ক্ষিপ্ত সর্দার বোধিসত্ত্বকে ঘর থেকে টেনে বার করে এলোপাতাড়ি মারতে আরম্ভ করল। তার সঙ্গে হাত মেলালো তার দলের কয়েক সঙ্গীও। বোধিসত্ত্ব কোনও আর্তনাদ বা অনুনয় না করে ক্রমাগত উচ্চস্বরে বলতে থাকলেন, কী নিষ্ঠুর! কী অকৃতজ্ঞা! কী কুৎসাকারিণী! কী মিত্রদ্রোহিণী!
২২.
ওরা যখন মাঝনদীতে জলকেলিতে মেতে তখন হঠাৎ চরাচর আঁধার করে ঝড় উঠল। সঙ্গে সবকিছু ভাসিয়ে দেওয়া প্রবল বৃষ্টি। দাসী-বাঁদি সহ স্নান করতে এসে দিশেহারা অবস্থা তখন শ্রেষ্ঠীকন্যা দুষ্টকুমারীর।
কোনও বাপ-মা তো আর সন্তানের এমন নাম দেবে না। নিজের স্বভাবদোষেই তার এমন নাম অর্জন। কুটিল মেয়েটি কর্মচারীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে, কখনও কখনও বয়স্ক দাসীদের গায়ে হাতও তোলে। তাদের মনে দিনে দিনে তীব্র ঘেন্না আর ক্ষোভ জমে। এখন এমন বিপদের থেকে তাকে বাঁচানোর তাই কোনও ইচ্ছেই জাগল না তার সঙ্গিনীদের। তারা কোনওরকমে সাঁতরে পারে উঠে পড়ল।
নদীর পাগলা স্রোতে ভেসে গেল দুষ্টকুমারী। তার ‘বাঁচাও বাঁচাও’ আর্তনাদ দুই কূলের জনবসতিহীন বনের মাঝে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে হতে এগিয়ে চলল।
জলে ওলোট-পালোট হয়ে ভাসতে ভাসতে মেয়েটির গলা যখন ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে, তখন শোনা গেল এক পুরুষের কণ্ঠস্বর, ভয় নেই আমি আসছি। এক যুবক তপস্বী। বোধিসত্ত্ব। বনের মাঝে তাঁর পর্ণকুটির। মনে ক্লেদ নেই, শরীরে হাতির বল। শক্তপোক্ত লতার টুকরো হাতে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন ভরা জোয়ারের নদীবক্ষে। কোনওরকমে তুলে আনলেন দুষ্টকুমারীর এলিয়ে যাওয়া দেহ।
………………………………………………………………………………………………………………………………………
যথেষ্ট সুস্থ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও এবং বোধিসত্ত্ব বারবার তার বাড়ির নিশানা জানতে চাইলেও সে বিশেষ উচ্চবাচ্য করে না। তার মনে অন্য এক পরিকল্পনা। নিঝুম দুপুরে, ঝিঁঝি-ডাকা রাতে সে নবীন তপস্বীকে প্রলুব্ধ করতে চায়।
………………………………………………………………………………………………………………………………………
হরিণীর দুধ, ফলের রস আর আন্তরিক শুশ্রূষায় মেয়েটি চোখ মেলল। গম্ভীর বনানী, পাখির কলকাকলি, নদীর কুলকুল– এমন এক পরিপ্রেক্ষিতে যুবক বোধিসত্ত্বের বরতনু তাকে বিহ্বল করে দিল। খুব দ্রুত সুস্থ বোধ করল সে। বোধিসত্ত্ব বললেন, আমার কুটিরে তুমি বিশ্রাম কর, আজকের রাতটা আমি গাছতলায় কাটাচ্ছি।
শুধু একদিন নয়। এমন চলল বেশ কয়েকদিন। যথেষ্ট সুস্থ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও এবং বোধিসত্ত্ব বারবার তার বাড়ির নিশানা জানতে চাইলেও সে বিশেষ উচ্চবাচ্য করে না। তার মনে অন্য এক পরিকল্পনা। নিঝুম দুপুরে, ঝিঁঝি-ডাকা রাতে সে নবীন তপস্বীকে প্রলুব্ধ করতে চায়।
জন্মের পর জন্মে ভালো-মন্দ নানা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে করতেই নিখুঁত গৌতম বুদ্ধ হয়ে ওঠা। এই জন্মে বোধিসত্ত্ব এক লোভের ফাঁদে পা দিলেন। তাঁর লতা-পাতায় ঘেরা আশ্রম হয়ে উঠল নবদম্পতির মিলনকক্ষ। তাতেও মন ভরল না কুমারীর। তার প্ররোচনায় ঘর বাঁধা হল নিকটস্থ লোকালয়ে। বোধিসত্ত্ব সেখানে তক্র (পালি ভাষায় ঘোল জাতীয় সরবত) বিক্রি করে আর অবসরে তর্কবাগীশ হিসেবে জ্ঞানচর্চায় জীবিকা নির্বাহ করতেন। স্থানীয় মানুষ ‘তক্র’ আর ‘তর্ক’ শব্দদু’টির একটাই অপভ্রংশ বানিয়ে তাঁর নামকরণ করল ‘তক্ক পণ্ডিত’।
কিন্তু এই আপাত সুখের স্থিতাবস্থাও বেশিকাল টিকল না। বসতিতে একদিন ডাকাত পড়ল। রাতের অন্ধকারে পাহাড় থেকে নেমে এসে সশস্ত্র দস্যুর দল গৃহস্থের সব সঞ্চয় লুটে নিয়ে গেল। যাওয়ার সময় সর্দারের নজর পড়ল দুষ্টকুমারীর ওপর। লুটে নিয়ে গেল তাকেও। তার ‘বাঁচাও বাঁচাও’ আর্তনাদ ধীরে ধীরে যখন মিলিয়ে যাচ্ছে, বিমূঢ় বোধিসত্ত্বের মনে পড়ে অনতিকাল আগের এক ঝোড়ো বিকেলের কথা।
দুষ্টকুমারী কিন্তু সেসব ভুলে যেতে চায়। সর্দারের আদর আর অপরিমিত সম্পদে তার মাথা ঘুরে গেল। মনে হল, বোধিসত্ত্বের সঙ্গে ছাপোষা দিনযাপনের চেয়ে এ-ই ঢের ভালো। এমনকী তার মনে আশঙ্কা জাগল, সাহসী বোধিসত্ত্ব যদি তাকে কোনওভাবে উদ্ধার করে নিয়ে যায়, তবে তো তার আরামের জীবনে দাঁড়ি পড়বে; তার চেয়ে মানুষটাকে নিকেশ করাই ভালো!
সে দস্যুদলের একজনকে ছদ্মবেশে পাঠালো বোধিসত্ত্বের কাছে। হাতচিঠিতে প্রণয়ের ভান করে লিখল, আর্য, আমি বনের অমুক জায়গায় আছি, আমাকে বাঁচাও।
বোধিসত্ত্ব যে রাতে তার ডেরায় পৌঁছলেন, দস্যুদল তখন ডাকাতি করতে বেরিয়ে গেছে। ইচ্ছে থাকলে পালিয়ে আসা যেত, কিন্তু দুষ্টকুমারী ছল করে তাঁকে এক ঘরে আপাতত লুকিয়ে থাকতে বলল। দলবল ভোরবেলা ফিরে এলে সর্দারকে বলল, আমার স্বামী আমাকে ছিনিয়ে নিয়ে যেতে এসেছে, তাকে আমি ওই ঘরে আটকে রেখেছি।
ক্ষিপ্ত সর্দার বোধিসত্ত্বকে ঘর থেকে টেনে বার করে এলোপাতাড়ি মারতে আরম্ভ করল। তার সঙ্গে হাত মেলালো তার দলের কয়েক সঙ্গীও। বোধিসত্ত্ব কোনও আর্তনাদ বা অনুনয় না করে ক্রমাগত উচ্চস্বরে বলতে থাকলেন, কী নিষ্ঠুর! কী অকৃতজ্ঞা! কী কুৎসাকারিণী! কী মিত্রদ্রোহিণী!
একতরফা প্রচণ্ড প্রহারের পর হাঁফাতে হাঁফাতে সর্দার ব্যঙ্গের সুরে বলল, আমাদের কেমন সব পণ্ডিতি গালাগাল দিচ্ছিস শুনি?
বোধিসত্ত্ব হাতের তালুতে ঠোঁটের রক্ত মুছে ম্লান হেসে বললেন, তোমাদের নয়, গালাগাল দিচ্ছি আমার সঙ্গিনীকে। শোনো তবে তার কাহিনি। এক ঝড়ের বিকেল থেকে তার সঙ্গে আমার পরিচয়।
সব শুনে সর্দার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর তার এক শাকরেদকে বলল তক্ক পণ্ডিতের ক্ষতে ওষধি লাগিয়ে দিতে। সে ধীর পায়ে ঢুকল অপেক্ষারতা দুষ্টকুমারীর ঘরে। তাকে কিছু বুঝতে না দিয়ে তলোয়ারের এক কোপে তাকে দ্বিখণ্ডিত করল।
ফিরে এসে বোধিসত্ত্বকে বলল, পণ্ডিত, তোমায় আর আটকাবো না, পারলে আমাদের ক্ষমা করে দিও।
বোধিসত্ত্ব পা বাড়ালেন। সর্দার বলল, আমার লোক তোমাকে কি বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসবে?
বোধিসত্ত্ব উত্তর দিলেন, আমি সেখানে যাচ্ছি না। আমি খুঁজে নেব আমার সেই নদী। তার তীরে কুটীর বানিয়ে আমার অসমাপ্ত তপস্যা আবার শুরু করতে হবে।
দলের সকলকে অবাক করে দিয়ে সর্দার বোধিসত্ত্বের পায়ে লুটিয়ে পড়ে বলল, ঠাকুর, আমাকেও তোমার সঙ্গে নাও।
সূত্র: তক্ক জাতক
…নব জাতক-এর অন্যান্য পর্ব…
নব জাতক পর্ব ২১: গাছতলায় শুয়ে রাত কাটাতে হল সারীপুত্রের মতো সম্মাননীয় শ্রমণকেও
নব জাতক পর্ব ২০: আফসোস যে শ্রেষ্ঠী-বালিকার পরিচয় অজ্ঞাত থেকে গেল
নব জাতক পর্ব ১৯: ছদ্মবেশে প্রজার সুখ দেখতে বেরিয়ে লজ্জিত হয়ে পড়লেন রাজা
নব জাতক পর্ব ১৮: ব্রাহ্মণের সন্তান হলেই ব্রাহ্মণ হওয়া যায় না
নব জাতক পর্ব ১৭: এত ছোট চারাই যদি এমন হয়, বড় বৃক্ষ হলে না জানি কেমন বিষাক্ত হবে
নব জাতক পর্ব ১৬: প্রকৃত চরিত্রবানের পিছনে তলোয়ারের আতঙ্ক রাখার দরকার হয় না
নব জাতক পর্ব ১৫: নেপথ্য থেকে যে নেতৃত্ব দেয়, তাকে অস্বীকার করা যায় না
নব জাতক পর্ব ১৪: প্রাণীহত্যার মতো নির্মম আয়োজনে দেবতার সন্তুষ্টি হয় কী করে!
নব জাতক পর্ব ১৩: এক হাজার দস্যুর লাশ আর রত্ন পেটিকা
নব জাতক পর্ব ১২: সীতা যখন রামের বোন, দিতে হয়নি অগ্নিপরীক্ষাও
নব জাতক পর্ব ১১: শাসকের পৃষ্ঠপোষকতায় কোনও সন্ত্রাসবাদীকে সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনা সে-ই বোধহয় প্রথম
নব জাতক পর্ব ১০: নিকটজনের অন্যায্য আবদারে রাজধর্মে বিচ্যুত হওয়া যায় না
নব জাতক পর্ব ৯: লকলকে লোভের আগুনে সদুপদেশ খাক হয়ে যায়
নব জাতক পর্ব ৮: যেখানে মৃত্যু প্রবেশ করতে পারে না, শুধু জীবনের জয়গান
নব জাতক পর্ব ৭: অভয় সরোবর সত্ত্বেও কেন ব্যাধ ফাঁদ পেতেছিল সুবর্ণহংসের জন্য?
নব জাতক পর্ব ৬: জন্ম-জন্মান্তরের বিষয়-আকাঙ্ক্ষা যখন হেলাফেলা করা যায়
নব জাতক পর্ব ৫: পলাশ গাছ ছায়া দিত কালো সিংহকে, তবু তারা শত্রু হয়ে গেল
নব জাতক পর্ব ৪: দৃষ্টি ক্ষীণ হলেও, অন্তর্দৃষ্টি প্রবলভাবে সজাগ
নব জাতক পর্ব ৩: শূকরের তাকানোয় বাঘের বুক দুরুদুরু!
নব জাতক পর্ব ২: আরও আরও জয়ের তৃষ্ণা যেভাবে গ্রাস করে অস্তিত্বকে
নব জাতক পর্ব ১: খিদে মেটার পরও কেন ধানের শীষ নিয়ে যেত পাখিটি?