Robbar

নৌকা থেকে পড়ে গিয়ে জ্যোতিদা বলেছিলেন, আজ স্নানটা ভালো হল

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 30, 2025 4:04 pm
  • Updated:December 30, 2025 9:37 pm  
Jyotirmoy Dutta and journey of Manimekhala boat by Maya Siddhanta

গার্ডেনরিচ থেকে ম্যানোফার জেটিতে নৌকা নোঙর করে দেওয়া হল। ১৫ জানুয়ারি, ১৯৭৮ সালে সকাল ১০টায় যখন জোয়ার এল, সেই জোয়ারের জলে ভাসানো হল নৌকা। ম্যানোফার জেটি উপচে পড়ছিল আমাদের শুভেচ্ছা জানাতে। পিলপিল করছে লোক! মোতায়েন হয়েছিল পুলিশও। প্রত্যেকেরই একটা প্রশ্ন ছিল, একজন মেয়ে যাচ্ছে, সে কই? তখন আমি নৌকার খোলের ভেতরে বোরোলীন থেকে সূচ– সব গুছিয়ে সামলে রাখছি।

মায়া সিদ্ধান্ত

১৯৭৭ সাল। বামনগাছিতে কবি আজিজুর রহমানের বাড়িতে আমার নেমন্তন্ন। তাঁর মেয়ে, দোলার অন্নপ্রাশন। সে-বাড়িতে আগেও গিয়েছি, আজিজুরের ছোট ভাইবোনদের টিউশন পড়াতাম। থাকি আমডাঙায়। বাসে, অনেকটা পথ। সেই দিন, আমার সঙ্গে প্রথম আলাপ জ্যোতির্ময় দত্তর। পরে, ‘জ্যোতিদা’। বামনগাছির সেই বাড়িতে তিনি আত্মগোপন করে থাকতেন। দেশে তখন জরুরি অবস্থা। গ্রেফতারি পরোয়ানা বেরিয়েছিল তাঁর নামে। জ্যোতির্ময় দত্ত আমার নাম ‘মায়া সিদ্ধান্ত’ শুনে, আলাপ করার আগ্রহ প্রকাশ করছিলেন। আমার ‘সিদ্ধান্ত’ পদবিটি কীভাবে এসেছে– জানতে ভারি উৎসুক হয়ে পড়েছিলেন। বলেছিলেন, আবারও দেখা করতে।

মায়া সিদ্ধান্ত, যৌবনে

আত্মগোপন থাকা সত্ত্বেও সেদিন আমাকে পরিচয় দিতে দ্বিধা করেননি জ্যোতির্ময় দত্ত। আমি বলেছিলাম, আপনি কি সেই জ্যোতির্ময় দত্ত যিনি যুগান্তর-এ ‘কোমল ক্যাকটাস’ লেখেন? উনি খুব অবাক হয়েছিলেন, গ্রামের একটি মেয়েও তাঁর এই লেখা পড়ে! বলেছিলেন, ‘কলকাতা’ পত্রিকায় সম্পাদক হিসেবে তিনি জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে লিখেছিলেন তাই তাঁর গ্রেফতারি পরোয়ানা বেরিয়েছে। সেই সময় আমি বিএ পরীক্ষা দিয়েছি। হাতে খানিকটা ফাঁকা সময়, পাড়ার অবৈতনিক স্কুলে পড়াচ্ছি। মনে আছে, বিএ পরীক্ষার ফলাফল বেরয় যখন তখন জ্যোতির্ময় দত্ত ধরা পড়েন। ফলে ওঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বেশ কিছুটা সময়ের জন্য।

জেলের চার দেওয়াল জ্যোতির্ময় দত্তর সমুদ্র অভিযানের পরিকল্পনায় ব্যাঘাত ঘটায়নি। আর কোনও বাঙালি জেলে বসে সমুদ্রাভিযানের কথা ভাবতে পেরেছেন বলে জানা নেই! এমনকী, ১৩ হাত পালতোলা কাঠের ডিঙিনৌকা করে যে সমুদ্দুরে যাওয়া যেতে পারে, তা তিনি ছাড়া কে-ই বা ভাবতে পারতেন! অজানা বঙ্গোপসাগরকে কাছ থেকে জানতে-চিনতেই এই বিস্ময়কর উদ্যোগ। জরুরি অবস্থা দেশ থেকে উঠে যাওয়ার পর তিনি ছাড়া পেলেন। জেল থেকে ফিরে ‘যুগান্তর’, ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’য় আবার যোগদান করলেন। এই সময় থেকে জ্যোতিদার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ শুরু হল আমার। ‘কলকাতা’ পত্রিকা ফের প্রকাশ করবেন– এই ভাবনা নিয়ে কলেজ স্ট্রিট কফিহাউসের তিনতলায় ‘র‌্যাডিক্যাল হিউম্যানিস্ট’-এর ঘরে পত্রিকার কাজ শুরু করলেন। আমার ডাক পড়ল। আমি আমডাঙা থেকে কফি হাউসের তিনতলায় যাতায়াত করা শুরু করি। ফলে দেখাসাক্ষাৎ আরও নিয়মিত হতে থাকে। লেখা দেখা, লেখা সম্পাদনা, বানান সংশোধন, লেখকদের কাছ থেকে লেখা চাওয়া– পত্রিকা করার ‘অ’ থেকে ‘বিসর্গ’ আমার জ্যোতিদার থেকে শেখা। এখনও আমি ‘মালিনী’ পত্রিকার সম্পাদনা করি, যে পত্রিকার বয়স ৪৬ বছর। আমার পত্রিকার করার মাস্টারমশাই তো তিনিই। আমি শিক্ষক-পিতার মেয়ে, ভাবতাম স্কুলে চাকরি করব। কিন্তু শিক্ষকতার বদলে যে সাংবাদিকতাকে বেছে নিলাম, পত্রিকা করলাম, তা এই জীবনে জ্যোতির্ময় দত্ত নামের একজন মানুষের সঙ্গে দেখা হয়েছিল বলেই।

গল্ফ ক্লাব রোডের ভাড়াবাড়ির একতলায় গিয়ে দেখেছি, কী পরিমাণ বই থরে থরে রাখা। সেখানে বাংলা সাহিত্যের ক্লাসিক্স তো রয়েইছে, এছাড়া বহু বিদেশি ইংরেজি পাতলা চটি বই। আমি তার আগে এত বই কারও বাড়িতে দেখিনি। জ্যোতিদার কথাবার্তায় বিচিত্র রকম বইপড়ুয়ার তীক্ষ্মতা এসে মিশে গিয়েছিল। এই স্মার্ট মেধার সমান্তরালে ছিল সংবেদনশীল একটি মন। অত্যন্ত অতিথি পরায়ণ। বাড়িতে এলে, সে যখনই আসুক না কেন, তাঁরা খেয়ে যাবেন– এই ছিল জ্যোতিদার কড়া অতিথি পরায়ণতার নিয়ম।

১৯৭৭ সালের শেষে, ‘কলকাতা’ পত্রিকা যখন প্রকাশিত হচ্ছে, আমি নিয়মিত যাচ্ছি জ্যোতিদার কাছে, হাতে-কলমে কাজ শিখছি– এক মায়াবী অবিশ্বাস্য বিকেলে তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘ডিঙিনৌকা নিয়ে সমুদ্র অভিযানে যাব মায়া, তুমিও আমাদের সঙ্গে যাবে।’ আমি ‘বিস্মিত’ হয়েছিলাম বললেও কম বলা হবে। যদিও ততদিনে ‘মণিমেখলা’ তৈরির সমস্ত ব্যাপারই জানতাম। নৌকা চালানোর কোনও অভিজ্ঞতা নেই– জেটিতে গঙ্গা পার হওয়ার যেটুকু অভিজ্ঞতা! তার আগে সমুদ্রও দেখিনি। তখন অনেক নারীই সমুদ্র অভিযানে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন, কিন্তু জ্যোতিদা বেছে নিয়েছিলেন আমাকেই– বহু কঠিন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর। আমার সাহসের ওপর জ্যোতিদার একটা পূর্ব-ভরসা ছিল। কারণ বামনগাছিতে আত্মগোপনের সময় উনি আমাকে দূতীর কাজ দিয়েছিলেন। ছোট ছোট চিঠি দিয়ে আসত হত নানা জায়গায়। ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র গৌরকিশোর ঘোষের কাছে, কখনও আমেরিকান লাইব্রেরি, কখনও অন্য কোথাও। অনেক পরে, সকলেই জানিয়েছে, আমি নাকি দুঃসাহসিক কাণ্ড করেছিলাম! কারণ একবার ধরা পড়লে, গ্রেফতার হতাম। সে যাই হোক, সম্রাট অশোক যেমন সংঘমিত্রাকে নিয়ে শ্রীলঙ্কা গিয়েছিলেন, সেরকমই তিনিও যাবেন, এবং এই পথে একজন তরুণী সঙ্গে থাকবে– এমনটা ভেবেছিলেন জ্যোতিদা।

‘মণিমেখলা’

‘যুগান্তর’-এ যখন এই সমুদ্রাভিযানের পরিকল্পনা বলেছিলেন, তার অনুমোদন করেছিলেন তুষারকান্তি ঘোষ। পরে অর্থসাহায্যের জন্য শুনেছিলাম ‘দ্য হিন্দু’, ‘মালয়লা মনোরমা’-ও সহযোগিতা করেছিল। এই সমস্ত কাজের সঙ্গেই আমাকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন জ্যোতিদা। আমার যাত্রার অনুমতি পেতে কেন্দ্রের তরফ থেকে খুব সমস্যা হয়েছিল। কিন্তু তুষারকান্তি ঘোষ তখন বড় ব্যক্তিত্ব, তিনিই এই অনুমতি নিয়ে আসেন। আমার বাবা-মার কাছ থেকেও অনুমতি নেওয়া এরপর সহজ হয়ে যায়।

তুষারকান্তি ঘোষ

কাকদ্বীপের মানিক পাত্রের কাঠগোলায় তৈরি হয়েছিল কাঠের নৌকাটি। প্রথমে ভাসানো হল কালিন্দী খালের জলে। কালিন্দী জুড়ে রয়েছে সমুদ্রের সঙ্গে। লগি ঠেলে ঠেলে সমুদ্রে ফেলা হল নৌকাটিকে। এসবই ছিল নৌকার প্রথম পর্বের পরীক্ষা। সেই প্রথম হাল, দাঁড়, লগি উঠল আমার হাতে। জ্যোতিদা সে-সময় একটি অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করেছিলেন কাকদ্বীপের কাঠগোলার অঙ্গনে। মহাবোধি সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত অনেকেই গিয়েছিলেন। তাঁদের ‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি’ মন্ত্রোচ্চারণের স্মৃতি এখনও অটুট। সমস্ত সংবাদপত্র ও দূরদর্শন থেকেও মিডিয়া-কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।

প্রথম একমাস চলেছিল এই প্রশিক্ষণ। জ্যোতিদাকে দেখলাম, তিনি নৌকা চালানোর ব্যাপারেও অভিজ্ঞ! কখন, কোথায় যে তিনি নৌকা চালিয়েছিলেন কে জানে! কখনও আমাকে, কখনও আজিজকে জ্যোতিদা শিখিয়ে দিচ্ছিলেন, দাঁড় কীভাবে ধরতে হবে, টানতে হবে কীভাবে। একমাস প্রশিক্ষণের পর ২৭ ডিসেম্বর ওই নৌকা চালিয়ে আমরা এলাম কলকাতায়। কারণ জ্যোতিদার কাছে খবর এসেছে নৌকা নিয়ে যে যাওয়া হবে, তা অনুমোদন করবে গার্ডেনরিচের জাহাজ তৈরির কারখানা। ইতিমধ্যে এই নৌকা নিয়েই আমরা বঙ্গোপসাগরের নানা জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি। কখনও দেড়দিন-দু’দিনও লেগেছে ফিরতে। তা সত্ত্বেও জাহাজ কারখানায় সে নৌকা জমা পড়ল। কোনও ভুল-ত্রুটি যদি থাকে, তাহলে তা সারিয়ে দেওয়া হবে, সমুদ্রের আরও উপযোগী করে তোলা হবে– জানানো হল কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে। আমরা যে-যার মতো বাসে করে সেদিন বাড়ি ফিরে গিয়েছিলাম। গার্ডেনরিচ থেকে আমাদের নৌকায় একটা ছোট্ট স্লাইডিং দরজা আর কেবিন করে দেওয়া হয়েছিল। সবথেকে জরুরি যা, সেক্সট্যান্ট কাঠ নৌকার মাঝখানটা চিরে বসিয়ে দিয়েছিল, যাতে টন টন জল কাটতে পারবে আমাদের নৌকা। নৌকার ভেতরে যাতে কখনওই জল না থাকে, সে ব্যবস্থাও করে দিয়েছিল তারা।

গার্ডেনরিচ থেকে ম্যানোফার জেটিতে নৌকা নোঙর করে দেওয়া হল। ১৫ জানুয়ারি, ১৯৭৮ সালে সকাল ১০টায় যখন জোয়ার এল, সেই জোয়ারের জলে ভাসানো হল নৌকা। ম্যানোফার জেটি উপচে পড়ছিল আমাদের শুভেচ্ছা জানাতে। পিলপিল করছে লোক! মোতায়েন হয়েছিল পুলিশও। প্রত্যেকেরই একটা প্রশ্ন ছিল, একজন মেয়ে যাচ্ছে, সে কই? তখন আমি নৌকার খোলের ভেতরে বোরোলীন থেকে সূচ– সব গুছিয়ে সামলে রাখছি। জ্যোতিদা বলেছিলেন, কোনও সময় পাল ছিঁড়ে গেলে, তা যেন সেলাই করে সামাল দেওয়া যায়। পরবর্তীকালে তা সত্যিই কাজে লেগেছিল।

যাত্রা শুরুর প্রথম দিকে, গঙ্গাসাগরের যাত্রী-নৌকার ভিড় কাটিয়ে আমরা গিয়েছিলাম দীঘার দিকে। তারপর সমুদ্র এল। আমাদের নামতে হল পারাদ্বীপ পোর্টে। সেখানে খবরের কাগজের লোকেরা অপেক্ষা করছিল। মূলত মালয়লা মনোরোমা-র সাংবাদিকরা। জ্যোতিদা বলেছিলেন, ‘দেখো মায়া, ওরা তোমাকেই প্রশ্ন করছে, তুমি উত্তর দিও, আমি তোমার দোভাষীর কাজ করে দেব।’ জ্যোতিদার পরিচিতির যে ব্যাপ্তি– তা দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম ওই পারাদ্বীপ পোর্টে। কত লোক যে ‘হাই জ্যোতির্ময়’, ‘হাই মিস্টার দত্ত’ বলে এগিয়ে এসেছিলেন! বেশিরভাগই কাগজে বেরনো তাঁর তুখড় কলামের মগ্ন পাঠক।

এই যাত্রায় আমাদের সঙ্গে ছিল টিন-ফুড। ৫ লিটারের প্রচুর জারিকেন কেনা হয়েছিল। সেখানে নেওয়া হয়েছিল খাবার জল। নৌকার দু’পাশে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল জারিকেনগুলো। আমার মা বলে দিয়েছিলেন, ‘একটু চাল-ডাল সঙ্গে রাখিস। সম্ভব হলে, একটা জনতা স্টোভ।’ সে ব্যবস্থাও করেছিলাম। সমুদ্র যখন স্থির হয়ে থাকত, হাওয়া নেই, ঢেউ নেই– তখন নৌকার খোলের মধ্যে জনতা স্টোভে চাল-ডাল ফুটিয়ে পিকনিক করতাম। একসময় আমাদের টিনফুড, চাল-ডাল সবই ফুরিয়ে গিয়েছিল। অল্প খাবার থাকলে বলছিলেন, ‌‘মায়া, এটা তুমি খাও।’ খুব ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছিলাম তিনি আমার এই সমুদ্রযাত্রার পিতা। আমাকে আগলে রাখছিলেন প্রতি মুহূর্তে।

বড় বড় সাইক্লোনে কখনওসখনও নৌকা ভেসে চলে যেত নানা দিকে। সঙ্গে কম্পাস থাকলেও আমরা তা ব্যবহার করতে পারতাম না। মনে আছে, একবার পাহাড়সমান এক ঢেউ সামনে, আমাদের নৌকা মুহূর্তে তার মাথায় উঠে পড়বে, আমরা জানি না, যখন নামব, তখন আর ভেসে উঠব কি না। এমন সময় জ্যোতিদা বলেছিলেন, ‘মায়া গান ধরো, গান ধরো, খরবায়ু বয় বেগে…’। নৌকা যখন ভেসে উঠত আবার, হাল ধরে বসে থাকা জ্যোতিদা আমার আর আজিজের মুখখানা ভালো করে দেখে নিতেন। যদি পরের বার আমাদের কারও সঙ্গে দেখা না হয়।

নৌকায় যেতে যেতে দেখতাম হাঙর, কচ্ছপ, কচ্ছপের পিঠে সিন্ধুসারস। দাঁড় টানতে গিয়ে বহুবার লাল সাপ জড়িয়ে যেত। জ্যোতিদা বলতেন, ‘মায়া, দাঁড়টাকে জলের মধ্যে ঝপাং ঝপাং করে বাড়ি মারো, সাপটা চলে যাবে।’ একবার টিনফুড খেয়ে জলের মধ্যে ফেলেছি, জ্যোতিদা ধমক দিলেন খুব: ‘করছ কী ইডিয়েট! হাঙরগুলো মাংসের স্বাদ পাবে! তোমাকে তো গিলে খাবে!’

চিল্কার কাছে ডাকাতদল বল্লম-বর্শা ইত্যাদি নিয়ে আক্রমণ করতে এসেছিল আমাদের। একজন জেনানা নৌকায় আছে বলে তারা বর্শার ফলা আমাদের বুকে বসায়নি। জ্যোতিদার মধুর সম্ভাষণ আর আত্মীয়সুলভ ব্যবহারে তারা আমাদের রীতিমতো আপ্যায়ন করে। শেষমেশ আমরা তাদের একদিনের অতিথি হয়েছিলাম!

আর একবার নৌকা থেকে পড়ে গেলেন জ্যোতিদা। আমাদের শ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। ভরা সমুদ্র! কী করে উঠবেন জ্যোতিদা! আমরাই বা কী করব! কিন্তু দেখলাম, অনায়াসে তিনি দিব্যি নৌকার কাঠ ধরে উঠে পড়লেন। উঠে মুচকি হাসলেন। বললেন, ‘আজকে আমার স্নানটা ভালো হল।’

বছর দশ-বারো আগে, জ্যোতিদা আরেকবার জানালেন, ‘মায়া, আমরা আবার সমুদ্র অভিযানে বেরব। তুমি যাবে তো?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি নিশ্চয়ই যাব।’ ‘অন্য কাউকে আর জোগাড় করব না, আজিজ কে ডেকে নেব।’ জ্যোতিদার বাড়িতে মিট করে, আমরা তিনজন চললাম গাড়ি করে নিশ্চিন্দপুরে। নিশ্চিন্দপুর– যেখানে বেস ক্যাম্প হয়েছিল। সেখানেই নৌকা রেখে আমরা জোয়ার-ভাটার অপেক্ষা করে নৌকা চালানো শিখতাম। মজার কথা, সেখানে জ্যোতিদার একটা ছোট্ট মাটির বাড়ি ছিল। সেখানে যাওয়ার উদ্দেশ্য, আবার লোক জোগাড়, নৌকা তৈরি, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র তৈরি করা। এইবার যদিও জ্যোতিদার মাটির বাড়ির খোঁজ মিলল না। গ্রামের কেউ কেউ এগিয়ে এলেন, চিনতে পারলেন আমাদের। জ্যোতিদা তাঁদের বললেন, ‘তোমরা নৌকা-টৌকার ব্যবস্থা করো, আমরা টাকাপয়সার জোগাড় করছি। এই দেখো, সেই মায়াদিদি, মনে পড়ছে?’

মিমিদি (মীনাক্ষী দত্ত) বললেন, ‘স্বামী-সন্তান-সংসার ছেড়ে সমুদ্রাভিযানে তুমি যাবে?’ বললাম, ‘হ্যাঁ। যাব তো।’ বললেন, ‘বেশ’। স্বামীকে জানাতে তিনিও বললেন, ‘সে তো যাবেই, কথা যখন হয়েছে জ্যোতিদার সঙ্গে!’ এসব ঘটছে যখন জ্যোতিদার তখন বয়স ৭৬ পেরিয়েছে! জ্যোতিদা ছিলেন এমনই বিস্ময়কর! শুধু সাংবাদিক নন, বলা উচিত ‘আন্তর্জাতিক সাংবাদিক’। তাঁর থেকেও বড় আপাদমস্তক স্বপ্নময় ভদ্রলোক। এ যাত্রায় আমাদের সমুদ্রে পাড়ি দেওয়া শেষমেশ হয়নি, তা তো আপনারা জানেনই।

২৮ ডিসেম্বরের সকালে, জ্যোতিদা এবার সমুদ্রে পাড়ি দিলেন একাই। ঢেউয়ের মাথায় উঠে, একলা নৌকায় তিনি হয়তো আবারও গাইছেন কোনও রবীন্দ্রসংগীত। আমরা, দূরত্ববশত, সে গান শুনতে পাচ্ছি না।