মূল লক্ষ্যটি হল, সংস্কৃত ভাষা এবং সাহিত্য জানা। সেটি জানলে আর প্রয়োজনমতো মাপছাঁট করে নেওয়া সনাতন কল্পটির দরকার পড়ত না। আমরা হয়তো সহজেই রাম কিংবা উমা-কল্পনার নিহিত অর্থটুকু গ্রহণ করতে পারতাম। মহাকাব্যের ভিতর দিয়ে দেখলে রামের প্রশ্নের মুখে পড়া কিংবা উমা-শঙ্করের রতি কোনওটিই অস্বস্তিকর বলে মনে হত না। সাহিত্য যে প্রসারতা দান করে, সংস্কৃত সাহিত্য তা আরও পরিশীলীত করে তুলতে পারত। এমনকী, উপনিষদের আপনাকে জানা-র সুতোয় সুতোয় যদিও আমরা এগোতে পারতাম তাহলেও ধর্মের সত্যি অর্থ একেবারে আমাদের হাত ফসকে যেত না।
সংস্কৃত ভাষা যেন ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পের রতন। দায়িত্ব-কর্তব্য সবই মুখ বুজে পালন। প্রতিদানে ভালোবাসা পাওয়ার স্বপ্ন দেখাই যেন বারণ। ‘বিলুপ্ত’ ভাষা শিখিবার দায় হায় পৃথিবীতে কাহার! কখনও সিলেবাসে কদাচিৎ তার দেখা মিললে– বছর দুয়েক ‘নর নরৌ নরাঃ, বেঞ্চির উপর দাঁড়া’ করে কায়ক্লেশে কাটিয়ে দেওয়া। মোটের ওপর ধরেই নেওয়া হয়, এ-ভাষা তো কোনও ব্যবহারিক কাজে লাগবে না, অতএব…।
রাজ্যে রাজ্যে মাতৃভাষার সমাদরনীতির দারুণ প্রয়োগে বাঙালির ছেলে মারাঠি বা তেলুগু শিখছে, এমনকী প্রথম তিন ভাষার মধ্যে বাংলা থাকছে না, তা-ও সই! তবে, সাধ করে কেউ বাচ্চাকে সংস্কৃত শেখাচ্ছেন, এরকমটা সচরাচর দেখা যায় না। তার অনেকানেক কারণের মধ্যে একটি হল, ব্যবহারিক দিক থেকে সংস্কৃতের প্রয়োগ ক্রমশ কমে আসা। নিশ্চিতই সে ভাষা নিয়ে চর্চা করার মানুষ আছেন, এখনও সংস্কৃত নিয়ে পড়াশোনা করা শিক্ষার্থী কম হলেও বিরল নয়; তবে সামগ্রিক একটা ছবি আঁকতে গেলে দেখা যাবে সংস্কৃত ভাষা যেন বাংলা ঋতুচক্রে হেমন্তকাল।
এদিকে হালে আবার সংস্কৃতের দরকার হয়ে পড়েছে বেজায়। সনাতন নামে কোনও এক দিকশূন্যপুরের দিকে এখন ঊর্ধ্বশ্বাস দৌড়। সেখানে যাওয়ার বৈতরণী পেরতে ভরসা সেই সংস্কৃত। নইলে দৈনন্দিনের ফর্দে তার তো সেভাবে দরকারই পড়ে না। এমনিতে খেয়াল করলে দেখা যাবে, সংস্কৃত ভাষাকে আমরা দারুণ সম্ভ্রম করি। অন্তত গঙ্গাজল না-ছড়িয়ে তা উচ্চারণই করা হয় না। পুজো-আচ্চার ব্যাপার। অর্থাৎ কেবলই মন্ত্র, তাও আবার প্রয়োজনমতো মুখে-ভাত, পৈতে, বিয়ে কিংবা শ্রাদ্ধে পুরুত ডেকে। এই পুরুত ডাকা-ই আসল ব্যাপার। কেউ কখনও খেয়াল করেন না যে, তিনি কী বলছেন, তার অর্থ কী! বিশ্বাস এমনই যে, সংস্কৃত উচ্চারণ মাত্রই তা এক শুদ্ধ আধ্যাত্মিক পরিবেশের জন্ম দেয়। যেন ঈশ্বরলাভের সহজ ছাড়পত্র। মহাকাব্য থেকে উপনিষদ যে-ভাষায় লেখা, তার প্রতি এহেন ভক্তি থাকা অমূলক নয়। তবে, যে-ভাষায় রবীন্দ্রনাথ বিশ্বমানবতাবোধের আলো নামিয়ে এনেছেন, সে-ভাষায় ঘৃণা ছড়ানো যায় না, এমনটা তো নয়। অর্থাৎ ভাষার ভিতরঘরটা জানা জরুরি– তা বাংলার জন্যও সত্যি, সংস্কৃতের জন্যেও। কতিপয় মানুষ, যাঁরা ভাষাটিকে চর্চা করেন, তাঁরা বাদে বাকিরা সে-পথের ছায়াও মাড়াইনি। যথেষ্ট সম্ভ্রম করে তাকে কুলুঙ্গির ঠাকুর করে রেখেছি। সম্মানের শেষ নেই, অথচ গ্রহণের দায়ও নেই। হেনকালে যখন সনাতনের ডাক পড়ল তখন ত্রাহি মধুসূদন! কে উদ্ধারকর্তা আর! টেনেটুনে আসনের ঠাকুরকে তখন নামানো হল হোয়াটসঅ্যাপের মুখরিত ভাষ্যে। সংস্কৃত দেখলেই বিগলিত হৃদয়, অথচ তার অধিকাংশ কথা বোধগম্যতার বাইরে। ভাষার সঙ্গে মানুষের এই দূরত্বের ভিতর যে-নিঃসঙ্গতা, সেখানে অনায়াসে সেঁধিয়ে পড়তে পারে বিকৃতি। হল এবং হচ্ছেও তাই-ই। দরকারমতো ভুল ব্যাখ্যায় রাজনীতির মন রাখতে গিয়ে শিখণ্ডী হচ্ছে সংস্কৃত।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৮৭২ সালে যিনি (সম্ভবত) প্রথম বাংলা ভাষায় ‘কুমারসম্ভব’ অনুবাদ করেছিলেন, তিনি ‘স্বদেশহিতৈষীমাত্রেরই’ মনে জেগে ওঠা এ-বাসনাকে অনুমোদন দিয়েই বলেছিলেন, ‘সেই বাসনা পূর্ণকরণে প্রাচীন গ্রন্থনিকর বিশেষতঃ স্বদেশীয় পুরাতন কাব্য-কলাপই সবিশেষ শক্তি রাখে।’ যাঁরা সংস্কৃতে সেভাবে জানেন না, তাঁদের জন্যই ভাষান্তরের চেষ্টা ছিল তাঁর। গৌরীনাথ শাস্ত্রীর মতো পণ্ডিত তো ভাষান্তর প্রকল্পকে ‘সুমহৎ জাতীয় কর্তব্যপালন’ হিসাবেই গণ্য করেছিলেন। এবং সংস্কৃতকে বিলুপ্ত করার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে ভাষান্তরই ছিল তাঁর কাছে দীপ্ত প্রতিবাদ।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
অথচ সংস্কৃত আমাদের বিকৃতির হাত থেকে বাঁচিয়ে দিতেই পারত। এখনও পারে। অতীতের অন্বেষণ মাত্রই তা ভ্রান্ত নয়। অভ্রান্তও নয়। এ-কথা ঠিক যে আমাদের দেশ বহুবারই হয়েছে উপনিবেশ, তার দরুন বদলে-বদলে গিয়েছে সংস্কৃতি। বহুযুগের ওপারে তাই দেশের রূপ কেমন ছিল আর এখন কী হয়েছে– তা পর্যালোচনা করার সাধ জাগতেই পারে। রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৮৭২ সালে যিনি (সম্ভবত) প্রথম বাংলা ভাষায় ‘কুমারসম্ভব’ অনুবাদ করেছিলেন, তিনি ‘স্বদেশহিতৈষীমাত্রেরই’ মনে জেগে ওঠা এ-বাসনাকে অনুমোদন দিয়েই বলেছিলেন, ‘সেই বাসনা পূর্ণকরণে প্রাচীন গ্রন্থনিকর বিশেষতঃ স্বদেশীয় পুরাতন কাব্য-কলাপই সবিশেষ শক্তি রাখে।’ যাঁরা সংস্কৃতে সেভাবে জানেন না, তাঁদের জন্যই ভাষান্তরের চেষ্টা ছিল তাঁর। গৌরীনাথ শাস্ত্রীর মতো পণ্ডিত তো ভাষান্তর প্রকল্পকে ‘সুমহৎ জাতীয় কর্তব্যপালন’ হিসেবেই গণ্য করেছিলেন। এবং সংস্কৃতকে বিলুপ্ত করার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে ভাষান্তরই ছিল তাঁর কাছে দীপ্ত প্রতিবাদ। উপরন্তু সংস্কৃত সাহিত্যভাণ্ডারের মণিমাণিক্য যদি বাংলা ভাষায় আসে, তাতে লাভ বই ক্ষতি তো নেই। অর্থাৎ মূল লক্ষ্যটি হল, সংস্কৃত ভাষা এবং সাহিত্য জানা। সেটি জানলে আর প্রয়োজনমতো মাপছাঁট করে নেওয়া সনাতন কল্পটির দরকার পড়ত না। আমরা হয়তো সহজেই রাম কিংবা উমা-কল্পনার নিহিত অর্থটুকু গ্রহণ করতে পারতাম। মহাকাব্যের ভিতর দিয়ে দেখলে রামের প্রশ্নের মুখে পড়া কিংবা উমা-শঙ্করের রতি কোনওটিই অস্বস্তিকর বলে মনে হত না। সাহিত্য যে প্রসারতা দান করে, সংস্কৃত সাহিত্য তা আরও পরিশীলিত করে তুলতে পারত। এমনকী, উপনিষদের ‘আপনাকে জানা’-র সুতোয় সুতোয় যদিও আমরা এগোতে পারতাম তাহলেও ধর্মের সত্যি অর্থ একেবারে আমাদের হাত ফসকে যেত না। তবে, সবকিছু থেকে দূরত্ব যে থেকে গেল, তার অন্যতম কারণ সংস্কৃত ভাষার সঙ্গে আমাদের স্বনির্বাচিত দূরত্ব এবং মাতৃভাষার মধ্য দিয়ে সংস্কৃত সাহিত্যভাণ্ডার দেখতে না-চাওয়ার তীব্র অনাগ্রহ। দু’য়ের দরুণ সংস্কৃত হয়ে রইল দূরের সন্ধ্যাতারা, তাকে কেবল মন্ত্র উচ্চারণ এবং বৈষয়িক প্রাপ্তির জন্য দেবতার দরবারে আর্জি জানানোর ভাষা হিসেবেই আমরা দেখলাম। ভাষার ভিতর যে-মহাদেশ, যে-সংস্কৃতি রাখা আছে, সেদিকে ফিরে না-তাকালে সংস্কৃত ভাষা দুর্বোধ্য হেঁয়ালি হয়েই থেকে যাবে। তাতে বিকৃতিরই বাড়বাড়ন্ত।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: কেবল অযোধ্যায় কেন! মনের মন্দিরেও থাকুন রাম
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ভালো কথা যে, সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতের জন্যও এবারের জ্ঞানপীঠ বরাদ্দ হয়েছে। যাঁকে এই সম্মান দেওয়া হচ্ছে, তিনি আধ্যাত্মিক গুরুও বটে। ‘রামচরিতমানস’ প্রকল্পটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। রাম মন্দির নির্মাণের ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তবে, তাতে সাধারণের সংস্কৃতপ্রীতিতে বোধহয় এতে তেমন কিছু হেরফের হবে না। স্বামীনাথনকে ভারতরত্ন প্রদানের বছরেও যেমন কৃষকদের অবস্থার কোনও বদল হচ্ছে না। দরকার ছিল সহমর্মিতার, কৃষকদের ক্ষেত্রে, সংস্কৃতের ক্ষেত্রেও। একমাত্র ভাষা হিসেবে সংস্কৃতকে জানা অথবা মাতৃভাষার চাবি হাতে সংস্কৃতের ভাঁড়ারের তালা খুললেই আমরা অতীতকে আবিষ্কার করব। সনাতনের স্বরূপ জানলে তাকে আর ছেঁটে-নেওয়া-সংস্কৃতি করে তোলার দরকার পড়ত না। তার জন্য তো আগে দরকার ভাষার প্রতি ভালোবাসা। সংস্কৃত এবং মাতৃভাষা, উভয়ের জন্য প্রেম।
অথচ জ্ঞানের বিহনে প্রেম নেই। প্রেমের বিহনে জ্ঞানও নেই। হাতে শুধু থেকে গেল জ্ঞানপীঠ, এই যা!