রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি যুগে যুগে মানুষকে কীভাবে উজ্জীবিত করছে এবং তাদের জীবন ধারণের রাস্তা করে দিচ্ছে। সংখ্যাতত্ত্ব অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে বাংলা ভাষাভাষীর সংখ্যা ৭২ কোটিরও বেশি। আজ দুই বঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গান এবং তার প্রচার, তার শিল্পী, তার শিক্ষক, শিক্ষালয়, তার রেকর্ডিং, তার সিডি, ডিজিটালাইজেশন– সমস্ত নিয়ে একটা বিশাল ইন্ডাস্ট্রি চলেছে যার ফলে হাজার হাজার রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ও এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত কয়েক লক্ষ মানুষ তাঁদের অন্নের সংস্থান করছেন। এ তো গেল শুধু গানের কথা। এবার ভাবুন রবীন্দ্রসাহিত্য।
২০.
অনেক দিন ধরে ব্র্যান্ড বাজিয়ে চলেছি। আপনারা কেউ পড়েছেন, কেউ পড়েননি। কারওর ভালো লেগেছে বা কারও ভালো লাগেনি। কিন্তু একটা বিষয় হয়তো আপনাদের বোঝাতে পেরেছি যে, ব্র্যান্ড কাকে বলে! তার কাজটা কী? আবার বলি, ব্র্যান্ড হচ্ছে বহু পণ্যের ভিড়ে একটি পণ্যের বা ওই পণ্যের প্রস্তুতকারী কোম্পানির বিশেষভাবে পরিচিতি তৈরি করা। এই পরিচিতির ওপরে নির্ভর করে বা বিশ্বাস করে মানুষ সেই ব্র্যান্ডের প্রোডাক্টগুলো ব্যবহার করেন। এতে করে ইন্ডাস্ট্রির বা শিল্প বাণিজ্যের উন্নতি হয় এবং দেশের আর্থিক উন্নতিতে এই সমস্ত ব্র্যান্ডের বিরাট ভূমিকা থাকে। আমরা নিশ্চয়ই জানি যে, গোটা বিশ্বে বহু ব্র্যান্ডেড পণ্য আছে, যা বহুদিন ধরে মনুষ্যসমাজের কাজে আসছে এবং দেশকে শিল্পোন্নত করছে কিন্তু শিল্পকলা-সাহিত্য নির্ভর একটি ব্র্যান্ড পৃথিবীর এক বিরাট অংশে প্রায় এক শতাব্দী ধরে কয়েক লক্ষ মানুষের অন্নসংস্থান এবং আত্মিক উন্নতির ইন্ধন জুগিয়ে চলছে, সে সম্বন্ধে আমরা কতটুকু জানি? আমরা বিশ্ব বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিকদের কথা জানি, শিল্পস্রষ্টাদের কথা জানি, বিজ্ঞানীদের কথা জানি, সংগীত স্রষ্টাদের কথা জানি, দার্শনিকদের কথা জানি, কিন্তু কখনও কি তাদেরকে নিয়ে একটা বিশ্বজোড়া ব্র্যান্ড তৈরি হতে দেখেছি? এতদিন ধরে ব্র্যান্ড ঘাঁটতে ঘাঁটতে আমার একটা কথা বারবার মনে হচ্ছে যে, এই একজন বাঙালি শিল্পকলা-সাহিত্য স্রষ্টা, কীভাবে একা একটি ব্র্যান্ড তৈরি করলেন এবং তা শতবর্ষেরও বেশি ধরে আমরা, এক বিরাট সংখ্যক বঙ্গভাষাভাষীরা, সেই ব্যান্ড আঁকড়ে ধরে আরও কত শত বছর পার করব জানি না। আজকের আলোচনা আমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আমি বিজ্ঞাপনী ভাষায় আশ্চর্যজনক সুপারব্র্যান্ড বলতে দ্বিধাবোধ করব না। একটি মানুষের মধ্যে এতরকম প্রতিভার বিকাশ পৃথিবীতে, আমার মতে, আর আছে কি না জানি না। যাঁরা ইতিহাস চর্চা বা শিল্পচর্চা করেন তাঁরা হয়তো জানেন যে, ঈশ্বর কয়েক শত বছর আগে এমন এক মানব সন্তান সৃষ্টি করেছিলেন যিনি একাধারে শিল্পস্রষ্টা, ইঞ্জিনিয়ার, চিন্তাবিদ যাঁর অসাধারণ ঐশ্বরিক প্রতিভা তাঁর কাজে কর্মে প্রতিফলিত। তিনি হলেন লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি। কিন্তু তিনি ‘ব্র্যান্ড’ হতে পারেননি। এটা সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত মতামত। ঈশ্বর কার্পণ্য করেননি। বিগত শতাব্দীতে তিনি আর এক মানব সন্তানকে ওই ঐশ্বরিক প্রতিভা দিয়ে আমাদের উপহার দিলেন। তিনি রবীন্দ্রনাথ।
তাঁর সৃষ্টি যুগে যুগে মানুষকে কীভাবে উজ্জীবিত করছে এবং তাদের জীবন ধারণের রাস্তা করে দিচ্ছে। সংখ্যাতত্ত্ব অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে বাংলা ভাষাভাষীর সংখ্যা ৭২ কোটিরও বেশি। আজ দুই বঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গান এবং তার প্রচার, তার শিল্পী, তার শিক্ষক, শিক্ষালয়, তার রেকর্ডিং, তার সিডি, ডিজিটালাইজেশন– সমস্ত নিয়ে একটা বিশাল ইন্ডাস্ট্রি চলেছে যার ফলে হাজার হাজার রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ও এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত কয়েক লক্ষ মানুষ তাঁদের অন্নের সংস্থান করছেন। এ তো গেল শুধু গানের কথা। এবার ভাবুন রবীন্দ্রসাহিত্য। তাঁর যে অগণিত সৃষ্টি, তার বিশাল সংখ্যক পাঠক আজ দুই বাংলা জুড়ে। এবং বিশ্বজুড়ে কিছু না হলেও কয়েক কোটি মানুষ সেই সাহিত্য নিয়ে গবেষণা, নতুন করে তাঁকে আবিষ্কারের কাজে ডুবে আছেন। এই ৭২ কোটি বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে যদি ২ কোটি মানুষও নিত্যদিন তাঁর কাব্যসাহিত্য নিয়ে চর্চা করে চলেন এবং সেই সূত্রে পুস্তক এবং পুস্তিকার যে বিক্রি বিশ্বজুড়ে তার হিসাব কি কেউ রেখেছেন? রবীন্দ্রপুস্তক প্রকাশনা একটি বিশাল ইন্ডাস্ট্রি যা প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ বই প্রকাশ করছে এবং মানুষ কিনছেন, পড়ছেন। পৃথিবী জুড়ে যেখানেই বাংলা ভাষাভাষী মানুষ তা সংগ্রহ করছেন। এর পরে আসি রবীন্দ্রনাথের বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনার কথা। আমি একজন বিখ্যাত ভারতীয় কোয়ান্টাম ফিজিক্সের বিজ্ঞানীকে বলতে শুনেছি যে, তিনি যখন বিজ্ঞান চিন্তা করেন তখন রবীন্দ্রনাথকে কাছে নিয়ে বসেন। কারণ রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞানচেতনা, যা ভীষণভাবে ভারতীয় প্রাচীন ঋষিমুনিদের দর্শন এবং বেদ-উপনিষদের বিখ্যাত বিশ্বজনীন ভাবনাচিন্তার ওপর আধারিত, তা তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে সহজভাবে প্রকাশিত হচ্ছে, সেটা এই বিজ্ঞানীর বিজ্ঞান ভাবনার কাজে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আমরা নিশ্চয়ই জানি যে, গোটা বিশ্বে বহু ব্র্যান্ডেড পণ্য আছে, যা বহুদিন ধরে মনুষ্যসমাজের কাজে আসছে এবং দেশকে শিল্পোন্নত করছে কিন্তু শিল্পকলা-সাহিত্য নির্ভর একটি ব্র্যান্ড পৃথিবীর এক বিরাট অংশে প্রায় এক শতাব্দী ধরে কয়েক লক্ষ মানুষের অন্নসংস্থান এবং আত্মিক উন্নতির ইন্ধন জুগিয়ে চলছে, সে সম্বন্ধে আমরা কতটুকু জানি? আমরা বিশ্ব বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিকদের কথা জানি, শিল্পস্রষ্টাদের কথা জানি, বিজ্ঞানীদের কথা জানি, সংগীত স্রষ্টাদের কথা জানি, দার্শনিকদের কথা জানি, কিন্তু কখনও কি তাদেরকে নিয়ে একটা বিশ্বজোড়া ব্র্যান্ড তৈরি হতে দেখেছি?
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
দুই স্বাধীন দেশের জাতীয় সংগীতের স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন তাঁর ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থের জন্য। যা চিরন্তন বিশ্বশ্রেষ্ঠ কবি-সাহিত্যিকরা একযোগে সমর্থন করেছিলেন। এবং সেই পুরস্কারের অর্থ রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজে লাগালেন, যা বিজ্ঞাপনী ভাষায় ‘ব্র্যান্ড বিল্ডিং এক্সারসাইজ’ বলা যেতে পারে। আসলে রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশ্য ছিল তাঁর স্থাপিত বিশ্ববিদ্যালয় মানুষকে প্রকৃতির পাঠ দেবে, মানুষকে মনুষ্যত্বের রাস্তায় নিয়ে যাবে এবং যেখানে সারা পৃথিবীর চিন্তাশীল, সৃষ্টিশীল মানুষেরা এসে শিক্ষা নেবেন এবং শিক্ষিত করবেন। এটিও বিজ্ঞাপনী ভাষায় বলে ‘ব্র্যান্ড ভ্যালু ক্রিয়েশন’। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ও আজ শতবর্ষ অতিক্রান্ত করছে এবং সারা দেশে তো বটেই বিশ্বজুড়ে তার অপরিসীম প্রভাব ফেলেছে। এই বিশ্ববিদ্যালয় এমন এক গ্রামীণ প্রাকৃতিক পরিবেশে তৈরি হয়েছিল যা সেখানকার অর্থনীতির উন্নতির ও সামাজিক উন্নতির একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত। আজ এই প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে লক্ষ মানুষের অন্ন সংস্থান হয়ে চলেছে এবং তাদের মানসিক ও আত্মিক উন্নতির পথ দেখাচ্ছে। এইরকম একটি ব্র্যান্ড গড়ে তোলার ক্ষমতা কি আর কারও মধ্যে আমরা দেখেছি? রবীন্দ্রনাথের পোশাক ভাবনা দেখুন। এক আন্তর্জাতিক, অভিজাত, দৃষ্টিনন্দন পোশাক– যা সারা পৃথিবীর মানুষকে আকৃষ্ট করেছে। সেটাও তো ব্র্যান্ড ইমেজ তৈরির আদর্শ উদাহরণ।
পরিশেষে বলি, রবীন্দ্রনাথ নিশ্চিতভাবে কোনও কিছুই নিজের ব্র্যান্ড তৈরির কথা ভেবে করেননি। কিন্তু আমাদের, কিছু ব্র্যান্ড বাজানো পার্টির কাজই হচ্ছে ব্র্যান্ড বিল্ডিং-এর গন্ধ শুঁকে বেড়ানো। রবীন্দ্রনাথের কাছে সশ্রদ্ধ ক্ষমাভিক্ষা করেও আপনাদের কাছে আমার, ব্র্যান্ড বাজনদারের, বিনীত প্রশ্ন, এই নিবেদনটি কি খুব অযৌক্তিক?
ব্র্যান্ড বাজাও-এর অন্যান্য পর্ব
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ১৯: ফ্লুরিজকে টেক্কা দিয়েছিল যারা
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ১৮: কথাবার্তা নেই, স্রেফ গন্ধই খাবারের বিজ্ঞাপন
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ১৭: বাড়িতে আগুন লাগলে আপনি কি চকোলেট খাবেন?
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ১৬: বিজ্ঞাপনের গোলকধাঁধায় চিকিৎসাও পণ্য!
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ১৫: বাঘ-ছাগলকে একঘাটে জল খাওয়াতে পারে যে চা
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ১৪: বিষ বিক্রি করে মিলিয়ান ডলারের মালিক!
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ১৩: বুকের দুধের বাজার গরম, ৩০০ মিলিলিটার ৪৫০০ টাকা!
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ১২: গেরুয়া লুঙ্গির কাছে গোহারান হেরেছে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ১১: ধর্মতলার সেই ভিক্ষুক যে বিজ্ঞাপনের কড়া স্ট্রাটেজিস্ট
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ১০: ‘টাটকা’ সবজি ‘জ্যান্ত’ বললে বিক্রি বাড়ে, এটাও বিজ্ঞাপন
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ৯: সে যাত্রায় বন্দুকের নল থেকে রক্ষা করেছিলেন সুনীল গাভাসকর
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ৮: যে কোম্পানির নামে আস্ত একটা নগরী!
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ৭: এক সামান্য নাপিতের উদ্যোগ ও চেষ্টা
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ৬: মহাকাশচারীদের জন্য বানানো টুথপেস্টে এখন শিশু ও পোষ্যদের দাঁত মাজানো হয়
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ৫: একখানা লিপস্টিক প্রায় দেড় কোটি টাকা!
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ৪: ইস চাম্পি মে বড়ে বড়ে গুণ
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ৩: ‘ওরে ব্লোরীন লাগা’
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ২: বাংলাভাষায় প্রথম সার্থক বুদ্ধিদীপ্ত বিজ্ঞাপন, রবীন্দ্রনাথও দিয়েছিলেন শংসাপত্র
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ১: ৫০০০ বছর আগেই ছিল ব্র্যান্ডিংয়ের ধারণা!