ফেসবুক, মিডিয়া তোলপাড় করা সিলকিয়ারার এই ঘটনাটির কেন্দ্রে থাকা চারধাম প্রকল্পের উদ্দেশ্য কেদারনাথ, যমুনোত্রী, গঙ্গোত্রী এবং বদ্রীনাথকে জুড়ে দেওয়া। অবশ্যই মানুষকে মানুষের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া নয়, মানুষকে প্রকৃতির সঙ্গেও মিলিয়ে দেওয়া নয়, বরং এক্ষেত্রে সামাজিক বিচ্ছিন্নতার তেজ বাড়িয়ে মানুষের ধার্মিক সেন্টিমেন্টকে আরও বেশি আঁটসাঁট করতেই সরকার ও সেনাবাহিনীর এই জরুরি আয়োজন। প্রচার, প্ররোচনায় খরচ হবে মাত্র ১২ হাজার কোটি টাকা। অতএব ম্যামথ স্কেলের এই জাতীয় প্রোজেক্টকে সাফল্যমণ্ডিত করতে দরকারি ৮২৬ কিমি সড়ক নির্মাণে সুপ্রিম কোর্ট, ভূতাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞদের মতামত বাউন্ডুলে চালে খারিজ করে, হিমালয়কে সরকারি সম্পত্তি বানিয়ে ইচ্ছেমতো কাটাছেঁড়া করাই যায়।
অবশেষে ১৭ দিন পর উত্তরকাশীর সিলকিয়ারা সুড়ঙ্গে আটকে থাকা ৪১ জন শ্রমিককে উদ্ধার করা হল। আমেরিকান যন্ত্র অগার বিকল হয়ে যাওয়ার পর বিভিন্ন খনি থেকে কাঁচামাল উত্তোলনের জন্য ‘ইঁদুরের গর্ত’ বা ‘র্যাটহোল মাইনিং’ পদ্ধতি ব্যবহার করে শ্রমিকদের বের করে আনার এই উদ্ধার কাজটির অফিশিয়াল নাম ছিল ‘অপারেশন জিন্দেগি’। কারণ, যুক্ত ছিলেন জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী (এনডিআরএফ)-র জওয়ানরা। তবে অপারেশন ‘অলআউট’-এর মতো এটি কাশ্মীরের সন্ত্রাসবাদকে ঢাল বানিয়ে প্রতিবাদী মানুষের জীবন খতম করার লক্ষ্যে নয়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে একদল বিপন্ন শ্রমিকের জীবন বাঁচালেন আরেকদল বিপন্ন শ্রমিক। ইতিমধ্যেই আপাদমস্তক শোষিত এই শ্রমিকদের গলায় মালা পরিয়ে আবারও শোষণ করা হবে আগামীর পুঁজিনিষ্ঠ মহার্ঘ্য ধার্মিক পণ্যগুলিকে সুরক্ষিত রাখার একমাত্রিক লক্ষ্যে। পরিহাস এখানেই।
সামগ্রিকতার মূর্ত বিশ্লেষণে, এখানে মানুষ জিতল নাকি প্রযুক্তি, শ্রমিক জিতল নাকি ধার্মিক, ভারত জিতল নাকি অস্ট্রেলিয়া– সে প্রশ্ন আপাতত মুলতবি রেখে স্পষ্ট করেই বলা যায়, ‘অপারেশন জিন্দেগি’ নামটায় কিন্ত রয়ে গেল রাষ্ট্রের প্রগাঢ় ছাপ।
শ্রমিক তুমি কে? সনাতন ভারত মাতার সন্তান নাকি জন হেনরির উত্তরসূরি
ভারত হোক বা ইন্ডিয়া– রং, রাজনীতি, দর্শনের বৈচিত্র অধ্যুষিত এই দেশে, ঘটনাটিকে ঘিরে মানুষের মন্তব্যে কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গির ঐক্য দেখা গেল না। সামাজিক মাধ্যমে এই বিভেদ ধরা পড়ল স্পষ্ট। বাঁদিকের শিবির বলল,
‘আমি মেশিনের হব প্রতিদ্বন্দ্বী
জন হেনরি বলে বুক ঠুকে
স্টিম-ড্রিলের সাথে চলে হাতুড়ির পাল্লা
কে আর বল তাকে রোখে।’– এই র্যাটহোল মাইনার্সরাই আজকের জন হেনরি।
ঠিক তখনই ডানের শিবির থেকে আওয়াজ এল, সুড়ঙ্গের মুখে উদ্ধার কাজে সাফল্যের জন্য কয়েকদিন আগে একটি ছোট মন্দির তৈরি হয়েছে। দেখা গিয়েছে বিদেশি উদ্ধারকারী বিশেষজ্ঞরাও সেই মন্দিরে ফুল দিচ্ছেন, প্রণাম করছেন।
এই সকল মানুষের মতে, বিগ্রহের অশেষ কৃপাতেই উদ্ধারকার্য অবশেষে সফল হল।
এই মন্তব্যের উত্তরে বাম শিবির বলে উঠল, আজ ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস্-এর জন্মদিন। তাঁর লেখা বইয়ের নাম যদি, The Condition of the Working Class in England হয়, সুড়ঙ্গে আটকে থাকা সেই শ্রমিক ও তাঁদের উদ্ধার করে আনা শ্রমিকের যৌথ সংহতিই হল ‘The Condition of the Working Class in India’. ইংল্যান্ড ও ভারত; ১৮৪৫ ও ২০২৩, যাই হোক না, শ্রমিকের কোনও সীমান্ত নেই। ‘দুনিয়ায় মজদুর এক হও।’
সেই মুহূর্তেই মুক্তি পাওয়া শ্রমিককে দেশের গণ্ডিতে, সীমান্ত-নজরদারির ভিতর আটকে দিতে ডান শিবির থেকে প্রবল উচ্ছ্বাস ভেসে এল, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি নয়, র্যাটহোল মাইনিং-এর মতো সনাতন দেশীয় পদ্ধতিই শেষ পর্যন্ত শ্রমিকদের উদ্ধার করল। উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিংহ ধামী এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা প্রাক্তন সেনাপ্রধান জেনারেল ভিকে সিংহ কোনওরকমে বেঁচে ফিরে আসা শ্রমিকদের আরাধনা করে যখন অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন, চারদিকে সেই সময় প্রবল উল্লাস– হর হর মহাদেব, ভারত মাতা কি জয়।
এখানেই শেষ নয়। আজকের ভারতে এমন মানুষও কিন্তু সমাজের একটা বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছেন, যাঁদের ঠিক কোনও শিবিরেই ফেলা যায় না। শ্রম, প্রযুক্তি, প্রকৃতি, ঈশ্বর, জাতীয়তাবাদ, আন্তর্জাতিকতার মধ্যের সহজ, স্বাভাবিক এবং নির্মাণ করা সম্পর্কের কুলকিনারা করতে না পেরে তাঁরা বলছেন, শেষ পর্যন্ত আমেরিকান মেশিনের পরাজয় মেনে দেশীয় শ্রমিকরা উদ্ধার করলেন শ্রমিকদের। ৪০০ ঘণ্টা পরে ইঁদুরের মতো গর্ত খুঁড়ে ৪১ জন শ্রমিককে উদ্ধার করা হল। করলেন জন হেনরির উত্তরসূরিরা।
মানুষ যখন বড় অসহায়, মানুষ যখন কাঁদছে, তখন পাখির মতো মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে মানুষকে উদ্ধার করার মতো মহৎ আর কিছুই হয় না। কিন্তু চন্দ্রযান, কোয়ান্টাম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে মানুষ হয়েও ইঁদুরের মতো গর্তের ভিতর দিয়ে আদানি-আম্বানির জন্য কয়লা তুলে আনার শ্রমে কোনও রকম মহত্ব থাকতে পারে না, তা সে যতই জোরজবরদস্তি আরোপ করা হোক না কেন কদর্য অ্যাজেন্ডায়। পুঁজিবাদী সামাজিক সম্পর্কে আজকের জন হেনরির উত্তরসূরিরা এতদিন মুখ বুজে এই কাজই করেছেন, আগামীতেও বুকে পাথর রেখে এই কাজই করবেন। পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৭ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে মেঘালয়ে ১০০০০ থেকে ১৫০০০ ইঁদুর-গর্ত খনি-শ্রমিক মারা গিয়েছেন।
নতুন করে বলার নেই যে শ্রমিকের নিবিড় শ্রমেই তৈরি হয় পৃথিবীর সম্পদ। শ্রমের মাধ্যমে প্রকৃতিকে পরিবর্তন করেই তৈরি হয়েছে উদ্ধারকারী প্রত্যেকটি মানুষের সেফটি জ্যাকেট, হেলমেট, গগলস, গ্লোভস, ড্রিল মেশিন এবং গ্যাস কাটারের মতো সেই সমস্ত যন্ত্রপাতি, যা কাজে লাগিয়ে এই উদ্ধারকাজ সম্ভব হয়েছে। অতএব শ্রমকে কেন্দ্রে রেখে মানুষ ও প্রকৃতির যোগাযোগই উদ্ধার কাজকে বাস্তবায়িত করেছে। এর সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই জুড়ে যায় বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৃতির অমোঘ নিয়মগুলি। অপরিহার্য এবং অলঙ্ঘনীয় এই বিশ্বজনীন সম্পর্কে তাই কোনও যুক্তিতে জায়গা পায় না কেদার-বদ্রীর মন্দিরগুলিতে লালন করা ঐশ্বরিক কর্মকাণ্ড, তীর্থক্ষেত্রে সমবেত কোটি কোটি মানুষের আধ্যাত্মিক প্রার্থনা ও দেশপ্রেমের সনাতনী ককটেল। যা কিছু করল তা শ্রমিকের হাত। প্রবীণ যাদব, রাজপুত রাই, ফিরোজ কুরেশি, নাসির হাসানরা নিখাদ মানুষের পরিচয়ে জীবন বাঁচালেন সুবোধ কুমার, টঙ্কু সর্দার,মহাদেব ভুক্তু মুর্মু, বীরেন্দ্র কিস্কু, জয়দেব প্রামাণিকদের। এখানে ঈশ্বরের কোনও হাত নেই।
সেকথা জেনেই আইটি-সেল কিন্তু নিরন্তর সক্রিয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় তৈরি নীচের ছবিটিকে ভালো করে লক্ষ করলে বোঝা যায়, শ্রম, শ্রমিক, প্রকৃতি, বিজ্ঞান, নিবিড় মানবিক সহযোগিতাকে ছাপিয়ে উগ্র জাতীয়তাবাদকে গেঁথে দেওয়ার অনুশীলন চলছে দেশপ্রেমে অতিরঞ্জিত একটি পতাকাকে সবকিছুর সামনে রেখে। ভুললে চলবে না, অফলাইন হোক বা অনলাইন, এই পতাকাটিকেও গড়ে তুলেছে শ্রমিকের কায়িক বা ডিজিটাল শ্রম। তবে ব্যাকগ্রাউন্ডে ‘ভারত মাতা কি জয়’-এর উদ্ধত স্লোগানে এই ডিপফেক ছবির ‘নিষ্প্রাণ পতাকাই যেন হয়ে উঠছে সবচেয়ে বেশি জীবন্ত।
সুড়ঙ্গে আটকে পড়া শ্রমিকরা নাকি ঈশ্বরের নামে প্রার্থনা করেছেন আটকে থাকার সময়। এমনকী, মুক্তির পরেও বেশিরভাগই মনে মনে ভগবানকে এবং প্রকাশ্যে মিডিয়াতে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তাঁদের সামনে কমলা রঙের মাইক্রোফোন এগিয়ে দেওয়া হলে একটি সংবাদমাধ্যমকে তাঁরা জানান, প্রাতঃভ্রমণ এবং যোগচর্চাকে কাজে লাগিয়েই দম বন্ধ করা পরিবেশে মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে পেরেছেন। একে অপরের পিঠ চাপড়ানোর দ্বিতীয় ভাগটি সম্পূর্ণ করতে নরেন্দ্র মোদি বলে ওঠেন, ‘ভগবানের আশীর্বাদ, তোমরা এখন সকলেই নিরাপদ’। অতএব যন্ত্রে হোক বা মন্ত্রে, হাতে হোক বা হাতিয়ারে, উদ্ধারের উপসংহার যেভাবেই ঘটুক না কেন, ক্রেডিট শুষে নিতেন কিন্তু একজনই।
মার্কস বলেছিলেন, ‘ধর্ম হচ্ছে নিপীড়িত মানুষের দীর্ঘশ্বাস, হৃদয়হীন পৃথিবীতে হৃদয়, বিবেকহীন পরিস্থিতিতে বিবেক… আবার একই সঙ্গে ধর্ম হচ্ছে মানুষের প্রকৃত দুঃখ-জ্বালার অভিব্যক্তি এবং প্রকৃত দুঃখ–জ্বালার বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিবাদ।’
বেঁচে থাকার তাগিদে টানেলের বিষাক্ত অন্ধকারে, ইঁদুর গর্তে যে সকল মানুষ বাধ্যতামূলক শ্রমেই জীবনের সিংহভাগ সময় কাটিয়ে দেন, যাপনের নিপীড়নে তাঁরা আটকে পড়ে আছেন বহুকাল আগে থেকেই। তাঁরা অভিজ্ঞতায়, নির্মম সব লেনদেনে বুঝে গিয়েছেন, মুক্তি নেই, কারণ, টানেলের বাইরের অন্ধকার আরও অনেক বেশি কালো। বাইরের পৃথিবী তাঁদের জন্য হৃদয়হীন। তাঁদের জ্বালার অভিব্যক্তি হৃদয়ের গভীরে অনুভব করার মানুষগুলোকে নিকেশ করা হচ্ছে একে একে। মানুষকে কিছু না কিছু অবলম্বন আঁকড়ে ধরে বাঁচতে হয় বলেই তাঁরা শ্বাস, প্রশ্বাস, দীর্ঘশ্বাসে মিশিয়ে নিয়েছেন ধর্মের ঘোর। IISC, ISRO-র বিজ্ঞানী থেকে IIT, IIM-এর হোয়াইট কলার টেকনোক্র্যাটরা ঈশ্বরে নতজানু হলে, মাকু-সেকু-চাড্ডি ছয়লাপ আরবান কালচার থেকে বহুক্রোশ দূরে শিক্ষা, স্বাস্থ্যের নূন্যতম পরিষেবা থেকে আজীবন বঞ্চিত এই মানুষেরা প্রায় মরতে মরতে আচমকা বেঁচে গিয়ে, ঈশ্বর এবং প্রধানমন্ত্রীর নাম জপ করবেন না, এমন কি হয়? এবং তারপর, আগামীর সম্ভাব্য মৃত্যুগুলি থেকে নিজেদের এবং সন্তানদের নিরাপদ দূরত্বেও রাখতে হবে তো।
রাষ্ট্র-ধর্ম-কর্পোরেট নেক্সাসে হিমালয়ের বাস্তুতন্ত্র
ফেসবুক, মিডিয়া তোলপাড় করা সিলকিয়ারার এই ঘটনাটির কেন্দ্রে থাকা চারধাম প্রকল্পের উদ্দেশ্য কেদারনাথ, যমুনোত্রী, গঙ্গোত্রী এবং বদ্রীনাথকে জুড়ে দেওয়া। অবশ্যই মানুষকে মানুষের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া নয়, মানুষকে প্রকৃতির সঙ্গেও মিলিয়ে দেওয়া নয়, বরং এক্ষেত্রে সামাজিক বিচ্ছিন্নতার তেজ বাড়িয়ে মানুষের ধার্মিক সেন্টিমেন্টকে আরও বেশি আঁটসাঁট করতেই সরকার ও সেনাবাহিনীর এই জরুরি আয়োজন। প্রচার, প্ররোচনায় খরচ হবে মাত্র ১২ হাজার কোটি টাকা। অতএব ম্যামথ স্কেলের এই জাতীয় প্রোজেক্টকে সাফল্যমণ্ডিত করতে দরকারি ৮২৬ কিমি সড়ক নির্মাণে সুপ্রিম কোর্ট, ভূতাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞদের মতামত বাউন্ডুলে চালে খারিজ করে, হিমালয়কে সরকারি সম্পত্তি বানিয়ে ইচ্ছেমতো কাটাছেঁড়া করাই যায়।
পণ্য-ফেটিশ সংস্কৃতিতে অনেকেই এখনও বোঝেন না যে পরিবেশগতভাবে হিমালয় একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল অঞ্চল, বিগ বাস্কেটে পয়সার বিনিময় সহজলভ্য ‘ফেসওয়াশ’ বা ‘বেবি ক্রিম’ নয়। টেকটনিক অ্যাক্টিভিটি এখনও গভীরে অব্যাহত থাকায় হিমালয় ভীষণই ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। হিমালয়ের বাস্তুতন্ত্র বিঘ্নিত হওয়া মানে তার সরাসরি প্রভাব পড়বে শৈত্যপ্রবাহ প্রতিরোধ, মৌসুমী বায়ুর স্বাভাবিক চলাচলে।
ইকবাল লিখেছিলেন, ‘The tallest of the mountains, neighbour of the sky, you are our guard our savior.’
হাইড্রো-ইলেকট্রিক প্রোজেক্ট নদীর স্বাভাবিক গতিমুখকে বদলে দেয়। বনাঞ্চল ধ্বংস করে ভারী বিস্ফোরণে বারুদের স্তর জমা হয় অবশিষ্ট জল, মাটি, ঘাসে। স্থানীয় বাসিন্দা, গবাদি পশুর জঠর বিষিয়ে ওঠে। বাড়িগুলিতে অকাল-ফাটল দেখা দেয়। যোশীমঠকে এভাবেই বিপর্যস্ত করে দেওয়া হয়েছে ভোটব্যাঙ্ক এবং পুঁজিপতিদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে।
পরিকল্পিত ধার্মিক উন্মাদনায় ঠাসা হাজার হাজার কোটি টাকার এই সমস্ত প্রকল্পের অন্তর্গত সীমাহীন বর্বরতাকে আজকাল প্রশ্ন করা মানেই দেশদ্রোহ। আমরা জেনেছি, জলবায়ু বিপর্যয়ের তীব্রতা আমাদের আশপাশের অঞ্চলগুলিতে প্রত্যেক দিন ক্রমবর্ধমান। তাই যদি হয়, এই আকালের দিনে এমন অমানবীয়, সর্বনাশা প্রকল্পের তোড়জোড় করার যুক্তি কী হতে পারে? বিশিষ্ট ভূতাত্ত্বিক ডক্টর সি পি রাজেন্দ্রন উত্তরে বলেছেন, ‘The present government is not interested in listening to science and wants to go ahead with grandiose construction projects as a symbol of the glory and triumph of the nation as part of its nationalist agenda.’
বস্তুত, নিসর্গের কোনও সীমান্ত হয় না। তা সকল প্রাণের জন্য অতিশয় উন্মুক্ত। যশোর রোড হোক বা যোশীমঠ, মেরু থেকে মরুভূমি, গ্রহের এই শ্রেষ্ঠ সম্পদকে রক্ষা করার দায়িত্ব অনন্য প্রজাতি হিসেবে সবচেয়ে বুদ্ধিমান মানুষেরই।
গল্পটির কথা অনেকেই জানেন, জলভরা পাত্রটিতে রয়েছে একটি প্রাঞ্জল ব্যাং। পাত্রর নীচে আগুন জ্বলছে ধিকি ধিকি। আস্তে আস্তে গরম হওয়া সেই জলের সঙ্গে ব্যাংটিও নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছে। এভাবে ক্রমশ তাপমাত্রা বাড়তে বাড়তে, মানিয়ে নিতে নিতে এক সময় সিদ্ধ হয়ে মারা যাচ্ছে ব্যাংটি। প্রতীকী এই ভাবনাটিকে বলা হয় ‘বয়লিং ফ্রগ সিনড্রোম’।
মার্কস বলেছিলেন, ‘প্রকৃতি মানুষের অজৈব শরীর’। একই সুরে রবীন্দ্রনাথের কথা, ‘বিদ্যুৎ-জল-অগ্নি-বাতাস দিনে দিনে আমাদেরই কর্ম-শরীর হয়ে উঠিতেছে’ বা ‘আমার জৈব প্রকাশের আধার হচ্ছে বিশ্বপ্রকৃতি’। গ্রিন করিডোর, গ্রিন এনার্জি, সাস্টেনেবল ডেভেলপমেন্ট জাতীয় শ্রুতিমধুর সোনার পাথরবাটির অভিঘাতে তছনছ করা হচ্ছে হিমালয়, হিমালয় আশপাশের বাস্তুতন্ত্র, গোটা পৃথিবীটাকেই। বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্যে বিশৃঙ্খলা নেমে আসা মানে আমাদের সকলের অজৈব শরীর বিপর্যস্ত। বিপন্ন আমাদেরই জৈব প্রকাশ। চারধামের মতো স্বপ্ন-প্রকল্পে বিপুল পরিমাণে মজুত হিন্দুত্ববাদী ধর্মের আফিমে মজে গিয়ে আমরা ক্রমেই হয়ে উঠছি ‘গলিত স্থবির ব্যাং’ আর তেতে ওঠা সেই জলপাত্রটির হুবহু চেহারা নিচ্ছে আমাদের এতদিনের আবাসভূমি, আমাদের একটি মাত্র পৃথিবী।
বেরিয়ে আসার পথ একটাই। জরুরি তৎপরতায় হারিয়ে যাওয়া মানুষ ও প্রকৃতির বিপাকীয় সম্পর্কের পুনরুদ্ধার। রন্ধ্রে বুঝে নেওয়া এই কাজে বাধা দেওয়া প্রত্যেকটি মানুষই মানবতার নিকৃষ্টতম শত্রু।
নিবিড়ে অনুভব করা এই মুহূর্তে বাঞ্ছনীয়, প্রকৃত সমাজ সেইটাই, যেখানে অন্তর নতজানু হবে মন্দির অভিমুখে নয়, সবুজ সঞ্জীবনী অরণ্যে সকল প্রাণের সান্নিধ্যে। মহিমায় অন্বিত হয় মূর্ত মানুষ, বিমূর্ত বিগ্রহ নয়। যাবতীয় স্পিরিচুয়ালিটি আপনা থেকেই অভাবনীয় সৃষ্টিকাজে রূপান্তরিত হয়ে যায় গঙ্গা-যমুনা-ভলগা-মিসিসিপির সহজ স্বাভাবিক স্রোতের খুব কাছাকাছি এসে।