ বলে অন্য কথা। বলে, এ তো ফূর্তির ঋতু, স্বাধীনভাবে নিজের ইচ্ছা মেটানোর সময়। যদি আগামী বছরে না পাও, তাই এই বছরই সমস্ত ইচ্ছা মিটিয়ে নাও। এছাড়াও আছে আরেকরকম শীত। যখন একদল মেয়েরা হল্লায় আরেকদল যুবকের হুল্লোড়ে মাতে। তাই শুধু দেখে যেতে হয় ‘কলকাতায় ক্রিসমাস, দিল্লিতে উল্লাস আর শান্তিনিকেতনে/ মেলা, খেলা, সারাবেলা– বেলা যায় যায়।’ যদি প্রতিটি ঋতুকে একটা গোটা জীবনের সাপেক্ষে ভাবি, তাহলে লক্ষ করি বুদ্ধদেব বসুর কবিজীবনে অকাল শীত এসেছে। ১৯৪৭ সালে যখন তার বয়স ৪০ পেরয়নি, তখন তিনি বলছেন ‘বেলা তো গেছেই, আমার তো বেলা গেছে। বুড়ো হয়ে উড়ো উড়ো মন মানায় না আর।’ একরাশ ক্লান্তি নিয়ে তিনি দেখেন উত্তরের হাওয়ায় ঠান্ডা ঘর। প্রতিবেশীদের কয়লা ধোঁয়ার ফাঁসি, পচা মাছ রান্নার প্রবল গন্ধের একেকটি দিন। এমন এক অস্থির সময়ে, শীত নয় সুখের সময় অন্তত আমার নয়, বলছেন বুদ্ধদেব। যখন টেবিলের কাঠ ঠান্ডা, যখন ঘর ঠান্ডা, বিছানা ঠান্ডা। তখন পশুর গুহার মতো লেপের গহ্বরই একমাত্র আশ্রয়। এই সূত্রে বুদ্ধদেব একাধিকবার বলছেন ‘আমি বুড়ো, প্রায় বুড়ো, তাই সারাদিন কাটাই চেয়ারে বসে।’ কিন্তু এই কথাই যে একমাত্র সত্যি এমন তো নয়। গান আছে। পাখির ডাকেও আছে সুরের বৈভব। তাই প্রায় বুড়ো একজন মানুষ কিন্তু বলছেন ‘বাড়ো গান, এখনো হয়নি শেষ আছে আরো আরো গান। আরো দিন।’ এরপরই বুদ্ধদেব যৌবনের সঙ্গে বেঁধে দিচ্ছেন প্রায় বুড়োর সেতু। যা ছিল দেহ তা হয়ে ওঠে প্রাণের ধর্ম। তাই গান আজও। গান যেহেতু কবিও ফিরে চান দূরে যান এবং ‘ক্রান্তির ক্লান্তিরে বিছাই মাংসহীন শীতের শরীরে’ এই বিশ্বাসে ভরসা রাখেন। এবার তাই বলা সহজ হল– ‘যদিও যৌবন গেছে তবু আছে কিছু দেরি আছে মাংসহীন শেষ– শূন্য শীতের মুক্তির।’ আর এভাবেই স্মৃতিভারাক্রান্ত এক মানুষ প্রবল এক শৈত্য পেরিয়ে নিজের চিন্তাকে বিছিয়ে দেন চারপাশে। এরপর আসে সেই অমোঘ কিছু পঙক্তি–

‘…যৌবন যখন ছিলো, যৌবনেরে
করেছি বন্দনা; যৌবন যখন যায়, যায়-যায়, তখনও আবার
যৌবনেরে করেছি বন্দনা; কেননা জীবন
যৌবনেরে ভালোবাসে– প্রকৃতির রীতি এই;
যার আছে সে-ও ভালোবাসে, যার নেই সে-ও ভালোবাসে।
সন্তানের যৌবনের তাপে রোদ্দুর পোহায় পিতা,
তরুণী নাৎনির তাতে মাতামহী হাত সেঁকে নেন;
পরস্পর-বিদ্বেষী বুড়োরা
পরস্পরের মুখে আঁকা
নিজের জরার ভয়ে হাত পাতে যৌবনের দম্ভের কাছেও–’

এই গান শুধু যৌবন-বন্দনা নয়, জন্তুর ধর্ম মেনে নিয়ে প্রকৃতির অন্ধ টান নয়, বরং শেষপর্যন্ত এই গান একজন কবির আত্মার ভালোবাসা, আত্মহারা ভালোবাসা। এই ভালোবাসা শব্দের ছন্দ নয়, ছন্দের সম্মোহন নয় এই ভালোবাসা। হৃদয়ে জরা ঠান্ডা আনে কিন্তু ভালোবাসায় শীত নেই, শেষ নেই। শৈত্য পেরিয়ে এই কবিতা এক উম্মত্ত, তীব্র আত্মহারা ভালোবাসা ছাড়া আর কিছু নয়। শারীরিক শীত থেকে ভালবাসার অনন্ত বসন্তের দিকে যাত্রা।

এই কাব্যগ্রন্থের শেষ কবিতার আগে রয়েছে ‘শীতরাত্রির প্রার্থনা’ কবিতাটি। এই কবিতাটির ভেতরে রয়েছে কবির জীবনের এক অন্তর্নিহিত দর্শন। অবশ্য মনে হয় এর প্রাথমিক কাঠামো রয়েছে এর আগেই রচিত ‘নতুন পাতা’ (১৯৪০) কাব্যগ্রন্থের ‘এই শীতে’ কবিতায়। যে দু’টি কবিতার মধ্যে ব্যবধান অন্তত ১৫ বছরের। এই শীতে এমন এক মৃত্যুর কথা আছে যা আসলে জন্মান্তর।

‘আমি যদি মরে যেতে পারতুম
এই শীতে
গাছ যেমন মরে যায়,
সাপ যেমন মরে থাকে
সমস্ত জীর্ণ শীত ভরে
শীতের শেষে গাছ নতুন হয়ে ওঠে,
শিকড় থেকে ঊর্ধ্বে বেয়ে ওঠে তরুণ প্রাণরস,
ফুটে ওঠে চিকন সবুজ পাতায়-পাতায়
আর অজস্র উদ্ধত ফুলে।’

এই বেঁচে ওঠা আসলে সৃষ্টির আনন্দে। কবিতাটি শেষ হয় ‘ভালো লেখার ভালবাসার চেষ্টায়।’ আলোচ্য কবিতায় (‘শীতরাত্রির প্রার্থনা’) শীতের রাতে কবি নিজেকে তৈরি হতে বলছেন, যখন বাইরে উত্তরের শীত, মেরু হাওয়ার ঢেউয়ের পর ঢেউ, তখনই সময় সংযত হওয়ার, নিবিড় হওয়ার। তৈরি হতে হবে মৃত্যুর জন্য। তার কারণ মৃত্যুর পর মাটিতে ঝরে পড়ার পরেই অন্ধকারে ডুবে যাবে বীজ। সেই বীজ, সেই লুপ্ত বীজ থেকেই উঠে আসবে নতুন জীবনের চারা। তাই শীত মানে মৃত্যুর জন্য প্রতীক্ষা। মানুষমাত্রেই অমৃতের পুত্র। মৃত্যু থেকে অমৃতে, জন্ম থেকে জন্মান্তরের আবর্তে জীবন অমৃতের দিকে যায়। মাংসের গণ্ডিতে বন্দী থাকে না। তাই প্রস্তুত হতে হবে, প্রতীক্ষা করতে হবে মৃত্যুর জন্য। এই শীত শেষ পর্যন্ত অন্ধকারের নয় আলোর, শীতের মৃত্যুর গর্ভেই জন্ম নেবে বসন্তের বীজ।

“যে-মৃত্যুকে ভেদ ক’রে লুপ্ত বীজ ফিরে আসে নির্ভুল,
রাশি-রাশি শস্যের উৎসাহে, ফসলের আশ্চর্য সফলতায়,
যে-মৃত্যুকে দীর্ণ ক’রে বরফের কবর ফেটে ফুল
জ্বলে ওঠে সবুজের উল্লাসে, বসন্তের অমর ক্ষমতায়–
সেই মৃত্যুর-নবজন্মের প্রতীক্ষা করো।

মৃত্যুর নাম অন্ধকার; কিন্তু মাতৃগর্ভ-তাও অন্ধকার, ভুলো না,
তাই কাল অবগুণ্ঠিত, যা হ’য়ে উঠছে তা-ই প্রচ্ছন্ন;
এসো, শান্ত হও; এই হিম রাত্রে, যখন বাইরে-ভিতরে কোথাও
আলো নেই,
তোমার শূন্যতার অজ্ঞাত গহ্বর থেকে নবজন্মের জন্য
প্রার্থনা করো, প্রতীক্ষা করো, প্রস্তুত হও।”

এই দু’টি প্রধান কবিতা ছাড়াও এই কবিতায় শীত এসেছে আরেকটি ভিন্ন অর্থে। তাকে বলতে পারি সম্পর্কের শৈত্য। এই শৈত্য থেকে শেষ পর্যন্ত জীবনের বিপন্নতা নয় বরং বিপর্যয় অতিক্রান্ত এক অনন্ত সত্যের দেখা মেলে। সেই দেখা শীত পেরিয়ে উত্তুরে বেদনার হিম পেরিয়ে, বসন্তের দিকে যাওয়া। প্রেমে একদিনের এক বিপর্যয় আর চলতে চলতে তাকে চিরদিনের করে পাওয়া বসন্তের উদযাপন।

এখানে মূলত তিনটি কবিতার কথা বলতে চাইছি। ‘আবার দেখা’ কবিতাটির কথাই ভাবি আপাতত। একটি ব্যর্থ প্রেমের কবিতা। একজন নারী জীবনের শুরুতেই কবিকে, কবির ভালোবাসাকে ব্যর্থ করে দিয়েছেন। অনেকদিন পর দু’জনের দেখা কোনও এক পার্টিতে। এখনও সে লাস্যময়ী, সমান কথকী এবং কবিকে করুণার ভিখারি ভেবে খুচরো আলিঙ্গনে জড়াতে চায়। কিন্তু কবি মনে মনে তা প্রত্যাখ্যান করেন। তার কারণ নারীটির প্রতি যে প্রেম তা একান্ত কবির। সেই ভালোবাসাই তাকে সুন্দর করেছিল, না হলে তার মূল্য নেই। সেই ভালোবাসার মৃত্যু হয়নি। তাই বাস্তবিক কোনও সম্পর্কের আর প্রয়োজন নেই। অন্তর্লীন সুরে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, জীবন আজ এক বিপুল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলেছে। এখানে সম্পর্কের শৈত্যের কথাই নিশ্চয় আছে, কিন্তু তা পেরিয়ে জীবন ভালোবাসার এক বাসন্তিক অসুখ পেয়েছে। নিবিড় বেদনাতেও পুলক লাগার সার্থকতা।

এবার বলব ‘খণ্ড দৃষ্টি’ কবিতাটির কথা। কবির ঘরে চাকর নেই। সে ছুটিতে দেশ গাঁয়ে গেছে। হয়তো মাঠে এখন ধান কাটার সময়। অথচ তাকে ছাড়া এক মুহূর্ত চলে না সংসারের। যে কোনও খুঁটিনাটি কাজে সে-ই একমাত্র ভরসা। টেবিলে তিনদিন আগের জল খাওয়া গ্লাসটা মেঘলা হয়ে পড়ে আছে। বিছানা অগোছালো। সবকিছু দেখে কবির মনে হয়– কোনও বিপদ তেমন বিপদ নয়, পুরনো চাকরের দেশে যাওয়ার মতো। এতদিন তার কাজটাই চোখে পড়েছে, আস্ত মানুষটাকে চোখে পড়েনি। আজ যখন সে অদৃশ্য, তখন তার সত্তাটি বড় হয়ে ওঠে। মনে হয়, মনিব চাকরের সম্পর্কের শৈত্য পেরিয়ে মানুষটিকে দেখা হয়নি। এতদিন পর মনে হয় সে নিতান্ত চাকর নয়, কারও স্বামী, কারও পিতা, কারও পুত্র। একটা গোটা সংসার যার জন্য অপেক্ষা করে থাকে। একটা গোটা সংসার যাকে খড়কুটোর মতো আঁকড়ে বেঁচে থাকে। সেই পরিবারে সে অপর বা অন্যান্য নয়। হয়তো চাকর কালীচরণ একদিন ফিরবে। সংসারের শান্তি জুড়োবে। কিন্তু বহুদূরের এক দৃষ্টি দিয়ে কবি দেখতে পান, ফেরার আগে স্বামীর জন্য ঘোমটার তলায় কাজল চোখের ছলছলানি। তীব্র এক বিরহের বসন্ত। সম্পর্কের শীত না পেরলে হয়তো কোনওদিন দেখা হত না।

‘ব্যক্ত’ কবিতাটি সম্পূর্ণ অন্য ধরনের। এই কবিতায় অনেকখানি আখ্যান জুড়ে গেছে। একজন লেখক এবং প্রকাশকের সম্পর্কের কথা বলছে এই গল্পটি। আর বলছে অন্তরালে অদৃশ্য আরেক সম্পর্কের কথা। গোলদিঘির ধারে গলির মোড়ে অবন্তীবাবুর বইয়ের দোকান। সময়-অসময়ে সাহিত্যিকদের আড্ডা জমে। সেখানে বাঙালি লেখকদের সঙ্গে তার দুই পুরুষের সম্পর্ক। আড্ডায় জড়ো হন প্রবীণ এবং নবীন লেখকের দল। প্রবীণদের জন্য নবীনদের মনে জন্মে করুণা (‘আমাদের যারা করুণা করবে তারা ঘরে-ঘরে বড় হচ্ছে’)।অবন্তীবাবুর ব্যবহারে পক্ষপাত নেই, অসাম্য নেই, বৈচিত্রও নেই। তিনি রসিক নন। কাউকে দেখলে খুশি হন না, দুঃখও পান না। এমনকী মানুষের মৃত্যু-সংবাদেও তাঁর কোনও ভাব পরিবর্তন হয় না। তিনি হাসেন না, রাগেন না, কথা কাটেন না, শুধু চুপ করে বসে থাকেন। আর ঘণ্টায় ঘণ্টায় লেখকদের জন্য চা, শিঙারা, সন্দেশ, সিগারেট, পান আসে। মাঝে মাঝে কেউ কানের কাছে গোপন কথা বললে তিনি দেরাজ খুলে টাকা বের করে দেন। হিসেব রাখেন না। কেন টাকা চাই, সত্যিই প্রয়োজন আছে কি না জানতেও চান না। বোঝাই যায়, ব্যবসায়িক বুদ্ধি তাঁর নেই। তাঁর বন্ধু নেই, আনন্দ নেই, উৎসাহ নেই। শুধু টেবিলে বসে থাকেন জড়ভরত। বাপের আমলে কারবার ভালো ছিল, এখন পড়তির দিকে। ব্যবসায় তেমন লাভ হয় বলে মনে হয় না। তবু কেন এমন খাতিরযত্ন? লেখকের অস্বাভাবিক লাগে। একদিন জৈষ্ঠের এক দুপুরবেলা লেখক গিয়েছিলেন অবন্তীবাবুর দোকানে। নেহাত গরম, তাই কিছুক্ষণ পাখার তলায় বসা। অমনি নজরে পড়ল চেয়ারের নিচে এক হাজার টাকার নোট পড়ে আছে অবহেলায়। অথচ অবন্তীবাবুর ভ্রুক্ষেপ নেই। টাকাটা নিয়ে রেখে দিলেন দেরাজে আর জানালেন এভাবেই অনেক টাকা নষ্ট হয়েছে। এর নেপথ্যে রয়েছে একটি কারণ। যখন তার স্ত্রী বেঁচে ছিলেন তখন টাকাপয়সা নিয়ে এখানে-সেখানে গুঁজে রাখতেন। এভাবে আনাচে-কানাচে কত যে টাকা জমিয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী! ব্যবসা করতে করতে একদিন এই টাকা ফুরল। তবু লেখক আপ্যায়নে ত্রুটি নেই। তার পূর্বপুরুষের ছিল পাঠ্যবইয়ের ব্যবসা কিন্তু তাঁর স্ত্রী চেয়েছিলেন অন্যরকম সৃজনশীল বই হোক যা পাঠককে আনন্দ দেবে। লেখককে সহায়তা করবে। তাঁর স্ত্রী রাশি রাশি বই পড়তেন আর লেখককে যত্ন করে নিজের বাড়িতে খাওয়াতেন। তারপর একদিন ভুল চিকিৎসায় তাঁর মৃত্যু। কিন্তু স্ত্রীর মর্যাদায় এখনও সেই কাজ করে চলেছেন অবন্তীবাবু, আর্থিক লোকসানের কথা না ভেবেই।লেখকের মনে হল, এতদিন বৃথাই রাশি রাশি বই পড়েছেন তিনি। মানবচরিত্রের নেপথ্য চেনা হয়নি তাঁর। এতদিন যে ব্যক্তি ছিলেন জড়ভরত, আজ তিনি যেন ব্যক্ত হলেন চরাচর জুড়ে হৃদয় বসন্তবনের খবর নিয়ে। যে মানুষটি নেই তার ভালোবাসার ভাষায় চায়ের স্বাদ সুন্দর হয়ে উঠল। লেখক-প্রকাশকের সম্পর্কের শৈত্য ছেড়ে আরেক সত্য দেখা দিল।একজন জড়ভরত মানুষের শীতের অন্তরে বসে বসন্তের উত্তর দিচ্ছেন আরেকজন অকালপ্রয়াত মানুষী।

এই কাব্যগ্রন্থের শীত দুঃসহ, রিক্ত, জীর্ণ পাতা ঝরাবার বেলা নিশ্চয়ই। আবার মনে হয় কবিজীবনের দিকে তাকালে মধ্যবয়সের এক অকাল বৈধব্য। আবার এই শীত জন্মান্তর। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে নতুন বীজের বসন্তের বার্তা। আর তাই দুঃসহ এই শীত শেষ কথা নয় বরং জীবনের চড়াই উৎরাই চলার পথ। এইসব কবিতায় প্রার্থনা আছে, প্রতীক্ষা আছে, অপেক্ষা আছে, প্রতিজ্ঞার জোর আছে। আর বসন্তের উত্তর সেই প্রতীক্ষার প্রস্তুতি থেকেই যেন নির্বাচিত, এক জীবনেই জন্ম জন্মান্তর। এই কাব্যগ্রন্থ যখন প্রকাশিত হচ্ছে, তার কিছুদিন আগে থেকেই বুদ্ধদেব বসু তৈরি হচ্ছিলেন তাঁর পরবর্তী কিংবদন্তি কাব্যগ্রন্থ ‘যে আঁধার আলোর অধিক’ (১৯৫৮)-এর জন্য। সেই কাব্যগ্রন্থে এক নতুন বুদ্ধদেবের জন্মান্তর। সেই কাব্যগ্রন্থ, আজকে যাঁদের পঞ্চাশের কবি বলি, তাঁদের অনেককেই জন্মান্তরিত করেছিল।