কার্লেস কুয়াদ্রাত, আপনি জানতেন, আপনার হাতে উঁচু দরের প্লেয়ার তুলে দেয়ার সামর্থ্য ইস্টবেঙ্গলের নেই। আর আপনি, চচ্চড়ির মশুলা দিয়ে বিরিয়ানি না রেঁধে উপাদেয় চচ্চড়িই রান্নার পরিকল্পনা নিয়ে পা রেখেছিলেন লেসলি ক্লডিয়াস সরণিতে।
মিস্টার কার্লেস কুয়াদ্রাত, এ চিঠি আপনাকে যখন লিখছি, তখন এ চিঠি লেখার আদর্শ সময় নয়। কারণ, সাফল্যের পাশে যে আলো, কিংবা ব্যর্থতার পাশে যে অন্ধকার, সে আলো-আঁধারে চিঠির সততা লঘু হয়ে যায়। সাফল্য বা ব্যর্থতার অব্যবহৃত বয়ান বদলে যাওয়াই দস্তুর। তবু, সামান্য খেলা-লিখিয়ে এবং এক ফুটবলপ্রেমীর এই সামান্য চিঠি আপনার কাছে যেহেতু পৌঁছবে না, তাই সে ভরসাতেই দু’পয়সা লিখে ফেলা যাক।
২০২০ সালে আইএসএলে যখন ইস্টবেঙ্গল এবং মোহনবাগান– দু’টি দলই খেলতে এল, মোহনবাগান ঘোষণা করেছিল এটিকে নামক দলটির সঙ্গে মার্জড হয়ে একটিই এন্টিটি ফর্ম করবে। এটিকে মোহনবাগান। তাই হল। রয় কৃষ্ণা, ডেভিড উইলিয়ামস থেকে প্রীতম কোটাল, প্রবীর দাস-সহ প্রায় ৮০ ভাগ এটিকের প্লেয়ার চলে এল সেই দলে। পুরাতন আইলিগ জয়ী মোহনবাগান থেকে প্রায় কেউ-ই ঠাঁই পেল না। সেবার দু’টো ডার্বিই জিতল এটিকে মোহনবাগান। মোহনবাগান সমর্থকরা এই এন্টিটিকে কেউ স্বীকার করলেন, কেউ করলেন না, কিন্তু বড় ম্যাচ জয়ের পর সেলিব্রেশনটা ছিল চোখে পড়ার মতো। তারপর ক্রমাগত তিনটে আইএসএলে একের পর এক ডার্বি জিতল তারা। ইস্টবেঙ্গলের সীমিত সামর্থ্যের সামান্য প্রতিরোধগুলো উড়ে গেল খড়কুটোর মতো। দুরমুশ করে জিতল এটিকে মোহনবাগান। ইস্টবেঙ্গলের অবস্থা তখন তথৈবচ। মাঝে মাঝে রাগ-দুঃখ বিরক্তিতে ইস্টবেঙ্গল জনতার মনে হতে শুরু করল, একটা দল, এতখানি বেনিফিট পেয়ে, একটা পোড়খাওয়া, একাধিক আইএসএল জেতা ম্যানেজমেন্ট পেয়ে, অসামান্য বাজেট পেয়ে একের পর এক ম্যাচ জিতে যাচ্ছে। আমরা কী পেলাম? এই অসম লড়াই? একশ যোজন দূরত্ব প্লেয়ারদের কোয়ালিটির, কয়েক যোজন দূরত্ব সঞ্জীব গোয়েঙ্কার সঙ্গে ইস্টবেঙ্গলের ইনভেস্টারদের। কোনওদিন আদৌ সম্ভব এই দূরত্ব মেটানো? সান্ত্বনা একটাই, ইস্টবেঙ্গল মাটি থেকে উঠছে৷ গাছের মতো। কোনওমতে টিকে আছে ঠিক। অপমানে। অসম্মানে। যেনতেনপ্রকারেণ।
‘যারা সুখে আছ তারা সুখে থাকো, এ সুখ সইবে না
দুখে আছো যারা বেঁচে থাকো, এ দুখ রইবে না…’
এসব আশাবাদ কি আঁকড়ে থাকা যায়? যেখানে ল অফ অ্যাভারেজটুকুও কাজ করে না, সেখানে যন্ত্রণার নীলকে কতদিন ঠেকিয়ে রাখবে এই অপটিমিজম? রাগ-ঘৃণা-হিংসা সবকিছু জমা হচ্ছিল। তখন একটা জিনিসই টিকিয়ে রেখেছিল। কোনও এস্কালেটর নেই। এলিভেটর নেই। তাই যেদিন জিতবে, সে অনাবিল আনন্দ কোনওদিন আর কেউ পাবে না, নেভার– যে অপেক্ষা যত দীর্ঘ, তার অবসান তত মধুর…
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
ডুরান্ডের ফাইনালে সবচেয়ে ভালো ফুটবল খেলেও ল্যাক অফ কনসেনট্রেশনের জন্য হারল দলটা। আপনি শব্দহীন ছিলেন। কারণ, আপনি জানেন, বিশ্বাস করেন, সব ম্যাচ জেতা যায় না। আপনার আগে, ইস্টবেঙ্গলের আইএসএল অন্তর্ভুক্তির পর তিনজন কোচ এসেছেন। তাঁদের কেউ-ই কি তবে কোনও প্রোগ্রেস দেখাননি? গতবছর আইএসএলের প্রথম ডার্বিতে স্টিভেন কনস্ট্যানটাইনের দলটা বেশ ভাল খেলেছিল। জিততেও পারত। কিন্তু জেতেনি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
মিস্টার কুয়াদ্রাত, সেপ্টেম্বর মাসে আপনি প্রেস কনফারেন্সে বলেছিলেন, ইস্টবেঙ্গলের আসল শক্তি তার সমর্থককুল। তারা যেন ভরসা না হারান। এই দলটাকে নিয়ে, (যা উহ্য রেখেছিলেন তা হল, যে সীমিত সামর্থ্যের দলটাকে নিয়ে) যতদূর লড়াই করা যায় আপনি লড়বেন, এবং একটা প্রসেস আপনি মেনে চলছেন, ধাপে ধাপে উন্নতি করে সেই প্রসেস-এর সর্বোত্তম আউটপুটে পৌঁছতে হবে। আমার মনে পড়ছিল মিস্টার কুয়াদ্রাত, আপনি একদা যে ক্লাবের অংশ ছিলেন, সেই বার্সেলোনার কথা। বার্সেলোনার রাইকার্ড জমানা তখন অতীত, জুনিয়র টিম থেকে একজন কোচ এলেন বার্সেলোনায়, তিনি প্রথম ম্যাচের পরেই সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছিলেন, আমরা একটা জার্নি শুরু করলাম। কেউ একা না, একসঙ্গে সবাই। কখনও জিতব, কখনও হারব, কিন্তু প্রসেসটা থামানো যাবে না। আমাদের সবার লক্ষ্য এক। সেই অখ্যাত তরুণকে এখন গোটা দুনিয়া চেনে, পেপ গুয়ার্দিওলা নামে। মনে করে দেখুন মিস্টার কুয়াদ্রাত, সেদিনের সেই বার্সেলোনা দলটার মাঝমাঠে তিনজন প্লেয়ারই ছিল নবাগত। পরে তাদের দুনিয়ে চিনেছিলে জাভি-ইনিয়েস্তা আর বুস্কেটস নামে। ‘দৌড় না নেহি, রুক না ভি নেহি, বাস চলতে রহেনা না হ্যায়…’– এই চলতে থাকাটাই সব। পথের শেষে কী আছে সেই হিসেব কষলে চলা যায় না।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: ক্রিকেট মনে করাল জীবনের ‘ডাবল’ ধামাকা
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
মিস্টার কুয়াদ্রাত, আপনি আসার পরে ডুরান্ডের প্রথম ডার্বিটাও ইস্টবেঙ্গল জেতে। কিন্তু ডমিনেশন? প্রতিপক্ষকে পায়ের তলায় কার্যত পিষে দিয়ে, দুমড়ে দিয়ে জেতার আনন্দ? যা এটিকে মোহনবাগান তিন তিনটে সিজন ভোগ করেছে? তা তো পাইনি। ডুরান্ডের ফাইনালে সবচেয়ে ভালো ফুটবল খেলেও ল্যাক অফ কনসেনট্রেশনের জন্য হারল দলটা। আপনি শব্দহীন ছিলেন। কারণ, আপনি জানেন, বিশ্বাস করেন, সব ম্যাচ জেতা যায় না। আপনার আগে, ইস্টবেঙ্গলের আইএসএল অন্তর্ভুক্তির পর তিনজন কোচ এসেছেন। তাঁদের কেউ-ই কি তবে কোনও প্রোগ্রেস দেখাননি? গতবছর আইএসএলের প্রথম ডার্বিতে স্টিভেন কনস্ট্যানটাইনের দলটা বেশ ভাল খেলেছিল। জিততেও পারত। কিন্তু জেতেনি। প্রায় ৭০ ভাগ ম্যাচে ইস্টবেঙ্গল শেষ ১০ মিনিটে গোল খেয়ে জেতা ম্যাচ হেরে যাচ্ছিল। আপনার কাছে চ্যালেঞ্জ ছিল, ভাল খেলার বৃত্তের বাইরে বেরিয়ে আপনাকে ম্যাচ জেতাতে হবে। আপনি নিশ্চই ওয়াকিবহাল যে বিখ্যাত ব্রিটিশ ক্লাব আর্সেনালে যখন মিকেল আর্তেতা এলেন কোচ হয়ে, তখন প্রথম তিন মরশুম তিনি কী দিতে পেরেছিলেন দলটাকে? লিগ টেবিলে তথৈবচ অবস্থা, এমিরেটস থেকে খেলা শেষের আগেই দর্শক বেরিয়ে যায়, প্রথম দুই সিজনে লিগ পজিশন অষ্টম আর পঞ্চম। কিন্তু তবু গানার্সরা আর্তেতাকে সময় দিয়েছিল। কেন? কারণ ধারাবাহিক ডমিনেন্স না দেখালেও ছোটো ছোটো আশার আলো আর্টেটা প্রথম সিজন থেকেই দিয়ে যাচ্ছিলেন। ম্যাঞ্চেস্টার সিটিকে এফএ কাপে হারানো, চেলসিকে ফাইনাল হারানো, কমিউনিটি শিল্ড জয়– অনেকক্ষেত্রে অবামেয়াং-এর ব্রিলিয়ান্স থাকলেও, দলটার ধারাবাহিক উন্নতি দৃশ্যমান না হলেও আভাস পাওয়া গিয়েছিল। মিস্টার কুয়াদ্রাত, আপনিও জানতেন ফুটবল রকেট-সায়েন্স না, আপনার সামনে পাহাড় ডিঙোনোর চাপ। অসম লড়াই। রাতারাতি আপনি আকাশ থেকে ট্রফি এনে দিতে পারবেন না, কিন্তু ডুরান্ডের প্রথম ডার্বিটি জিতে আপনি প্রমাণ করেছিলেন, ক্রুয়েফের সেই কথা– ‘টাকার বস্তা মাঠে নেমে ফুটবল খেলে না।’ – আর ঐ ছিল জিয়নকাঠি, যার জন্য আইএসএলে হারের হ্যাটট্রিকের পরেও আপনাকে রক্তচক্ষু দেখাননি সমর্থকেরা। সময় দিচ্ছিল। যে দলটা তিনটে আইএসএলে খাবি খেয়েছে, আপনার হাতে পড়ে প্রথম টুর্নামেন্টেই রানার্স আপ। উপমহাদেশের ফুটবল সমর্থনের চরিত্র আপনার কোচিং প্রজ্ঞা পরে নিল গোড়াতেই। আপনার তিন পূর্বসূরির মতো আপনি অভিযোগ আনেননি ভাল প্লেয়ার না থাকার। আপনি জানতেন, আপনার হাতে উঁচু দরের প্লেয়ার তুলে দেয়ার সামর্থ্য ইস্টবেঙ্গলের নেই। আর আপনি, চচ্চড়ির মশুলা দিয়ে বিরিয়ানি না রেঁধে উপাদেয় চচ্চড়িই রান্নার পরিকল্পনা নিয়ে পা রেখেছিলেন লেসলি ক্লডিয়াস সরণিতে। পজেশনাল ফুটবলের বিরুদ্ধে লো আর টাইট মিড ব্লক রেখে প্রতি আক্রমণ, আপনার মগজাস্ত্র থেকে যে মোক্ষম অস্ত্রটি নিক্ষেপ করা সম্ভব ছিল– তাই করলেন। এই সিস্টেমে দরকার দুজন ইনভার্টেড উইঙ্গার– দলে এলেন নন্দাকুমার আর রইলেন আগের দু’মরশুমের ধারাবাহিক পারফর্মার মহেশ। আর দরকার ছিল সেন্টার করিডর অন অফ করার জন্য দু’জন মিডফিল্ডার। দলে নিলেন সল ক্রেসপো আর সৌভিককে। হিজাজি মাহের আর পারদো দরের নিরিখে উঁচু না হলেও সেন্ট্রাল করিডর বন্ধ করলে প্রতিপক্ষের একমাত্র পথ– এরিয়াল বল সাফ করতে দক্ষ।
এই প্ল্যানিং বাস্তবায়ন কি খুব সোজা ছিল? ছিল না। কিন্তু আপনি বিশ্বাসটা রেখেছিলেন। আর বাঙালি ইউরোপীয় ফুটবল দেখে এখন বুঝে গেছে গেগানপ্রেসিং, বুঝে গেছে লো ব্লক-মিড ব্লকের ধারণা, বুঝে গেছে কীভাবে কার্লো আন্সেলোত্তি বা দিদিয়ের দেশঁ– কোনও স্ট্রাইকার ছাড়া দু’জন গতিশীল উইঙ্গার দিয়েই বাজিমাত করেন, কীভাবে যুর্গেন ক্লপ প্রতিপক্ষ অর্ধ থেকে বল প্রেসিং-এর ধারণার রূপান্তর ঘটিয়েছেন। তাই আপনাকে চিনতে তাদের সমস্যা হয়নি গোড়া থেকেই…
মিস্টার কুয়াদ্রাত, আপনি ডার্বি জয়ের পরেও প্রেস কনফারেন্সে এসে বললেন, এই ম্যাচ জয় কেবল আপনাকে সেমিফাইনালের টিকিট দিয়েছে। প্রসেস-এর মাঝপথে আপনি। এখনও অনেক পথ বাকি। কারণ, আমরা, সমর্থকরা দৌড়ানোর সুযোগ পেলে ভুলে যাই সবকিছু, আবার হোঁচট খেলে থমকে যাই। কিন্তু আপনি জানেন এই দুই-ই আসলে বিভ্রান্তিকর। শান্তভাবে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়াটুকুই সব। সম্ভবত ইস্টবেঙ্গলের আবহমান ইতিহাসের সঙ্গে, ইস্টবেঙ্গলের কলোনিয়ালিজমের সঙ্গে, ইস্টবেঙ্গলের আত্মার সঙ্গে এই আপনার শিকড়ের যোগ…