বিভিন্ন জায়গায় বারাণসীরাজ ঘুরে বেরালেন– কখনও রাজরথে, কখনও ছদ্মবেশে। এমনকী নিজের রাজ্যের সীমানা পেরিয়েও কিছু দূর গেলেন। সব জায়গায় নিজের গুণকীর্তনই শুনলেন। দেখা গেল সবাই রাজাকে নিয়ে, তাঁর শাসনপ্রণালী নিয়ে, রাজকর্মচারীদের নিয়ে সন্তুষ্ট। কোথাও কোনওরকম অভাব বা অভিযোগ, ক্ষোভ বা খেদ নেই।
২৪.
বারাণসীরাজ ব্রহ্মদত্ত-কুমারের বিচারসভা। সিংহাসনে মহারাজ। দু’পাশে প্রাজ্ঞ বিচারকরা। ভাবগম্ভীর পরিবেশ। বাদী-বিবাদী উভয়পক্ষের জন্য দু’দিকে প্রশস্ত বসার ব্যবস্থা। উভয়দিকেই পর্যাপ্ত সংখ্যক পাইক-পেয়াদা। সব ব্যবস্থাই সুচারু। শুধু নেই কোনও বিচারপ্রার্থী।
শুধু আজ নয়। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস বিচারসভা ফাঁকা। বিচারকরা সবাই নিষ্কর্মা বসে। রাজা বিচলিত বোধ করেন, তবে কি আমাদের বিবেচনার প্রতি প্রজাকুল আস্থা হারাচ্ছে?
না, না মহারাজ, তা নয়, প্রধান অমাত্য আশ্বস্ত করেন, প্রজারা এতটাই সুখে, শান্তিতে, সুশাসনে রয়েছে যে, তাদের আর কোনও অভিযোগ নেই, কলহ নেই। তাই তারা আর বিচারসভায় আসার প্রয়োজন বোধ করে না।
কথাটায় রাজার বিশেষ প্রত্যয় হল না। তিনি প্রাসাদের সবাইকে জিজ্ঞেস করলেন, আমার শাসনে কোথায় দোষ হচ্ছে বলো?
সবাই এক বাক্যে বলল, দোষ নেই তো বলব কী, মহারাজ?
রাজা ভাবলেন, আমার কর্মচারীরা আমাকে বলতে সাহস পাচ্ছে না। দেখি রাজ্যে খুঁজতে বেরোই।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
দুই রাজার শিক্ষা-দীক্ষা, সেনাবল, ঐশ্বর্য, বংশমর্যাদা, যশ নিয়ে একে একে কথা উঠল। দেখা গেল, সে সবেও তাঁরা একে অপরের সমান সমান। এদিকে কোনও সমাধান সূত্র না বেরনোয় দুই রথে দুই রাজা অস্বস্তিতে। তাঁরা দু’জনেই সুভদ্র, সজ্জন। চাইছেন, একটা কোনও বিষয়ে প্রতিবেশী রাজার শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নিয়ে তাঁকে সসম্মানে পথ ছেড়ে দিতে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
বিভিন্ন জায়গায় তিনি ঘুরে বেরালেন– কখনও রাজরথে, কখনও ছদ্মবেশে। এমনকী, নিজের রাজ্যের সীমানা পেরিয়েও কিছু দূর গেলেন। সব জায়গায় নিজের গুণকীর্তনই শুনলেন। দেখা গেল, সবাই রাজাকে নিয়ে, তাঁর শাসনপ্রণালী নিয়ে, রাজকর্মচারীদের নিয়ে সন্তুষ্ট। কোথাও কোনওরকম অভাব বা অভিযোগ, ক্ষোভ বা খেদ নেই।
নিশ্চিন্ত ব্রহ্মদত্ত-কুমার রথে চড়ে নিজের রাজধানীর পথ ধরলেন। ফেরার পথে তাঁর রথের মুখোমুখি আর এক রথ এসে পড়ল। সেখানের রাস্তা এত সংকীর্ণ যে পাশাপাশি দু’টি রথ যাওয়ার জো নেই।
এদিকের রথের সারথি হাঁক পাড়ল, রথ ফেরাও, পথ ছাড়ো, আমার রথে বারাণসীরাজ।
ওদিকের রথের সারথি হাঁক পাড়ল, আমার রথে কোশলরাজ মল্লিক। নিজের রাজ্য ও সন্নিহিত এলাকা পরিদর্শনে বেরিয়েছিলেন, সকলকে সন্তুষ্ট দেখে রাজা এখন নিজের রাজধানীর পথে।
আশ্চর্য, এক সরু রাস্তায় দুই রাজার রথ মুখোমুখি! কে কাকে পথ ছাড়বেন? কার মর্যাদা বেশি?
এদিকের সারথি হাঁক পাড়ল, তোমার মহারাজের বয়ঃক্রম?
কী কাণ্ড, দেখা গেল, দু’জনেই সমবয়সি!
এদিকের সারথি বলল, আমাদের বারাণসী রাজ্য ৩০০ যোজন লম্বা।
ওদিকের সারথি বলল, আমাদের কোশল রাজ্যও ত্রিশত যোজন বিস্তৃত।
তারপর দুই রাজার শিক্ষা-দীক্ষা, সেনাবল, ঐশ্বর্য, বংশমর্যাদা, যশ নিয়ে একে একে কথা উঠল। দেখা গেল, সে সবেও তাঁরা একে অপরের সমান সমান। এদিকে কোনও সমাধান সূত্র না বেরনোয় দুই রথে দুই রাজা অস্বস্তিতে। তাঁরা দু’জনেই সুভদ্র, সজ্জন। চাইছেন, একটা কোনও বিষয়ে প্রতিবেশী রাজার শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নিয়ে তাঁকে সসম্মানে পথ ছেড়ে দিতে।
শেষে কথা উঠল উভয়ের চরিত্রগুণ নিয়ে। ব্যক্তিগত চরিত্র তো উভয়েরই নিষ্কলুষ। কিন্তু শাসন-কর্তা হিসেবে দুই রাজার চরিত্র-বৈশিষ্ট্য কার কেমন, তা এবার বিচার করা যেতে পারে। বারাণসীরাজের সারথি শুধোলো, তোমাদের রাজামশাইয়ের শীলাচার কীরূপ?
ওদিকের সারথি দু’হাত কপালে ঠেকিয়ে বলল, কোশলরাজের জয় হোক। আমাদের রাজা কঠোরের প্রতি কঠোর, কোমলের প্রতি কোমল; সাধুর প্রতি সাধুজনোচিত, নিষ্ঠুরের প্রতি নিষ্ঠুর। তাঁর এই শঠে শাঠ্যং নৈর্ব্যক্তিক নীতির জন্যই গোটা রাজ্যে নিরবচ্ছিন্ন শান্তি বিরাজমান। এখানে সৎ মানুষেরা শান্তিতে, দুর্বৃত্তেরা তটস্থ। এবার বলো বন্ধু, তোমাদের রাজামশাইয়ের রাজ্যশাসনের নীতিও কি এমনই?
মৃদু হেসে এদিকের সারথি ঘাড় নাড়ে, না, তার রাজার নীতি অনেকটাই ভিন্ন। স্বয়ং বোধিসত্ত্ব সেই জন্মে ব্রহ্মদত্তের জ্যেষ্ঠ পুত্র ব্রহ্মদত্ত-কুমার হিসেবে জন্ম নিয়েছেন। তাঁর শীলাচার তো মৌলিক হবেই।
তাঁর সারথি দু’হাত কপালে ঠেকিয়ে জয়ধ্বনি দিল, বারাণসীরাজ দীর্ঘজীবী হোন। আমাদের রাজা সবার প্রতি সমান কোমল। ক্রোধীকে তিনি শান্ত হয়ে সামলান, কৃপণ তাঁর দান গ্রহণ করে লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে চায়; অসাধু তাঁর সাধু কার্যকলাপ প্রত্যক্ষ করে নিজেকে শুধরে নেয়, প্রবল শত্রুকে তিনি প্রবলতর মহানুভবতায় বশ করেন। তাঁর এই সর্বজনীন প্রেমের শাসনে আমাদের রাজ্যে সদা শান্তির সুস্থিতি।
কোশলরাজ আলতো করে হাত রাখলেন তাঁর সারথির পিঠে। ইঙ্গিত বুঝতে পেরে সে লাফিয়ে রথ থেকে নেমে ঘোড়ার বাঁধন খুলে সামনের রথকে পথ ছেড়ে দিল। নেমে এলেন কোশলরাজ নিজেও। জোড়হাতে বারাণসীরাজের রথের সামনে গিয়ে বললেন, তোমার কাছে হার মেনে আমি ধন্য হলাম, বন্ধু। তুমি এগিয়ে চলো। আমায় পথ দেখাও।
রথ থেকে নেমে এসে বারাণসীরাজ জড়িয়ে ধরলেন তাঁর সমবয়সি কোশলরাজকে।
সূত্র: রাজাববাদ জাতক
…নব জাতক-এর অন্যান্য পর্ব…
নব জাতক পর্ব ২৩: দুষ্টসঙ্গে অপরিণামদর্শী হয়ে মানুষ কেমন নিজের ধ্বংস নিজেই নিয়ে আসে
নব জাতক পর্ব ২২: এই জন্মে বোধিসত্ত্ব এক লোভের ফাঁদে পা দিলেন
নব জাতক পর্ব ২১: গাছতলায় শুয়ে রাত কাটাতে হল সারীপুত্রের মতো সম্মাননীয় শ্রমণকেও
নব জাতক পর্ব ২০: আফসোস যে শ্রেষ্ঠী-বালিকার পরিচয় অজ্ঞাত থেকে গেল
নব জাতক পর্ব ১৯: ছদ্মবেশে প্রজার সুখ দেখতে বেরিয়ে লজ্জিত হয়ে পড়লেন রাজা
নব জাতক পর্ব ১৮: ব্রাহ্মণের সন্তান হলেই ব্রাহ্মণ হওয়া যায় না
নব জাতক পর্ব ১৭: এত ছোট চারাই যদি এমন হয়, বড় বৃক্ষ হলে না জানি কেমন বিষাক্ত হবে
নব জাতক পর্ব ১৬: প্রকৃত চরিত্রবানের পিছনে তলোয়ারের আতঙ্ক রাখার দরকার হয় না
নব জাতক পর্ব ১৫: নেপথ্য থেকে যে নেতৃত্ব দেয়, তাকে অস্বীকার করা যায় না
নব জাতক পর্ব ১৪: প্রাণীহত্যার মতো নির্মম আয়োজনে দেবতার সন্তুষ্টি হয় কী করে!
নব জাতক পর্ব ১৩: এক হাজার দস্যুর লাশ আর রত্ন পেটিকা
নব জাতক পর্ব ১২: সীতা যখন রামের বোন, দিতে হয়নি অগ্নিপরীক্ষাও
নব জাতক পর্ব ১১: শাসকের পৃষ্ঠপোষকতায় কোনও সন্ত্রাসবাদীকে সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনা সে-ই বোধহয় প্রথম
নব জাতক পর্ব ১০: নিকটজনের অন্যায্য আবদারে রাজধর্মে বিচ্যুত হওয়া যায় না
নব জাতক পর্ব ৯: লকলকে লোভের আগুনে সদুপদেশ খাক হয়ে যায়
নব জাতক পর্ব ৮: যেখানে মৃত্যু প্রবেশ করতে পারে না, শুধু জীবনের জয়গান
নব জাতক পর্ব ৭: অভয় সরোবর সত্ত্বেও কেন ব্যাধ ফাঁদ পেতেছিল সুবর্ণহংসের জন্য?
নব জাতক পর্ব ৬: জন্ম-জন্মান্তরের বিষয়-আকাঙ্ক্ষা যখন হেলাফেলা করা যায়
নব জাতক পর্ব ৫: পলাশ গাছ ছায়া দিত কালো সিংহকে, তবু তারা শত্রু হয়ে গেল
নব জাতক পর্ব ৪: দৃষ্টি ক্ষীণ হলেও, অন্তর্দৃষ্টি প্রবলভাবে সজাগ
নব জাতক পর্ব ৩: শূকরের তাকানোয় বাঘের বুক দুরুদুরু!
নব জাতক পর্ব ২: আরও আরও জয়ের তৃষ্ণা যেভাবে গ্রাস করে অস্তিত্বকে
নব জাতক পর্ব ১: খিদে মেটার পরও কেন ধানের শীষ নিয়ে যেত পাখিটি?