বিদ্যুৎ দূরে বসেই ফোনে আয়োজন করল সব। দু’জন পুরনো ছেলেকে ফেরানো আর রানিগঞ্জের একটা টিম, পাঁচজন জনের। রাতের দিকে ঢুকে কাজ সেরেই আবার বেরিয়ে যাবে। বিদ্যুৎ আইনের হাতের বাইরে থাকবে। আর এলাকার লোক তার অলিখিত পদধ্বনি শুতে পাবে। বাঁশরীর মৃত্যুর বদলা মাধাই। তুলনায় সফট টার্গেট। ঢালপালায় হয়তো মাওবাদীদের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু ও বন্দুক, পিস্তল রাখে বলে এখনও খবর নেই।
১৬.
বাঁশরীলালের চিরকেলে জমিদারি হালচাল। বিশেষ করে হাতে টাকা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চালবাজিটাও বেড়েছে। সামনে থেকে যা ব্যবসা চোখে দেখা যায়, তার আড়ালেও নাকি নানা কীর্তি আছে। যখন যাঁরা ক্ষমতায় থাকে, সেই দলের লোকেরা তাঁর কথায় ওঠবোস করে। আবার উল্টোদিকেও বিরাট প্রভাব। টাকার গুণ। লোকটার আজব শখ। নিজে সরাসরি রাজনীতি করবেন না, কিন্তু নেতা আর প্রশাসনের লোকজনের ওপর ছড়ি ঘোরাবেন। নিজে লেঠেলবাহিনী পোষেন সেই কবে থেকে। দেবতা ইমেজ গড়ার কোনও ইচ্ছা নেই। তাঁকে সবাই ভয় পাবে, এতেই তৃপ্তি। বহুকাল আগে এক মারামারির মধ্যে পড়ে তাঁর মাথা ফেটেছিল। ব্যান্ডেজ পড়েছিল। কিন্তু সেই অবস্থায় কেউ তাঁকে দেখেনি। বাইরে চলে যান। ফেরেন যখন, মাথা ঠিকঠাক। সাতদিনের মধ্যে দুটো লাশ ফেলে দিয়েছিলেন। নিজেই বলতেন, ‘আমাকে ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায় কেউ দেখতে পাবে না। ভয় চলে যাবে। সবাই জানে বাঁশরী মারে। বাঁশরীকে যে মারা যায়, এসব দেখানো যাবে না।’ জঙ্গলমহলের এই দিকটায় বাঁশরীরাজ চলে আসছে বহু বছর। এর মধ্যে সরকারি কাজের ঠিকাদারি, রেশন দোকান, নানারকম ডিলারশিপ নিয়েছেন। সরকারি কাজের টাকা প্রথমে নিজে সরান, তারপর যারা কাজ দিল তাদের দেন, বাকিটুকু দিয়ে যতটা পারেন করেন।
বিদ্যুৎকে এমন এক সাম্রাজ্যের যুবরাজ হিসেবে বাড়িয়ে তুলেছেন বাঁশরী। এলাকার দাদা। সবাই সমঝে চলবে। বিদ্যুৎ যা ইচ্ছে, করে বেড়াবে। তবে না বাঁশরীলালের ছেলে! বিদ্যুৎকে ক্লাসে একটি চড় মেরেছিলেন স্কুলের এক শিক্ষক। তাঁকে চটজলদি বদলির আগে প্রকাশ্যে নিজের কান ধরে ক্ষমা চেয়ে যেতে হয়েছিল। এই বার্তা রটে যেতে বিদ্যুতের প্রথম নাম ছড়ায় জোরালোভাবে।
এখন বিদ্যুৎ বাবাকেও টপকে গিয়েছে।
কুসুমডিহার কাব্য। পর্ব ১৫: প্রতিমাকে পাওয়া গেল কুসুমডিহায়, মিথ্যে ধর্ষণের মামলায় ফাঁসি হয়েছে তাঁর বরের
কিন্তু দিনকাল বদলেছে, তাই আগের খুল্লামখুল্লা দাদাগিরিতে মাঝে মাঝে ব্রেক মারতে হয়।
এই যেমন, একটা সময় একটা পাতাকুড়োনো পরিবারের লোককে বেদম মেরেছিলেন বাঁশরী। পরে তার ছেলে পঞ্চায়েতের সদস্য হয়ে গিয়েছে। জমির কী একটা কাগজে তার সই দরকার। এদেরকে মাথায় তোলা হয়ে গিয়েছে।
তারপর ইদানীং এই মাওবাদী ঝামেলা। সাধারণ দলগুলোকে ম্যানেজ করা যায়। কিন্তু এই বিপদটা বড় বিপদ। তাদের পাল্লায় পড়ে এই মাধাইয়ের মতো ছেলেগুলো ধরাকে সরা জ্ঞান করছে। এরা যাই করুক, পিছনে কোথাও একটা জঙ্গলবাহিনীর যোগ আছে। ফলে বিদ্যুৎকেও নিজের বাহিনীকে ‘আপগ্রেড’ করতে হয়েছে। কিন্তু শেষরক্ষা হল কই!
বাঁশরীলালের মৃত্যুটা নিতে পারছে না বিদ্যুৎ। মনে হচ্ছে তার গালে কেউ পরপর চড় মেরে চলেছে। এতদিন এলাকার বাইরে থাকাটাও একটা পরাজয়। অন্য কেউ হলে ওই হামলার পর সেঁকে থাকত, বিদ্যুৎ ঘোর কাটিয়ে, একটু সুস্থ হয়েই, এলাকায় ঢুকে পাল্টা মারের অঙ্ক কষছে।
কমরেড ব্রহ্মা কতদিন পালিয়ে বেড়াবে? কতদিন মাধাইদের মদত দেবে? বাবাকে মেরে বিদ্যুৎকে এলাকাছাড়া করেছে ওরা। তার বাহিনীও ঘরছাড়া। বিদ্যুৎ ভেবে চলেছে এলাকায় ফিরতে হবে, পাল্টা মারতে হবে।
সমস্যা হল এই সরকারটাও। আগের সরকারের আমলে যা ইচ্ছে করা যেত। এখন তো মুখ্যমন্ত্রী চাষের জমিতে কারখানাটাও বন্ধ করে দিলেন। ইঙ্গিত পেয়ে পুলিশও অনেকটা পাল্টে গিয়েছে, কলকাতা থেকে নাকি অফিসারও গিয়ে বসে আছে।
বিদ্যুতের নানা কুমন্ত্রণা দেওয়ার লোক জহর। জহরের মাথা বেশ খোলে। জহর বলল, ‘দুম করে এলাকায় কিছু করতে যাওয়া ঠিক হবে না। রাগটা পুষে রাখো দাদা। আগে পুলিশের কাঁধে বন্দুক রেখে ওই ব্রহ্মাটাকে শেষ কর। ওর লাইন কাটো। তারপর আবার এলাকা ধরা যাবে।’
বিদ্যুৎ রাজি নয়। অন্তত মাধাইকে ওড়াতে হবে। একটা ধামাকা না হলে এলাকায় মানসম্মান থাকছে না। ভয়টাই কেটে যাচ্ছে। বাবাকে মারল, তাকে এলাকাছাড়া করল, এরপর কেউ মানবে না।
জহর বলল, ‘দাদা, মাধাই কি আদৌ ব্রহ্মাকে চেনে? ও তো গ্রামেই লাফিয়ে বেড়ায়। ওকে মেরে জল আরও ঘোলা হবে না?’
কুসুমডিহার কাব্য। পর্ব ১৪: এখন খবরের শীর্ষে কুসুমডিহায় মাওবাদী হামলা আর কমরেড ব্রহ্মা
বিদ্যুতের জেদ, ‘একটা কিছু না করলে কুসুমডিহায় এতদিনের তৈরি করা ইমেজ শেষ হয়ে যাবে। যাকে হাতের কাছে পাওয়া যাবে, তাকেই মারতে হবে।’
বাঁশরীর মৃত্যু, নিজে গুলি খেয়ে এলাকা থেকে পালিয়ে থাকাটা বিদ্যুতের কাছে পরাজয়। এটা আর সে নিতে পারছে না। ফিরতে হবে। আর তার আগে পাল্টা দিতে হবে।
বিদ্যুৎ দূরে বসেই ফোনে আয়োজন করল সব। দু’জন পুরনো ছেলেকে ফেরানো আর রানিগঞ্জের একটা টিম, পাঁচজন জনের। রাতের দিকে ঢুকে কাজ সেরেই আবার বেরিয়ে যাবে। বিদ্যুৎ আইনের হাতের বাইরে থাকবে। আর এলাকার লোক তার অলিখিত পদধ্বনি শুতে পাবে। বাঁশরীর মৃত্যুর বদলা মাধাই। তুলনায় সফট টার্গেট। ঢালপালায় হয়তো মাওবাদীদের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু ও বন্দুক, পিস্তল রাখে বলে এখনও খবর নেই। ছেলেটাকে মারতে পারলে মুখরক্ষা হয়।
জহর বিষয়টা পছন্দ না করলেও বিদ্যুৎকে থামানোর ক্ষমতা নেই। এলাকা থেকে দূরে বসে বিদ্যুতের মস্তিষ্ক আরও বেশি করে শয়তানের বাসা। জহরও বহু খারাপ বুদ্ধি দেয়, কিন্তু কেন যেন তার মনে হচ্ছে এখন সময়টা পাল্টা মারের নয়। জলটা একটু থিতু হতে দিতে হত। তাছাড়া এই ব্রহ্মার নেটওয়ার্কটা এখনও অজানা। কিন্তু বিদ্যুৎ শুনবে না। রানিগঞ্জ বাহিনীকে টার্গেট ডেটও ফাইনাল করে দিল সে। মাধাইকে খতম করতে হবে, রাতে, ঝড়ের বেগে ঢুকে, অপারেশন শেষ করে বেরিয়ে যাবে টিম। দরকার হলে বোমা চার্জ করবে। কিন্তু রাতে তেমন চাপ হয়তো হবে না। পথ চেনানোর লোক থাকবে, সমস্যা নেই। মাধাইয়ের বাড়িটাও তেমন পোক্ত কোনও দুর্গ নয়। লোকে বুঝবে, বিদ্যুৎ আগের মেজাজেই আছে।
এদিকে, মাধাই নিজেও ক’দিন ধরে ভাবছে ব্রহ্মাকে নিয়ে। এই বেল্টে সক্রিয়। মানে সব নজর রাখেন। অথচ মাধাই জানে না। মাধাই দু’-চারজনকে চেনে, তারা গণআন্দোলনে কী করতে হবে বলে দেন। কিন্তু একেবারে সশস্ত্র হামলার শক্তি তারা ধরেন কি? কয়েকজন তো বন্দি। যে দু’-একজন বাইরে আছে, যোগাযোগ করায়, তাদের সঙ্গে কথা বলেও তো এসবের আঁচ মেলে না। পুলিশকেও অতটুকুই বলেছে মাধাই। তাও যা জানে, সবটা বলেনি। আসলে পুলিশ নির্ঘাত তার ফোন ট্যাপ করছে। মাধাইকে তো বলা হয়েছিল, বাঁশরীরা গ্রামে ঢোকার সময় বিক্ষোভ দেখাতে। কিন্তু তার আগেই যে হামলাটা হল, মাধাই নিজেও অবাক। তবে বিদ্যুৎরা না ফেরায় গ্রামে আর উত্তেজনা নতুন করে তৈরি হয়নি।
মাধাই বিকেলে ফিরছিল, রেশমির সঙ্গে দেখা।
( চলবে)
যারা ষষ্ঠ গেমে কার্লসেনের আচরণকে গুকেশের প্রতি অসম্মান হিসেবে দেখছেন কিংবা কার্লসেন গুকেশকে হেয় করেন এমনটা বলছেন, তাঁরা হয়তো প্রথম গেমটা দেখেননি। গুকেশকে হারানোর পরে কার্লসেনের চোখেমুখে প্রতিদ্বন্দ্বিতা উপভোগ করার তৃপ্তিটুকু দেখেননি। ক্রীড়াবিদের জীবনে ওতঃপ্রোত এগুলো।
মধ্যরাতে পাশের দেশ আক্রমণের পর যুদ্ধ-পরিস্থিতি তুঙ্গে। আজ যারা তিরিশ-বত্রিশের যুবা, শেষ কার্গিল যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে তারা বঞ্চিত। তাই যুদ্ধ ছাড়া গতি নেই এমন এক রব উঠেছে চারদিকে। ঠিক যেমন প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে বলা হয়েছিল ‘A war to end all wars’, কুড়ি বছরেই তার পরিণাম কী হয়েছিল আমরা জানি।